কানাডায় উর্দুতে ঈদের নামাজ by সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
একালের ঈদ, সেকালের ঈদ/ গ্রামের ঈদ, শহরের ঈদ/ ছোটবেলার ঈদ- এধরনের লেখা প্রায় প্রতিবছরই ঈদ সংখ্যাগুলোতে যত্ন করে ছাপা হয়। অনেক বছর আগে দৈনিক ভোরের কাগজে লিখেছিলাম- আনন্দের ঈদের বিপরীতে বেদনার, বিরক্তির, বিড়ম্বনার ঈদ নিয়ে। এবার ‘স্বদেশের ঈদ, বিদেশে ঈদ’ লেখাটি লিখতে গিয়ে সেই সব কথা মনে পড়লো।
স্বদেশে ঈদের বিষয়-আশয়, আমেজ-আনন্দ সম্পূর্ণ আলাদা। যে ফুরফুরে আনন্দের ঢেউ সর্বত্রই ছড়িয়ে থাকে সারাদেশে। আর বিদেশে-বিভূঁইয়ে অর্থাৎ প্রবাসে তা একেবারেই ব্যতিক্রম। অনেকটা ঘরে ঘরে ঈদের উৎসব সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই। তার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ে রয়েছে নানান জাতি। ফলে বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি কিংবা আফগানরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ঈদ উদযাপন করে। অর্থাৎ এখানে নিজ নিজ জাতিস্বত্ত্বার এতিহ্য কাজ করে। অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রমও রয়েছে। চেনাজানা পরিচিত অন্য জাতির সাথেও ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদের আনন্দ বিনিময় হয়। তার সংখ্যা সামান্য।
আবার সমস্যাও রয়েছে। যেমন উর্দুতে ঈদের নামাজ পড়া।...মন্ট্রিয়লে পাকিস্তানি ‘ইমাম সাহেব বা ইমাম সাহেবদের তল্পিবাহকরা খুতবা বা যাবতীয় ইনস্ট্রাকশন উর্দুতে দিতে থাকেন। আর এ-ও দেখে আসছি এই ১১/১২ বছর ধরে প্রতিটি জামাতে বিশেষ দেশের মুসল্লিরা ঈদ বা কোরবানি সম্পর্কে ফতোয়া দিচ্ছেন উর্দুতে। প্রতি বছরই এর প্রতিবাদ করা হচ্ছে সে বাংলাদেশিদের তরফ থেকে হোক আর বিশ্বের অন্য মুসলিম দেশের সদস্যদের তরফ থেকেই হোক। প্রতিবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একই কায়দা চলে আসছে।*১
একবার তো রীতিমতো চমকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কানাডায় প্রথম মহিলা ইমাম মরিয়ম মির্জা ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঈদুল ফিতর এ ঈদের নামাজে ইমামতি করেন। যা সারা বিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হয়।*২
তেরো হাজার মেইল দূরে দিনরাত্রির তারতম্যের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে আগের দিন এবং প্রবাসে পরের দিন ঈদ পালিত হয়। ফলে প্রবাসীরা দু’দিনই আনন্দ উপভোগ করে। ফোনে মেইলে স্বজনদের খোঁজখবর নেয়। দু’দিনই ঈদটাকে সমানে ভাবে শেয়ার করে। বিভিন্ন ভাবে উপহার পাঠায়, শুভেচ্ছা বিনিময় করে। স্বদেশের প্রতি, শেকড়ের প্রতি এই নাড়ির টানে শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়, লিখে তা পূর্ণাঙ্গ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
‘ঈদ সংখ্যা: প্রাপ্তি-প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক লেখায় ফখরুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন-‘টরন্টোর বিভিন্ন হাটবাজারে প্রবাসী বাঙালিদের ভিড় দেখলে মাঝে মধ্যে মনে হয়, লিটল বাংলাদেশেই আছি। কানাডার রাজধানী অটোয়ায় আছেন লুৎফর রহমান রিটন। ...রিটন বললেন, ঈদে অনেক কিছুই দেশের এখানে পান না। পাওয়ার কথাও নয়। তবে অনেক কিছুর মধ্যেও সবচেয়ে যে জিনিসের অভাব তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়, তা হলো ঈদ সংখ্যাগুলো’।*৩
প্রবাসে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে বা খোলা মাঠে। অবশ্যই তা নির্ভর করে আবহাওয়া আর ঋতুর উপর। টরন্টোসহ সারা কানাডায় বিপুল ঊৎসাহ উদ্দীপনায় মুসলিম সম্প্রদায় দু’দিনব্যাপী পবিত্র ঈদুল ফেতর পালন করে। একই ভাবে অটোয়া, মন্ট্রিয়ল, ক্যালগরি, সাসকাচুয়ান, ভ্যাঙ্কুভারেও ঈদ উদযাপিত হয়। দূতাবাসে আয়োজন করা হয় ঈদ পূনর্মিলনীর ।
টরন্টোর ড্যানফোর্থ অধ্যুষিত বাঙালিপাড়ায় ডেন্টনিয়া পার্কে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বায়তুল মোকাররম ও বায়তুল আমান মসজিদে আরো দু’টি ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী অংশ নেন।
