শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র- এখনই গ্যাস তোলার উদ্যোগ নিতে হবে by মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন
১৩ জুলাই ২০১২ বাপেক্স কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে শ্রীকাইল ভূগঠনে অনুসন্ধান কূপ খনন করে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। নতুন যেকোনো কিছু প্রাপ্তি বা আবিষ্কারের পর সাধারণত পুরোনো ব্যর্থতার গ্লানি ধুয়ে-মুছে যায়। শ্রীকাইলে গ্যাস আবিষ্কারের পর তার ব্যতিক্রম ঘটল।
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের আনন্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, শ্রীকাইল ভূগঠনে ২০০৪ সালে খননকৃত প্রথম কূপে গ্যাস না পাওয়ার পেছনে বহুজাতিক চক্রান্তের ধূম্রজালের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এলেন অধ্যাপক বদরূল ইমাম (প্রথম আলো, ১৫.০৭.২০১২)।
সাফল্যের দাবিদার অনেককেই হতে দেখা গেলেও ব্যর্থতার দায়ভার সাধারণত কেউই নিতে চায় না। তারই ফলে বিশেষত কূপ খনন করার পর তেল বা গ্যাস কিছুই পাওয়া না গেলে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কাউকে চিহ্নিত করতে না পারার কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সম্ভাবনার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। ষাটের দশকে চট্টগ্রামের জলদীতে একে একে তিনটি কূপ খনন করার পর তেল বা গ্যাস যখন কিছুই পাওয়া গেল না, তখনকার মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী জানল, জলদীর তেল উত্তোলন করা হলে আসামের তেল উৎপাদন কমে যাবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে জলদীর কূপগুলো থেকে যাতে ভবিষ্যতেও কোনো দিন তেল-গ্যাস উৎপাদন করা না যায়, সে জন্য কূপগুলোকে একেবারে সীসা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমরা যদি জেনেই থাকি আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে ২০০৪ সালে শ্রীকাইলের প্রথম কূপটিকে অসফল কূপে পর্যবসিত করা হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় কূপ খননের ব্যবস্থা না করে, আট বছর পর ২০১২ সালে কেন দ্বিতীয় কূপ খনন করা হলো? আমরা কি তবে যুগের পর যুগ ধরে সব সরকারের (বিএনপি, আ.লীগ, তত্ত্বাবধায়ক) আমলেই নানা ধরনের চক্রান্তের পাকে নিমজ্জিত হয়েই থাকি? এটা কি তবে আমাদের জাতিগত অযোগ্যতা নয়?
প্রসঙ্গক্রমে শ্রীকাইলে প্রথম কূপ খননের ইতিহাস একটু উল্লেখ আবশ্যক। যেকোনো স্থানে কূপ খননের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা এবং খননের নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিতকরণের জন্য ন্যূনতম কার্যক্রম হিসেবে বিস্তারিত ২-ডি সাইসমিক জরিপ (সাধারণভাবে একটি সাইসমিক লাইন থেকে অন্যটির দূরত্ব আধা কিলোমিটার) একান্ত আবশ্যক। জুলাই ১৯৮৯-এ অভ্যুদয়ের পরই বাপেক্সেকে একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা দূরে থাক, রাজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্যই কোনো বরাদ্দ বা আয়ের কোনো উৎস ছিল না। একপর্যায়ে সৌদি উন্নয়ন তহবিলের একটি ঋণ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যৎসামান্য বরাদ্দ দিয়ে পুরো নব্বইয়ের দশকে অর্ধমৃত বাপেক্স পাথারিয়া ও শাহবাজপুরে অনুসন্ধান কূপ খনন করে এবং বেশ কিছু সাইসমিক জরিপ পরিচালনা করে। ১৯৯০-৯২ সালের দুটি জরিপ মৌসুমে কুমিল্লার লালমাই-কাশিমপুর-সালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় আঞ্চলিক (Regional) সাইসমিক জরিপ করা হয়।
উল্লিখিত সাইসমিক জরিপকালে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি সাইসমিক লাইনে লালমাই থেকে শ্রীকাইল পর্যন্ত জরিপ করা হয় এবং ওই লাইনের উত্তর অংশে শ্রীকাইল ভূগঠন চিহ্নিত করা হয়। অনুরূপভাবে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অপর একটি সাইসমিক লাইনে শ্রীকাইল থেকে সালদা নদী পর্যন্ত জরিপ করা হয়। ওই লাইনের পশ্চিমাংশে শ্রীকাইল ভূগঠন নিশ্চিত করা হয়। আঞ্চলিক জরিপ যেমন হয়ে থাকে, ১২-ফোল্ড সাইসমিক জরিপের উপাত্ত ছিল সাধারণ মানের।
