শহরের চোখ খুলছে কই by কামাল পারভেজ
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সাংবাদিকতা শুরুর পর একদিন ঢাকায় যেতে হয়েছিল। যে কাগজে কাজ করছি সেই কাগজটির অফিস কেমন, ঢাকায় কিভাবে কাজ হয়-তা দেখতেই যাওয়া। সেই কাগজটি হচ্ছে দৈনিক জনকন্ঠ। মতিঝিলে অফিস। দুরু দুরু বুকে, নানা কৈফিয়ত শেষে মফস্বল সম্পাদকের টেবিলটি খুঁজে পেয়েছি। পরিচয় দিতে সামান্য হাসেন। অনেক কষ্টে বসতে বলেন।
মফস্বল থেকে গেছি, সুতরাং হাসিটি তাঁর মোলায়েম হবে কেন! একথা সে কথার পর তাকে জানাই, আমার তো অনেকদিন হয়ে গেল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কি পাব না ! আবারো হাসেন তিনি, সৌজনের খাতিরে দুপুরে লাঞ্চের জন্য বার্গার আসে। সুনজরের আভাস ভেবে বড়মুখ করে খেয়ে নিই। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকাল হয়। থাকব কোথায় ঠিক হয়নি। মফস্বল সম্পাদক মহোদয়ের খোলাসা উত্তর মেলে না। আমার কাজটি (চাকরি বলছি না) পারমানেন্ট হবে কিনা জানি না। ছয় ঘন্টা সেই টেবিলে কাটিয়ে আসার সময় কেবল প্রাপ্তি, ‘দেখি কাজ করে যাও, পরে দেখা যাবে।’
আমি হতাশা নিয়ে রাস্তায় নামি। বুকভার করে হাঁটি। তারপর কাজ করে যাই। সময় গড়িয়ে যায়। একদিন আসে সেই কাঙ্ক্ষিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। অবৈতনিক সংবাদদাতা। কোন সম্মানী নেই। বাপের খেয়ে কাজ করা। তারপরও সুদিনের আশায় কাজ করে যাই। রোজ রোজ বাপের কাছে হাত পাতি।
অত:পর, দারুণ হতাশায় ডুবে থেকেও কাজ করে গেছি। সেই পর্ব পেরিয়ে এসেছি। এখন পত্রিকায় নেই। টেলিভিশনে কাজ করি। অবস্থা পাল্টেছে। প্রিয় ফজলুল বারী ভাই আর নাজিম উদ্দিনের লেখা পড়ে একটু লিখতে ইচ্ছে হলো। গ্রামে থাকেন যারা, তারা যে আসলে হরিজন, তার অনেক গল্প-কাহিনী ভাল জানেন বারী ভাই।
গ্রামে গ্রামে ঘুরতে গিয়ে অনেক তৃণমূল সংবাদকর্মীর কষ্টগাঁথা সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন। সেজন্যই বারী ভাই আবারো খুঁচিয়ে এনেছেন তাদের দু:খ গাঁথা। আর নাজিম বলতে চেয়েছেন অবস্থা বদলানোর কথা। গ্রাম সাংবাদিকদের চোখ খুলছে।
অবস্থা বদলেছে গ্রাম সাংবাদিকতার। সত্যি। এখন পত্রিকাগুলো ভাল সম্মানী-বেতন দেয় মফস্বল সাংবাদিকদের। টেলিভিশনগুলোও দেয়। অতএব দু:খ থাকার কথা নয়। কিন্তু দু:খটা অন্য জায়গায়। কেবল কী গ্রাম সাংবাদিকদের চোখ খুললেই সব হয়ে যায়। আমরাতো আজীবন দেখে এসেছি, গ্রাম-বাংলার সাংবাদিকদের চোখ খোলা। কেবল চোখ বন্ধ করে থাকেন রাজধানীর গেটকিপাররা। চোখওয়ালারা।
এখনো কেউ কী জোর দিয়ে বলতে পারেন, সেই পুরনো সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরা? ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা হয়ত ভাল দিচ্ছেন, কিন্তু মর্যাদার জগতটা কতটা তারা বদলে দিতে পেরেছেন। এখনো পত্রিকার বেলায় গ্রামের ভাল আইটেমটি জায়গা নিচ্ছে ভেতরের পাতায়, অথবা বাইরের পৃষ্ঠার সিঙ্গেল কলাম। টেলিভিশনে আরো দুরাবস্থা।
