মিডিয়া ভাবনা- হুমায়ূন আহমেদের প্রতি মিডিয়ার শ্রদ্ধাঞ্জলি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু উপলক্ষে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া মোটামুটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। নিউইয়র্ক থেকে মরদেহ আনতে দেরি হওয়ার সুযোগটি মিডিয়া কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়েছে। মাঝেমধ্যে দেশে এমন এক-একটি বড় ঘটনা ঘটে, যখন মিডিয়া নানা দিক থেকে বিষয়টি তুলে ধরার সুযোগ পায়।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সে রকমই একটি বড় ঘটনা ছিল।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নানা এক্সক্লুসিভ খবর থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার প্রকাশ ও প্রচার করেছে। পাঠক বা দর্শকেরা আগে যে সাক্ষাৎকার মনোযোগ দিয়ে শোনেননি বা পড়েননি, তা আবার নতুন করে পড়েছেন বা দেখেছেন। এসব সাক্ষাৎকারে নতুন এবং প্রায় অজানা অনেক তথ্য যেমন উঠে এসেছে, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের জীবনদর্শনও তাতে জানা গেছে।
মিডিয়ায় যারা ঘন ঘন সাক্ষাৎকার দেন, হুমায়ূন আহমেদ সে রকম লোক ছিলেন না। তিনি বরং ছিলেন প্রচারবিমুখ ও লাজুক প্রকৃতির। মাঝেমধ্যে তাঁর জন্মদিনে হয়তো মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেখা যায়, সব টিভি চ্যানেলে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে। এসব টিভি সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে গত মে মাসে, যখন তিনি ২০ দিনের জন্য দেশে এসেছিলেন তখন। যাঁরা হুমায়ূন আহমেদকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁরা জানেন, তিনি এই প্রকৃতির লোক নন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর সর্বশেষ বাংলাদেশে সফরের সময় মিডিয়ার ব্যাপারে বেশ উদার ছিলেন। মনে হয়েছে, তাঁর মনে বহু কথা ছিল যা তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানাতে চান। কথাবার্তা শুনে এমনও মনে হয়েছে, তাঁর মনের গহিন কোণে এমন একটি অনুভূতি কাজ করেছে যে তিনি হয়তো এসব কথা বলার আর সময় পাবেন না। যদিও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বার বার বলেছেন, ‘আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসব। আবার লিখব। আবার ছবি বানাব।’ তিনি তা বলেছেন বটে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন।
লক্ষ করার বিষয়, গত মে-জুন মাসে সর্বশেষ দেশে আসার পর তিনি বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে। বিমানবন্দর থেকে সোজা নুহাশপল্লী। এবং মিডিয়ায় যত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সবই নুহাশপল্লীতে। কোনো প্রথাবদ্ধ আনুষ্ঠানিক টিভি সাক্ষাৎকার নয়। নুহাশপল্লীর বাগানে, পুকুর ঘাটে এবং নানা জায়গায় কখনো বসে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে এসব সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন। একজন মিডিয়া-কর্মী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, তিনি তাঁর নন্দিত দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে টিভি মিডিয়ায় যত কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলেছেন গত মে-জুন মাসে। এই ২০ দিনের যে টিভি ফুটেজ তা এক স্মরণীয় সংগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁরা রীতিমতো কষ্ট করে গাজীপুরে নুহাশপল্লীতে গিয়ে এসব সাক্ষাৎকার ধারণ করেছেন। সাংবাদিকেরাও কি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরা এই নন্দিত সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আর না-ও পেতে পারেন? অনেক সময় মানুষের এ রকম মনে হয়। বিশেষ করে মরণব্যাধিতে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে।
এসব সাক্ষাৎকারে মৃত্যু সম্পর্কেও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নানা ধারণা বা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এই কথাগুলো এত তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ নেবে তা কেউ তখন ভাবতেও পারেননি।
নুহাশপল্লীতে ছাড়াও নিউইয়র্ক যাওয়ার দিন তিনি বিমানবন্দরেও মিডিয়ার সামনে কিছু কথা বলেছেন। সেই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তিনি বলেছেন: ‘আমি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসব। আবার লিখব। আবার ছবি বানাব।’ ইত্যাদি। তাঁর এসব উক্তি এখন তাঁর স্বজন, বন্ধু, আত্মীয় ও পাঠকদের বেদনার্ত করে তুলেছে।
হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি সাম্প্রতিক লেখা, একটি বইয়ের (বাদশাহ নামদার) উৎসর্গপত্র ও বাংলাদেশে তাঁর শেষ ২০ দিনের অবস্থানকালীন নানা সাক্ষাৎকারের বক্তব্যে অনেকেরই মনে হতে পারে তিনি তাঁর মৃত্যুর ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছিলেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর থেকে দাফনের খবর পর্যন্ত যে পশাদারি কভারেজ দিয়েছে তা খুবই প্রশংসাযোগ্য। এত বৈচিত্র্যময় লেখা, বিশেষ করে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণা, চকিত মূল্যায়ন, টুকরো কথা, অসংখ্য ছবি সেই কয়েক দিনের দৈনিক সংবাদপত্রকে হুমায়ূন অনুরাগীদের কাছে মহামূল্যবান করে তুলেছিল। নিছক দৈনিক সংবাদপত্র নয়, এ যে এক মূল্যবান সংকলন। যার অনেক লেখা বার বার পড়তে হয়েছে। অনেক লেখা পড়তে পড়তে চোখ মুছতে হয়েছে। অনেক মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথা ছাপা হয়েছে এই কদিনে। হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা যদি এসব স্মৃতিকথা না লিখতেন, তাহলে তাঁর পাঠক ও অনুরাগীরা বহু অজানা কথা থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। কারণ, অন্তর্মুখী হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর আনন্দ ও কষ্টের নানা উপলক্ষ, তাঁর মজা করার নানা ভঙ্গি, তাঁর মানবিকতা, বন্ধুদের জন্য তাঁর ভালোবাসার গভীরতা, তাঁর প্রতিদিনের সান্ধ্য আড্ডা, ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ঘনিষ্ঠজনদের নানা স্মৃতিকথায়।
আমার ধারণা, হুমায়ূন আহমেদের বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের এগুলো মাত্র খণ্ডাংশ। সংবাদপত্রের ও টিভি অনুষ্ঠানের সীমিত কলেবরে স্মৃতিচারণার খুব সামান্যই প্রকাশিত হয়েছে। হয়তো উদ্যোগী সম্পাদক ও প্রকাশকেরা নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের বৈচিত্র্যময় দিক ও বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রকাশ করবেন।
গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের খুব সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নও হয়েছে। বলাবাহুল্য, এখন মূল্যায়নের সময় নয়। এখন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের সময়। যখন প্রকৃত সময় হবে, তখন হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চয় হবে।
গত কয়েক দিন হুমায়ূন স্মরণে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠানও বেশ প্রশংসাযোগ্য। শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন বা স্মৃতিচারণার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান সীমিত ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকে মুখ্য করে নানা ধরনের সুপরিকল্পিত সংগীতানুষ্ঠান বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। এই কয়েক দিন পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক, বুয়েটের সংকট, মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ কিংবা মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশবিষয়ক শুনানি সংক্রান্ত কোনো খবর বা আলোচনাই বেশির ভাগ দর্শককে তেমন টানেনি। টিভিতে এসব খবর বা টক শো অনেকটা পানসেই ঠেকেছে। মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ নিয়ে বহু আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারত, কিন্তু সংগত কারণেই তা হয়নি। এখন আবার নতুন করে এই আলোচনা শুরু হতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতা ও মৃত্যুতে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক, ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভির নিউইয়র্ক প্রতিনিধিরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা খবর ও ছবি পাঠিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন তাও প্রশংসাযোগ্য। ঢাকার কয়েকটি টিভি চ্যানেল নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম জানাজা ঢাকার সময় গভীর রাতে লাইভ প্রচার করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে নিউইয়র্ক ও ঢাকার ঘটনার প্রতি মুহূর্তের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দর্শকেরা জানতে পেরেছেন। একটি মুহূর্তও কোথাও অপচয় হয়নি।
