সাদাকালো-জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন খাদ্যে-ওষুধে by আহমদ রফিক
গত ৩ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, গুণগত মান ইত্যাদি স্বাস্থ্যসেবা বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। এ বিষয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ।
প্রবন্ধে মূলত সংবাদপত্রের প্রতিবেদনভিত্তিক যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তা যেমন সময়োপযোগী তেমনি একই সঙ্গে সমাজকল্যাণমুখী।
আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও প্রকৌশলীরা। মূল বিষয়ে সবাই প্রায় একমত যে ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ওষুধ, চিকিৎসা ও চিকিৎসাসেবায় যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তার সুফল ব্যাপক জনস্তরে প্রসারিত হওয়া দূরে থাক, মূল লক্ষ্যই বরং দিকহারা হয়ে গেছে দুর্বল ওষুধ প্রশাসন ও ওষুধনীতির সময়োপযোগী এবং জনকল্যাণমুখী পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের অভাবে।
বরং যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদেশি বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজি বন্ধ হয়েছে, তাদের অধিকাংশ এ দেশ থেকে ওষুধবাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাদের জায়গা দখল করেছে অনুরূপ কয়েকটি স্বদেশি ওষুধ কম্পানি; যারা মুনাফাবাজির চরিত্রগুণে পূর্বোক্ত বিদেশি বহুজাতিক ওষুধ কম্পানির মতোই হয়ে উঠেছে। দেশি কম্পানি হওয়ার কারণে তাদের ক্ষমতা বরং অপেক্ষাকৃত বেশি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে কারো কারো সমালোচনা সত্ত্বেও লক্ষ করার মতো ঘটনা যে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে কথিত তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজি ও জনস্বার্থের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণের কারণে তাদের ভূমিকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিচারে চিহ্নিত হয় 'ভেষজ ঔপনিবেশিকতা'রূপে। যেখানে শোষণ মূল কথা। তাদের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের মুনাফা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার পড়ে না। এ বিষয়ে লেখালেখি কম হয়নি। স্বদেশি কম্পানির ঔপনিবেশিকতাসুলভ বাণিজ্য কী চমৎকার!
বাংলাদেশে প্রণীত ওষুধনীতি এর জনস্বার্থমূলক চরিত্রের কারণে ভেষজ বিশ্বে অভিনন্দিত ও সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু আমরা এর সুফল ব্যাপকভিত্তিক করে তোলার পরিবর্তে অনেকটাই নষ্ট করেছি সংশোধনের নামে ওষুধ কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজির সুযোগ করে দিয়ে, ওষুধ প্রশাসনকে শক্তিহীন ও বৃহৎ ওষুধ উৎপাদকদের স্বাধীনতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে। যার ফলে যখন-তখন খেয়ালখুশিমতো ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ক্রেতা-ভোক্তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে চলেছে। এমনকি ওষুধ আমদানি বা ভেজাল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ থাকছে না। থাকলেও তা বৃহৎ কম্পানির স্বার্থ দেখছে।
ওষুধনীতির প্রাথমিক পর্বে ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের যে নিয়মনীতি ও বাধ্যবাধকতা ছিল, তা বহুল পরিমাণে শিথিল হওয়ার কারণে বলা যায়, একধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। মনে হয় যেন বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিগুলোই দেশি নামে বাংলাদেশের ওষুধ ভুবনে বাণিজ্য করছে। মনে রাখা দরকার, উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের চাহিদা মেটাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ওষুধ খাতটি জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি খাত, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন-মরণের সঙ্গে যুক্ত সেখানে অনিয়ম, মুনাফাবাজি, ভেজাল-প্রবণতার মতো ঘটনা জাতীয় স্বার্থবিরোধী হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য।
