স্বপ্নমুখীর যাত্রাপথে...

সংখ্যার বিচারে কণ্ঠশিল্পী নির্ঝরের কাজের পরিমাণ কম হলেও, মান আর জনপ্রিয়তার বিচারে তাঁর আসন বেশ উঁচুতেই। ‘মাদার অব আর্টস’ তথা নাচ দিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাত্রা শুরু, তবে সাফল্য আজ তাঁর সঙ্গীতের হাত ধরেই এসেছে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গানের হাতেখড়ি নেন দাদির কাছে। এরপর নির্ঝর তালিম নিয়েছেন ক্লাসিক এবং


নজরুল সঙ্গীতে। একাধারে ১০ বছর খুলনার নজরুল একাডেমীতে ওস্তাদ আজিজুর রহমান আর ভারতের ওস্তাদ গোলক বিহারীর কাছ থেকে সঙ্গীতে দীক্ষা নেন তিনি। পরিবার, চেনাজন আর ওস্তাদদের উৎসাহে অংশ নিয়েছিলেন শিশুদের নানা রকম গানের প্রতিযোগিতায়। গানে নিয়মিত হয়ে পড়ায় বাদ দিতে হলো শখের নাচ এবং অভিনয়। মজার ব্যাপার হলো শিল্পের এই দুটি শাখাতেও ক্ষুদে নির্ঝর সাফল্য এবং অপার সম্ভাবনার প্রমাণ দিয়েছিলেন। জয় করেছিলেন নানা রকম পুরস্কার আর স্বীকৃতি। কণ্ঠে সঙ্গীতের জাদু ছড়ানোর স্বপ্ন পূরণের আশায় কলেজজীবন পার করে ২০০০ সালে চলে আসেন ঢাকায়। এ বছরই নির্বাচিত হন এটিএন বাংলায় নবীনবরণ শিল্পী হিসেবে। একই বছর এই তরুণ তুর্কী ঘরে তুলেছেন নতুন কুঁড়ি, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, জাতীয় শিশু পুরস্কারসহ বেশ কিছু স্বীকৃতি। সেইসব স্বীকৃতিই নির্ঝরকে আজকের শিল্পীতে পরিণত করেছে বলে মনে করেন তিনি। শিল্পী হওয়ার বাসনায় ঢাকায় এসে সঙ্গীতে পুনরায় তালিম নেন বাসুদেব ঘোষের কাছে। মূলত তখন থেকেই মিডিয়াতে পদার্পণ বলা যেতে পারে। এরপর ২০০৩ সালে সাউন্ডটেকের ব্যানারে বাজারে আসে নির্ঝরের প্রথম একক এ্যালবাম, ‘পোড়ামুখী’। বাংলা গানের সেই সুন্দর দিনগুলোতে বেশ সাড়া জাগায় নির্ঝরের এ্যালবামটি। এ সাফল্যের হাত ধরেই বাংলা টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। পাশাপাশি ব্যস্ততা বাড়ল স্টেজ প্রোগ্রাম আর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলেও। এভাবেই একটু একটু করে পরিচিতি পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। ২০০৫ সালে এসে সেই পরিচিতি ধরে রাখতে বাজারে আনলেন নিজের দ্বিতীয় একক ‘সূর্যমুখী’। তবে ওয়ার্ল্ড মিউজিকের ব্যানারে এ্যালবামটি প্রকাশ হওয়ার সময় পড়াশোনার তাগিদে দেশের বাইরে ছিলেন নির্ঝর। নানা সমস্যায় এবং তদারকির অভাবে ‘সূর্যমুখী’ সব রকম শ্রোতাদের কাছে পৌঁছতে পারেননি। সেজন্য দীর্ঘ সাত বছর কোন একক এ্যালবাম বাজার আসেনি তাঁর। নির্ঝর বলেন, ‘সূর্যমুখী’ এ্যালবামের কাজ গুছিয়েই আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল। আমার অনুপস্থিতিতেই এ্যালবামটি প্রকাশ হয়। স্বাভাবিকভাবেই একটা অবহেলার বিষয় থাকে। তাই পড়াশোনা শেষ না করে আর কোন একক কাজে হাত দেইনি। কারণ পড়াশোনার কারণে আমি দীর্ঘদিন দেশে স্থায়ীভাবে থাকতে পারিনি। তবে এখন আমি ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। পড়াশোনা শেষ করেছি। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে নির্ঝরের তৃতীয় একক এ্যালবাম ‘স্বপ্নমুখী’। ঈদ উপলক্ষে এই এ্যালবামটি বাজারে এসেছে সময়ের আলোচিত সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিডি চয়েজের ব্যানারে। এই এ্যালবামে নির্ঝরের জন্য গান তৈরি করেছেন হৃদয় খান, ইমরান। আর একটি দেশের গানে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন বাসুদেব ঘোষ এবং অন্য একটি গানে শিল্পী নিজেই সুরারোপ করেছেন। এখানে শ্রোতারা পাবেন মেলোডি, সফট মেলোডিসহ ভিন্ন আমেজের মোট ১২টি গান। নিজের এ্যালবাম নিয়ে নির্ঝর বলেন, ‘অনেক সময় নিয়ে যতœ দিয়ে এ্যালবামের প্রতিটি গান করেছি। শ্রোতারা আমার কাছে যে ধরনের গান আশা করে তেমন কিছু গান দিয়েই সাজানো ‘স্বপ্নমুখী’। শ্রোতাদের ভাল লাগবে বলে বিশ্বাস আমার। এর বেশি কিছু বলব না। তাছাড়া আমার যত মনের কথা সবই গানে গানে বলে দিয়েছি। আশা করি শুনবেন সবাই।’ উল্লেখ্য, নির্ঝরের আগের দুটি এ্যালবামের নামের শেষে ছিল ‘মুখী’ শব্দটি, নতুন এ্যালবামেও স্বপ্নের শেষে ‘মুখী’ যোগ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মিষ্টি হেসে শিল্পী বলেন, ‘এর আসলে গূঢ় কোন রহস্য নেই। কেবল এ্যালবামের নামকরণে একটা মিল রাখতে এবং শ্রোতারা আমার এ্যালবামগুলো যেন সহজেই পৃথক করতে পারে সেজন্যই ‘পোড়ামুখী’, ‘সূর্যমুখী’, নামকরণের পর তৃতীয় এ্যালবামের নাম রেখেছি ‘স্বপ্নমুখী’। তবে হ্যাঁ, এই নামকরণে এ্যালবাম প্রকাশের সময়গুলোতে আমার মনমানসিকতার একটা প্রভাব কিংবা ছায়া থাকে। আশা করছি এই এ্যালবামের গানগুলো শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা কওে নেবে। পড়াশোনার ব্যস্ততায় বিগত কয়েক বছর লন্ডনে যাওয়া-আসা করলেও বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে আছেন স্থায়ীভাবেই। খুলনার মেয়ে আজমেরী নির্ঝরের জন্ম ১৪ জানুয়ারি। বাবা এসএম আলাউদ্দীন। মা ইফফাত আরা। দুই বোনের মধ্যে বড় আলিয়া আবিদ। নির্ঝর লন্ডন থেকে মার্কেটিং নিয়ে এমবিএ করেছেন। পাশাপাশি সম্পন্ন করেছেন চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্সির গুরুত্বপূর্ণ কোর্সগুলো। ভাবছেন ব্যাবসায় ক্যারিয়ার গড়বেন। গানের পেশাদারিত্বের কথা জানতে চাইলে নির্ঝর জানান, ‘গানকে পেশা হিসেবে নেয়ার কথা ভাবেন না। গান তাঁর কাছে ভালবাসার সেরা একটি শখ এবং তিনি নিয়মিতভাবে এর সাধনা করে যেতে চান। গান নিয়ে খ্যাতি বা মোহ কুড়াতে চান না তিনি।’ অন্য কোন পেশায় থেকেই গানকে তিনি লালন করবেন। অনেক বেশি গানের শিল্পী হওয়ার বাসনা নয়, নির্ঝর চান এক জীবনে অমর হয়ে থাকার মতো কিছু গান। তবে সঙ্গীত জীবনে নিজের অতৃপ্তি ঘোচাতে একটি নজরুল সঙ্গীতের এ্যালবাম প্রকাশ ও ভাষা দিবস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে গান করার স্বপ্ন দেখেন নির্ঝর। এ পর্যন্ত কাজ করেছেন হাবিব, হৃদয়, বাপ্পা, ফুয়াদ, ইমরানসহ অসংখ্য জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে। সর্বমোট কণ্ঠ দিয়েছেন প্রায় ২০টি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে, ৬-৭টি মিক্সড এ্যালবাম এবং ২টি চলচ্চিত্রে। জানালেন, ভাল গান হলে যে কোন মিউজিশিয়ানের সঙ্গেই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। তার প্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী এবং পছন্দের মিউজিক আইকন এআর রহমান। ২০০৫ সালে স্বনামখ্যাত মিউজিশিয়ান হাবিব ওয়াহিদের কম্পোজিশনে ‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও’ ও ‘ময়না গো’ গানের রিমেক ভার্সনে কণ্ঠ দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন নির্ঝর এবং অর্জন করেন আকাশছোঁয়া শ্রোতাপ্রিয়তা। সঙ্গীতাঙ্গনে নতুন প্রজন্মের এই তরুণী গায়িকার নাম উঠে আসে জনপ্রিয় তারকাশিল্পী হিসেবে। তারপর থেকে শ্রোতাদের কাছে বেড়েছে নির্ঝরের প্রতি আগ্রহ এবং অন্য রকম প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণে সফলভাবেই পথ চলছেন নির্ঝর। তাঁর গান হোক মানুষের মনের আনন্দ-বেদনার ভালবাসার আশ্রয়, বেঁচে থাকুক তাঁর কণ্ঠ-সুর কোটি শ্রোতার ভাললাগায়।

No comments

Powered by Blogger.