বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৭৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবদুল মালেক, বীর বিক্রম অনন্য সাহসী যোদ্ধা ১৯৭১ সালে রাজশাহীতে সেনানিবাস ছিল না। তবে উপশহরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্থায়ী একটি ক্যাম্প। সেখানে অবস্থান করছিল ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ব্যাটালিয়নটি পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু মার্চের শুরুতে তাদের যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাতে তারা অবস্থান নেয় রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে।
অন্যদিকে, ৪ নম্বর ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল রাজশাহী শহরে। এর দুটি উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) একটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও একটি নওগাঁয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই সেক্টরের বাঙালি ইপিআরের সদস্যরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দুই উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বেশির ভাগ রওনা হন রাজশাহীতে। মো. আবদুল মালেক ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।
এ সময় গোদাগাড়িতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের বাধা দেয়। আবদুল মালেকরা ২ এপ্রিলের মধ্যে শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হন। এরপর তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। স্থানীয় ছাত্র-যুবকেরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
তখন পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান ঢাকা থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। আকাশ থেকে গোলাগুলির পরও মুক্তিযোদ্ধারা আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বিশেষ করে আবদুল মালেক বিচলিত হননি। অদম্য ছিল তাঁর সাহস ও মনোবল। নিজ অবস্থানে থেকে আক্রমণ প্রতিহত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা উপশহরে সমবেত হয় এবং সেখানকার অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা আরও জোরদার করে। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বেশির ভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা উপশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধ ভেদ করে তাঁরা অগ্রসর হতে পারেননি।
এ সময় আবদুল মালেক কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে ছিলেন কোর্ট স্টেশনের কাছে। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি ছুটে আসে তাঁর দিকে। ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। শহীদ হন এই বীরযোদ্ধা। পরে স্থানীয় এলাকাবাসী শহীদ আবদুল মালেকের মরদেহ সমাহিত করেন, কিন্তু চিহ্নিত নয়।
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ফসিউদ্দিনের (শহীদ আবদুল মালেকের দলনেতা, তখন হাবিলদার) ১৯৭৪ সালের বয়ানে আছে মো. আবদুল মালেকের শহীদ হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ‘...চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে গোদাগাড়িতে (আমাদের) কিছুসংখ্যক লোক ডিফেন্স তৈরি করে। রাতে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। আমরা আস্তে আস্তে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকি। গোলাগুলি চলতেই থাকে।
‘রাজশাহীর কাছিয়াডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস (গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার) নওগাঁ থেকে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। সেই সময় আমাদের কোনো অফিসার না থাকায় তিনি নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের কাছে ডিফেন্সে থাকাকালীন আমাদের একজন নায়েক, আবদুল মালেক শহীদ হন। এরপর রাজশাহী সেনানিবাস দখলের জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়।’
মো. আবদুল মালেক চাকরি করতেন ইপিআরে। কর্মরত ছিলেন রাজশাহী সেক্টরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ উইংয়ে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে গোদাগাড়ি যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল মালেককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১০।
মো. আবদুল মালেকের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার (ডাক পিরকাসিমপুর) কড়িবাড়ি গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মো. ইছহাক, মা রহিমা খাতুন। স্ত্রী আছিয়া খাতুন। তাঁদের তিন মেয়ে, তিন ছেলে। মো. আবদুল মালেকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মো. মনির মিয়া (মো. আবদুল মালেক বীর বিক্রমের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
অন্যদিকে, ৪ নম্বর ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল রাজশাহী শহরে। এর দুটি উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) একটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও একটি নওগাঁয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই সেক্টরের বাঙালি ইপিআরের সদস্যরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দুই উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বেশির ভাগ রওনা হন রাজশাহীতে। মো. আবদুল মালেক ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।
এ সময় গোদাগাড়িতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের বাধা দেয়। আবদুল মালেকরা ২ এপ্রিলের মধ্যে শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হন। এরপর তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। স্থানীয় ছাত্র-যুবকেরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
তখন পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান ঢাকা থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। আকাশ থেকে গোলাগুলির পরও মুক্তিযোদ্ধারা আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বিশেষ করে আবদুল মালেক বিচলিত হননি। অদম্য ছিল তাঁর সাহস ও মনোবল। নিজ অবস্থানে থেকে আক্রমণ প্রতিহত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা উপশহরে সমবেত হয় এবং সেখানকার অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা আরও জোরদার করে। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বেশির ভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা উপশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধ ভেদ করে তাঁরা অগ্রসর হতে পারেননি।
এ সময় আবদুল মালেক কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে ছিলেন কোর্ট স্টেশনের কাছে। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি ছুটে আসে তাঁর দিকে। ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। শহীদ হন এই বীরযোদ্ধা। পরে স্থানীয় এলাকাবাসী শহীদ আবদুল মালেকের মরদেহ সমাহিত করেন, কিন্তু চিহ্নিত নয়।
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ফসিউদ্দিনের (শহীদ আবদুল মালেকের দলনেতা, তখন হাবিলদার) ১৯৭৪ সালের বয়ানে আছে মো. আবদুল মালেকের শহীদ হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ‘...চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে গোদাগাড়িতে (আমাদের) কিছুসংখ্যক লোক ডিফেন্স তৈরি করে। রাতে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। আমরা আস্তে আস্তে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকি। গোলাগুলি চলতেই থাকে।
‘রাজশাহীর কাছিয়াডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস (গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার) নওগাঁ থেকে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। সেই সময় আমাদের কোনো অফিসার না থাকায় তিনি নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের কাছে ডিফেন্সে থাকাকালীন আমাদের একজন নায়েক, আবদুল মালেক শহীদ হন। এরপর রাজশাহী সেনানিবাস দখলের জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়।’
মো. আবদুল মালেক চাকরি করতেন ইপিআরে। কর্মরত ছিলেন রাজশাহী সেক্টরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ উইংয়ে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে গোদাগাড়ি যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল মালেককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১০।
মো. আবদুল মালেকের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার (ডাক পিরকাসিমপুর) কড়িবাড়ি গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মো. ইছহাক, মা রহিমা খাতুন। স্ত্রী আছিয়া খাতুন। তাঁদের তিন মেয়ে, তিন ছেলে। মো. আবদুল মালেকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মো. মনির মিয়া (মো. আবদুল মালেক বীর বিক্রমের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments