লবণ সিন্ডিকেটে জড়িত তিন প্রতিষ্ঠানÑগুরুতর অভিযোগ-বিশ্ববাজারে শর্ত দিয়েছেÑ অন্য কোন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা যাবে না by মিজান চৌধুরী

লবণ সিন্ডিকেটের সঙ্গে শীর্ষ তিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার সন্ধান পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ওই তিন প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববাজার থেকে লবণ ক্রয় করছে। আবার ওই চক্র বিদেশী বিক্রেতাদের শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে লবণ বিক্রি না করার।


ফলে সাধারণ কোন প্রতিষ্ঠান লবণ আমদানি করতেও পারছে না। এমন তথ্যও পেয়েছে তদন্ত কমিটি। শুধু তাই নয়, র লবণ আমদানির পর ফিনিশড না করেই অতি মুনাফার লোভে অন্যত্র বিক্রি করেছে ওই চক্র। যে কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে লবণের বাজার। যদিও বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার লবণ আমদানি উম্মুক্ত করে দেয়। এ পর্যন্ত দেশে এক লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা লবণ ও ৬০ হাজার টন ফিনিশড লবণ আমদানি হয়েছে। কিন্তু বাজারে কোন প্রভাব পড়েনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তদন্ত কমিটির সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের খাতিরে আপাতত তিন কোম্পানির নাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অনেক তথ্যই তারা পেয়েছেন।
এদিকে লবণ সিন্ডিকেট শনাক্ত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির মেয়াদ আরও সাত কর্মদিবস বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গত রবিবার তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ওয়াদুদ আহমেদকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করে তিন দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়। বুধবার কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, কমিটি এই নির্ধারিত সময়ে পুরো কাজ শেষ করতে পারেনি। এ জন্য আরও সাত দিন সময় চেয়েছে। তদন্তের জন্য ওই কমিটি বুধবার নারায়ণগঞ্জের একাধিক লবণ ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেছে। কোন্ দামে লবণ ক্রয় আমদানি করছে, কি পরিমাণ লবণ বিক্রি করছে, উৎপাদন খরচ কত হয়েছে তদন্ত কমিটি এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে।
মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, তিনজন শীর্ষ আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লবণের বাজারকে অস্থির করে কয়েক শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও সন্ধান পেয়েছে ওই তিন কোম্পানি বিশ্ব বাজারে যাদের কাছ থেকে লবণ ক্রয় করেছে তাদের উল্টো শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশের অন্য কোন কোম্পানির কাছে লবণ বিক্রি না করার জন্য। ফলে সরকার লবণ আমদানি উম্মুক্ত করলেও অনেক সাধারণ কোম্পানি আমদানি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমদানির বাজার কুক্ষিগত করে সিন্ডিকেট চক্র র লবণ এনেই বিক্রি করছে। ফিনিশড করার প্রয়োজন মনে করেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুসন্ধানে দেখতে পায় আড়াই টাকা দরে প্রতিকেজি কাঁচা লবণ বিদেশ থেকে আমদানি করলেও দেশে এনে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। আর যারা দশ টাকা দরে কাঁচা লবণ ক্রয় করছে ফিনিশড করে তারা ৩৫ টাকা দরে খুচরা বাজারে বিক্রি করছে। যে কারণে সরকার মূল্য কমানোর জন্য আমদানি উম্মুক্ত করলেও কার্যত কোন সুফল বয়ে আনেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, লবণ এনে বিক্রি করার বিধান নেই। এর পরও কিছু কোম্পানি এ কাজ করেছে। এটি এক ধরনের অপরাধ। এছাড়া অতিমুনাফায় র লবণ বিক্রি করেছে। যারা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়েছে তারাই মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করেছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে। পরে এ ব্যাপারে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এদিকে লবণের বাজারে সিন্ডিকেট অপেন হয়ে পড়েছে। অনেক সাধারণ মিল মালিক এদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, দোষী কয়েক কোম্পানি বলার চেষ্টা করছে লবণের দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে কম দামের লবণ এখন বিক্রি করছে না। অবশ্য তাদের এ কথা ধরে তদন্ত কমিটি খুচরা বাজারেও অনুসন্ধান করবে। মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।
বিসিক-এর তথ্য অনুসারে চলতি বছর লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ১১ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া গত বছরের মজুদ রয়েছে আরও প্রায় ২ লাখ মেট্রিকটন। সব মিলিয়ে দেশে লবণের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ মেট্রিকটন। বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন। এ অবস্থায় প্রায় ১ লাখ মেট্রিকটন লবণের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে বিসিক। তবে লবণ শিল্প মালিকদের দাবি দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিকটন। ফলে উৎপাদন ও মজুদ হিসেবে নিলে প্রায় ৪ লাখ টন লবণ ঘাটতি রয়েছে বলে দাবি করে লবণ শিল্প মালিকরা।
লবণের এ ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এক মাসের জন্য অপরিশোধিত লবণ আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর দাম কমাতে পরিশোধিত লবণ আমদানির সুযোগ দেয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
লবণ আমদানির পরও আশা করা হয় বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দেখা গেছে আমদানির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গুটি কয়েক কোম্পানি সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থির করেছে।

No comments

Powered by Blogger.