ঈদের নামাজের পর যথারীতি বাংলাদেশি আমেজে কোলাকুলির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়। তারপর ঘরে ফিরে বাহারি খাবার, সেই সাথে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীদের আগমন ঈদের আনন্দের মাত্রা বৃদ্ধি করে আর সেই সাথে বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত চ্যানেলগুলোতে ঈদের অনুষ্ঠান উপভোগ।
অনেকেই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে চলে যান। আবার কেউ কেউ ঈদ করতে আসেন প্রবাসে। যেমনঃ ঈদুল ফিতর ২০১১-তে বাংলাদেশ থেকে আগত অনেক অতিথিও প্রবাসীদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন। তাদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ এমপি, সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর এমপি, প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রাহমান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, বিশিষ্ট লেখক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, অভিনেত্রী দিলারা জামান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নিউ ইয়র্কের ভারপ্রাপ্ত কনস্যুলার শাহেদুর রহমান প্রমুখ।
কানাডার ভেতর আলাদা সিডনি, দিল্লি, রোম, নিউ ইর্য়ক, লন্ডন শহর রয়েছে। অনেকেই তাতে বিভ্রান্ত হন। আমিও হয়েছি। অন্টারিওর ভেতর লন্ডন! সেই লন্ডনে ঈদ উদযাপন নিয়ে মাহাবুবুল হাসান নীরু লিখেছেন- ‘আমি প্রথম জামাতে নামাজ আদায় করি। নামাজের শেষে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় লন্ডনের মেয়র অ্যান ম্যারি দডিসিক্কোর সাথে।... ম্যারি ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেন, লন্ডনে সব ধর্মের, সব মানুষের মধ্যে সম্প্রতি ও সুন্দর সম্পর্ক নিশ্চিত করতে আমি সর্বদা বদ্ধ পরিকর।*৪
শুধু লন্ডনের মেয়র ম্যারিই নন; অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডেল্টন ম্যাকগুয়েন্টিও এসে হাজির হন ঈদের জামাতে। তিনিও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মূলধারার মিডিয়াগুলোও তা তুলে ধরে।
তবে সমস্যা হচ্ছে, ছুটি নিয়ে। দেশে যে ভাবে ঈদের দিন, ঈদের আগেও পরের দিন সরকারি ছুটি থাকে, প্রবাসে তা সম্ভব নয়। ফলে যে কোনো মুসলিম কর্মস্থল থেকে খুব সহজেই ধর্মীয় ঐচ্ছিক ছুটি নিতে পারে না। যা প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ে জন্যই প্রযোজ্য। কানাডা সরকার এক দিন ঈদের ছুটি দিতে সম্মত হলেও ঈদের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ নির্ধারণ করতে না পারায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
কানাডাজুড়ে ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতর দু’টোতেই দু’দিন করে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ‘মন্ট্রিয়লে ঈদ দু’দিন কেন’ শিরোনামে কাজী আলম বাবু লিখেছেন যে, প্রথমত, চাঁদ দেখার বিভ্রান্তি, দ্বিতীয়ত, দ্বিধাবিভক্ত কমিউনিটি, তৃতীয়ত, পশ্চিম ও প্রাচ্যের ভৌগলিক দূরত্ব তথা টাইম জোনের পার্থক্য সমস্যা, চতুর্থত, ইসলামিক বিধানের জটিলতা, পঞ্চমত, ঐকমত্যে সুনির্দিষ্ট ঘোষণার অভাব।*৫ ফলে এতে মুসলিম বিশ্বমৈত্রী আর মানববন্ধনের সংকট ফুটে উঠে।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী টরন্টোর ঈদ নিয়ে লিখেছেন- This year it also happened. Eid was celebrated on two days! One occasion, two celebrations! One group, dependent on verdict by Hilal committee opted for Eid on the second day. The one on Global Moon sighting committee preferred to celebrate Eid on first day, 30 August. Hilal group believes seeing the Eid moon with own eyes is all important. Where as, Global group relies more on science being debated through out the Muslim world and on scientific calculation and news of moon sighting from different parts of the world. This is a subject better to be left to the experts to dwell at.
