নারী ক্ষমতায়ন ও শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য by স্বদেশ রায়

জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার এ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হলো। এই সেমিনারউত্তর ইফতার ও ডিনার দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ডিনার শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক জনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, আপনারা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজ দেখতে পান না। কিন্তু বিদেশীরা তো অনেক কিছুই বলে গেলেন।


ডা. দীপু মনির কথাটা অনেক সঠিক। ভালো কাজ আমরা খুব কম দেখি। আমরা খারাপটাই দেখি। ভালো কিছু, উন্নয়নের কিছু যে এখনও সংবাদ এমনটি আমরা ভাবি না। তাছাড়া মার্শাল ম্যাকলুহানের সেই সেরা লাইনটিও কাজ করে। কী দেখছি সেটা বড় নয়, কিভাবে দেখছি সেটাই বড়। আসলে আমরা দেখি নেগেটিভ চোখে। যেমন ওই ডিনারে অনেক আলাপ হলো ভারতে নিযুক্ত নামিবিয়ার কাউন্সিলর রিচার্ড ফ্রেজের সঙ্গে। রিচার্ড তাঁর ছাত্র জীবনে তিন বছর ল পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষ অবধি আইন পড়তে ভাল লাগেনি। তিনি পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়েন। রাজনীতি তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট। রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেও তিনি বেশ ভাল বাসেন।
রিচার্ড বাংলাদেশে আসেন তিন দিনের জন্য। তাঁর কথায়, বাস্তবে দেশটির তেমন কিছুই তিনি দেখার সুযোগ পেলেন না। সেমিনারে সেমিনারে তাঁর সময় কেটে গেল। তার ওপর অনেক বেশি ট্রাফিক রাস্তাতে। তিনি জানতে চান আসলে কী সব সময়ে এমন ট্রাফিক থাকে। রিচার্ডকে বলি, রাস্তায় যে আমাদের ট্রাফিক কম সেটা বললে ভুল হবে। তবে তুমি এখন যে সময়টিতে এসেছেন এটা রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়। আর মাত্র ১৫ দিন পরেই ঈদ-উল-ফিতর। এ দেশের মেজরিটি অর্থাৎ নব্বই ভাগ লোকের সব থেকে বড় উৎসব। তাই অধিকাংশ মানুষ এখন এই উৎসবে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও প্রিয়জনের জন্য গিফট কিনতে শপিং মল থেকে শপিং মলে ঘুরছে। যে কারণে রাস্তায় এত ট্রাফিক। তাছাড়া ঢাকায় প্রায় বিশ মিলিয়নের কাছাকাছি মানুষ বাস করে। অন্যদিকে এই রমজান মাসে গ্রাম থেকে কমপক্ষে এক থেকে দেড় মিলিয়ন মানুষ বাড়তি রোজগারের জন্য ঢাকায় এসেছে। এ কারণে রাস্তায় ট্রাফিক বেশি। তোমাকে বেশি সময় আটকে থাকতে হয়েছে।
রিচার্ড বললেন, তোমাদের এই ট্রাফিক ঝামেলা কমানোর জন্য সরকার মনে হয় বেশ কাজ করছে। কারণ, দেখলাম নানান জায়গায় ওভার পাস, ফ্লাই ওভার তৈরি হচ্ছে। এটা অবশ্য তোমাদের জন্য খুব উপকারী হবে। কারণ, বাস্তবে তো তোমাদের শহরে লোকের ঘনত্ব দিল্লীর থেকেও বেশি। এ অবস্থায় তোমাদের এগুলো না করে তো কোন উপায় নেই। অনেক কাজ হচ্ছে তোমাদের। এখানেই মনে হয় রিচার্ডের দেখার সঙ্গে আমাদের দেখার পার্থক্য। আমরা সব সময়ই গালমন্দ করি। রাস্তার যানজট না কমাতে পারার জন্য সরকারের মু-ুপাত করি। কিন্তু ওইভাবে কখনও দেখি না দিল্লী শহরের থেকেও জনঘনত্বপূর্ণ অথচ দিল্লীর থেকে এই ছোট শহরের যানজট কমানো খুব সহজ বিষয় নয়। তারপরেও সরকার যেগুলো করছে তার সুফল খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে। অতএব কোন একটা ভালর জন্য তো কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। এবং ভাল কিছু আসছে এ জন্য রিচার্ডের মতো খুশি মনে সেটাকে গ্রহণ করতে হবে।
এর পরে রিচার্ড নিজের থেকে নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি তুললেন। তিনি বললেন, তোমাদের দেশের নারী ক্ষমতায়ন সত্যিই প্রশংসনীয়। কারণ, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সকলেই নারী। আমি একটু হেসে বলি তোমার সোজাসুজি ওই টেবিলে যিনি বসে আছেন উনি আমাদের কৃষি মন্ত্রী। পঞ্চান্ন বছরের ওপরে তাঁর রাজনৈতিক জীবন। কত বার জেলে গেছেন, পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেগুলো রেফারেন্স শাখার সাহায্য ছাড়া তোমাকে সঠিক বলতে পারব না। আর এই প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শ্রমপ্রতিমন্ত্রীÑ এঁরা কেউই কিন্তু নারী হিসেবে আজকের এই অবস্থানে আসেননি। যোগ্যতার বলে এসেছেন। তবে এঁরা প্রত্যেকেই নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই কিন্তু এর আগেরবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সামরিক বাহিনীতে নারীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। তুমি হয়ত লক্ষ্য করবে তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য নারী এবং তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে এ কথাও বলেছেন, তিনি দেশের সেনাপ্রধান হিসেবে একজন নারীকে দেখতে চান এবং যেদিন সেটা দেখতে পাবেন তিনিই সব থেকে খুশি হবেন।
রিচার্ড বললেন, তার মানে তোমাদের সরকার ভিতর থেকেই বা নীতিগতভাবে নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করছে। রিচার্ডের আগ্রহ দেখে বুঝতে পারি, পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে তাঁর বিষয়টি খুব ভাল লাগছে। সে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। ঠিক ওই পরিবেশ ও সময় না থাকায় সংক্ষেপে তাকে বলি, দেখ কয়েকটি বিষয় তুমি যদি বাংলাদেশের তথ্য উপাত্ত নেও, তুমি দেখতে পাবে আমাদের দেশের সরকারের নীতি ও সমাজের কাঠামো নারী ক্ষমতায়নে কতটা সাহায্য করছে। যেমন বর্তমানের এই উদার গণতান্ত্রিক সরকার বা বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী প্রথম ক্ষমতায় আসার পরে এ দেশের লোকাল গবর্নমেন্টের সর্বনিম্ন পর্যায়ে অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিলে নারী আসনের জন্য নারীদের নির্বাচিত হবার বিধান করেন, যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নারীদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে ক্ষমতাবান করছে। বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম বড় এক মাইলফলক এটি। হয়ত এর প্রচার নেই বলে বিদেশীরা জানেন না। তাছাড়া স্থানীয় সরকারের এই নারী সদস্যদের প্রথম প্রথম কিছু অসুবিধা হয়েছিল সেগুলো আমাদের মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই নারীরা যে কত সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্য হয়েছেন, তাঁরা সমাজে কতটা ক্ষমতাবান সে বিষয়ে আর কোন প্রচার হয়নি। অবশ্য রিচার্ডকে বলেনি, তবে মনে হয়েছিল এই বিষয়টি সাধারণের সামনে তুলে আনা, বহির্বিশ্বে প্রচার করার দায়িত্ব সরকারের প্রচার বিভাগের। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো বর্তমান সরকারের কোন প্রচার বিভাগ নেই। এই সরকারের বা প্রধানমন্ত্রীর কোন সাফল্য প্রচার বিভাগ আজও অবধি প্রচার করতে পারেনি। নইলে নারী ক্ষমতায়নের তার এত বড় পদক্ষেপ কেন দিল্লীতে বসেও একজন ডিপ্লোম্যাট জানবেন না? এর পরে রিচার্ডের দেশের মিডিয়া নিয়ে কিছু কথা হবার পরেই সে আবার নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি টেনে আনে। তখন তাকে বলি, দেখ তুমি যদি আমাদের স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোর পরীক্ষার রেজাল্টের তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ কর, তুমি দেখবে কিভাবে সেখানে মেয়েরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখছে, যা কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নেই। রিচার্ড হেসে বলল, আমার নামিবিয়াতেও নেই।
