যুক্তি তর্ক গল্প- মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা চাই by আবুল মোমেন

প্রায় ছয় সপ্তাহ বিরতির পর লিখতে বসেছি। এই ছয় সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ সপ্তাহ কেটেছে উত্তর আমেরিকায়—যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। গরিবের ঘোড়া রোগের মতো একান্তই বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেশ দেখাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে কলামে এ প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ হলো, দেখতে দেখতে মনে যেসব চিন্তার উদয় হয়, তার কিছু পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।


আমেরিকায় এ দেশের মানুষ এখন আকছার যাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ডিভি আর গ্রিন কার্ড পদ্ধতির মতো বৈধ মাধ্যমে এ সংখ্যা তো বাড়ছেই, অবৈধ পথেও মরিয়া ভাগ্যান্বেষী বাঙালির আমেরিকা-যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ফলে আমেরিকা সম্পর্কে শিক্ষিতজনের জানার পরিধি কম নয়। তবু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দেখা ও বোঝার ফারাক থাকতে পারে—এই ভেবে লিখতে বসে আমেরিকার প্রসঙ্গ টেনে আনা।
আমি গত শতাব্দীর ষাটের শেষে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের একজন। তথ্যটা এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, এ প্রজন্ম বেড়েই উঠেছে মার্কিনবিরোধী চেতনা নিয়ে। সিআইএ, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ইত্যাদি কারণে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দৃষ্টিতে ছিল খলনায়ক। আজকের বিশ্বরাজনীতি, ইরাক, আফগান পরিস্থিতি বা মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানির সর্বগ্রাসী ভূমিকা ইত্যাদি মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে এ দেশে বাস করে মত পরিবর্তনের তেমন কারণ ঘটেনি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী এক মেরু বিশ্বে কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি, কোনো দিক থেকেই মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আমাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া গতি নেই। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা থেকে আমাদের জানা-বোঝার কি কিছু নেই? আছে অবশ্যই।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা যায় উন্নত বিশ্ব। একসময় আমাদের মতো দেশকে তৃতীয় বিশ্ব বলা হতো, যার অর্থ উপরোল্লিখিত দেশগুলো গড়ে তুলেছিল প্রথম বিশ্ব। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিয়ে ছিল দ্বিতীয় বিশ্ব। ইদানীং আর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে বিভক্তি টানা হয় না, সমাজতান্ত্রিক জগৎ বিলুপ্ত হওয়ায় টানার উপায়ও নেই। বলা হয় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ।
শোভন-শালীন উচ্চারণের যত আড়াল নিই না কেন, বাস্তব সত্য হলো, ওরা ধনী দেশ আর আমরা গরিব দেশ। ধনী দেশ না হয়েও কীভাবে দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠা যায়, সেটা আমাদের জানার বিষয়। অর্থের সংকটে আমরা কোনো কিছুই আদর্শ রূপে গড়ে তুলতে পারছি না—সেটা পাঠ্যপুস্তক থেকে পদ্মা সেতু, সবটাতেই খাটে। কিন্তু ব্যবস্থা ঠিক না হলে অর্থের জোগান দিলেও কাজ হবে না; দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থায় সব ভেস্তে যাবে। অনেকেই আফসোস করে বলেন, স্বাধীনতার পর ৪০ বছর অতিবাহিত হলো, কিন্তু আমরা এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছি আর অর্থনৈতিক কিছু কিছু সূচকে এগোলেও সন্তুষ্ট থাকা যায় না, যখন জানি যে এখনো দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, আর ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যরেখার নিচে বাস করে। শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষ উভয়ের মধ্যেই দেশ নিয়ে হতাশা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা চরমে। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও এ কথা সত্য। আমরা প্রতিনিয়ত একে অপরকে প্রশ্ন করে পথের সন্ধান খুঁজি। মার্কিন মুলুকে দেশ ঘিরে বাঙালিদের অনেক প্রশ্ন ছিল, আর দেশে ফেরার পর ওখান থেকে কী শেখার আছে, তেমন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হচ্ছি।
আদতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। যুক্তরাষ্ট্র বিশাল দেশ, আমাদের চেয়ে ৩০ গুণেরও বড়। কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র ৩২ কোটি, অর্থাৎ আমাদের দ্বিগুণ মাত্র। ফলে ভূমি ও মানুষের অনুপাতের দিক থেকে বিরাট সুবিধায় আছে সে দেশ। তার ওপর দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, আদতে এটি হলো ইউরোপীয় ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রীদের দখল করা মূলত ককেশীয় জনগোষ্ঠীর দেশ। নির্মম নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা ও বঞ্চনার মাধ্যমে স্থানীয় আদিবাসী ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করে এ হলো প্রায় একটি (দক্ষিণ আমেরিকাসহ দুটি) মহাদেশকে ইউরোপীয়করণের কাজ। মূলত ব্রিটিশ, ফরাসি, স্প্যানিশ অভিযাত্রী-অভিবাসীরা নতুন আমেরিকা সৃষ্টি করেছে। গত আড়াই শ বছরে ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আরও অভিবাসনের মাধ্যমে বহু ভাষা-সংস্কৃতির মিশ্রণে এ কাজ পূর্ণতা পেয়েছে। দেশটি আবাদ করার জন্য তারা শ্রমিক এনেছে আফ্রিকা থেকে—সেও চরম নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে। আজও সমাজের মূলত তুচ্ছ কাজগুলো করার জন্য এশিয়া, লাতিন আমেরিকা থেকে মানুষ আনছে তারা।
শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে সূচিত যে নতুন দর্শনকে মানুষ গ্রহণ করেছে, যে জীবনব্যবস্থায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তার সূচনা ইউরোপে, তাদের মাধ্যমে আমেরিকাও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রয়েছে।
আমরা জাতি-রাষ্ট্র গঠন করেছি, গণতন্ত্র আমাদের আরাধ্য, মানবাধিকার ও আইনের শাসন বাস্তবায়নে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, আমরাও উন্নয়ন বলতে মূলত নগরায়ণ ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশা করছি, কিংবা নাগরিক অধিকার বা মৌলিক অধিকারের যে অঙ্গীকার, ধারণা, ঘোষণা, চার্টার ইত্যাদি আমরাও গ্রহণ করেছি। এসবের সূতিকাগার কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব।
আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো গ্রামীণ সংস্কৃতি, এখানে গড়ে ওঠে আত্মীয়সমাজ; নাগরিক জীবন তৈরি হয় না। এর বিপরীতে পশ্চিমে, মার্কিন মুলুকেও, ব্যক্তি নাগরিকের অস্তিত্ব, অধিকার হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাকে আইন সুরক্ষা দেয় এবং দায়িত্ব পালনে বাধ্য করে। আইনের দ্বারা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনেই নাগরিক যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমি এই তিনটি ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যের কথা বলব—
১. একজন নাগরিকের স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে তার মর্যাদা এবং মর্যাদা ও স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে নাগরিক হিসেবে তার ভূমিকার মান। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন এবং সনাতন আত্মীয়সমাজে বসবাসের অভ্যস্ততায় আমরা ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদা উভয়ই সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে স্বাধীনতা অর্জন করলেও বা গণতন্ত্র চালু থাকলেও কোনোটিরই প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি, সাধারণজন প্রকৃত সুফল পায় না।
২. এ দেশে আইন সবার ক্ষেত্রে সমান নয়, আবার দুর্নীতির কারণে আইনের প্রয়োগেও তারতম্য ঘটে। মোট কথা, আইনের শাসন কেবল মুখের কথাতেই সীমিত হয়ে পড়ছে। সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলেও আইনি অধিকারে বৈষম্য নেই এবং আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো ঘটে থাকে।
৩. মর্যাদাহীন মানুষ আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়ে এবং সে কারণে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সিস্টেম সুষ্ঠুভাবে চলে না, অর্থাৎ পদে পদে বিশৃঙ্খলা আমাদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করে রাখে। ওদের জীবন নিয়ম ও শৃঙ্খলায় বাঁধা।
ঔপনিবেশিক শক্তি কেবল নবাব বা বাদশাকে পরাজিত করে শাসনদণ্ড কেড়ে নিয়েছিল, তা নয়; তারা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করেছিল। কিংবা তৎকালীন গ্রাম্য সমাজে ব্যক্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ ঘটেনি বলে কথাটা সেভাবে বলা যেন ঠিক হবে না। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে বারবার অবজ্ঞা ও অপমান করেছে, নানা রকম হীন বিধি ও কর্তৃত্বের অধীন করে রেখেছে। সব অফিসে-দপ্তরে কর্তৃত্ব ছিল সাদা কর্তার কিংবা তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে, সাধারণ মানুষ ছিল পরাধীন, অধীন, হুকুমের দাস। আজও আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতি সেই ঔপনিবেশিক ধারাতেই চলছে। এমনকি রাজনীতি, সমাজ কোথাও আমরা ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
আমাদের মন্ত্রীরা চলেন প্রাচীনকালের রাজা-বাদশার মতো সেপাই শান্ত্রীর পাহারায় শব্দবাদ্য বাজিয়ে, আমলারাও নবাব বাহাদুরের মতো প্রতিপত্তি ভোগ করেন। এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতারা চলেন জমিদারের মতো নায়েব-গোমস্তা অনুগ্রহকামী প্রজা পরিবৃত হয়ে। পশ্চিমে প্রধানমন্ত্রী রুটি কিনতে বাজারে যান, মন্ত্রী নাটক দেখতে লাইনে দাঁড়ান কিংবা বিচারপতি ব্রিফকেস নিয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে অফিসেও যান। প্রেসিডেন্ট ওবামা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন তাঁর মন্ত্রী ও পরামর্শকদের নিয়ে ওভাল টেবিলের যেকোনো জায়গায় বসে। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট আসন নেই, বা তাঁর প্রবেশ-প্রস্থানে আতিশয্য আড়ম্বর নেই। তুলনায় ভাবুন, আমাদের মন্ত্রিপরিষদের সভার দৃশ্য। প্রধানমন্ত্রীর প্রবেশের জন্য মন্ত্রীদের আসন নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় এবং তিনি এলে সবাইকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হয়। কেউ যদি বলেন ব্যক্তি নয় চেয়ারকে সম্মান জানানো হচ্ছে, তাহলেও বলব পদ্ধতিটা অগণতান্ত্রিক।
সব মানুষের কাজ ও পেশার পার্থক্য সত্ত্বেও, মর্যাদা ও স্বাধীনতা অনেক দূর রক্ষিত হলে সবার জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাঠুরিয়া থেকে রাষ্ট্রপতি, এমনকি ইতিহাসের অবিস্মরণীয় রাষ্ট্রপতি হওয়া যায়, বাদামচাষি থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়াও সম্ভব হয়। আবার এ কালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যানকে দেখি কলেজ-পর্যায়ে পড়া ছেড়ে দিয়ে দোকানের বিক্রেতার কাজ করে আবার উচ্চতর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে ও সফল হতে।
স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র এলে মানুষের জন্য এ মুক্তির পথটি খুলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারিনি। মানুষ এখনো পরাধীন বা পরাধীনতার এক অমানবিক অনাধুনিক সংস্কৃতিকে আমরা বহন করে চলেছি। এ রকম পরিবেশে মানুষ স্বাধীনতা হারায়, হারায় তার মর্যাদা।
মার্কিনরা সে দেশের নেটিভদের প্রতি যে অবিচার ও অন্যায় করেছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। আজও তারা বিশ্বের দেশে দেশে আধিপত্য বিস্তার ও রক্ষার যে আগ্রাসী জাল বিস্তার করে চলেছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। এর বিরুদ্ধে বলতে হবে ও সংগ্রাম চালাতেই হবে। তবে সেই সঙ্গে বুঝতে হবে, আমরা যে পথে এগোতে চাইছি, যে পথে মুক্তির পথ খুঁজতে চাইছি, তা পেতে হলে পশ্চিমের সমাজ সংস্কার ও সাধনার যে অভিজ্ঞতা, তার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। পশ্চিমের সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ মার্কিন মুলুকেও পাওয়া যায়।
আমাদের লোকজন সেখানে সুশৃঙ্খল, পরিশ্রমী, কর্মমুখী এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের হারও খুব ভালো। মানুষ মানুষের মর্যাদায় স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের সুযোগ পেলে তার শ্রেষ্ঠটাই দিতে পারে। হীনতার মধ্যেই হীনম্মন্যতার জন্ম হয়—দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, অসততা, মিথ্যাচার, চালাকি, প্রতারণা ইত্যাদিতে এর প্রকাশ ঘটে। এর রেশ ধরে আরও বড় ধরনের অপরাধেরও জন্ম হতে থাকে। এসব দেখতে দেখতে এ দেশের মানুষ অতিষ্ঠ, তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু এ পরিবর্তন আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনলে হবে না। এর জন্য মানুষকে সচেতন করার, সোচ্চার করে তোলার কাজ করতে হবে। সে কাজটা রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা সর্বত্র হতে হবে। তার জন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.