ইতিপূর্বে পুরো দেশকে ২৩টি ব্লকে বিভক্ত করে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক তেল কোম্পানির নিকট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়। বাপেক্সের জন্য কোথাও কোন ব্লক বা ভূগঠন তখন বরাদ্দ রাখা ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার শরণাপন্ন হয়ে একটি ব্লক এবং কয়েকটি ভূগঠন বাপেক্সেকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আবেদন জানায়। উপদেষ্টা মহোদয়ের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে পেট্রোবাংলা তখন কেবল ৯ নম্বর ব্লকের শ্রীকাইল ভূগঠন বাপেক্সকে বরাদ্দ দেয়। ইতিমধ্যে শেভরন-তাল্লোকে ৯ নম্বর ব্লক বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং তারা ২০০২ সালে ৬০ ফোল্ড ২-ডি সাইসমিক জরিপ এবং বাঙ্গুরাসহ নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ৩-ডি সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম শুরু করে। তারা রসুলপুর, লালমাই ও বাঙ্গুরায় তিনটি কূপ খনন করে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাঙ্গুরাকে বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
কেবল দুটি সাধারণ মানের ১২-ফোল্ড ২-ডি সাইসমিক লাইনের ওপর ভিত্তি করে বাঙ্গুরা থেকে পাঁচ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত শ্রীকাইলে বাপেক্স ২৫ এপ্রিল ২০০৪ এ কূপ খনন কার্যক্রম শুরু করে। এত কম তথ্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হয় না। প্রবল বন্যা ও উচ্চচাপসংক্রান্ত জটিলতা মোকাবিলা করার পর ডিসেম্বর ২০০৪-এ বাপেক্স খনন সম্পন্ন করে শ্রীকাইলে গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল বাপেক্স যে স্তরে গ্যাস আবিষ্কারের দাবি করেছে, বাঙ্গুরায় ওই স্তরে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। আবার বাঙ্গুরায় যে স্তর থেকে উচ্চচাপে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে, শ্রীকাইলে খননকৃত কূপে এ স্তরটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শুরু তা-ই নয়, বাপেক্স যে স্তরে গ্যাস আবিষ্কারের দাবি করেছে, সে স্তরে গ্যাসের চাপ অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ ওই স্তরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস নেই।
উল্লেখ্য ৯ নম্বর ব্লকে বাপেক্স ১০ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে। ওই সুবাদে ২০০৫ সালের শেষদিকে তাল্লো বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধান ৯ নম্বর ব্লকে সংগৃহীত সাইসমিক উপাত্ত হস্তান্তরের জন্য বাপেক্সের দপ্তরে এলে, তাঁর সঙ্গে বাঙ্গুরায় গ্যাসপ্রাপ্তি এবং শ্রীকাইলে ব্যর্থতা নিয়ে এই লেখকের আলোচনা হয়। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, বাঙ্গুরায় খনন-রিগের ভূমি অবস্থান থেকে যদি উল্লম্বভাবে কূপ খনন করা হতো, তাহলে তাদের প্রথম কূপটিতেও কোন গ্যাস পাওয়া যেত না। কিন্তু ৩-ডি সাইসমিক ডেটার বিশদ পর্যালোচনা করে তারা দেখেছে যে বাঙ্গুরা ভূগঠনে যে স্তরে গ্যাস থাকার সম্ভাবনা বিদ্যমান, সে স্তরটির পশ্চিমাংশ প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত। গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য তারা কূপের ভূমির অবস্থান থেকে খনন লক্ষ্যমাত্রা আধা কিলোমিটারেরও বেশি উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। এটা খুবই সম্ভব যে বাঙ্গুরার মতো শ্রীকাইল ভূগঠনের পশ্চিমাংশ সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ভূগঠনের সর্বোচ্চ স্থানে খনন করতে গিয়ে বাপেক্স মূল গ্যাসস্তরটি স্পর্শ করতে পারেনি।
তবে এটা নিশ্চিত জানা গেল যে, সঠিক স্থানে কূপ খনন করা হলে শ্রীকাইলে বাণিজ্যিক গ্যাস পাওয়া যাবে, অবশ্য তা ধারণার চেয়ে বহুলাংশে কম হবে। ইতিমধ্যে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাল্লো বাংলাদেশ বাঙ্গুরা থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে। সাইসমিক উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে বাপেক্সের ওই সময়ের সিদ্ধান্ত ছিল কালবিলম্ব না করে শ্রীকাইল ভূগঠনে কূপ খনন এবং গ্যাস উৎপাদন শুরু করা আবশ্যক।
বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্র একটি ছোট গ্যাসক্ষেত্র, প্রমাণিত মজুদ মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। তাল্লো দীর্ঘদিন যাবৎ সেখান থেকে চারটি কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের (এমএমসিএফ) অধিক গ্যাস উত্তোলন করছে। অনেকের মতে, প্রমাণিত রিজার্ভের সঙ্গে বাঙ্গুরার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন সংগতিপূর্ণ নয়। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বর্তমানে উৎপাদন হ্রাস করে চাপ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাঙ্গুরার কূপ থেকে দৈনিক ৫০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলনকালে যে চাপ ছিল, শ্রীকাইলের কূপে একই চাপে তার অর্ধেক গ্যাস উৎপাদিত হবে বলে ধারণা করি। বর্তমানে বাঙ্গুরার যে কূপটি থেকে সর্বাধিক গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে, সেটি শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে।
শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র ক্ষুদ্রতর এবং গ্যাসস্তর মারাত্মকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত। শ্রীকাইলে মজুদ ১৫০ বিসিএফ বা আরও কম হওয়াই যুক্তিযুক্ত (কোনোভাবেই ৩০০ বিসিএফ হওয়া সম্ভব নয় যেমনটি পত্রপত্রিকায় উদ্ধৃত হয়েছে)। বাঙ্গুরা ও শ্রীকাইলের গ্যাসস্তর প্রায় একই সমতলে অবস্থিত। বাঙ্গুরা থেকে অধিক পরিমাণে গ্যাস উত্তোলনের প্রভাব শ্রীকাইলে কতখানি পড়তে পারে, সেটি বিবেচনা করে অতি দ্রুত শ্রীকাইলে দ্বিতীয় কূপ খনন করে শ্রীকাইল থেকে সর্বাধিক পরিমাণ গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। ইতিপূর্বের বিস্তারিত ২-ডি সাইসমিক জরিপ গ্যাসস্তরটিকে সুচারুরূপে চিহ্নিত করেছে। এমতাবস্থায় সেখানে বর্তমানে ৩-ডি সাইসমিক জরিপ পরিচালনা নিতান্ত কালক্ষেপণ ও অর্থের অপচয় বলে প্রতীয়মান।
মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন: সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স।
সাফল্যের দাবিদার অনেককেই হতে দেখা গেলেও ব্যর্থতার দায়ভার সাধারণত কেউই নিতে চায় না। তারই ফলে বিশেষত কূপ খনন করার পর তেল বা গ্যাস কিছুই পাওয়া না গেলে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কাউকে চিহ্নিত করতে না পারার কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সম্ভাবনার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। ষাটের দশকে চট্টগ্রামের জলদীতে একে একে তিনটি কূপ খনন করার পর তেল বা গ্যাস যখন কিছুই পাওয়া গেল না, তখনকার মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী জানল, জলদীর তেল উত্তোলন করা হলে আসামের তেল উৎপাদন কমে যাবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে জলদীর কূপগুলো থেকে যাতে ভবিষ্যতেও কোনো দিন তেল-গ্যাস উৎপাদন করা না যায়, সে জন্য কূপগুলোকে একেবারে সীসা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমরা যদি জেনেই থাকি আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে ২০০৪ সালে শ্রীকাইলের প্রথম কূপটিকে অসফল কূপে পর্যবসিত করা হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় কূপ খননের ব্যবস্থা না করে, আট বছর পর ২০১২ সালে কেন দ্বিতীয় কূপ খনন করা হলো? আমরা কি তবে যুগের পর যুগ ধরে সব সরকারের (বিএনপি, আ.লীগ, তত্ত্বাবধায়ক) আমলেই নানা ধরনের চক্রান্তের পাকে নিমজ্জিত হয়েই থাকি? এটা কি তবে আমাদের জাতিগত অযোগ্যতা নয়?