Muslims in Canada celebrated on two days. And this has been happening for the last few years much to the disappointment of all. The main Eid Jamat of Greater Toronto Area was held at Metro Toronto Convention Center. Nearly 10,000 devotees offered their prayers here. Biggest congregation of the Bangladeshi Muslims was held at the Danforth Dentonia Park.
Prayers were held in local mosques. In Baitul Aman Masjid in Danforth, run by Danforth Community Center, three Jamats were held from 9 to 11 in the morning. All three Jamats had spilled over devotees. Here one feels at home though away from home! Only difference I was noticing was that here we were in the mosque under the constant surveillance of close circuit camera, like ‘big brother watching’ of Animal Farm ! *৬
ছুটি সংক্রান্ত জটিলতার জন্যই প্রবাসে পহেলা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (শনি/রোববার) করা হয়। ফলে দেখা যায়, নির্ধারিত দিন তারিখের আগের রোববার বা পরের শনিবার তা পালিত হচ্ছে।
প্রবাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঈদোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশের দু’একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর সাথে স্থানীয় শিল্পীরাও অংশ নেন। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জমজমাট মিলন মেলা বসে। কখনো কখনো ঈদের আগেও ঈদমেলা হয়।
প্রবাসে ঈদুল ফেতরের আগে পবিত্র রমজানে ঘরে ঘরে রোজার আয়োজন উপভোগ করার মতো। নানা রকমের ইফতারি আর নানা ধরনের সেহরির রান্না ও রোজার পূর্ণতা বাড়িয়ে দেয়।
আবার কেউ কেউ স্বজনদের সান্বিধ্যে ঈদ করার জন্য স্বদেশে চলে যায়। হয়ত কয়েক বছর পর সবার সাথে স্বদেশে, এর আনন্দই অন্যরকম। তবে প্রবাসে ব্যতিক্রম ঈদুল আজহায় অর্থাৎ কুরবানির ঈদে। এখানে যত্রতত্র, যেখানে সেখানে গরু-ছাগল, উট-দুম্বা জবাই করা বিধি অনুযায়ী নিষেধ। তাই যারা কুরবানি দিতে আগ্রহী, তারা নির্দিষ্ট মাংসের কারখানায় গিয়ে অগ্রিম বুকিং দিয়ে আসেন। তারপর যথাসময়ে সংগ্রহ।
এ সব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রবাসীরা আনন্দে-আবেগে ঈদ উৎসব পালন করে। মজার ব্যাপার, বাঙালি হিন্দু বা খ্রিস্টানেরাও এই উৎসবে শেয়ার করে। একই ভাবে বাঙালি মুসলমানেও পূজা-পার্বনে যোগ দেয়। ফলে প্রবাসে ঐক্য ও সাম্যর বন্ধনে ঈদের উৎসব নতুন মাত্রা পায়। সেই সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা দেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান।
তথ্যসূত্রঃ
১. ঈদের জামাতে উর্দূ/ রমু ইসলাম, সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, মার্চ ০১, ১৯৯৫, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
২. সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে, ১৪তম ৪২ সংখ্যা, টরন্টো, কানাডা
৩. দৈনিক আমার দেশ, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১১, ঢাকা
৪. সৌন্দর্যে আত্মহুতি/ মাহাবুবুল হাসান নীরু। প্রকাশকঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন। প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০১১, ঢাকা, পৃ-২৪/২৫
৫. মন্ট্রিয়লে ঈদ দু’দিন কেন/ কাজী আলম বাবু, সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, মার্চ ০১, ১৯৯৫, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
