অভিজাত চোর বিশ্বাসী চোর by হাসান হাফিজ
চোরদের কাহিনী বলতে বসেছি আজ। প্রথমে বলব অভিজাত চোরদের গল্প। এরা যে সে চোর না। বড্ড সেয়ানা মাল। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চায় না তারা। টার্গেট মহান, বিদেশিরা। চুরির এরিয়া রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর কূটনীতিক পাড়া। ওই জায়গা নিরাপদ, সে কারণে ওদের বিশেষ পছন্দ। বিধি বাম। ধরা খেয়ে শ্রীঘরে যেতে হয়েছে। কথায় বলে, চোরের দশ দিন সাধুর এক দিন।
ওরা কট হয়েছে বলেই না আমরা জানতে পেরেছি তাদের সম্পর্কে। আমরা কূটনীতিক না, সেজন্যে ওদের টার্গেট নই। তাতে কি! আমরা এদেশের বাসিন্দা তো বটে। বিদেশিদের কাছে মাথা হেঁট হওয়ার খবরে পুলক বোধ করে কোন্ বেল্লিক? এই সংবাদে শরমিন্দা হতেই হয়। এই বেদনা আসলেই ডিজিটাল, এনালগ নয়। অভিজাত চোরেরা বড়ই হুঁশিয়ার। পেশাদার এক গণ্ডা প্লাস এক জোড়া—একুনে ছয় ছয়খান চোর পাকড়াও হয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি, ধোলাই খাওয়ার কপাল ওদের। মুখ খুলেছে ওরা। বলেছে চৌর্যবৃত্তির খুঁটিনাটি বিত্তান্ত। ওস্তাদের নাম বাবলু। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ (অতন্দ্র প্রহরীর চোখ) ফাঁকি দিয়ে তারা এই কুকর্ম চালিয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। রক্ষীদের চক্ষু এমনই শ্যেন যে, কয়েক বছরেও এরা ধরা পড়েনি। হতে পারে, ওরা (চোরপুঙ্গবরা) যখন অপারেশন চালায়, সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর্তব্যরত রক্ষীরা তখন চক্ষু মুদিত রাখে। সন্ধ্যার পর অভিযানে বেরোয় তস্করদল। রক্ষীরা রাতে চোখ খোলা রাখবে কেন? বুজিয়ে রাখলেই আরাম, আ-রা-ম!! কাজে কাজেই চোরাদের পোয়াবারো। নির্বিঘ্নে তারা শুভকাজ সম্পন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সাতটি মোবাইল ফোন সেট, চারটি দামি হাতঘড়ি, বিদেশি মুদ্রা, একটি আংটি, একটি ডায়মন্ড সিলেকটরসমেত বিভিন্ন মালামাল।
পালের গোদা বাবলু জানিয়েছে, গুলশান বনানীর আবাসিক এলাকা ও কূটনীতিক পাড়ায় চুরির ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো খোঁজখবর হয় না। এ পর্যন্ত ২০-২৫টি বাড়িতে তারা গ্রিল ও জানালা কেটে চুরিকর্ম সমাধা করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঘটনাই আড়ালে থেকে গেছে।
চুরির আরেকখানা ঘটনা উল্লেখ করে মূল কথায় যাবো। সে এক বিশ্বাসী চোর। কাজ করে জুয়েলারির দোকানে। চট্টগ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। সোনার দোকানে অল্প বেতনে চাকরি করতো রেজাউল করিম ওরফে করিম নামের এক লোক। তার খায়েশ হলো সে কোটিপতি হবে। এমপি ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর সাহেবের ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ টিভি প্রোগ্রামে আমরা দেখি, কোটিপতি হওয়ার কম্মটি মোটেও সহজ নয়। বড়ই পিছলা ও মায়াবী সেই পথ। বেশিরভাগ প্রতিযোগীই গোড়ার দিকে বা মাঝপথে আচমকা ছিটকে পড়ে। তিনখানা লাইফ লাইন নিয়েও চিঁড়ে ভেজাতে ব্যর্থ হন তারা। অনেককে মাত্তর হাজার দশেক টাকা নিয়েই