খোলা হাওয়া- গণতন্ত্রের চর্চা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে গিয়ে বলেছেন, আবুল হোসেন দেশপ্রেমী এবং আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। প্রথম কথাটা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আবুল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী যতটা চেনেন, আমরা তার অর্ধেকটাও চিনি না, ফলে তিনি যে দেশপ্রেমী তা নিশ্চয়ই আমাদের মেনে নিতে হবে।
পদ্মা সেতু, যা তৈরি হলে আমাদের জিডিপি বছরে আরও ১ শতাংশ বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, ওই সদ্য পদত্যাগী মন্ত্রীর কারণে না হতে পারাটা তাহলে কোনো ব্যাপার নয়। তিনি দেশপ্রেমী, এটাই বড় কথা। এই দেশপ্রেমের জন্য তাঁকে অবিলম্বে আবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে, এই আশা আমরা পোষণ করব। কোনো দেশপ্রেমী অকারণে শাস্তি পান, এটি আমরা চাই না।
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় কথা দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বিদেশে বসে গণতন্ত্রের চর্চার কথা বললে নিশ্চয়ই দেশে ফিরে এর নিরন্তর উন্নতির প্রয়োজনীয়তাটা তিনি আরও গভীরভাবে বুঝবেন। গণতন্ত্রের যে চর্চা হচ্ছে, তা তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। এবং তা করতে গিয়ে বর্তমানের ভুলভ্রান্তি, অভাব এবং অনুপস্থিতিগুলোও নিশ্চয়ই তাঁর চোখে পড়বে এবং সেগুলো নিরসনের জন্য তিনি অবশ্যই উদ্যোগ নেবেন। এ কথা তো সত্য, বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা এখন বসে বসে আয়েশি ঢেকুর তুলব। আমাদের দেশে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আছে, সংসদ আছে, মোটামুটি শক্তিশালী মিডিয়া আছে (স্বাধীন কথাটি শর্ত সাপেক্ষ, সে জন্য ব্যবহার করলাম না, যেহেতু সরকার ততটা হস্তক্ষেপ না করলেও মালিকদের হস্তক্ষেপের জন্যও একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে)। কিন্তু এর বাইরে খুব বেশি প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করছে এমন বলা যাবে না। আদালতের কথাটা উহ্যই রাখলাম। যাঁরা নিম্ন আদালতের দুরবস্থা দেখেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। প্রশাসনের প্রসঙ্গটিও না তোলাই ভালো—এ যন্ত্রটি কখনো জি-হুজুরের ভূমিকা থেকে ওপরে উঠতে পেরেছে, তেমন প্রমাণ আমাদের সামনে নেই। একই কথা খাটে পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে।
তবে গণতন্ত্র যে খোদ দলগুলোতেই নেই, এ বিষয়টা কি প্রমাণ করে গণতন্ত্র চর্চায় আমরা আন্তরিক? দলগুলো চলছে চেয়ারপারসন বা দল প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী। এগুলোর নেতৃত্ব অনির্বাচিত, কার্যকর পরিষদগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। দলের ভেতর সমালোচনার কোনো জায়গা নেই। সরকার চালাবে যে দল, এবং সংসদে ও সংসদের বাইরে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে তাকে পথে রাখবে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের পেছনে লেগে থাকবে যে দল—সেই দুটি দলেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের চর্চাটা তো একটা কথার কথা হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত, বাস্তবের কথা নয়।
তার পরও পাকিস্তান বা মিয়ানমারের অথবা আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের অবস্থায় আমরা নেই। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের মানুষের স্বাধীনতা স্পৃহার জন্য, গণতান্ত্রিক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকারের জন্য। এখন যদি ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নিয়ে শুরু করে সব প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করা যায়, যদি রাষ্ট্র পরিচালনার সব স্তরে, জনজীবনের প্রতিটি জবাবদিহির জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সেগুলোকে পরিচালনা করে, তাহলে বলা যাবে, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তা না হলে বড়জোর বলা যাবে, সিকিভাগ হচ্ছে, বাকিটা হবে। ওই বাকিটা নিয়েই সব দলের এবং আমাদের নেমে পড়া উচিত। যেমন ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন। যেমন উপজেলা নির্বাচন। এগুলোতে নির্বাচন যদি নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর নিয়মমতো হয়, যদি এদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গণতন্ত্রের তৃণমূল শক্তিশালী হবে। মূল শক্তিশালী হলে যত ওপরে ওঠা যাবে, শক্তির কোনো অভাব দেখা যাবে না। এরপর পৌরসভাগুলো হচ্ছে, সিটি করপোরেশনগুলো আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দুই ভাগ করা হলো, বলা হলো উন্নত সেবার জন্য এটি করা হয়েছে। উন্নত সেবা দূরে থাক, আগের সেবাটাও দিতে পারছে না দুই টুকরা হওয়া কর্পোরেশনটি। এখন সে দুটিতেও নির্বাচন প্রয়োজন।