স্বাধীনতা-পূর্বকালেও কয়েকটি বড় ঘটনার সময় গণমাধ্যম অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যখন টিভি ছিল না (বা স্বাধীন টিভি চ্যানেল ছিল না) তখন কয়েকটি সংবাদপত্র এই ভূমিকা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে। ১৯৬৮-৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ও প্রথম সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ১-২৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন কিংবা নব্বইয়ের গণআন্দোলনের খবর, বিশ্লেষণ ও আলোকচিত্র প্রকাশে সেকালের সংবাদপত্র যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে তাঁর লাখ লাখ পাঠক ও অনুরাগীদের অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলও প্রায় সে রকম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এ জন্য সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক, টিভি অনুষ্ঠান প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান, লেখক, শিল্পী, কথক সবার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অনেক রক্ষণশীল পাঠক বা দর্শকের কাছে এত টিভি অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তাঁদের বক্তব্যের পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাঙালি (বাংলাদেশি) আবেগময় জাতি। তাদের আবেগ ও ভালোবাসা কোনো সীমা মানে না। সে জন্য সচেতনভাবেও সীমা অতিক্রম করা কিছু কাজ হয়ে যায়। এই সাংবাদিকতাকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
তবে গণমাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের মৃত মুখের ছবি প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। কোনো মৃত মুখের ছবি গণমাধ্যমে প্রচার করা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সাংবদিকদের সচেতন হওয়া উচিত ছিল। সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর তার শোকাকুল মায়ের কাছে ‘প্রতিক্রিয়া’ জানতে চাওয়াও ‘ঠিক সাংবাদিকতা’ নয়। যখন হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দাফন নিয়ে পারিবারিকভাবে বিতর্ক চলছে, তখন একটি টিভি চ্যানেল ‘এক্সক্লুসিভ’ হওয়ার লোভে গভীর রাতে স্ত্রীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে। এগুলো এক ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা।
এ রকম দু-একটি দুর্বলতা ছাড়া আমাদের গণমাধ্যম নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর যে কভারেজ দিয়েছে তা এক কথায় তুলনাহীন। পত্রিকাগুলোর এসব ইস্যু ও বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানের সিডি অনেকের কাছে সংগ্রহযোগ্য হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রে নানা লেখালেখি ও অসংখ্য টিভি অনুষ্ঠানে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞ জাতির অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখ এটুকুই, মানুষ তাঁকে কত ভালোবাসে তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নানা এক্সক্লুসিভ খবর থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার প্রকাশ ও প্রচার করেছে। পাঠক বা দর্শকেরা আগে যে সাক্ষাৎকার মনোযোগ দিয়ে শোনেননি বা পড়েননি, তা আবার নতুন করে পড়েছেন বা দেখেছেন। এসব সাক্ষাৎকারে নতুন এবং প্রায় অজানা অনেক তথ্য যেমন উঠে এসেছে, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের জীবনদর্শনও তাতে জানা গেছে।
মিডিয়ায় যারা ঘন ঘন সাক্ষাৎকার দেন, হুমায়ূন আহমেদ সে রকম লোক ছিলেন না। তিনি বরং ছিলেন প্রচারবিমুখ ও লাজুক প্রকৃতির। মাঝেমধ্যে তাঁর জন্মদিনে হয়তো মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেখা যায়, সব টিভি চ্যানেলে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে। এসব টিভি সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে গত মে মাসে, যখন তিনি ২০ দিনের জন্য দেশে এসেছিলেন তখন। যাঁরা হুমায়ূন আহমেদকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁরা জানেন, তিনি এই প্রকৃতির লোক নন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর সর্বশেষ বাংলাদেশে সফরের সময় মিডিয়ার ব্যাপারে বেশ উদার ছিলেন। মনে হয়েছে, তাঁর মনে বহু কথা ছিল যা তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানাতে চান। কথাবার্তা শুনে এমনও মনে হয়েছে, তাঁর মনের গহিন কোণে এমন একটি অনুভূতি কাজ করেছে যে তিনি হয়তো এসব কথা বলার আর সময় পাবেন না। যদিও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বার বার বলেছেন, ‘আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসব। আবার লিখব। আবার ছবি বানাব।’ তিনি তা বলেছেন বটে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন।
লক্ষ করার বিষয়, গত মে-জুন মাসে সর্বশেষ দেশে আসার পর তিনি বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে। বিমানবন্দর থেকে সোজা নুহাশপল্লী। এবং মিডিয়ায় যত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সবই নুহাশপল্লীতে। কোনো প্রথাবদ্ধ আনুষ্ঠানিক টিভি সাক্ষাৎকার নয়। নুহাশপল্লীর বাগানে, পুকুর ঘাটে এবং নানা জায়গায় কখনো বসে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে এসব সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন। একজন মিডিয়া-কর্মী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, তিনি তাঁর নন্দিত দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে টিভি মিডিয়ায় যত কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলেছেন গত মে-জুন মাসে। এই ২০ দিনের যে টিভি ফুটেজ তা এক স্মরণীয় সংগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁরা রীতিমতো কষ্ট করে গাজীপুরে নুহাশপল্লীতে গিয়ে এসব সাক্ষাৎকার ধারণ করেছেন। সাংবাদিকেরাও কি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরা এই নন্দিত সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আর না-ও পেতে পারেন? অনেক সময় মানুষের এ রকম মনে হয়। বিশেষ করে মরণব্যাধিতে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে।
এসব সাক্ষাৎকারে মৃত্যু সম্পর্কেও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নানা ধারণা বা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এই কথাগুলো এত তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ নেবে তা কেউ তখন ভাবতেও পারেননি।
নুহাশপল্লীতে ছাড়াও নিউইয়র্ক যাওয়ার দিন তিনি বিমানবন্দরেও মিডিয়ার সামনে কিছু কথা বলেছেন। সেই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তিনি বলেছেন: ‘আমি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসব। আবার লিখব। আবার ছবি বানাব।’ ইত্যাদি। তাঁর এসব উক্তি এখন তাঁর স্বজন, বন্ধু, আত্মীয় ও পাঠকদের বেদনার্ত করে তুলেছে।
হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি সাম্প্রতিক লেখা, একটি বইয়ের (বাদশাহ নামদার) উৎসর্গপত্র ও বাংলাদেশে তাঁর শেষ ২০ দিনের অবস্থানকালীন নানা সাক্ষাৎকারের বক্তব্যে অনেকেরই মনে হতে পারে তিনি তাঁর মৃত্যুর ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছিলেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর থেকে দাফনের খবর পর্যন্ত যে পশাদারি কভারেজ দিয়েছে তা খুবই প্রশংসাযোগ্য। এত বৈচিত্র্যময় লেখা, বিশেষ করে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণা, চকিত মূল্যায়ন, টুকরো কথা, অসংখ্য ছবি সেই কয়েক দিনের দৈনিক সংবাদপত্রকে হুমায়ূন অনুরাগীদের কাছে মহামূল্যবান করে তুলেছিল। নিছক দৈনিক সংবাদপত্র নয়, এ যে এক মূল্যবান সংকলন। যার অনেক লেখা বার বার পড়তে হয়েছে। অনেক লেখা পড়তে পড়তে চোখ মুছতে হয়েছে। অনেক মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথা ছাপা হয়েছে এই কদিনে। হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা যদি এসব স্মৃতিকথা না লিখতেন, তাহলে তাঁর পাঠক ও অনুরাগীরা বহু অজানা কথা থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। কারণ, অন্তর্মুখী হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর আনন্দ ও কষ্টের নানা উপলক্ষ, তাঁর মজা করার নানা ভঙ্গি, তাঁর মানবিকতা, বন্ধুদের জন্য তাঁর ভালোবাসার গভীরতা, তাঁর প্রতিদিনের সান্ধ্য আড্ডা, ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ঘনিষ্ঠজনদের নানা স্মৃতিকথায়।
আমার ধারণা, হুমায়ূন আহমেদের বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের এগুলো মাত্র খণ্ডাংশ। সংবাদপত্রের ও টিভি অনুষ্ঠানের সীমিত কলেবরে স্মৃতিচারণার খুব সামান্যই প্রকাশিত হয়েছে। হয়তো উদ্যোগী সম্পাদক ও প্রকাশকেরা নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের বৈচিত্র্যময় দিক ও বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রকাশ করবেন।
গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের খুব সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নও হয়েছে। বলাবাহুল্য, এখন মূল্যায়নের সময় নয়। এখন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের সময়। যখন প্রকৃত সময় হবে, তখন হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চয় হবে।