বেজার মুখে হট সিট ত্যাগ করতে হয়। তো, বিশ্বাসী চোর করিমের কথা হচ্ছিল। সে ভাবলো, চাকরি-বাকরি করে কোটিপতি হওয়া সম্ভব হবে না এই জীবনে। সুতরাং শর্টকাট পথই ভালো। তক্কে তক্কে ছিল সে। মওকা পেয়ে সে ভয়ঙ্কর। সুপ্ত বীরত্ব চাগাড় দিয়ে ওঠে তার। নিপুণ দক্ষতায় সে হাতিয়ে নেয় ১৩৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু তার কপাল মন্দ। টেকাপয়সা ও সোনাদানা হজম করবার আগেই সে বেমক্কা কট হয়ে গেল। আফসোস! সে ছিল খাজা জুয়েলার্সের মালিকের বড়ই বিশ্বস্ত কর্মচারী। মালিক সন্দেহ করবেন না, এই বিশ্বাসে সে থেকে গিয়েছিল দোকানেই। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও। এই অতিআত্মবিশ্বাস যে তার কাল হবে, সেটা বোধকরি সে ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি। অভিজাত চোর ও ছিঁচকে চোরদের কামনা-বাসনা, তত্পরতা, দুর্গতি ও পরিণতির কথা আমরা জানলাম। জানবার আরো বাকি আছে। অনেকখানিই বাকি। সবকিছু জানা বোধহয় এই জন্মে সম্ভবও না। ওদের চেয়েও আরো আরো বড়, আরো মহান চোর আছে। যাদের আমরা সমীহ করি, ভয় পাই। শ্রদ্ধা করি, একআধটু কৃপা পাওয়ার জন্যে সর্বক্ষণ প্রভুভক্ত কুকুরের মতন লেজ নাড়ি। উচ্ছিষ্ট পেলে ধন্য মনে করি নিজেদের। তারা আমাদের আস্থা চুরি করে, বিশ্বাস চুরি করে। স্বপ্ন তছনছ করে দেয়। গরিবের সহায়-সম্পদ, শান্তি-স্বস্তি সবই তাদের চরণে নিবেদিত। তারা তুষ্ট নন। না পেলে বড্ড রুষ্ট। কবির ভাষায়, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। এইসব চোর অতি অভিজাত চোর। কুলীন ব্রাহ্মণ তারা। তাদের কোনো দোষ ধরতে নেই। ধরার নিয়মও নেই। আমরা সব অন্ত্যজ, হরিদাস পাল। আমার দেশ-এর স্টাফ রিপোর্টার কাদের গনি চৌধুরী জানাচ্ছেন : দেশে উন্নয়ন কাজের নামে চলছে ব্যাপক লুটপাট। টেন্ডারের ৬০ ভাগ টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারদের পকেটে। বাকি ৪০ ভাগ টাকার কাজ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট করা হচ্ছে সড়ক, সেতু নির্মাণ ও সংস্কার, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ এবং বিভিন্ন মেরামত কাজে। কোনো ধরনের কাজ না করেই নদীখনন ও বাঁধ নির্মাণের নামে পুরো টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে বা দাতাগোষ্ঠীকে ফেরত না দিয়ে বেমালুম আত্মসাত্ করা হচ্ছে। মন্তব্য করার কিছু আছে কি? নাহ। শুধু একটা গানের কথাই মনে আসছে এক্ষণে। —ধন্য মানি জীবনটাকে জন্মেছি এই দেশে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
পালের গোদা বাবলু জানিয়েছে, গুলশান বনানীর আবাসিক এলাকা ও কূটনীতিক পাড়ায় চুরির ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো খোঁজখবর হয় না। এ পর্যন্ত ২০-২৫টি বাড়িতে তারা গ্রিল ও জানালা কেটে চুরিকর্ম সমাধা করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঘটনাই আড়ালে থেকে গেছে।
চুরির আরেকখানা ঘটনা উল্লেখ করে মূল কথায় যাবো। সে এক বিশ্বাসী চোর। কাজ করে জুয়েলারির দোকানে। চট্টগ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। সোনার দোকানে অল্প বেতনে চাকরি করতো রেজাউল করিম ওরফে করিম নামের এক লোক। তার খায়েশ হলো সে কোটিপতি হবে। এমপি ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর সাহেবের ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ টিভি প্রোগ্রামে আমরা দেখি, কোটিপতি হওয়ার কম্মটি মোটেও সহজ নয়। বড়ই পিছলা ও মায়াবী সেই পথ। বেশিরভাগ প্রতিযোগীই গোড়ার দিকে বা মাঝপথে আচমকা ছিটকে পড়ে। তিনখানা লাইফ লাইন নিয়েও চিঁড়ে ভেজাতে ব্যর্থ হন তারা। অনেককে মাত্তর হাজার দশেক টাকা নিয়েই বেজার মুখে হট সিট ত্যাগ করতে হয়। তো, বিশ্বাসী চোর করিমের কথা হচ্ছিল। সে ভাবলো, চাকরি-বাকরি করে কোটিপতি হওয়া সম্ভব হবে না এই জীবনে। সুতরাং শর্টকাট পথই ভালো। তক্কে তক্কে ছিল সে। মওকা পেয়ে সে ভয়ঙ্কর। সুপ্ত বীরত্ব চাগাড় দিয়ে ওঠে তার। নিপুণ দক্ষতায় সে হাতিয়ে নেয় ১৩৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু তার কপাল মন্দ। টেকাপয়সা ও সোনাদানা হজম করবার আগেই সে বেমক্কা কট হয়ে গেল। আফসোস! সে ছিল খাজা জুয়েলার্সের মালিকের বড়ই বিশ্বস্ত কর্মচারী। মালিক সন্দেহ করবেন না, এই বিশ্বাসে সে থেকে গিয়েছিল দোকানেই। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও। এই অতিআত্মবিশ্বাস যে তার কাল হবে, সেটা বোধকরি সে ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি। অভিজাত চোর ও ছিঁচকে চোরদের কামনা-বাসনা, তত্পরতা, দুর্গতি ও পরিণতির কথা আমরা জানলাম। জানবার আরো বাকি আছে। অনেকখানিই বাকি। সবকিছু জানা বোধহয় এই জন্মে সম্ভবও না। ওদের চেয়েও আরো আরো বড়, আরো মহান চোর আছে। যাদের আমরা সমীহ করি, ভয় পাই। শ্রদ্ধা করি, একআধটু কৃপা পাওয়ার জন্যে সর্বক্ষণ প্রভুভক্ত কুকুরের মতন লেজ নাড়ি। উচ্ছিষ্ট পেলে ধন্য মনে করি নিজেদের। তারা আমাদের আস্থা চুরি করে, বিশ্বাস চুরি করে। স্বপ্ন তছনছ করে দেয়। গরিবের সহায়-সম্পদ, শান্তি-স্বস্তি সবই তাদের চরণে নিবেদিত। তারা তুষ্ট নন। না পেলে বড্ড রুষ্ট। কবির ভাষায়, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। এইসব চোর অতি অভিজাত চোর। কুলীন ব্রাহ্মণ তারা। তাদের কোনো দোষ ধরতে নেই। ধরার নিয়মও নেই। আমরা সব অন্ত্যজ, হরিদাস পাল। আমার দেশ-এর স্টাফ রিপোর্টার কাদের গনি চৌধুরী জানাচ্ছেন : দেশে উন্নয়ন কাজের নামে চলছে ব্যাপক লুটপাট। টেন্ডারের ৬০ ভাগ টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারদের পকেটে। বাকি ৪০ ভাগ টাকার কাজ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট করা হচ্ছে সড়ক, সেতু নির্মাণ ও সংস্কার, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ এবং বিভিন্ন মেরামত কাজে। কোনো ধরনের কাজ না করেই নদীখনন ও বাঁধ নির্মাণের নামে পুরো টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে বা দাতাগোষ্ঠীকে ফেরত না দিয়ে বেমালুম আত্মসাত্ করা হচ্ছে। মন্তব্য করার কিছু আছে কি? নাহ। শুধু একটা গানের কথাই মনে আসছে এক্ষণে। —ধন্য মানি জীবনটাকে জন্মেছি এই দেশে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
No comments