আর নির্বাচন প্রয়োজন ছোট-বড় সব দলে। এসবের অঙ্গসংগঠনগুলোতে। কিছুদিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের (ডাকসুর) নির্বাচন আয়োজনের জন্য বাম ধারার কিছু ছাত্র সংগঠন আন্দোলন করছে। আমি তাদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করি, কিন্তু আমার গুরুতর ভয়, বড় দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা প্রতিষ্ঠা না করে, ছাত্র সংগঠনগুলোকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার বড় দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন না করে ডাকসু নির্বাচন করাটা খুব অর্থবহ হবে না। এখন নির্বাচন হলে ছাত্রদল কি অংশ নিতে পারবে? দলটি তো ক্যাম্পাস ছাড়া। তা ছাড়া, ছাত্রলীগের মধ্যেই তো কোন্দল দেখা দিতে পারে। সহিংসতাও একটা বাস্তব আশঙ্কা। তবে দুটি বড় দল আন্তরিক হলে ডাকসু নির্বাচন নির্বিঘ্নেই হতে পারে, এ আমার বিশ্বাস।
এই আন্তরিক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং চর্চা করাটা শুধু রাষ্ট্রের হাতে বর্তায় না, শুধু সরকার বা বিরোধী দলের কর্তব্য হতে পারে না—গণতন্ত্র চর্চাটা হতে হবে সর্বস্তরে। এবং তা হতে হবে আন্তরিক। যেসব প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে নিয়ে অধস্তন সবার একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রত্যয় হতে হবে এই চর্চা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রে ঘুমিয়ে থাকার বা জেগে ঘুমিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হলে দেশটি কখনো কাজের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়বে না। শ্রমিকদের, কৃষিজীবীদের, কর্মজীবীদের সংগঠনগুলোকে গণতান্ত্রিক ও কার্যকর করাটা মালিক-শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যেমন কর্তব্য, ভোক্তা এবং সুবিধাভোগীদেরও তেমনি দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে, গণতান্ত্রিক সিবিএ (সম্মিলিত দর-কষাকষির প্রতিনিধি) থাকলে শ্রমিক-মালিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হয়, কলকারখানা অকারণে বন্ধ হয় না, শ্রমিক বিক্ষোভ হয় না, দেশের ক্ষতি হয় না। সে রকম, সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (এবং পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে) শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত সংসদ থাকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শুধু নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হয়। কারণ, সংসদগুলো সহশিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করতে পারে। সর্বোপরি, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে।
নির্বাচনের কথায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর দুরবস্থার প্রসঙ্গটি এসে যায়। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনের বিধান রয়েছে, তার তিনটিতেই অনির্বাচিত উপাচার্য রয়েছেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নির্বাচিত। সেটিও সম্ভব হয়েছে নির্বাচিত উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের দৃঢ়তা এবং আদালতের সহায়তার জন্য। ড. হোসেনকে অভিনন্দন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ ডিন, সিন্ডিকেটসহ অন্যান্য নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল, ড. হোসেন নিজেকে ঠিকই নির্বাচনী পরীক্ষায় নামিয়েছিলেন। এ কাজটি না করেও তিনি উপাচার্য থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন জাকসু নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন সফলভাবে করতে পারলে তাঁকে আরেক প্রস্থ অভিনন্দন জানাব। এখন বাকি তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারাও নির্বাচিত হয়ে একটা নৈতিক শক্তি নিয়ে নিজেদের আসনে বসুন। অনির্বাচিতের নৈতিক আসনটি থাকে নড়বড়ে। এ রকম কেন হবে বলুন? দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদার এসব বিদ্যাপীঠের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া কি উচিত? তা ছাড়া এগুলোতে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা হলে তা বড় দলগুলোর কাছে একটা বার্তা পাঠাবে। বার্তাটি হবে গণতন্ত্র চর্চাকে সর্বজনীন করার এবং সব পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতার একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরি করার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা চলছে, সে জন্য ওই গণতন্ত্রহীনতাই দায়ী। আমার একটি দৃৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের নিচে আনা হলে, উপাচার্যসহ অনেকগুলো নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে, ছাত্রসংসদগুলোর নির্বাচন করা হলে এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলের লেজ হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করা হলে, দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমাগত উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে। এবং দেশের সব এ রকম সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, দল, সংঘ, সংগঠন এবং যেটায় যেদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, সেগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা হবে। সেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেতা একখানে বসে বিদেশি সাংবাদিকদের বলতে পারবেন, দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ভালোই হচ্ছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় কথা দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বিদেশে বসে গণতন্ত্রের চর্চার কথা বললে নিশ্চয়ই দেশে ফিরে এর নিরন্তর উন্নতির প্রয়োজনীয়তাটা তিনি আরও গভীরভাবে বুঝবেন। গণতন্ত্রের যে চর্চা হচ্ছে, তা তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। এবং তা করতে গিয়ে বর্তমানের ভুলভ্রান্তি, অভাব এবং অনুপস্থিতিগুলোও নিশ্চয়ই তাঁর চোখে পড়বে এবং সেগুলো নিরসনের জন্য তিনি অবশ্যই উদ্যোগ নেবেন। এ কথা তো সত্য, বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা এখন বসে বসে আয়েশি ঢেকুর তুলব। আমাদের দেশে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আছে, সংসদ আছে, মোটামুটি শক্তিশালী মিডিয়া আছে (স্বাধীন কথাটি শর্ত সাপেক্ষ, সে জন্য ব্যবহার করলাম না, যেহেতু সরকার ততটা হস্তক্ষেপ না করলেও মালিকদের হস্তক্ষেপের জন্যও একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে)। কিন্তু এর বাইরে খুব বেশি প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করছে এমন বলা যাবে না। আদালতের কথাটা উহ্যই রাখলাম। যাঁরা নিম্ন আদালতের দুরবস্থা দেখেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। প্রশাসনের প্রসঙ্গটিও না তোলাই ভালো—এ যন্ত্রটি কখনো জি-হুজুরের ভূমিকা থেকে ওপরে উঠতে পেরেছে, তেমন প্রমাণ আমাদের সামনে নেই। একই কথা খাটে পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে।
তবে গণতন্ত্র যে খোদ দলগুলোতেই নেই, এ বিষয়টা কি প্রমাণ করে গণতন্ত্র চর্চায় আমরা আন্তরিক? দলগুলো চলছে চেয়ারপারসন বা দল প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী। এগুলোর নেতৃত্ব অনির্বাচিত, কার্যকর পরিষদগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। দলের ভেতর সমালোচনার কোনো জায়গা নেই। সরকার চালাবে যে দল, এবং সংসদে ও সংসদের বাইরে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে তাকে পথে রাখবে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের পেছনে লেগে থাকবে যে দল—সেই দুটি দলেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের চর্চাটা তো একটা কথার কথা হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত, বাস্তবের কথা নয়।
তার পরও পাকিস্তান বা মিয়ানমারের অথবা আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের অবস্থায় আমরা নেই। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের মানুষের স্বাধীনতা স্পৃহার জন্য, গণতান্ত্রিক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকারের জন্য। এখন যদি ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নিয়ে শুরু করে সব প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করা যায়, যদি রাষ্ট্র পরিচালনার সব স্তরে, জনজীবনের প্রতিটি জবাবদিহির জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সেগুলোকে পরিচালনা করে, তাহলে বলা যাবে, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তা না হলে বড়জোর বলা যাবে, সিকিভাগ হচ্ছে, বাকিটা হবে। ওই বাকিটা নিয়েই সব দলের এবং আমাদের নেমে পড়া উচিত। যেমন ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন। যেমন উপজেলা নির্বাচন। এগুলোতে নির্বাচন যদি নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর নিয়মমতো হয়, যদি এদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গণতন্ত্রের তৃণমূল শক্তিশালী হবে। মূল শক্তিশালী হলে যত ওপরে ওঠা যাবে, শক্তির কোনো অভাব দেখা যাবে না। এরপর পৌরসভাগুলো হচ্ছে, সিটি করপোরেশনগুলো আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দুই ভাগ করা হলো, বলা হলো উন্নত সেবার জন্য এটি করা হয়েছে। উন্নত সেবা দূরে থাক, আগের সেবাটাও দিতে পারছে না দুই টুকরা হওয়া কর্পোরেশনটি। এখন সে দুটিতেও নির্বাচন প্রয়োজন।
আর নির্বাচন প্রয়োজন ছোট-বড় সব দলে। এসবের অঙ্গসংগঠনগুলোতে। কিছুদিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের (ডাকসুর) নির্বাচন আয়োজনের জন্য বাম ধারার কিছু ছাত্র সংগঠন আন্দোলন করছে। আমি তাদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করি, কিন্তু আমার গুরুতর ভয়, বড় দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা প্রতিষ্ঠা না করে, ছাত্র সংগঠনগুলোকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার বড় দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন না করে ডাকসু নির্বাচন করাটা খুব অর্থবহ হবে না। এখন নির্বাচন হলে ছাত্রদল কি অংশ নিতে পারবে? দলটি তো ক্যাম্পাস ছাড়া। তা ছাড়া, ছাত্রলীগের মধ্যেই তো কোন্দল দেখা দিতে পারে। সহিংসতাও একটা বাস্তব আশঙ্কা। তবে দুটি বড় দল আন্তরিক হলে ডাকসু নির্বাচন নির্বিঘ্নেই হতে পারে, এ আমার বিশ্বাস।
এই আন্তরিক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং চর্চা করাটা শুধু রাষ্ট্রের হাতে বর্তায় না, শুধু সরকার বা বিরোধী দলের কর্তব্য হতে পারে না—গণতন্ত্র চর্চাটা হতে হবে সর্বস্তরে। এবং তা হতে হবে আন্তরিক। যেসব প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে নিয়ে অধস্তন সবার একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রত্যয় হতে হবে এই চর্চা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রে ঘুমিয়ে থাকার বা জেগে ঘুমিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হলে দেশটি কখনো কাজের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়বে না। শ্রমিকদের, কৃষিজীবীদের, কর্মজীবীদের সংগঠনগুলোকে গণতান্ত্রিক ও কার্যকর করাটা মালিক-শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যেমন কর্তব্য, ভোক্তা এবং সুবিধাভোগীদেরও তেমনি দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে, গণতান্ত্রিক সিবিএ (সম্মিলিত দর-কষাকষির প্রতিনিধি) থাকলে শ্রমিক-মালিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হয়, কলকারখানা অকারণে বন্ধ হয় না, শ্রমিক বিক্ষোভ হয় না, দেশের ক্ষতি হয় না। সে রকম, সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (এবং পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে) শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত সংসদ থাকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শুধু নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হয়। কারণ, সংসদগুলো সহশিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করতে পারে। সর্বোপরি, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে।
নির্বাচনের কথায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর দুরবস্থার প্রসঙ্গটি এসে যায়। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনের বিধান রয়েছে, তার তিনটিতেই অনির্বাচিত উপাচার্য রয়েছেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নির্বাচিত। সেটিও সম্ভব হয়েছে নির্বাচিত উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের দৃঢ়তা এবং আদালতের সহায়তার জন্য। ড. হোসেনকে অভিনন্দন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ ডিন, সিন্ডিকেটসহ অন্যান্য নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল, ড. হোসেন নিজেকে ঠিকই নির্বাচনী পরীক্ষায় নামিয়েছিলেন। এ কাজটি না করেও তিনি উপাচার্য থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন জাকসু নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন সফলভাবে করতে পারলে তাঁকে আরেক প্রস্থ অভিনন্দন জানাব। এখন বাকি তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারাও নির্বাচিত হয়ে একটা নৈতিক শক্তি নিয়ে নিজেদের আসনে বসুন। অনির্বাচিতের নৈতিক আসনটি থাকে নড়বড়ে। এ রকম কেন হবে বলুন? দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদার এসব বিদ্যাপীঠের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া কি উচিত? তা ছাড়া এগুলোতে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা হলে তা বড় দলগুলোর কাছে একটা বার্তা পাঠাবে। বার্তাটি হবে গণতন্ত্র চর্চাকে সর্বজনীন করার এবং সব পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতার একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরি করার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা চলছে, সে জন্য ওই গণতন্ত্রহীনতাই দায়ী। আমার একটি দৃৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের নিচে আনা হলে, উপাচার্যসহ অনেকগুলো নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে, ছাত্রসংসদগুলোর নির্বাচন করা হলে এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলের লেজ হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করা হলে, দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমাগত উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে। এবং দেশের সব এ রকম সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, দল, সংঘ, সংগঠন এবং যেটায় যেদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, সেগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা হবে। সেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেতা একখানে বসে বিদেশি সাংবাদিকদের বলতে পারবেন, দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ভালোই হচ্ছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments