উত্তাল নরসিংদী by শাহেদ চৌধুরী ও প্রীতিরঞ্জন সাহা,
শান্তির শহর নরসিংদী এখন উত্তাল। বিক্ষুব্ধ জনতা বুধবার ট্রেনে আগুন দিয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজি আবদুস সাত্তারের শহরের বাড়িতে অগি্নসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে।এদিকে অফুরন্ত ভালোবাসা আর অশেষ শ্রদ্ধায় নরসিংদীর মাটি-মানুষের প্রিয় নেতা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনকে গতকাল বুধবার সমাহিত করা হয়। সর্বস্তরের লাখো মানুষ চোখের পানিতে তাকে শেষ বিদায় জানায়।
মঙ্গলবার রাতে শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন লোকমান হোসেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও লোকমান হোসেনের আত্মীয়স্বজনরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে এক প্রভাবশালী নেতা কলকাঠি নেড়েছেন বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন।
আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে আগামীকাল পর্যন্ত নরসিংদীর প্রতিটি বাড়ি এবং সব প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। শুক্রবার বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার দেশের ৩১১টি পৌরসভায় কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করা হবে।
একনজর দেখার জন্য :গতকাল ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই হাজার হাজার মানুষ লোকমান হোসেনকে একনজর দেখার জন্য তার বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে মরদেহ ঢাকা থেকে এসে পেঁৗছলে সেখানে অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। সমবেত সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। অনেকেই বুক চাপড়ে মাতম করতে থাকেন। নীরবে চোখের পানি ফেলেন। অনেককেই ডুকরে কাঁদতে দেখা গেছে।
এ সময় বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ ছিল। কিন্তু মানুষের চাপে ফটকটি খুলে যায়। পুলিশও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। ওই সময় থেকে বাদ আসর পর্যন্ত হাজারো মানুষ তাদের প্রিয় মেয়রকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা দু'লাইনে
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে লোকমান হোসেনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। লোকমান হোসেনের বাড়িতে তখন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
স্বর্ণপদকজয়ী দেশের শ্রেষ্ঠ মেয়র লোকমান হোসেনের মরদেহ প্রথমে রাখা হয় তার প্রিয় পৌরবাসীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। পরে কিছু সময়ের জন্য তার মরদেহ বাড়ির ভেতর নেওয়া হলে তার মা মাজেদা বেগম, স্ত্রী বুগলি বেগম, দুই সন্তান সালপি, নাজা, চার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল, খলিল, শাহীন, শামীম নেওয়াজ, তিন বোন রুবি, রোজি ও রেমিসহ আত্মীয়স্বজনরা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আর্তনাদ ও বুকফাটা আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দুপুর পৌনে ১টায় লোকমান হোসেনের মরদেহ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও হাজারো মানুষের অনুরোধে মরদেহ আবার বাসভবনে ফিরিয়ে আনা হয়।
জানাজায় লাখো মানুষ : নরসিংদীর মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে লোকমান হোসেনের প্রথম জানাজা বাদ আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মানুষের ভিড়ের কারণে তা হয়নি। এখানে জানাজা হয় মাগরিবের নামাজের আগে। জানাজায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বিকেলেই পুরো স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যায়। স্টেডিয়ামে এক চিলতে জায়গা না পেয়ে অনেককেই রাস্তার ওপর জানাজায় অংশ নিতে হয়েছে। নরসিংদীর ইতিহাসে আর কারও জানাজায় এত মানুষের উপস্থিতি ছিল না।
এখানে জানাজার পর লোকমান হোসেনের মরদেহ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগ অফিস ও পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে নেওয়া হয়। এসব জায়গায় শোকাহত মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। কাউরিয়াপাড়ায় পৌরসভার ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় দফা জানাজার পর তাকে রাত পৌনে ৭টায় শালিধা পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির জানান, আজ থেকে এ কবরস্থানে দরবার (সালিশ) শুরুর কথা ছিল মেয়র লোকমান হোসেনের। আজ তিনি সেই কবরস্থানেই শায়িত হলেন।
কে এই খুনি : এ নির্মম হত্যাকা ের কোনো কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় কয়েক বক্তা লোকমান হোসেন হত্যার জন্য এক শক্তিমান রাজনৈতিক নেতাকে দুষেছেন। তবে তারা কারও নাম উল্লেখ করেননি।
লোকমান হোসেনের ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ। তিনি বলেন, নরসিংদীবাসীর প্রাণপ্রিয় নেতা আর নেই। কী অপরাধ ছিল তার? এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। তিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ চাইলেও একজন লোকমান হোসেনকে খুন করে রাজনীতির মাঠ পরিষ্কার করতে পারবে না। তাই সজাগ থাকতে হবে। তিনি খুনিদের খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানান।