প্রসঙ্গক্রমে শ্রীকাইলে প্রথম কূপ খননের ইতিহাস একটু উল্লেখ আবশ্যক। যেকোনো স্থানে কূপ খননের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা এবং খননের নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিতকরণের জন্য ন্যূনতম কার্যক্রম হিসেবে বিস্তারিত ২-ডি সাইসমিক জরিপ (সাধারণভাবে একটি সাইসমিক লাইন থেকে অন্যটির দূরত্ব আধা কিলোমিটার) একান্ত আবশ্যক। জুলাই ১৯৮৯-এ অভ্যুদয়ের পরই বাপেক্সেকে একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা দূরে থাক, রাজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্যই কোনো বরাদ্দ বা আয়ের কোনো উৎস ছিল না। একপর্যায়ে সৌদি উন্নয়ন তহবিলের একটি ঋণ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যৎসামান্য বরাদ্দ দিয়ে পুরো নব্বইয়ের দশকে অর্ধমৃত বাপেক্স পাথারিয়া ও শাহবাজপুরে অনুসন্ধান কূপ খনন করে এবং বেশ কিছু সাইসমিক জরিপ পরিচালনা করে। ১৯৯০-৯২ সালের দুটি জরিপ মৌসুমে কুমিল্লার লালমাই-কাশিমপুর-সালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় আঞ্চলিক (Regional) সাইসমিক জরিপ করা হয়।
উল্লিখিত সাইসমিক জরিপকালে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি সাইসমিক লাইনে লালমাই থেকে শ্রীকাইল পর্যন্ত জরিপ করা হয় এবং ওই লাইনের উত্তর অংশে শ্রীকাইল ভূগঠন চিহ্নিত করা হয়। অনুরূপভাবে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অপর একটি সাইসমিক লাইনে শ্রীকাইল থেকে সালদা নদী পর্যন্ত জরিপ করা হয়। ওই লাইনের পশ্চিমাংশে শ্রীকাইল ভূগঠন নিশ্চিত করা হয়। আঞ্চলিক জরিপ যেমন হয়ে থাকে, ১২-ফোল্ড সাইসমিক জরিপের উপাত্ত ছিল সাধারণ মানের।
ইতিপূর্বে পুরো দেশকে ২৩টি ব্লকে বিভক্ত করে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক তেল কোম্পানির নিকট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়। বাপেক্সের জন্য কোথাও কোন ব্লক বা ভূগঠন তখন বরাদ্দ রাখা ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার শরণাপন্ন হয়ে একটি ব্লক এবং কয়েকটি ভূগঠন বাপেক্সেকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আবেদন জানায়। উপদেষ্টা মহোদয়ের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে পেট্রোবাংলা তখন কেবল ৯ নম্বর ব্লকের শ্রীকাইল ভূগঠন বাপেক্সকে বরাদ্দ দেয়। ইতিমধ্যে শেভরন-তাল্লোকে ৯ নম্বর ব্লক বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং তারা ২০০২ সালে ৬০ ফোল্ড ২-ডি সাইসমিক জরিপ এবং বাঙ্গুরাসহ নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ৩-ডি সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম শুরু করে। তারা রসুলপুর, লালমাই ও বাঙ্গুরায় তিনটি কূপ খনন করে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাঙ্গুরাকে বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
কেবল দুটি সাধারণ মানের ১২-ফোল্ড ২-ডি সাইসমিক লাইনের ওপর ভিত্তি করে বাঙ্গুরা থেকে পাঁচ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত শ্রীকাইলে বাপেক্স ২৫ এপ্রিল ২০০৪ এ কূপ খনন কার্যক্রম শুরু করে। এত কম তথ্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হয় না। প্রবল বন্যা ও উচ্চচাপসংক্রান্ত জটিলতা মোকাবিলা করার পর ডিসেম্বর ২০০৪-এ বাপেক্স খনন সম্পন্ন করে শ্রীকাইলে গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল বাপেক্স যে স্তরে গ্যাস আবিষ্কারের দাবি করেছে, বাঙ্গুরায় ওই স্তরে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। আবার বাঙ্গুরায় যে স্তর থেকে উচ্চচাপে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে, শ্রীকাইলে খননকৃত কূপে এ স্তরটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শুরু তা-ই নয়, বাপেক্স যে স্তরে গ্যাস আবিষ্কারের দাবি করেছে, সে স্তরে গ্যাসের চাপ অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ ওই স্তরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস নেই।