রিচার্ডদের সঙ্গে কথা বলার পরে মনে হলো, আসলে আমরা সকলেই তো একটা গোলক ধাঁধার ভিতর আছি। আমাদের সামনে এবং বিদেশে সব সময়ই প্রচার হচ্ছে বাংলাদেশের কয়েকটি এনজিওই এ দেশের নারীর ক্ষমতায়ন করছে। আর সেই প্রচারে আমরাও বিশ্বাস করছি। আমরাও তাদেরকেই মূল সার্টিফিকেটটি ইতোমধ্যে দিয়ে বসে আছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়ন সব থেকে বেশি হয়েছে শেখ হাসিনার দুই টার্মের এই ক্ষমতার কালে। আমার এক বন্ধু অনেক সময় বর্তমান সরকারকে নারী স্থান বলে ঠাট্টা করে। কিন্তু রিচার্ডের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার পরে নিজেও ভেবে দেখেছি। বাস্তবে বিনা বেতনে নারী শিক্ষার সুযোগ দিয়ে শেখ হাসিনা যেভাবে এ দেশে নারীকে শিক্ষিত করে নারী ক্ষমতায়ন করেছেন এর বিপরীতে নারীকে একটি মুরগি কেনার ঋণ দিয়ে তো প্রকৃত নারী ক্ষমতায়ন করা যায় না। আজ কোটি কোটি নারীকে শিক্ষিত করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নে যে অবদান রেখেছেন তার বিপরীতে নারীকে দিয়ে ছাগল, গরু, হাঁস, মুরগি পালনের কাজ করিয়ে কতটা নারী ক্ষমতায়ন করা সম্ভব? কিন্তু যারা এই গরু, ছাগল কেনার ঋণ দিচ্ছেন, তার বদলে চড়া সুদ নিচ্ছেন তাদের কথা দেশ বিদেশে প্রচার হয় আর শেখ হাসিনার এই অবদান দেশের মানুষের সামনে ওইভাবে তুলে ধরা হয় না। বর্তমানের এই তথ্য ও মিডিয়ার যুগে একটি সরকারের দক্ষ ও যোগ্য মিডিয়াম্যান না থাকলে কী হয় তার প্রমাণ এর থেকে আর বড় কী হতে পারে?
এখান থেকে কয়েক বছর আগে ঢাকায় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের একটি সম্মেলন হয়েছিল। ওই সম্মেলনে কথা হয়েছিল কয়েক নারী ইউপি সদস্যের সঙ্গে। বেশ খোলাখুলিভাবে তারা বলেছিলেন, ভাই প্রথম প্রথম মেম্বার হয়ে একটু ভয় ভয় করত। এখন কিন্তু কোন অসুবিধা হয় না। বরং সারা দিন অনেক কাজ করি। কত লোকের যে সালিশ মধ্যস্থতা করি তার শেষ নেই। একজন তো বললেন, আমার এলাকায় আমি সাধারণত কাউকে থানা পুলিশ বা কোর্ট কাছারি করতে দেই না। সেখানে গেলে বাড়তি খরচ। বরং সবই আমি সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে দেই। আর মেয়েদের বিষয় আমি অন্যভাবে দেখি। কারণ, নিজে তো মেয়ে। বুঝি তো আমাদের সমাজে মেয়েদের অসুবিধা কোথায়? তাই সেগুলো বিশেষভাবে সমাধান করি।
বাস্তবে এমনি একজন নয়, হাজার হাজার নারী ইউপি সদস্য সারাদেশে কাজ করছেন। কাজ করছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানরা। তাছাড়া নানান ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারে নারীদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সব মিলে শেখ হাসিনার দুই টার্মের সরকারে নারীদের জন্য কী কী করা হয়েছে সেটা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পৃথিবীর অনেক দেশের থেকে অনেক বেশি করা হয়েছে। অথচ দুর্ভাগ্য হলো প্রচারের অভাবে এই শেখ হাসিনার সরকারের কাছে উদ্বেগের চিঠি আসে যে, তার সরকার যেন নারী ক্ষমতায়নে বাধা না দেয়। সরকার কি যোগ্য লোকের হাতে দায়িত্ব দিয়ে তার এ দুর্ভাগ্যের পরিসমাপ্তি ঘটাবে না?

swadeshroy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.