৬. Eid in North America by Fakharuzzan Chowdhury/ Daily Independent, September 23, 2011, Dhaka.
আবার সমস্যাও রয়েছে। যেমন উর্দুতে ঈদের নামাজ পড়া।...মন্ট্রিয়লে পাকিস্তানি ‘ইমাম সাহেব বা ইমাম সাহেবদের তল্পিবাহকরা খুতবা বা যাবতীয় ইনস্ট্রাকশন উর্দুতে দিতে থাকেন। আর এ-ও দেখে আসছি এই ১১/১২ বছর ধরে প্রতিটি জামাতে বিশেষ দেশের মুসল্লিরা ঈদ বা কোরবানি সম্পর্কে ফতোয়া দিচ্ছেন উর্দুতে। প্রতি বছরই এর প্রতিবাদ করা হচ্ছে সে বাংলাদেশিদের তরফ থেকে হোক আর বিশ্বের অন্য মুসলিম দেশের সদস্যদের তরফ থেকেই হোক। প্রতিবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একই কায়দা চলে আসছে।*১
একবার তো রীতিমতো চমকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কানাডায় প্রথম মহিলা ইমাম মরিয়ম মির্জা ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঈদুল ফিতর এ ঈদের নামাজে ইমামতি করেন। যা সারা বিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হয়।*২
তেরো হাজার মেইল দূরে দিনরাত্রির তারতম্যের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে আগের দিন এবং প্রবাসে পরের দিন ঈদ পালিত হয়। ফলে প্রবাসীরা দু’দিনই আনন্দ উপভোগ করে। ফোনে মেইলে স্বজনদের খোঁজখবর নেয়। দু’দিনই ঈদটাকে সমানে ভাবে শেয়ার করে। বিভিন্ন ভাবে উপহার পাঠায়, শুভেচ্ছা বিনিময় করে। স্বদেশের প্রতি, শেকড়ের প্রতি এই নাড়ির টানে শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়, লিখে তা পূর্ণাঙ্গ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
‘ঈদ সংখ্যা: প্রাপ্তি-প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক লেখায় ফখরুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন-‘টরন্টোর বিভিন্ন হাটবাজারে প্রবাসী বাঙালিদের ভিড় দেখলে মাঝে মধ্যে মনে হয়, লিটল বাংলাদেশেই আছি। কানাডার রাজধানী অটোয়ায় আছেন লুৎফর রহমান রিটন। ...রিটন বললেন, ঈদে অনেক কিছুই দেশের এখানে পান না। পাওয়ার কথাও নয়। তবে অনেক কিছুর মধ্যেও সবচেয়ে যে জিনিসের অভাব তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়, তা হলো ঈদ সংখ্যাগুলো’।*৩
প্রবাসে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে বা খোলা মাঠে। অবশ্যই তা নির্ভর করে আবহাওয়া আর ঋতুর উপর। টরন্টোসহ সারা কানাডায় বিপুল ঊৎসাহ উদ্দীপনায় মুসলিম সম্প্রদায় দু’দিনব্যাপী পবিত্র ঈদুল ফেতর পালন করে। একই ভাবে অটোয়া, মন্ট্রিয়ল, ক্যালগরি, সাসকাচুয়ান, ভ্যাঙ্কুভারেও ঈদ উদযাপিত হয়। দূতাবাসে আয়োজন করা হয় ঈদ পূনর্মিলনীর ।
টরন্টোর ড্যানফোর্থ অধ্যুষিত বাঙালিপাড়ায় ডেন্টনিয়া পার্কে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বায়তুল মোকাররম ও বায়তুল আমান মসজিদে আরো দু’টি ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী অংশ নেন।
ঈদের নামাজের পর যথারীতি বাংলাদেশি আমেজে কোলাকুলির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়। তারপর ঘরে ফিরে বাহারি খাবার, সেই সাথে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীদের আগমন ঈদের আনন্দের মাত্রা বৃদ্ধি করে আর সেই সাথে বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত চ্যানেলগুলোতে ঈদের অনুষ্ঠান উপভোগ।