গত কয়েক দিন হুমায়ূন স্মরণে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠানও বেশ প্রশংসাযোগ্য। শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন বা স্মৃতিচারণার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান সীমিত ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকে মুখ্য করে নানা ধরনের সুপরিকল্পিত সংগীতানুষ্ঠান বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। এই কয়েক দিন পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক, বুয়েটের সংকট, মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ কিংবা মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশবিষয়ক শুনানি সংক্রান্ত কোনো খবর বা আলোচনাই বেশির ভাগ দর্শককে তেমন টানেনি। টিভিতে এসব খবর বা টক শো অনেকটা পানসেই ঠেকেছে। মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ নিয়ে বহু আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারত, কিন্তু সংগত কারণেই তা হয়নি। এখন আবার নতুন করে এই আলোচনা শুরু হতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতা ও মৃত্যুতে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক, ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভির নিউইয়র্ক প্রতিনিধিরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা খবর ও ছবি পাঠিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন তাও প্রশংসাযোগ্য। ঢাকার কয়েকটি টিভি চ্যানেল নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম জানাজা ঢাকার সময় গভীর রাতে লাইভ প্রচার করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে নিউইয়র্ক ও ঢাকার ঘটনার প্রতি মুহূর্তের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দর্শকেরা জানতে পেরেছেন। একটি মুহূর্তও কোথাও অপচয় হয়নি।
স্বাধীনতা-পূর্বকালেও কয়েকটি বড় ঘটনার সময় গণমাধ্যম অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যখন টিভি ছিল না (বা স্বাধীন টিভি চ্যানেল ছিল না) তখন কয়েকটি সংবাদপত্র এই ভূমিকা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে। ১৯৬৮-৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ও প্রথম সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ১-২৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন কিংবা নব্বইয়ের গণআন্দোলনের খবর, বিশ্লেষণ ও আলোকচিত্র প্রকাশে সেকালের সংবাদপত্র যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে তাঁর লাখ লাখ পাঠক ও অনুরাগীদের অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলও প্রায় সে রকম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এ জন্য সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক, টিভি অনুষ্ঠান প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান, লেখক, শিল্পী, কথক সবার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অনেক রক্ষণশীল পাঠক বা দর্শকের কাছে এত টিভি অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তাঁদের বক্তব্যের পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাঙালি (বাংলাদেশি) আবেগময় জাতি। তাদের আবেগ ও ভালোবাসা কোনো সীমা মানে না। সে জন্য সচেতনভাবেও সীমা অতিক্রম করা কিছু কাজ হয়ে যায়। এই সাংবাদিকতাকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
তবে গণমাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের মৃত মুখের ছবি প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। কোনো মৃত মুখের ছবি গণমাধ্যমে প্রচার করা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সাংবদিকদের সচেতন হওয়া উচিত ছিল। সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর তার শোকাকুল মায়ের কাছে ‘প্রতিক্রিয়া’ জানতে চাওয়াও ‘ঠিক সাংবাদিকতা’ নয়। যখন হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দাফন নিয়ে পারিবারিকভাবে বিতর্ক চলছে, তখন একটি টিভি চ্যানেল ‘এক্সক্লুসিভ’ হওয়ার লোভে গভীর রাতে স্ত্রীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে। এগুলো এক ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা।
এ রকম দু-একটি দুর্বলতা ছাড়া আমাদের গণমাধ্যম নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর যে কভারেজ দিয়েছে তা এক কথায় তুলনাহীন। পত্রিকাগুলোর এসব ইস্যু ও বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানের সিডি অনেকের কাছে সংগ্রহযোগ্য হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রে নানা লেখালেখি ও অসংখ্য টিভি অনুষ্ঠানে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞ জাতির অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখ এটুকুই, মানুষ তাঁকে কত ভালোবাসে তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
No comments