কাজেই দরকার অবস্থা সোজাসাপ্টা করতে ব্যবস্থা গ্রহণ; ওষুধ প্রশাসনকে কার্যকর ও শক্তিশালী করে তোলা, ওষুধ কম্পানিগুলোক নিয়ন্ত্রণে আনা ও রাখা, ওষুধনীতিকে অধিকতর জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। আশ্চর্যের বিষয়, গত ৩০ বছরে ওষুধনীতির আনুষঙ্গিক অবকাঠামো বিস্তৃত ও দূষণমুক্ত করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। ওষুধ মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগারের দক্ষ জনবল তৈরিতেও মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে বড় কথা, ওষুধনীতিকে সময়োপযোগী করে তোলার কোনো চেষ্টাই দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতও বিবেচনায় আসেনি। ওষুধের গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। ওষুধ কম্পানির অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা বৃদ্ধিও এর একটি কারণ। দেশি উৎপাদক বৃদ্ধির স্লোগানের টানে নীতি-নৈতিকতার জায়গাটিতে কিছু না কিছু বিপর্যয় যে ঘটেছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই।
প্রফেসর মুনীর উদ্দিনের নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভুবনের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগেই বলেছি, প্রবন্ধটি নির্ভরযোগ্য তথ্যাবলির ভিত্তিতে রচিত এবং তা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্প্রতি ওষুধের কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধি জনমানসে ও সংবাদপত্র মহলে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য অনুধাবনযোগ্যই শুধু নয়, এর প্রতিকার, প্রতিবিধান, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ওই সভায় শরীর-স্বাস্থ্য, জীবন-মৃত্যুবিষয়ক যে আলোচনা ও শঙ্কার প্রকাশ ঘটেছে তাতে যুক্ত হয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা যায়, বিষাক্ত ও ভেজাল খাদ্য, যার দুষ্টপ্রভাব যেমন রয়েছে তাৎক্ষণিক, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী রূপে। বিষাক্ত লিচু খেয়ে সাম্প্রতিক শিশুমৃত্যুর ঘটনা (অনেকটা বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ গ্রহণ করে শিশুমৃত্যুর মতো) যেমন সত্য, তেমনি সত্য এর দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন আগেই সবাইকে হুঁশিয়ার করেছিলেন ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণে কিডনি বিকল হওয়া সম্পর্কে। সাম্প্রতিক তথ্যে কিডনি রোগের ব্যাপকতা ও বিকল কিডনিজনিত মৃত্যুর সংখ্যাধিক্য তাঁদের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত করেছে। তা ছাড়া দেহযন্ত্রে ক্যান্সার রোগের আশঙ্কাও বহুল আলোচিত বিষয়। দিনের পর দিন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে কিভাবে আম, কাঁঠাল, পেঁপে, লিচু, এমনকি তরমুজ বা আনারসের মতো সুস্বাদু ফলে কীটনাশক ব্যবহার করে, ফরমালিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে সেগুলো বিষাক্ত ও খাওয়ার অনুপযোগী করে তোলা হচ্ছে।
পূর্বোক্ত বিষাক্ত লিচু খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনাটি সপ্তাহ কয়েক আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মৌসুমের সেরা সুস্বাদু ফল আমে কীটনাশক ছিটানোর সচিত্র প্রতিবেদন তো আমের মৌসুমে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
স্বভাবতই স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত। অনেকে ফল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কলার মতো সারা বছর খাওয়ার উপযোগী ফলও আর আগ্রহের বিষয় নয়। যেমন নয় বিদেশাগত সুস্বাদু উপকারী ফল আপেল।
তাহলে খাবেন কী? সুস্বাদু ফলের তালিকা থেকে তো সবই বাদ পড়ে যাচ্ছে! কাজেই অনেকে ঝুঁকি নিয়েই এসব ফল খাচ্ছেন। খাচ্ছেন নিত্যকার ভেজালযুক্ত খাদ্য- হোক তা ভেজাল আটা বা মসলা কিংবা ফরমালিনযুক্ত দুধ। বাংলাদেশের কী উৎপাদক, কী ব্যবসায়ীকুল (জানি না ব্যতিক্রমীদের সংখ্যা কত) এমনই মূল্যবোধহীন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে যে তারা নিজ পরিবারের স্বাস্থ্যক্ষতি নিয়েও মাথা ঘামাতে নারাজ। মুনাফা একমাত্র লক্ষ্য তাদের। ভেজাল খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ, বিষাক্ত ফল বা শাকসবজির মুনাফা-বাণিজ্যে তারা এতটাই বেপরোয়া যে তাদের তুলনা বিরল। কবির ভাষায় বলতে হয়, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।'- অবশ্য বিপরীত অর্থে।