ঢাকার কাগজগুলো যাওবা তাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের খানিকটা হলেও মূল্যায়ন করছে। কিন্তু আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো কতটা উন্নতি করেছে ? কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে মফস্বল প্রতিনিধিদের ? বিশেষ করে আর্থিকভাবে? আমরা যে যতই বলি, রাজধানীর অনেক পত্রিকার চেয়ে এখন অনেক আঞ্চলিক পত্রিকা ভাল অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। চাইলে তারা অনায়াসে নজর দিতে পারে গ্রামের দিকে।
আমিও এক সময় একটি উপজেলায় কাজ করে এসেছি। সেখানে আমার সহকর্মী যারা ছিলেন-আছেন, কই তাদের কোন পরিবর্তনতো আমার চোখে পড়ে না। আমার কাজ দেখে হয়ত কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে নিয়ে তাদের অফিসে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু যারা এখনো সেখানে আছেন, তারাও কিন্তু কম কাজ জানেন এমন নয়। কিন্তু একটা অবারিত সুযোগ নিয়ে বসে থেকেও আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো তাদের প্রতিনিধিদের সেই প্লাটফর্ম করে দিচ্ছে না।
একটু প্রশিক্ষণ, আর্থিক প্রণোদনা বা নির্ভয়ে কাজ যাওয়ার নিশ্চয়তা চাইলেই দেওয়া যায়। গ্রামে থাকতে একবার একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দাওয়াতপত্র যেটি দিয়েছে, তাতে নিচে লেখা-দুপুরে সাংবাদিকদের জন্য লাঞ্চের-যাতায়ত খরচের ব্যবস্থা আছে। আমি সেই অনুষ্ঠানে যাইনি। পরে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন লিখেছিলেন এই কথাটি। তিনি যা জানালেন, তাও আরেক বিস্ময়ের।
সাংবাদিকরা অনেক কষ্ট করে চলেন। তারা এক বেলা যদি এখানে খেতে পারেন তাহলে তাদের জন্য খুব সহায়ক হয়। বিস্ময়-অপমানে আমি কথা বলতে পারিনি। একই ঘটনার আরো কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছি শহরে এসে।
অর্থাৎ সময় পাল্টালেও সেই ধারাটি এখনো কি পাল্টেছে? অথচ, এখন গ্রামে অনেকে শিক্ষা-যোগ্যতায় শহরের অনেকের চেয়ে এগিয়ে থেকে কাজ করছেন। ভাল কিছু খবর উঠে আসছে তাদের হাত ধরে। খবরের ধরণ অনেক বদলে গেছে। গ্রাম থেকেও জাতীয় পর্যায়ের আইটেম হচ্ছে। বিষয়-বৈচিত্র্য অনেক পাল্টেছে।
সে কারণেই বলছি, গ্রাম-বাংলার সাংবাদিকদের চোখ খুলেছে ঠিক। কিন্তু শহরের তো চোখ খোলেনি। রাজধানীরতো চোখ খোলেনি। এখনো রাজধানীর বাইরের ভাল আইটেমটি দেখলে ডেস্কের কেউ কেউ নাক সিঁটকান। এখনো অনেক ভাবেন, শহরের সাংবাদিকই বেশি জানেন-বোঝেন। গ্রামের সাংবাদিক কত আর বোঝেন! তাই বলছি, এই জায়গাতে চোখ খুললেই অনেক কিছু বদলে যাবে। আমাদের সাংবাদিকতার জগতটাও বদলে যাবে।
বারীভাই বলেছেন, এই বদলানোর জন্য শ্রমের মূল্য আদায়ে একটা ঐক্য দরকার। আমরাও সেটা অনুভব করি। জানি-বুঝি। কিন্তু সেই ঐক্যটা কিভাবে হবে? কারা দায়িত্ব নেবে? আমাদের জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে একাধিক প্রেসক্লাব-ইউনিয়ন।
