এই দিনে- শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা by তারাপদ আচার্য্য

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ‘হে ভারত, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায়, তখন আমি অবতীর্ণ হই। অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টদের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি’ (জ্ঞানযোগ ৭/৮)। আর এ কারণগুলোর জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে অবতরণ অর্থাৎ অবতার রূপে জন্ম নিয়েছিলেন।


গীতার কথামতো ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো ভগবৎপ্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী ও নিরপরাধ মানুষদের ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচারী ও বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদগুণ ও সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণ ও দুরাচারের অত্যধিক বৃদ্ধি।
দ্বাপর যুগের শেষ ভাগে ভারতে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়। কামরূপের রাজা নরক ও বান এবং পুণ্ড্ররাজ্যের অধিপতি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খচক্রাদি চিহ্ন ধারণ করে নিজেকে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ বলে পরিচয় দেন। এমনই অরাজকতার সময় কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বের ত্রাণকর্তা শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের পিতা-মাতার নাম বসুদেব ও দেবকী। বসুদেব-দেবকী কারাগারে বন্দী হওয়ার নেপথ্যে কারণ রয়েছে।
কংসের বোন দেবকী। কংস শখ করে বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর বোন আর ভগ্নিপতিকে নিয়ে রথে চড়ে তিনি যখন নগর ভ্রমণ করছিলেন, তখন মথুরাধিপতি অত্যাচারী কংস দৈববাণীতে শুনতে পান, দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্রসন্তানই তাঁকে বধ করবে। সেই থেকে কংস বসুদেব ও দেবকীকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। একে একে দেবকীর গর্ভে সাতটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারাও কংসের যমদূত হতে পারে—এই ভয়ে অত্যাচারী কংস নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেন। এরপর দেবকী অষ্টমবারের মতো সন্তানসম্ভবা হলে কারাগারে বসানো হয় কঠোর নিরাপত্তা।
চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে অষ্টমী তিথিতে অরাজকতার দিন অবসান করতে গভীর অন্ধকার রাতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি। মধ্যরাত্রির নিবিড় অন্ধকারে ভুবন আবৃত। সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এ রকম সময় শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, চতুর্ভুজ মূর্তিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে আবির্ভূত হন। বসুদেব-দেবকী বিস্ময় বস্ফািরিত চোখে প্রত্যক্ষ করলেন শ্রীভগবানের সেই জ্যোতির্ময় আবির্ভাব। আলোর বন্যায় ভেসে গেল বিশ্বচরাচর। দেবকী-বসুদেব নয়ন ভরে দেখলেন অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোহর শিশুকে—চতুর্ভুজ, বর্ণমালা, পীত বসন পরিহিত অবস্থায়। সর্বাঙ্গে বহুমূল্য বলয়, বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন, সারা অঙ্গে মণিমুক্তাখচিত মূল্যবান অলংকারাদি।
শ্রীভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবলীলা সত্যিই অপূর্ব সুশোভামণ্ডিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষ্ণের নির্দেশমতো তাঁকে কোলে করে সেই ঘোর আঁধার রাতে বেরোলেন বসুদেব। কারাগারে লোহার শিকল ও বন্ধ দরজা আপনা-আপনি উন্মুক্ত হলো। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে অনন্তদেব এসে ফণা বিস্তার করে চক্র ধারণ করলেন। ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণ গমনের পথ সুগম করে দিলেন নিজেই। এসবই শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ। যুক্তিবাদীরা এসবকে অবিশ্বাস্য কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও ভক্তের হূদয় যতই চিন্ময়ের দিকে অগ্রসর হয়, ততই এসব মধুর শাশ্বত লীলা ভক্তের হূদয়ে সত্যরূপে উদ্ভাসিত হতে থাকে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখ আছে, যিনি যেভাবে তাঁকে ভজন করেন, ভগবান সেভাবেই তাঁকে অনুগ্রহ করেন। তাই কংসের কারাগারে দেবকী-বসুদেবের সম্মুখে শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী আর নন্দালয়ে তিনি পূর্ণ অবতারস্বরূপ দ্বিভুজ মূর্তিতে উপস্থিত। ঐশ্বর্যলেশহীন বাৎসল্য প্রেমে নন্দালয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক হলো সাধারণ মানবিক পরিবেশে।
পৃথিবীর সব ধর্মের মর্মবাণীই এক ও অভিন্ন। মৌলিক বিষয়ে কোনো প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা কিছু মূলত প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিকতায়। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান, তিনি পরম করুণাময়—এসব মৌলিক প্রশ্নে সব ধর্মের অবস্থানই এক। তাই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে অযথা হিংসা-বিদ্বেষ, বিবাদ-বিসংবাদ ও সংঘাত-সংঘর্ষের কোনো অর্থই হয় না। ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের অপূর্ণ বা খণ্ডিত জ্ঞানই এসব মানবতাবিরোধী তৎপরতার জন্য দায়ী। ধর্মের মূল মর্ম থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্বের কল্পিত অহংকার থেকে জন্ম নেয় মানুষে মানুষে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতার। ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের অপূর্ণ জ্ঞান ও সংকীর্ণ মানসিকতাই ধর্মে ধর্মে এমনকি একই ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হানাহানির কারণ ঘটায়। এ কারণে এই পৃথিবীর মাটি আজ রক্তস্নাত, মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত, শান্তি বিঘ্নিত।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে অকল্যাণ ও অমঙ্গলের সবকিছুই চিরবিদায় নিয়ে শান্তি বর্ষিত হোক—এটাই আজকের প্রার্থনা।
তারাপদ আচার্য্য
সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।

No comments

Powered by Blogger.