আমরা ভাবতে পারি না, কাগজ-কাগজে এত সচিত্র প্রতিবেদন ও কলামের পর কলাম লেখার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিভাবে নির্বিকার-নিষ্ক্রিয় থাকতে পারছে? তাদের পরিবারের সদস্যরা কি এসব বিষক্রিয়ার ঊর্ধ্বে! কেন বুঝতে পারছে না যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ টাকার জরিমানায় তাদের কিছুই যায়-আসে না। বরং ওই লোকসান পূরণ করতে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে সক্রিয় হয়ে উঠবে।
কাজেই আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ সরকারের প্রতি, কিছু একটা কার্যকর ব্যবস্থা নিন- যেমন যথার্থ ওষুধনীতির প্রয়োগে, তেমনি খাদ্যনীতির বাস্তবায়নে। ভেবে দেখুন, দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া কার্যকলাপে জনস্বাস্থ্য বিরাট হুমকির সম্মুখীন, যেমন তাৎক্ষণিকভাবে, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়ায়। কীটনাশক বড় মারাত্মক উপকরণ, দরকার আশু ব্যবস্থা গ্রহণ।
যখন ওষুধনীতি প্রণীত হয় তখনই আমরা লিখেছিলাম তাতে কার্যকর খাদ্যনীতি যুক্ত করার জন্য। এখন আবারও বলি, বলি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে, এখনই গঠন করুন নয়া খাদ্য ও ওষুধনীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক কাঠামো 'খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা'- 'ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি' সৎ, মেধাবী বিশেষজ্ঞের সাহায্যে। নীতি প্রণয়নে সাহায্য নিন নবীন-প্রবীণ মেধাবী বিশেষজ্ঞদের। নীতি বাস্তবায়নে সাহায্য করবে সৎ প্রশাসন। তবে শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যেমন চলবে না, তেমনি প্রশাসক নির্বাচনে নিরপেক্ষ না হলে চলবে না দলীয়-নির্দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব থেকে।
জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝবেন না; অথচ বিশেষ দায়িত্ব পালন করবেন, তা কেমন করে হয়? কোনো সময় আপনার একান্ত নিকটজনও তো বিষাক্ত খাদ্য- হতে পারে ফল বা ভেজাল ওষুধে অঘটনের শিকার। তাই সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন এবং জনগণের শুভেচ্ছা মাথায় তুলে নিন- মাত্র এটুকুই আমাদের দাবি। অনেকের লেখায় উঠে এসেছে একটি আদর্শ স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বপ্ন, পাল্টা কেউ লিখেছেন চিকিৎসাসেবার দুর্নীতি নিয়ে। পরে একসময় লিখব এ বিষয়ে। আপাতত নয়া ওষুধনীতি ও সাংগঠনিক কাঠামোই হোক।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও প্রকৌশলীরা। মূল বিষয়ে সবাই প্রায় একমত যে ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ওষুধ, চিকিৎসা ও চিকিৎসাসেবায় যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তার সুফল ব্যাপক জনস্তরে প্রসারিত হওয়া দূরে থাক, মূল লক্ষ্যই বরং দিকহারা হয়ে গেছে দুর্বল ওষুধ প্রশাসন ও ওষুধনীতির সময়োপযোগী এবং জনকল্যাণমুখী পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের অভাবে।
বরং যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদেশি বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজি বন্ধ হয়েছে, তাদের অধিকাংশ এ দেশ থেকে ওষুধবাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাদের জায়গা দখল করেছে অনুরূপ কয়েকটি স্বদেশি ওষুধ কম্পানি; যারা মুনাফাবাজির চরিত্রগুণে পূর্বোক্ত বিদেশি বহুজাতিক ওষুধ কম্পানির মতোই হয়ে উঠেছে। দেশি কম্পানি হওয়ার কারণে তাদের ক্ষমতা বরং অপেক্ষাকৃত বেশি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে কারো কারো সমালোচনা সত্ত্বেও লক্ষ করার মতো ঘটনা যে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে কথিত তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজি ও জনস্বার্থের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণের কারণে তাদের ভূমিকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিচারে চিহ্নিত হয় 'ভেষজ ঔপনিবেশিকতা'রূপে। যেখানে শোষণ মূল কথা। তাদের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের মুনাফা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার পড়ে না। এ বিষয়ে লেখালেখি কম হয়নি। স্বদেশি কম্পানির ঔপনিবেশিকতাসুলভ বাণিজ্য কী চমৎকার!