উল্লেখ্য ৯ নম্বর ব্লকে বাপেক্স ১০ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে। ওই সুবাদে ২০০৫ সালের শেষদিকে তাল্লো বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধান ৯ নম্বর ব্লকে সংগৃহীত সাইসমিক উপাত্ত হস্তান্তরের জন্য বাপেক্সের দপ্তরে এলে, তাঁর সঙ্গে বাঙ্গুরায় গ্যাসপ্রাপ্তি এবং শ্রীকাইলে ব্যর্থতা নিয়ে এই লেখকের আলোচনা হয়। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, বাঙ্গুরায় খনন-রিগের ভূমি অবস্থান থেকে যদি উল্লম্বভাবে কূপ খনন করা হতো, তাহলে তাদের প্রথম কূপটিতেও কোন গ্যাস পাওয়া যেত না। কিন্তু ৩-ডি সাইসমিক ডেটার বিশদ পর্যালোচনা করে তারা দেখেছে যে বাঙ্গুরা ভূগঠনে যে স্তরে গ্যাস থাকার সম্ভাবনা বিদ্যমান, সে স্তরটির পশ্চিমাংশ প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত। গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য তারা কূপের ভূমির অবস্থান থেকে খনন লক্ষ্যমাত্রা আধা কিলোমিটারেরও বেশি উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। এটা খুবই সম্ভব যে বাঙ্গুরার মতো শ্রীকাইল ভূগঠনের পশ্চিমাংশ সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ভূগঠনের সর্বোচ্চ স্থানে খনন করতে গিয়ে বাপেক্স মূল গ্যাসস্তরটি স্পর্শ করতে পারেনি।
তবে এটা নিশ্চিত জানা গেল যে, সঠিক স্থানে কূপ খনন করা হলে শ্রীকাইলে বাণিজ্যিক গ্যাস পাওয়া যাবে, অবশ্য তা ধারণার চেয়ে বহুলাংশে কম হবে। ইতিমধ্যে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাল্লো বাংলাদেশ বাঙ্গুরা থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে। সাইসমিক উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে বাপেক্সের ওই সময়ের সিদ্ধান্ত ছিল কালবিলম্ব না করে শ্রীকাইল ভূগঠনে কূপ খনন এবং গ্যাস উৎপাদন শুরু করা আবশ্যক।
বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্র একটি ছোট গ্যাসক্ষেত্র, প্রমাণিত মজুদ মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। তাল্লো দীর্ঘদিন যাবৎ সেখান থেকে চারটি কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের (এমএমসিএফ) অধিক গ্যাস উত্তোলন করছে। অনেকের মতে, প্রমাণিত রিজার্ভের সঙ্গে বাঙ্গুরার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন সংগতিপূর্ণ নয়। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বর্তমানে উৎপাদন হ্রাস করে চাপ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাঙ্গুরার কূপ থেকে দৈনিক ৫০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলনকালে যে চাপ ছিল, শ্রীকাইলের কূপে একই চাপে তার অর্ধেক গ্যাস উৎপাদিত হবে বলে ধারণা করি। বর্তমানে বাঙ্গুরার যে কূপটি থেকে সর্বাধিক গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে, সেটি শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে।
শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র ক্ষুদ্রতর এবং গ্যাসস্তর মারাত্মকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত। শ্রীকাইলে মজুদ ১৫০ বিসিএফ বা আরও কম হওয়াই যুক্তিযুক্ত (কোনোভাবেই ৩০০ বিসিএফ হওয়া সম্ভব নয় যেমনটি পত্রপত্রিকায় উদ্ধৃত হয়েছে)। বাঙ্গুরা ও শ্রীকাইলের গ্যাসস্তর প্রায় একই সমতলে অবস্থিত। বাঙ্গুরা থেকে অধিক পরিমাণে গ্যাস উত্তোলনের প্রভাব শ্রীকাইলে কতখানি পড়তে পারে, সেটি বিবেচনা করে অতি দ্রুত শ্রীকাইলে দ্বিতীয় কূপ খনন করে শ্রীকাইল থেকে সর্বাধিক পরিমাণ গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। ইতিপূর্বের বিস্তারিত ২-ডি সাইসমিক জরিপ গ্যাসস্তরটিকে সুচারুরূপে চিহ্নিত করেছে। এমতাবস্থায় সেখানে বর্তমানে ৩-ডি সাইসমিক জরিপ পরিচালনা নিতান্ত কালক্ষেপণ ও অর্থের অপচয় বলে প্রতীয়মান।
মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন: সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স।
No comments