অনেকেই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে চলে যান। আবার কেউ কেউ ঈদ করতে আসেন প্রবাসে। যেমনঃ ঈদুল ফিতর ২০১১-তে বাংলাদেশ থেকে আগত অনেক অতিথিও প্রবাসীদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন। তাদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ এমপি, সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর এমপি, প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রাহমান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, বিশিষ্ট লেখক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, অভিনেত্রী দিলারা জামান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নিউ ইয়র্কের ভারপ্রাপ্ত কনস্যুলার শাহেদুর রহমান প্রমুখ।
কানাডার ভেতর আলাদা সিডনি, দিল্লি, রোম, নিউ ইর্য়ক, লন্ডন শহর রয়েছে। অনেকেই তাতে বিভ্রান্ত হন। আমিও হয়েছি। অন্টারিওর ভেতর লন্ডন! সেই লন্ডনে ঈদ উদযাপন নিয়ে মাহাবুবুল হাসান নীরু লিখেছেন- ‘আমি প্রথম জামাতে নামাজ আদায় করি। নামাজের শেষে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় লন্ডনের মেয়র অ্যান ম্যারি দডিসিক্কোর সাথে।... ম্যারি ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেন, লন্ডনে সব ধর্মের, সব মানুষের মধ্যে সম্প্রতি ও সুন্দর সম্পর্ক নিশ্চিত করতে আমি সর্বদা বদ্ধ পরিকর।*৪
শুধু লন্ডনের মেয়র ম্যারিই নন; অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডেল্টন ম্যাকগুয়েন্টিও এসে হাজির হন ঈদের জামাতে। তিনিও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মূলধারার মিডিয়াগুলোও তা তুলে ধরে।
তবে সমস্যা হচ্ছে, ছুটি নিয়ে। দেশে যে ভাবে ঈদের দিন, ঈদের আগেও পরের দিন সরকারি ছুটি থাকে, প্রবাসে তা সম্ভব নয়। ফলে যে কোনো মুসলিম কর্মস্থল থেকে খুব সহজেই ধর্মীয় ঐচ্ছিক ছুটি নিতে পারে না। যা প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ে জন্যই প্রযোজ্য। কানাডা সরকার এক দিন ঈদের ছুটি দিতে সম্মত হলেও ঈদের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ নির্ধারণ করতে না পারায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
কানাডাজুড়ে ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতর দু’টোতেই দু’দিন করে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ‘মন্ট্রিয়লে ঈদ দু’দিন কেন’ শিরোনামে কাজী আলম বাবু লিখেছেন যে, প্রথমত, চাঁদ দেখার বিভ্রান্তি, দ্বিতীয়ত, দ্বিধাবিভক্ত কমিউনিটি, তৃতীয়ত, পশ্চিম ও প্রাচ্যের ভৌগলিক দূরত্ব তথা টাইম জোনের পার্থক্য সমস্যা, চতুর্থত, ইসলামিক বিধানের জটিলতা, পঞ্চমত, ঐকমত্যে সুনির্দিষ্ট ঘোষণার অভাব।*৫ ফলে এতে মুসলিম বিশ্বমৈত্রী আর মানববন্ধনের সংকট ফুটে উঠে।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী টরন্টোর ঈদ নিয়ে লিখেছেন- This year it also happened. Eid was celebrated on two days! One occasion, two celebrations! One group, dependent on verdict by Hilal committee opted for Eid on the second day. The one on Global Moon sighting committee preferred to celebrate Eid on first day, 30 August. Hilal group believes seeing the Eid moon with own eyes is all important. Where as, Global group relies more on science being debated through out the Muslim world and on scientific calculation and news of moon sighting from different parts of the world. This is a subject better to be left to the experts to dwell at.
Muslims in Canada celebrated on two days. And this has been happening for the last few years much to the disappointment of all. The main Eid Jamat of Greater Toronto Area was held at Metro Toronto Convention Center. Nearly 10,000 devotees offered their prayers here. Biggest congregation of the Bangladeshi Muslims was held at the Danforth Dentonia Park.
Prayers were held in local mosques. In Baitul Aman Masjid in Danforth, run by Danforth Community Center, three Jamats were held from 9 to 11 in the morning. All three Jamats had spilled over devotees. Here one feels at home though away from home! Only difference I was noticing was that here we were in the mosque under the constant surveillance of close circuit camera, like ‘big brother watching’ of Animal Farm ! *৬
ছুটি সংক্রান্ত জটিলতার জন্যই প্রবাসে পহেলা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (শনি/রোববার) করা হয়। ফলে দেখা যায়, নির্ধারিত দিন তারিখের আগের রোববার বা পরের শনিবার তা পালিত হচ্ছে।
প্রবাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঈদোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশের দু’একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর সাথে স্থানীয় শিল্পীরাও অংশ নেন। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জমজমাট মিলন মেলা বসে। কখনো কখনো ঈদের আগেও ঈদমেলা হয়।
প্রবাসে ঈদুল ফেতরের আগে পবিত্র রমজানে ঘরে ঘরে রোজার আয়োজন উপভোগ করার মতো। নানা রকমের ইফতারি আর নানা ধরনের সেহরির রান্না ও রোজার পূর্ণতা বাড়িয়ে দেয়।
আবার কেউ কেউ স্বজনদের সান্বিধ্যে ঈদ করার জন্য স্বদেশে চলে যায়। হয়ত কয়েক বছর পর সবার সাথে স্বদেশে, এর আনন্দই অন্যরকম। তবে প্রবাসে ব্যতিক্রম ঈদুল আজহায় অর্থাৎ কুরবানির ঈদে। এখানে যত্রতত্র, যেখানে সেখানে গরু-ছাগল, উট-দুম্বা জবাই করা বিধি অনুযায়ী নিষেধ। তাই যারা কুরবানি দিতে আগ্রহী, তারা নির্দিষ্ট মাংসের কারখানায় গিয়ে অগ্রিম বুকিং দিয়ে আসেন। তারপর যথাসময়ে সংগ্রহ।
এ সব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রবাসীরা আনন্দে-আবেগে ঈদ উৎসব পালন করে। মজার ব্যাপার, বাঙালি হিন্দু বা খ্রিস্টানেরাও এই উৎসবে শেয়ার করে। একই ভাবে বাঙালি মুসলমানেও পূজা-পার্বনে যোগ দেয়। ফলে প্রবাসে ঐক্য ও সাম্যর বন্ধনে ঈদের উৎসব নতুন মাত্রা পায়। সেই সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা দেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান।
তথ্যসূত্রঃ
১. ঈদের জামাতে উর্দূ/ রমু ইসলাম, সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, মার্চ ০১, ১৯৯৫, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
২. সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে, ১৪তম ৪২ সংখ্যা, টরন্টো, কানাডা
৩. দৈনিক আমার দেশ, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১১, ঢাকা
৪. সৌন্দর্যে আত্মহুতি/ মাহাবুবুল হাসান নীরু। প্রকাশকঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন। প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০১১, ঢাকা, পৃ-২৪/২৫
৫. মন্ট্রিয়লে ঈদ দু’দিন কেন/ কাজী আলম বাবু, সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, মার্চ ০১, ১৯৯৫, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
৬. Eid in North America by Fakharuzzan Chowdhury/ Daily Independent, September 23, 2011, Dhaka.
No comments