বাংলাদেশে প্রণীত ওষুধনীতি এর জনস্বার্থমূলক চরিত্রের কারণে ভেষজ বিশ্বে অভিনন্দিত ও সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু আমরা এর সুফল ব্যাপকভিত্তিক করে তোলার পরিবর্তে অনেকটাই নষ্ট করেছি সংশোধনের নামে ওষুধ কম্পানিগুলোর মুনাফাবাজির সুযোগ করে দিয়ে, ওষুধ প্রশাসনকে শক্তিহীন ও বৃহৎ ওষুধ উৎপাদকদের স্বাধীনতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে। যার ফলে যখন-তখন খেয়ালখুশিমতো ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ক্রেতা-ভোক্তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে চলেছে। এমনকি ওষুধ আমদানি বা ভেজাল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ থাকছে না। থাকলেও তা বৃহৎ কম্পানির স্বার্থ দেখছে।
ওষুধনীতির প্রাথমিক পর্বে ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের যে নিয়মনীতি ও বাধ্যবাধকতা ছিল, তা বহুল পরিমাণে শিথিল হওয়ার কারণে বলা যায়, একধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। মনে হয় যেন বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিগুলোই দেশি নামে বাংলাদেশের ওষুধ ভুবনে বাণিজ্য করছে। মনে রাখা দরকার, উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের চাহিদা মেটাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ওষুধ খাতটি জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি খাত, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন-মরণের সঙ্গে যুক্ত সেখানে অনিয়ম, মুনাফাবাজি, ভেজাল-প্রবণতার মতো ঘটনা জাতীয় স্বার্থবিরোধী হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য।
কাজেই দরকার অবস্থা সোজাসাপ্টা করতে ব্যবস্থা গ্রহণ; ওষুধ প্রশাসনকে কার্যকর ও শক্তিশালী করে তোলা, ওষুধ কম্পানিগুলোক নিয়ন্ত্রণে আনা ও রাখা, ওষুধনীতিকে অধিকতর জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। আশ্চর্যের বিষয়, গত ৩০ বছরে ওষুধনীতির আনুষঙ্গিক অবকাঠামো বিস্তৃত ও দূষণমুক্ত করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। ওষুধ মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগারের দক্ষ জনবল তৈরিতেও মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে বড় কথা, ওষুধনীতিকে সময়োপযোগী করে তোলার কোনো চেষ্টাই দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতও বিবেচনায় আসেনি। ওষুধের গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। ওষুধ কম্পানির অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা বৃদ্ধিও এর একটি কারণ। দেশি উৎপাদক বৃদ্ধির স্লোগানের টানে নীতি-নৈতিকতার জায়গাটিতে কিছু না কিছু বিপর্যয় যে ঘটেছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই।
প্রফেসর মুনীর উদ্দিনের নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভুবনের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগেই বলেছি, প্রবন্ধটি নির্ভরযোগ্য তথ্যাবলির ভিত্তিতে রচিত এবং তা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্প্রতি ওষুধের কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধি জনমানসে ও সংবাদপত্র মহলে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য অনুধাবনযোগ্যই শুধু নয়, এর প্রতিকার, প্রতিবিধান, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ওই সভায় শরীর-স্বাস্থ্য, জীবন-মৃত্যুবিষয়ক যে আলোচনা ও শঙ্কার প্রকাশ ঘটেছে তাতে যুক্ত হয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা যায়, বিষাক্ত ও ভেজাল খাদ্য, যার দুষ্টপ্রভাব যেমন রয়েছে তাৎক্ষণিক, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী রূপে। বিষাক্ত লিচু খেয়ে সাম্প্রতিক শিশুমৃত্যুর ঘটনা (অনেকটা বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ গ্রহণ করে শিশুমৃত্যুর মতো) যেমন সত্য, তেমনি সত্য এর দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন আগেই সবাইকে হুঁশিয়ার করেছিলেন ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণে কিডনি বিকল হওয়া সম্পর্কে। সাম্প্রতিক তথ্যে কিডনি রোগের ব্যাপকতা ও বিকল কিডনিজনিত মৃত্যুর সংখ্যাধিক্য তাঁদের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত করেছে। তা ছাড়া দেহযন্ত্রে ক্যান্সার রোগের আশঙ্কাও বহুল আলোচিত বিষয়। দিনের পর দিন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে কিভাবে আম, কাঁঠাল, পেঁপে, লিচু, এমনকি তরমুজ বা আনারসের মতো সুস্বাদু ফলে কীটনাশক ব্যবহার করে, ফরমালিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে সেগুলো বিষাক্ত ও খাওয়ার অনুপযোগী করে তোলা হচ্ছে।