নানা সংগঠন। দলাদলি। কখনো রাজনৈতিক, কখনো পেশাগত রেষারেষি। এখনো বেশিরভাগ এলাকায় সাংবাদিকরা এক জায়গায় বসতে পারেন না। এক সুরে কথা বলতে পারেন না। আবার অফিসের ভিতরকার দলাদলিটাও কম নয়। প্রযুক্তির সঙ্গে-পড়াশনার সঙ্গে অনেকে দৌড়াচ্ছে ঠিক, কিন্তু এসব বিপত্তি-বাধা জয় করার জন্য যুথবদ্ধতা কোথায়? শহরের চোখ খোলার জন্য সেই তীব্র আলোটা কে ফেলবে?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন বাংলা, চট্টগ্রাম অফিস।
আমি হতাশা নিয়ে রাস্তায় নামি। বুকভার করে হাঁটি। তারপর কাজ করে যাই। সময় গড়িয়ে যায়। একদিন আসে সেই কাঙ্ক্ষিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। অবৈতনিক সংবাদদাতা। কোন সম্মানী নেই। বাপের খেয়ে কাজ করা। তারপরও সুদিনের আশায় কাজ করে যাই। রোজ রোজ বাপের কাছে হাত পাতি।
অত:পর, দারুণ হতাশায় ডুবে থেকেও কাজ করে গেছি। সেই পর্ব পেরিয়ে এসেছি। এখন পত্রিকায় নেই। টেলিভিশনে কাজ করি। অবস্থা পাল্টেছে। প্রিয় ফজলুল বারী ভাই আর নাজিম উদ্দিনের লেখা পড়ে একটু লিখতে ইচ্ছে হলো। গ্রামে থাকেন যারা, তারা যে আসলে হরিজন, তার অনেক গল্প-কাহিনী ভাল জানেন বারী ভাই।
গ্রামে গ্রামে ঘুরতে গিয়ে অনেক তৃণমূল সংবাদকর্মীর কষ্টগাঁথা সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন। সেজন্যই বারী ভাই আবারো খুঁচিয়ে এনেছেন তাদের দু:খ গাঁথা। আর নাজিম বলতে চেয়েছেন অবস্থা বদলানোর কথা। গ্রাম সাংবাদিকদের চোখ খুলছে।
অবস্থা বদলেছে গ্রাম সাংবাদিকতার। সত্যি। এখন পত্রিকাগুলো ভাল সম্মানী-বেতন দেয় মফস্বল সাংবাদিকদের। টেলিভিশনগুলোও দেয়। অতএব দু:খ থাকার কথা নয়। কিন্তু দু:খটা অন্য জায়গায়। কেবল কী গ্রাম সাংবাদিকদের চোখ খুললেই সব হয়ে যায়। আমরাতো আজীবন দেখে এসেছি, গ্রাম-বাংলার সাংবাদিকদের চোখ খোলা। কেবল চোখ বন্ধ করে থাকেন রাজধানীর গেটকিপাররা। চোখওয়ালারা।
এখনো কেউ কী জোর দিয়ে বলতে পারেন, সেই পুরনো সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরা? ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা হয়ত ভাল দিচ্ছেন, কিন্তু মর্যাদার জগতটা কতটা তারা বদলে দিতে পেরেছেন। এখনো পত্রিকার বেলায় গ্রামের ভাল আইটেমটি জায়গা নিচ্ছে ভেতরের পাতায়, অথবা বাইরের পৃষ্ঠার সিঙ্গেল কলাম। টেলিভিশনে আরো দুরাবস্থা।
ঢাকার কাগজগুলো যাওবা তাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের খানিকটা হলেও মূল্যায়ন করছে। কিন্তু আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো কতটা উন্নতি করেছে ? কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে মফস্বল প্রতিনিধিদের ? বিশেষ করে আর্থিকভাবে? আমরা যে যতই বলি, রাজধানীর অনেক পত্রিকার চেয়ে এখন অনেক আঞ্চলিক পত্রিকা ভাল অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। চাইলে তারা অনায়াসে নজর দিতে পারে গ্রামের দিকে।
আমিও এক সময় একটি উপজেলায় কাজ করে এসেছি। সেখানে আমার সহকর্মী যারা ছিলেন-আছেন, কই তাদের কোন পরিবর্তনতো আমার চোখে পড়ে না। আমার কাজ দেখে হয়ত কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে নিয়ে তাদের অফিসে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু যারা এখনো সেখানে আছেন, তারাও কিন্তু কম কাজ জানেন এমন নয়। কিন্তু একটা অবারিত সুযোগ নিয়ে বসে থেকেও আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো তাদের প্রতিনিধিদের সেই প্লাটফর্ম করে দিচ্ছে না।
একটু প্রশিক্ষণ, আর্থিক প্রণোদনা বা নির্ভয়ে কাজ যাওয়ার নিশ্চয়তা চাইলেই দেওয়া যায়। গ্রামে থাকতে একবার একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দাওয়াতপত্র যেটি দিয়েছে, তাতে নিচে লেখা-দুপুরে সাংবাদিকদের জন্য লাঞ্চের-যাতায়ত খরচের ব্যবস্থা আছে। আমি সেই অনুষ্ঠানে যাইনি। পরে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন লিখেছিলেন এই কথাটি। তিনি যা জানালেন, তাও আরেক বিস্ময়ের।
সাংবাদিকরা অনেক কষ্ট করে চলেন। তারা এক বেলা যদি এখানে খেতে পারেন তাহলে তাদের জন্য খুব সহায়ক হয়। বিস্ময়-অপমানে আমি কথা বলতে পারিনি। একই ঘটনার আরো কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছি শহরে এসে।
অর্থাৎ সময় পাল্টালেও সেই ধারাটি এখনো কি পাল্টেছে? অথচ, এখন গ্রামে অনেকে শিক্ষা-যোগ্যতায় শহরের অনেকের চেয়ে এগিয়ে থেকে কাজ করছেন। ভাল কিছু খবর উঠে আসছে তাদের হাত ধরে। খবরের ধরণ অনেক বদলে গেছে। গ্রাম থেকেও জাতীয় পর্যায়ের আইটেম হচ্ছে। বিষয়-বৈচিত্র্য অনেক পাল্টেছে।
সে কারণেই বলছি, গ্রাম-বাংলার সাংবাদিকদের চোখ খুলেছে ঠিক। কিন্তু শহরের তো চোখ খোলেনি। রাজধানীরতো চোখ খোলেনি। এখনো রাজধানীর বাইরের ভাল আইটেমটি দেখলে ডেস্কের কেউ কেউ নাক সিঁটকান। এখনো অনেক ভাবেন, শহরের সাংবাদিকই বেশি জানেন-বোঝেন। গ্রামের সাংবাদিক কত আর বোঝেন! তাই বলছি, এই জায়গাতে চোখ খুললেই অনেক কিছু বদলে যাবে। আমাদের সাংবাদিকতার জগতটাও বদলে যাবে।
বারীভাই বলেছেন, এই বদলানোর জন্য শ্রমের মূল্য আদায়ে একটা ঐক্য দরকার। আমরাও সেটা অনুভব করি। জানি-বুঝি। কিন্তু সেই ঐক্যটা কিভাবে হবে? কারা দায়িত্ব নেবে? আমাদের জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে একাধিক প্রেসক্লাব-ইউনিয়ন।
নানা সংগঠন। দলাদলি। কখনো রাজনৈতিক, কখনো পেশাগত রেষারেষি। এখনো বেশিরভাগ এলাকায় সাংবাদিকরা এক জায়গায় বসতে পারেন না। এক সুরে কথা বলতে পারেন না। আবার অফিসের ভিতরকার দলাদলিটাও কম নয়। প্রযুক্তির সঙ্গে-পড়াশনার সঙ্গে অনেকে দৌড়াচ্ছে ঠিক, কিন্তু এসব বিপত্তি-বাধা জয় করার জন্য যুথবদ্ধতা কোথায়? শহরের চোখ খোলার জন্য সেই তীব্র আলোটা কে ফেলবে?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন বাংলা, চট্টগ্রাম অফিস।
No comments