নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-অভিযোগের তীর মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের দিকে by হায়দার আলী,
নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনের করুণ মৃত্যুর জন্য দায়ী তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তাঁর জনপ্রিয়তা নরসিংদীর অনেক জাতীয় নেতাকেও ছাড়িয়ে যায়। সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এবং তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে লোকমান হোসেনের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এ ঘটনার জের ধরেই লোকমানের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গত ২২ অক্টোবর বিভিন্ন অপকর্মের হোতা মন্ত্রী রাজুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করেন।
ওই ঘটনার পুরো দায়ভার মেয়র লোকমান হোসেনের ওপর চাপিয়ে দেন মন্ত্রী রাজু। এ রকম আরো অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মন্ত্রী রাজু ও তাঁর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর প্রত্যক্ষ মদদে লোকমান হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।' এসব অভিযোগ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজ সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম কাইয়ূম।
কালের কণ্ঠের কাছে এস এম কাইয়ূম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের ভেতরে এসে সন্ত্রাসীরা লোকমান ভাইকে গুলি করে যায়, এরা কত বড় ক্ষমতা নিয়ে এসেছে এই ঘটনায় তা সহজেই অনুমান করা যায়।'
এস এম কাইয়ূম মেয়র লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
গতকাল বুধবার সারা দিন নরসিংদী ঘুরে নানা শ্রেণী, পেশা ও পক্ষের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,
মুখোশধারী দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নরসিংদীর বিপুল জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় নরসিংদীর সর্বসাধারণের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। সবার এক কথা_জনপ্রিয়তাই লোকমানের কাল হয়ে দাঁড়ায়। লোকমানের পরিবারের লোকজনের ভাষ্য, নরসিংদীবাসীর সবাই জানে কারা তাঁকে হত্যা করেছে। আর লোকমানের ঘনিষ্ঠজনরা স্পষ্ট ভাষায় বলছে, জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর উত্থানের কারণে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার রাতেই বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় এবং নরসিংদীতে মন্ত্রীর আশ্রয়স্থল সার্কিট হাউস ও মন্ত্রীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত হাজি ছাত্তারের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে লোকমান : নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের মেনজের কান্দি গ্রামের শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার ছেলে লোকমান হোসেন। নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় তাঁর বাড়ি। বাবা শাহনেওয়াজ নব্বইয়ের দশকে স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়েকে রেখে মারা যান। লোকমান হোসেন ১৯৮৫ সালে নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৪ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকারকে। লোকমান হোসেন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নরসিংদী শহরের রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ও পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। এর স্বীকৃতিস্বরূপ লোকমান হোসেনকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পরপর দুইবার (২০০৮ ও ২০০৯ সালে) দেশের শ্রেষ্ঠ পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে স্বর্ণপদক প্রদান করে।
বিরোধের বীজ বোনে জনপ্রিয়তা : অনুসন্ধানে জানা যায়, নরসিংদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে লোকমান হোসেনের উত্থানে আওয়ামী লীগপাড়া হিসেবে খ্যাত শহরের বেপারীপাড়ার নেতাদের রাজনৈতিক শক্তি খর্ব হতে থাকে। এরই জের ধরে লোকমান হোসেনের সঙ্গে বেপারীপাড়ার নেতাদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরই সঙ্গে যোগ হয় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে মতবিরোধ।
জানা যায়, জেলা ছাত্রলীগ ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনীতি ছিল মেয়রের নিয়ন্ত্রণে। এক বছর আগে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে মেয়রের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শামীমসহ ছাত্রলীগের মনোনীত পূর্ণ প্যানেলকে পরাজিত করার জন্য মন্ত্রী রাজু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা চরম বিরোধিতা করেন। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শামীমসহ ১৩ জন জয়লাভ করেন। পাশাপাশি পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেন ২২ হাজার ভোটের ব্যবধানে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।
ধীরে ধীরে মন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক এতটাই বিরোধপূর্ণ হয় যে, মন্ত্রী যে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থাকেন, তাতে মেয়র লোকমান অংশ নেন না। এ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচবার এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। এমনকি সমপ্রতি নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে পৌর প্রশাসন যে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে, তা মন্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে করা হয় বলে প্রশাসনের তোপের মুখে পড়েন মেয়র লোকমান হোসেন। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে মন্ত্রী নরসিংদী শহরে নবনির্মিত ডাকঘর ভবন উদ্বোধন করলেও সেখানে মেয়রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলের সম্ভাব্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছিল। পৌর মেয়র লোকমান হোসেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন বলে জানা যায়। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি জেলার বিভিন্ন উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। অন্যদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর নাম রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু রাজুর নির্বাচনী এলাকা রায়পুরা উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রীর অবাধ্য হয়ে অংশ নিয়ে আলোচিত হওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কাইয়ুম লোকমান হোসেনের অনুগত হওয়ায় তাঁদের বিরোধ নতুন মাত্রা পায়। এরই জের ধরে গত ১৫ অক্টোবর দুপুরে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর অনুগত নরসিংদী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেহানুল ইসলাম লেলিনের ওপর হামলা চালানো হয়। অভিযোগ ওঠে, এ হামলা চালায় মেয়র লোকমান হোসেনের অনুগত জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল লোক। এ ঘটনায় লেলিন বাদী হয়ে পরদিন ছয়জনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ছাত্রলীগ থেকে রেহানুল ইসলাম লেলিন ও সোহেবকে বহিষ্কার করা হয়। ওই মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের চার নেতা আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করলে বিচারক জামিন মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরই প্রতিবাদে জেলা ছাত্রলীগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে জুতা ও ঝাড়ু মিছিল বের করে এবং বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ এনে তারা মন্ত্রীকে নরসিংদীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।
ওই সময় মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ বলেন, নরসিংদীতে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। মন্ত্রীর হুকুমে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা সংগঠনবিরোধী। এমন নেতা আমাদের আর দরকার নেই।
অভিযোগের তীর : শহর যুবলীগের সহসভাপতি দীপক সাহা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পৌর নির্বাচনে পরাজিত শক্তি ও বিরোধীদলীয় শক্তি লোকমান হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। নরসিংদীবাসী সবাই তাদের চেনে। জনতাই তাদের রাজপথে বিচার করবে।
লোকমানের বাসাইলের বাসভবনে কথা হয় শহরের ব্রাহ্মন্দী এলাকার আবুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লোকমান ভাইকে মন্ত্রীর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। মন্ত্রী জনতা তৈরি করে না, জনতাই মন্ত্রী তৈরি করে। তাই জনতাই মন্ত্রীর বিচার করবে।
লোকমান হত্যার প্রতিবাদে মেয়রের সমর্থকরা শহরে বিক্ষোভ মিছিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তাঁরা নরসিংদীতে মন্ত্রীকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কাইয়ুম স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ করেন, মন্ত্রী রাজু ও তাঁর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর প্রত্যক্ষ মদদে লোকমান হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি বিদেশে রয়েছেন। তাঁর ভাই বাচ্চুর মোবাইল ফোনও সারা দিন বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মেয়র হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউ যদি মন্ত্রীকে সন্দেহ করে থাকে, তাহলে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা কোনো দলীয় ব্যাপার না। মেয়রের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব থাকতে পারে, এটা আমার জানা নেই।'
কেন সার্কিট হাউসে হামলা : ডাক ও টেলিযোযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু প্রতি সপ্তাহে নরসিংদীর সার্কিট হাউসে এসে উঠতেন। রাত কাটাতেন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে। গত মঙ্গলবার লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর উত্তেজিত সমর্থকরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের হাত রয়েছে অভিযোগ তুলে সার্কিট হাউসের ভেতরে গাড়িসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্ত্রী রাজু যে কক্ষটিতে অবস্থান করতেন, সেটিও ভাঙচুর করা হয়। সার্কিট হাউস ভাঙচুরের পর মন্ত্রীর খুব কাছের লোক বলে পরিচিত হাজি আবদুস সাত্তারের বাড়িতে বিক্ষুব্ধরা হামলা চালায় এবং আগুন জ্বালিয়ে দেয়। লোকমান হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীতে ৭২ ঘণ্টা হরতালেরও ডাক দেওয়া হয়।
সার্কিট হাউসে কেন আগুন দেওয়া হলো_জানতে চাইলে লোকমান সমর্থক শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মিঠুন সাহা বলেন, মন্ত্রীর অপকর্মের আস্তানা সার্কিট হাউস। তাই সব নেতা-কর্মীর ক্ষোভের স্বীকার হয়েছে সার্কিট হাউস।
লোকমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী বলেন, নরসিংদীতে খুনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। একটি খুন আরেকটি খুনকে ত্বরান্বিত করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে আমাদের সুশীল সমাজকেই।
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পরিকল্পিতভাবে মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা যত বড়ই হোক না কেন, প্রশাসনের উচিত তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা। অন্যথায় নরসিংদীতে খুনের রাজনীতি বন্ধ হবে না।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মেয়র খুন হয়েছেন। এতে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এ ঘটনায় বিএনপিকে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
নরসিংদী মডেল থানার ওসি মজিবুর রহমান বলেন, 'মেয়র লোকমান খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর জন্য এটি একটি কারণও হতে পারে। হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এগুলোকে সামনে রেখে তদন্তকাজ এগিয়ে যাচ্ছে।' তবে তিনি তদন্তের স্বার্থে এখনই সাংবাদিকদের তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
কালের কণ্ঠের কাছে এস এম কাইয়ূম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের ভেতরে এসে সন্ত্রাসীরা লোকমান ভাইকে গুলি করে যায়, এরা কত বড় ক্ষমতা নিয়ে এসেছে এই ঘটনায় তা সহজেই অনুমান করা যায়।'
এস এম কাইয়ূম মেয়র লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
গতকাল বুধবার সারা দিন নরসিংদী ঘুরে নানা শ্রেণী, পেশা ও পক্ষের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,
মুখোশধারী দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নরসিংদীর বিপুল জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় নরসিংদীর সর্বসাধারণের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। সবার এক কথা_জনপ্রিয়তাই লোকমানের কাল হয়ে দাঁড়ায়। লোকমানের পরিবারের লোকজনের ভাষ্য, নরসিংদীবাসীর সবাই জানে কারা তাঁকে হত্যা করেছে। আর লোকমানের ঘনিষ্ঠজনরা স্পষ্ট ভাষায় বলছে, জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর উত্থানের কারণে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার রাতেই বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় এবং নরসিংদীতে মন্ত্রীর আশ্রয়স্থল সার্কিট হাউস ও মন্ত্রীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত হাজি ছাত্তারের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে লোকমান : নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের মেনজের কান্দি গ্রামের শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার ছেলে লোকমান হোসেন। নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় তাঁর বাড়ি। বাবা শাহনেওয়াজ নব্বইয়ের দশকে স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়েকে রেখে মারা যান। লোকমান হোসেন ১৯৮৫ সালে নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৪ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকারকে। লোকমান হোসেন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নরসিংদী শহরের রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ও পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। এর স্বীকৃতিস্বরূপ লোকমান হোসেনকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পরপর দুইবার (২০০৮ ও ২০০৯ সালে) দেশের শ্রেষ্ঠ পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে স্বর্ণপদক প্রদান করে।
বিরোধের বীজ বোনে জনপ্রিয়তা : অনুসন্ধানে জানা যায়, নরসিংদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে লোকমান হোসেনের উত্থানে আওয়ামী লীগপাড়া হিসেবে খ্যাত শহরের বেপারীপাড়ার নেতাদের রাজনৈতিক শক্তি খর্ব হতে থাকে। এরই জের ধরে লোকমান হোসেনের সঙ্গে বেপারীপাড়ার নেতাদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরই সঙ্গে যোগ হয় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে মতবিরোধ।
জানা যায়, জেলা ছাত্রলীগ ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনীতি ছিল মেয়রের নিয়ন্ত্রণে। এক বছর আগে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে মেয়রের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শামীমসহ ছাত্রলীগের মনোনীত পূর্ণ প্যানেলকে পরাজিত করার জন্য মন্ত্রী রাজু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা চরম বিরোধিতা করেন। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শামীমসহ ১৩ জন জয়লাভ করেন। পাশাপাশি পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেন ২২ হাজার ভোটের ব্যবধানে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।
ধীরে ধীরে মন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক এতটাই বিরোধপূর্ণ হয় যে, মন্ত্রী যে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থাকেন, তাতে মেয়র লোকমান অংশ নেন না। এ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচবার এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। এমনকি সমপ্রতি নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে পৌর প্রশাসন যে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে, তা মন্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে করা হয় বলে প্রশাসনের তোপের মুখে পড়েন মেয়র লোকমান হোসেন। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে মন্ত্রী নরসিংদী শহরে নবনির্মিত ডাকঘর ভবন উদ্বোধন করলেও সেখানে মেয়রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলের সম্ভাব্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছিল। পৌর মেয়র লোকমান হোসেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন বলে জানা যায়। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি জেলার বিভিন্ন উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। অন্যদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর নাম রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু রাজুর নির্বাচনী এলাকা রায়পুরা উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রীর অবাধ্য হয়ে অংশ নিয়ে আলোচিত হওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কাইয়ুম লোকমান হোসেনের অনুগত হওয়ায় তাঁদের বিরোধ নতুন মাত্রা পায়। এরই জের ধরে গত ১৫ অক্টোবর দুপুরে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর অনুগত নরসিংদী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেহানুল ইসলাম লেলিনের ওপর হামলা চালানো হয়। অভিযোগ ওঠে, এ হামলা চালায় মেয়র লোকমান হোসেনের অনুগত জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল লোক। এ ঘটনায় লেলিন বাদী হয়ে পরদিন ছয়জনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ছাত্রলীগ থেকে রেহানুল ইসলাম লেলিন ও সোহেবকে বহিষ্কার করা হয়। ওই মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের চার নেতা আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করলে বিচারক জামিন মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরই প্রতিবাদে জেলা ছাত্রলীগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে জুতা ও ঝাড়ু মিছিল বের করে এবং বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ এনে তারা মন্ত্রীকে নরসিংদীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।
ওই সময় মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ বলেন, নরসিংদীতে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। মন্ত্রীর হুকুমে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা সংগঠনবিরোধী। এমন নেতা আমাদের আর দরকার নেই।
অভিযোগের তীর : শহর যুবলীগের সহসভাপতি দীপক সাহা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পৌর নির্বাচনে পরাজিত শক্তি ও বিরোধীদলীয় শক্তি লোকমান হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। নরসিংদীবাসী সবাই তাদের চেনে। জনতাই তাদের রাজপথে বিচার করবে।
লোকমানের বাসাইলের বাসভবনে কথা হয় শহরের ব্রাহ্মন্দী এলাকার আবুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লোকমান ভাইকে মন্ত্রীর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। মন্ত্রী জনতা তৈরি করে না, জনতাই মন্ত্রী তৈরি করে। তাই জনতাই মন্ত্রীর বিচার করবে।
লোকমান হত্যার প্রতিবাদে মেয়রের সমর্থকরা শহরে বিক্ষোভ মিছিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তাঁরা নরসিংদীতে মন্ত্রীকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কাইয়ুম স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ করেন, মন্ত্রী রাজু ও তাঁর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর প্রত্যক্ষ মদদে লোকমান হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি বিদেশে রয়েছেন। তাঁর ভাই বাচ্চুর মোবাইল ফোনও সারা দিন বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মেয়র হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউ যদি মন্ত্রীকে সন্দেহ করে থাকে, তাহলে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা কোনো দলীয় ব্যাপার না। মেয়রের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব থাকতে পারে, এটা আমার জানা নেই।'
কেন সার্কিট হাউসে হামলা : ডাক ও টেলিযোযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু প্রতি সপ্তাহে নরসিংদীর সার্কিট হাউসে এসে উঠতেন। রাত কাটাতেন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে। গত মঙ্গলবার লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর উত্তেজিত সমর্থকরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের হাত রয়েছে অভিযোগ তুলে সার্কিট হাউসের ভেতরে গাড়িসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্ত্রী রাজু যে কক্ষটিতে অবস্থান করতেন, সেটিও ভাঙচুর করা হয়। সার্কিট হাউস ভাঙচুরের পর মন্ত্রীর খুব কাছের লোক বলে পরিচিত হাজি আবদুস সাত্তারের বাড়িতে বিক্ষুব্ধরা হামলা চালায় এবং আগুন জ্বালিয়ে দেয়। লোকমান হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীতে ৭২ ঘণ্টা হরতালেরও ডাক দেওয়া হয়।
সার্কিট হাউসে কেন আগুন দেওয়া হলো_জানতে চাইলে লোকমান সমর্থক শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মিঠুন সাহা বলেন, মন্ত্রীর অপকর্মের আস্তানা সার্কিট হাউস। তাই সব নেতা-কর্মীর ক্ষোভের স্বীকার হয়েছে সার্কিট হাউস।
লোকমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী বলেন, নরসিংদীতে খুনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। একটি খুন আরেকটি খুনকে ত্বরান্বিত করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে আমাদের সুশীল সমাজকেই।
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পরিকল্পিতভাবে মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা যত বড়ই হোক না কেন, প্রশাসনের উচিত তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা। অন্যথায় নরসিংদীতে খুনের রাজনীতি বন্ধ হবে না।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মেয়র খুন হয়েছেন। এতে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এ ঘটনায় বিএনপিকে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
নরসিংদী মডেল থানার ওসি মজিবুর রহমান বলেন, 'মেয়র লোকমান খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর জন্য এটি একটি কারণও হতে পারে। হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এগুলোকে সামনে রেখে তদন্তকাজ এগিয়ে যাচ্ছে।' তবে তিনি তদন্তের স্বার্থে এখনই সাংবাদিকদের তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
No comments