পূর্বোক্ত বিষাক্ত লিচু খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনাটি সপ্তাহ কয়েক আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মৌসুমের সেরা সুস্বাদু ফল আমে কীটনাশক ছিটানোর সচিত্র প্রতিবেদন তো আমের মৌসুমে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
স্বভাবতই স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত। অনেকে ফল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কলার মতো সারা বছর খাওয়ার উপযোগী ফলও আর আগ্রহের বিষয় নয়। যেমন নয় বিদেশাগত সুস্বাদু উপকারী ফল আপেল।
তাহলে খাবেন কী? সুস্বাদু ফলের তালিকা থেকে তো সবই বাদ পড়ে যাচ্ছে! কাজেই অনেকে ঝুঁকি নিয়েই এসব ফল খাচ্ছেন। খাচ্ছেন নিত্যকার ভেজালযুক্ত খাদ্য- হোক তা ভেজাল আটা বা মসলা কিংবা ফরমালিনযুক্ত দুধ। বাংলাদেশের কী উৎপাদক, কী ব্যবসায়ীকুল (জানি না ব্যতিক্রমীদের সংখ্যা কত) এমনই মূল্যবোধহীন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে যে তারা নিজ পরিবারের স্বাস্থ্যক্ষতি নিয়েও মাথা ঘামাতে নারাজ। মুনাফা একমাত্র লক্ষ্য তাদের। ভেজাল খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ, বিষাক্ত ফল বা শাকসবজির মুনাফা-বাণিজ্যে তারা এতটাই বেপরোয়া যে তাদের তুলনা বিরল। কবির ভাষায় বলতে হয়, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।'- অবশ্য বিপরীত অর্থে।
আমরা ভাবতে পারি না, কাগজ-কাগজে এত সচিত্র প্রতিবেদন ও কলামের পর কলাম লেখার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিভাবে নির্বিকার-নিষ্ক্রিয় থাকতে পারছে? তাদের পরিবারের সদস্যরা কি এসব বিষক্রিয়ার ঊর্ধ্বে! কেন বুঝতে পারছে না যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ টাকার জরিমানায় তাদের কিছুই যায়-আসে না। বরং ওই লোকসান পূরণ করতে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে সক্রিয় হয়ে উঠবে।
কাজেই আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ সরকারের প্রতি, কিছু একটা কার্যকর ব্যবস্থা নিন- যেমন যথার্থ ওষুধনীতির প্রয়োগে, তেমনি খাদ্যনীতির বাস্তবায়নে। ভেবে দেখুন, দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া কার্যকলাপে জনস্বাস্থ্য বিরাট হুমকির সম্মুখীন, যেমন তাৎক্ষণিকভাবে, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়ায়। কীটনাশক বড় মারাত্মক উপকরণ, দরকার আশু ব্যবস্থা গ্রহণ।
যখন ওষুধনীতি প্রণীত হয় তখনই আমরা লিখেছিলাম তাতে কার্যকর খাদ্যনীতি যুক্ত করার জন্য। এখন আবারও বলি, বলি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে, এখনই গঠন করুন নয়া খাদ্য ও ওষুধনীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক কাঠামো 'খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা'- 'ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি' সৎ, মেধাবী বিশেষজ্ঞের সাহায্যে। নীতি প্রণয়নে সাহায্য নিন নবীন-প্রবীণ মেধাবী বিশেষজ্ঞদের। নীতি বাস্তবায়নে সাহায্য করবে সৎ প্রশাসন। তবে শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যেমন চলবে না, তেমনি প্রশাসক নির্বাচনে নিরপেক্ষ না হলে চলবে না দলীয়-নির্দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব থেকে।
জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝবেন না; অথচ বিশেষ দায়িত্ব পালন করবেন, তা কেমন করে হয়? কোনো সময় আপনার একান্ত নিকটজনও তো বিষাক্ত খাদ্য- হতে পারে ফল বা ভেজাল ওষুধে অঘটনের শিকার। তাই সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন এবং জনগণের শুভেচ্ছা মাথায় তুলে নিন- মাত্র এটুকুই আমাদের দাবি। অনেকের লেখায় উঠে এসেছে একটি আদর্শ স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বপ্ন, পাল্টা কেউ লিখেছেন চিকিৎসাসেবার দুর্নীতি নিয়ে। পরে একসময় লিখব এ বিষয়ে। আপাতত নয়া ওষুধনীতি ও সাংগঠনিক কাঠামোই হোক।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments