দ্রব্যমূল্য নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন-বাজারের ৪০ ব্যবসায়ী 'সতর্ক' তালিকায় by আবুল কাশেম

ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল ও খেজুর- রমজান ও ঈদের নিত্যপ্রয়োজনীয় এই চার পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কমপক্ষে ৪০ ব্যবসায়ীর ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারে এসব পণ্যের কোনো সংকট নেই।


আমদানিও হয়েছে যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও রমজান ও ঈদে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কেউ যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকে কঠোর নজরদারির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। তালিকায় ভোজ্য তেল ও চিনির মিল মালিক ছাড়াও আছেন ডিও ব্যবসায়ী ও বড় আমদানিকারকও। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল বাণিজ্যসচিবের কাছে পাঠানো এই গোপন প্রতিবেদনে ভোজ্য তেলের কয়েকজন মিল মালিক ও ডিও ব্যবসায়ী, চিনির দুজন মিল মালিক, ডাল ও ছোলার আমদানিকারক এবং পাইকারি ব্যবসায়ী সম্পর্কে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রমজানের বাকি কয়েক দিন এবং ঈদে এসব ব্যবসায়ী যাতে কারসাজি করার সুযোগ না পায় সে জন্য আগে থেকেই এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে মিল থেকে তেল উত্তোলনের আগেই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের কিছু কিছু ডিও তিন-চারবার হাত বদল হচ্ছে। চট্টগ্রামের ৫০ থেকে ৭০ জন ডিও ব্যবসায়ীর মাধ্যমে দেশের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ ডিও বিক্রি হয়ে থাকে। তাঁদের মধ্য থেকে খাতুনগঞ্জের সাত প্রতিষ্ঠানের ৯ ডিও ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই ব্যবসায়ীরা হলেন মেসার্স মীর আহমেদ সওদাগরের মালিক মীর আহমেদ সওদাগর, সোনা মিয়া মার্কেটের মো. হোসাইন, এস করপোরেশনের বিশ্বনাথ পোদ্দার ও ওয়াজেদ আলী, বাদশা মিয়া মার্কেটের আরএম এন্টারপ্রাইজের আলমগীর হোসেন ও শাহেদুল আলম, মেসার্স আল সাপার মালিক আবুল বশর চৌধুরী, এশিয়া সেন্টারের মো. মোসলেম চৌধুরী ও সোনা মিয়া মার্কেটের পরিতোষ রায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশে যে পরিমাণ ভোজ্য তেল মজুদ আছে, তাতে বাজারে সংকট সৃষ্টি হবে না মনে হলেও অসাধু মিল মালিক, ডিও ব্যবসায়ী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের ক্ষমতার চেয়ে কম পরিমাণ তেল উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। ফলে বাজারে তেল সরবরাহের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় কমেছে। তা ছাড়া রমজান ও ঈদে বোতলজাত তেলের চাহিদা বেশি থাকে। এই সুযোগ নিতে রোজার আগেই বোতলজাত তেলের সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট সৃষ্টি করে মিলগুলো। ঈদ পর্যন্ত ভোজ্য তেলের মিলগুলো যাতে ২৪ ঘণ্টা পরিশোধন অব্যাহত রাখে সে জন্য উদ্যোগ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর আগে এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসে, রমজান মাসে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থিতিশীল করতে চট্টগ্রামের ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান নূরজাহান অয়েল মিল, এসএ গ্রুপের কামাল ভেজিটেবল অয়েল, রুবাইয়া অয়েল মিল, ইলিয়াস ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপের মেসার্স এমএম অয়েল মিলস, টিকে অয়েল মিল তেল সরবরাহ বন্ধ রাখে। তাদের সঙ্গে বাজার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মেসার্স এম হোসেন ট্রেডার্সের মালিক ইব্রাহীম ও আরএম ট্রেডার্সের মালিক আলমগীর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত মিল মালিকদের শোকজ করে। এ ছাড়া অবৈধভাবে দাম বাড়ানোর অভিযোগে মেঘনা, এসএ অয়েল ও এস আলম গ্রুপকে শোকজ করা হয়। এরই মধ্যে কেউ কেউ দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি দেখিয়ে, কেউ ক্ষমা চেয়ে জবাব দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন বলেন, 'অভিযুক্ত ভোজ্য তেল কম্পানিগুলোর জবাব পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আইন, প্রতিযোগিতা আইনের পাশাপাশি দেশে প্রচলিত সাধারণ আইনেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। আমরা এখন সে বিষয়টিই পরীক্ষা করে দেখছি। এ ছাড়া অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যবসায়ীর বিষয়েও মন্ত্রণালয় সতর্ক রয়েছে। এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভিন্ন কৌশলে বাজার মনিটরিং করছে। ফলে এই রমজানে জনগণ কিছুটা স্বস্তিতেই রয়েছে।' স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের পরামর্শগুলো পর্যালোচনা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
রমজান ও ঈদে ডালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ঢাকার শ্যামপুর, রহমতগঞ্জ, বাদামতলী, কারওয়ান বাজারসহ দেশের অন্যান্য বড় বাজারে মসুর ডালের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাকি রমজান ও ঈদে যাতে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগ না পায় সে জন্য ঢাকার ১৩ জন বড় ডাল ব্যবসায়ীর বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা ডাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন রহমতগঞ্জ ডাল ও ভুসি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এবং দেওয়ান ট্রেডার্সের মালিক হাজি সালাউদ্দিন দেওয়ান, সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মেসার্স এমজি ট্রেডিংয়ের কর্ণধার মো. জাহিদ হোসেন, রহমতগঞ্জের মেসার্স মহিউদ্দিন অ্যান্ড সন্সের মালিক মো. বদর উদ্দিন, মাখন অ্যান্ড কোং-এর মালিক হাজি আলী আকবর, মেসার্স আল্লাহর দান স্টোরের মালিক মো. আব্দুল লতিফ, বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও চকবাজারের শোভা বাণিজ্য বিতানের শফি মাহমুদ, একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চকবাজারের মেসার্স মীম এন্টারপ্রাইজের মো. শফিকুল ইসলাম, মেসার্স সুমন ডাল মিলের মালিক মো. নেছার উদ্দিন খান, মেসার্স জাহিদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক জাহিদ হোসেন, কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের ইসলামিয়া শান্তি সমিতির রহমত উল্লাহ, রহমতগঞ্জের মেসার্স আজাদ ট্রেডার্সের মো. বাবু, রাজ্জাক বিতানের মো. চুন্নু মিয়া ও জনতা ট্রেডার্সের মো. ওয়াকিল। এর আগে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মসুর ডাল ও ছোলার বাজার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ ওঠে খাতুনগঞ্জের মেসার্স নিউ বার আউলিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স সততা ট্রেডার্স ও হক সওদাগরের বিরুদ্ধে।
এদিকে এবারের রমজানে চিনির বাজার স্থিতিশীল থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতের পাঁচটি চিনিকলের মধ্যে তীর ব্র্যান্ডের সিটি গ্রুপ ও ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মেঘনা গ্রুপই দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন চিনির স্বাভাবিক চাহিদা তিন হাজার ৮০০ টন। রমজানে চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭০০ টন। মিলগুলোর দৈনিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা আট থেকে ৯ হাজার টন হলেও তারা গড়ে চার হাজার টন উৎপাদন করছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে ডেলিভারি অর্ডার জমা দেওয়ার পর মিল থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীদের চিনি পেতে ২০ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে। মিলগুলো যাতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়ায় সে জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
খেজুরের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ খেজুর আমদানি করে তা বাজারে বিক্রি না করে বেশি দামে ভারতে পাচার করে থাকেন। সরবরাহ ঘাটতির কারণে দেশের বাজারে খেজুরের দাম বেড়ে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে খেজুর পাচার রোধের পাশাপাশি আমদানিকারক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত তদারকির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের খেজুরের আমদানিকারক ১০ জন। তাঁরা হলেন ঢাকার বাদামতলীর এসএম এন্টারপ্রাইজের সিরাজুল ইসলাম, মদিনা ফ্রুটসের হাজি সেলিম, তানভীর এন্টারপ্রাইজের রাসেল হোসেন, খাজা ফ্রুটসের হাজি বয়রাত হোসেন, আল্লার দানের মালিক হাজি আফসার আলী, শাকিল ফ্রুটসের মালিক হাজি শামসু হাওলাদার, জিল্লুর এন্টারপ্রাইজের জিল্লুর রহমান, নাবিল এন্টারপ্রাইজের হাজি মনির হোসেন ও জয়া এন্টারপ্রাইজের হাজি সাজাহান। খেজুরের সাত পাইকারি ব্যবসায়ী হলেন বাদামতলীর রুমা এন্টারপ্রাইজের যোগেন্দ্রনাথ দাস, শিহাব এন্টারপ্রাইজের নুর উদ্দিন আহমেদ, মামুন এন্টারপ্রাইজের আবদুল জলিল, সনি এন্টারপ্রাইজের মো. আবুল কালাম, বাগদাদ ফ্রুট এজেন্সির মো. বাহাউদ্দিন ও মৌসুমী এন্টারপ্রাইজের মো. তারেক মিয়া।

No comments

Powered by Blogger.