লোকমান হোসেনের আরেক ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, কার কাছে বিচার চাইব? জনগণ এ হত্যার বিচার করবে। আমাদের পরিবার জনতার কাছে বিচার চায়। কে বা কারা আমার ভাইকে খুন করেছে এবং খুন করিয়েছে_ সেটা আমি জানি। ইনশাল্লাহ নরসিংদীবাসী এর বিচার করবে। তিনি তাদের পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানান।
নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম কাইয়ুম বলেন, জনগণের ভালোবাসাই ছিল লোকমান হোসেনের অপরাধ। তিনি ছাত্রনেতা থেকে জননেতা হয়েছেন_ এটাই তার ত্রুটি। ষড়যন্ত্রের পরও তিনি দ্বিতীয় দফা মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন_ এটাই ছিল তার অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে খুন করা হয়েছে। লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তার কারণে বড় নেতারা কোণঠাসা হয়েছিলেন। এসব কারণেই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন লোকমান হোসেন। তাই ন্যায়বিচার হবে কি-না জানি না, তবে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ হত্যাকা ের কোনো সুরাহা না হলে নরসিংদীর জনগণ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে, যা বাংলাদেশে নজীরবিহীন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কোথা থেকে খুনিরা এসেছে তা স্থানীয় প্রশাসনকে বলতে হবে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার দাবি : আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক, নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক মোহন ও নরসিংদী-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন দ্রুত লোকমান হোসেন হত্যাকাদ্ধো জানাতে পারেননি।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউসার বলেছেন, যারা খুন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় তারাই লোকমান হোসেনকে হত্যা করেছে। মেয়র অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি গাজীপুরের টঙ্গী পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, ধৈর্যের একটা সীমা আছে। খুনিদের খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান এই হত্যাকা ের বিচার দাবি করেছেন। জেলা জাতীয় পার্টি সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিক আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেছেন। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম বলেছেন, 'লোকমান হোসেন হত্যার বিচার চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই।'
শান্ত থাকার আহ্বান : প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, 'দ্রুত খুনিদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে। আপনারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করুন। সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুন। সহিংসতায় জড়াবেন না।'
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু বলেছেন, 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। লোকমান হোসেন চলে গেছেন। আমরা বেঁচে আছি তার হত্যার বদলা নিতে।' ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত শেষে খুনিদের ফাঁসি দিতে হবে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেছেন, 'প্রশাসনের প্রতি আস্থা রাখুন। নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন পুরো ঘটনা মনিটরিং করছেন। তবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বেআইনি কাজ করার সুযোগ খুঁজছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।'
জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম বলেছেন, এই হত্যার বিচার হতেই হবে। এ জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তার পুরোটাই নিশ্চিত করবে স্থানীয় প্রশাসন। হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, এটা জেলা প্রশাসনের অঙ্গীকার।
লোকমানের পরিবারের মাঝে আওয়ামী লীগ নেতারা : জানাজার পর লোকমান হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা, স্ত্রী, সন্তান ও ভাই-বোনদের সান্ত্বনা জানান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন এবং উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এ সময় নিহতের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়লে সেখানে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা শোকার্ত স্বজনদের জানান, লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দেখছেন। শিগগির খুনিদের খুঁজে বের করে আইনের বিচারের আওতায় আনা হবে।
ট্রেনে আগুন, ভাংচুর : বিক্ষুব্ধ জনতা সকাল ১০টায় লোকমান হোসেনের বাড়ির সামনে বাসাইল রেলগেট এলাকায় গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ওপর জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। প্রথমে তারা রেলগেটের ব্যারিকেড ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর ট্রেন এগার সিন্ধুর ঘটনাস্থলে এসে পেঁৗছলে ক্ষুব্ধ জনতা রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে লাল ব্যানার দেখিয়ে ট্রেনটি থামানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তারা রেললাইনের ওপর গাছ ও কাঠ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ফলে ট্রেনটি থেমে যায়। এ সময় হাজার হাজার মানুষ ট্রেনটি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ওই সময় ট্রেনের ভেতরে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় উত্তেজিত জনতা প্রথমে যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়। পরে তারা ট্রেনে ব্যাপক ভাংচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। অগি্নকা ে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ ১৪টি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দুপুর ১টার দিকে ট্রেনের আগুন নেভায়। বেলা ২টার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনটিকে নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী জিনারদী স্টেশনে সরিয়ে নেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর কিছু লোককে ভস্মীভূত ট্রেনের লোহা-লক্কড় নিয়ে যেতে দেখা গেছে। রাত ৯টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নোয়াখালী রেলপথে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
আ'লীগ নেতার বাড়িতে আগুন : মেয়র লোকমান হোসেন নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে মঙ্গলবার রাতেই মেয়র সমর্থক ও উত্তেজিত জনতা নরসিংদী জেলা রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি, মন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত হাজী আবদুস সাত্তারের দাসপাড়াস্থ বাসভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করেছে। হাজী আবদুস সাত্তার জানান, রাত সাড়ে ১০টায় একটি বিশাল মিছিল এসে তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির আসবাবপত্র ভাংচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি ও তার পরিবারের লোকজন বাথরুমে গিয়ে রক্ষা পান। তিনি বলেন, লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল।
বিআরটিসি বাস ভাংচুর : এগার সিন্ধুর ট্রেনে অগি্নসংযোগের আগে সকাল পৌনে ১০টার দিকে ভেলানগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিআরটিসির একটি বাস ভাংচুর করেছে উত্তেজিত জনতা। তারা বাসটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাসটি ঢাকা থেকে আসছিল।
এদিকে নরসিংদী রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মরণ দাস জানান, মঙ্গলবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা আপাতত সম্ভব নয়। তবে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত টিমের রিপোর্ট পাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
শহরে থমথমে অবস্থা : শোকের নগরী নরসিংদীর সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লোকমান হোসেন হত্যাকা্রেদ্ধা জানাতে সবাই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছেন। শোকাহত মানুষ বাকরুদ্ধ।
শহরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। ভোর থেকে শহরের মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। রাতেও এ টহল অব্যাহত ছিল। সন্ধ্যার পর পুরো শহরে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দেখে মনে হয়েছে, এটা যেন মৃতের নগরী। এক ধরনের আতঙ্ক আর অজানা আশঙ্কায় ভুগছে মানুষ।
জেলা ছাত্রলীগ তিন দিনের হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করলেও জানাজা এবং দাফনের জন্য বিকেল ৫টা পর্যন্ত হরতাল স্থগিত ছিল। তারপরও শহরে কোনো যানবাহন চলেনি।
বাস চলাচল পরিস্থিতি : সকাল থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ আশপাশ এলাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। যার কারণে বিভিন্ন স্থানে আটকেপড়া বাসযাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দুপুরের পর থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও তা ছিল সীমিত।
দু'দিনের কর্মসূচি : আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত নরসিংদীর প্রতিটি বাড়ি এবং সব প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিল, বিশেষ দোয়া, বাদ জুমা জেলার সব মসজিদে মিলাদ, মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আজ থেকে দু'দিন কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ করবে। এর আগে সকালে নরসিংদী আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে জরুরি সভা করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এ সময় অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, আবদুল মতিন ভূঁইয়া, আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, আসাদুজ্জামান খোকন, অ্যাডভোকেট এসএ হাদী, অ্যাডভোকেট ফজলুল হক, আতাউর রহমান পিয়াল, বিজয় গোস্বামী, রঞ্জন সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মেয়র অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, আজ বৃহস্পতিবার দেশের ৩১১টি পৌরসভায় কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করা হবে।
লোকমান হোসেনের কর্মস্থল নরসিংদী পৌরসভায় গতকাল সকালে প্যানেল পৌর মেয়র জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠক করেছে পৌর পরিষদ। পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির জানিয়েছেন, আজ বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ১৫ দিন শোক দিবস পালন করা হবে। আগামী ১৬ নভেম্বর পৌরসভা মিলনায়তনে শোকসভা, জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ ও মানববন্ধন করা হবে। এ ছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে শোকের প্রতীক কালো ব্যানার টাঙ্গানো হবে।
গ্রেফতার হয়েছেন যারা : লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনকে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে নরসিংদী সদর উপজেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম, স্থানীয় বিএনপির কর্মী তৌহিদ সরকার, সঞ্জীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেনকে।
খায়রুল কবীর খোকনের বাড়ি লোকমান হোসেনের বাড়ির পাশে চিনিশপুরে। গত সংসদ নির্বাচনে খায়রুল কবীর খোকনের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক সমকালকে বলেছেন, খায়রুল কবীর খোকনকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা তার জানা নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ : মঙ্গলবার রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে মেয়র লোকমান হোসেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় তার বাম পাশে বসা ছিলেন নরসিংদী কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, লোকমান হোসেনের ডান পাশে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া ও বাম পাশে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াসহ সাত থেকে আটজন নেতাকর্মী বসা ছিলেন।
অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন। সবাই জীবন বাঁচাতে শুয়ে পড়েন। ওই সময় মেয়রকে জেলা ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি জুবায়ের ভূঁইয়াসহ শ্যামল সাহা ও সুদীপ্ত সাহা রিকশায় করে দ্রুত নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান।
এ সময় সবাইকে নিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলেন লোকমান হোসেন। ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়ে লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় মেয়র উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ওই তরুণ পরপর আরও চার রাউন্ড গুলি ছুড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তরুণটি দেখতে সুন্দর। সে মুখোশধারী ছিল। দু'চোখ ছাড়া তার মুখম লের কিছুই দেখা যায়নি। তার পরনে ছিল নীল রঙের গেঞ্জি ও কালো রঙের জিন্সের প্যান্ট।
অহিভূষণ চক্রবর্তী বলেছেন, গত সাত-আট দিন ধরে নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে আসতেন লোকমান হোসেন। সব সময় তার সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ কর্মী থাকতেন। গতকাল তিনি অফিসে এসে কর্মীদের চা পান করিয়ে বিদায় করে দেন। পরে তিনি নেতাদের জন্য মুড়ি আনেন।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে : নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ ছয় বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকের গ্রেফতারের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় খোকনের চিনিশপুরের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদী জেলা বিএনপি আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক খোকনের স্ত্রী শিরিন সুলতানা, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, সহ-সভাপতি সুলতান উদ্দিন মোল্লা, সাংগঠনিক সম্পাদক দীন মোহাম্মদ দীপু, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সমির ভূঁইয়া, নরসিংদী শহর বিএনপির সভাপতি গোলাম কবির কামাল প্রমুখ। বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। নিজেদের দায় বিএনপির কাঁধে চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলসহ প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করার অসৎ উদ্দেশ্যে খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি নেতা জায়েদুল ইসলাম, তৌহিদ সরকার, সজীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেনকে। বিনা মামলায় বিনা ওয়ারেন্টে বিএনপির এসব নেতাকে গ্রেফতার করে সারাদিন জেল সুপারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। পরে সন্ধ্যায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে সন্দেহে তাদের বিরুদ্ধে ৫৪ ধারায় মামলা করে আদালতে পাঁচদিনের রিমান্ড দাবি করে পুলিশ, যা বিএনপির নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর সরকারি জুলুম। তারা এ ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার ও জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি করেন। এ ছাড়া বক্তারা মেয়র লোকমান হত্যার তীব্র নিন্দা জানান এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তারা অবিলম্বে প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইন আমলে নেওয়ার দাবি জানান।
রাষ্ট্রপতিসহ বিভিন্ন মহলের শোক : রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার রাতে তিনি অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নিহত হন। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রপতি নরসিংদী মেয়রের এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সৈয়দ আশরাফ বুধবার এক শোক বিবৃতিতে মরহুম লোকমান হোসেনের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, গুণগ্রাহী, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীসহ সবার প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে এছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন তারা হলেন_ জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নরসিংদী জেলা শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এসএম আলতাফ হোসেন, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম মোঃ শহিদ খান, ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম।
আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে আগামীকাল পর্যন্ত নরসিংদীর প্রতিটি বাড়ি এবং সব প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। শুক্রবার বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার দেশের ৩১১টি পৌরসভায় কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করা হবে।
একনজর দেখার জন্য :গতকাল ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই হাজার হাজার মানুষ লোকমান হোসেনকে একনজর দেখার জন্য তার বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে মরদেহ ঢাকা থেকে এসে পেঁৗছলে সেখানে অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। সমবেত সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। অনেকেই বুক চাপড়ে মাতম করতে থাকেন। নীরবে চোখের পানি ফেলেন। অনেককেই ডুকরে কাঁদতে দেখা গেছে।
এ সময় বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ ছিল। কিন্তু মানুষের চাপে ফটকটি খুলে যায়। পুলিশও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। ওই সময় থেকে বাদ আসর পর্যন্ত হাজারো মানুষ তাদের প্রিয় মেয়রকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা দু'লাইনে
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে লোকমান হোসেনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। লোকমান হোসেনের বাড়িতে তখন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
স্বর্ণপদকজয়ী দেশের শ্রেষ্ঠ মেয়র লোকমান হোসেনের মরদেহ প্রথমে রাখা হয় তার প্রিয় পৌরবাসীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। পরে কিছু সময়ের জন্য তার মরদেহ বাড়ির ভেতর নেওয়া হলে তার মা মাজেদা বেগম, স্ত্রী বুগলি বেগম, দুই সন্তান সালপি, নাজা, চার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল, খলিল, শাহীন, শামীম নেওয়াজ, তিন বোন রুবি, রোজি ও রেমিসহ আত্মীয়স্বজনরা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আর্তনাদ ও বুকফাটা আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দুপুর পৌনে ১টায় লোকমান হোসেনের মরদেহ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও হাজারো মানুষের অনুরোধে মরদেহ আবার বাসভবনে ফিরিয়ে আনা হয়।
জানাজায় লাখো মানুষ : নরসিংদীর মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে লোকমান হোসেনের প্রথম জানাজা বাদ আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মানুষের ভিড়ের কারণে তা হয়নি। এখানে জানাজা হয় মাগরিবের নামাজের আগে। জানাজায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বিকেলেই পুরো স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যায়। স্টেডিয়ামে এক চিলতে জায়গা না পেয়ে অনেককেই রাস্তার ওপর জানাজায় অংশ নিতে হয়েছে। নরসিংদীর ইতিহাসে আর কারও জানাজায় এত মানুষের উপস্থিতি ছিল না।
এখানে জানাজার পর লোকমান হোসেনের মরদেহ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগ অফিস ও পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে নেওয়া হয়। এসব জায়গায় শোকাহত মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। কাউরিয়াপাড়ায় পৌরসভার ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় দফা জানাজার পর তাকে রাত পৌনে ৭টায় শালিধা পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির জানান, আজ থেকে এ কবরস্থানে দরবার (সালিশ) শুরুর কথা ছিল মেয়র লোকমান হোসেনের। আজ তিনি সেই কবরস্থানেই শায়িত হলেন।
কে এই খুনি : এ নির্মম হত্যাকা ের কোনো কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় কয়েক বক্তা লোকমান হোসেন হত্যার জন্য এক শক্তিমান রাজনৈতিক নেতাকে দুষেছেন। তবে তারা কারও নাম উল্লেখ করেননি।
লোকমান হোসেনের ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ। তিনি বলেন, নরসিংদীবাসীর প্রাণপ্রিয় নেতা আর নেই। কী অপরাধ ছিল তার? এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। তিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ চাইলেও একজন লোকমান হোসেনকে খুন করে রাজনীতির মাঠ পরিষ্কার করতে পারবে না। তাই সজাগ থাকতে হবে। তিনি খুনিদের খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানান।
লোকমান হোসেনের আরেক ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, কার কাছে বিচার চাইব? জনগণ এ হত্যার বিচার করবে। আমাদের পরিবার জনতার কাছে বিচার চায়। কে বা কারা আমার ভাইকে খুন করেছে এবং খুন করিয়েছে_ সেটা আমি জানি। ইনশাল্লাহ নরসিংদীবাসী এর বিচার করবে। তিনি তাদের পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানান।
নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম কাইয়ুম বলেন, জনগণের ভালোবাসাই ছিল লোকমান হোসেনের অপরাধ। তিনি ছাত্রনেতা থেকে জননেতা হয়েছেন_ এটাই তার ত্রুটি। ষড়যন্ত্রের পরও তিনি দ্বিতীয় দফা মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন_ এটাই ছিল তার অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে খুন করা হয়েছে। লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তার কারণে বড় নেতারা কোণঠাসা হয়েছিলেন। এসব কারণেই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন লোকমান হোসেন। তাই ন্যায়বিচার হবে কি-না জানি না, তবে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ হত্যাকা ের কোনো সুরাহা না হলে নরসিংদীর জনগণ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে, যা বাংলাদেশে নজীরবিহীন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কোথা থেকে খুনিরা এসেছে তা স্থানীয় প্রশাসনকে বলতে হবে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার দাবি : আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক, নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক মোহন ও নরসিংদী-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন দ্রুত লোকমান হোসেন হত্যাকাদ্ধো জানাতে পারেননি।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউসার বলেছেন, যারা খুন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় তারাই লোকমান হোসেনকে হত্যা করেছে। মেয়র অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি গাজীপুরের টঙ্গী পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, ধৈর্যের একটা সীমা আছে। খুনিদের খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান এই হত্যাকা ের বিচার দাবি করেছেন। জেলা জাতীয় পার্টি সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিক আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেছেন। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম বলেছেন, 'লোকমান হোসেন হত্যার বিচার চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই।'
শান্ত থাকার আহ্বান : প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, 'দ্রুত খুনিদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে। আপনারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করুন। সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুন। সহিংসতায় জড়াবেন না।'
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু বলেছেন, 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। লোকমান হোসেন চলে গেছেন। আমরা বেঁচে আছি তার হত্যার বদলা নিতে।' ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত শেষে খুনিদের ফাঁসি দিতে হবে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেছেন, 'প্রশাসনের প্রতি আস্থা রাখুন। নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন পুরো ঘটনা মনিটরিং করছেন। তবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বেআইনি কাজ করার সুযোগ খুঁজছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।'
জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম বলেছেন, এই হত্যার বিচার হতেই হবে। এ জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তার পুরোটাই নিশ্চিত করবে স্থানীয় প্রশাসন। হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, এটা জেলা প্রশাসনের অঙ্গীকার।
লোকমানের পরিবারের মাঝে আওয়ামী লীগ নেতারা : জানাজার পর লোকমান হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা, স্ত্রী, সন্তান ও ভাই-বোনদের সান্ত্বনা জানান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন এবং উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এ সময় নিহতের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়লে সেখানে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা শোকার্ত স্বজনদের জানান, লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দেখছেন। শিগগির খুনিদের খুঁজে বের করে আইনের বিচারের আওতায় আনা হবে।
ট্রেনে আগুন, ভাংচুর : বিক্ষুব্ধ জনতা সকাল ১০টায় লোকমান হোসেনের বাড়ির সামনে বাসাইল রেলগেট এলাকায় গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ওপর জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। প্রথমে তারা রেলগেটের ব্যারিকেড ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর ট্রেন এগার সিন্ধুর ঘটনাস্থলে এসে পেঁৗছলে ক্ষুব্ধ জনতা রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে লাল ব্যানার দেখিয়ে ট্রেনটি থামানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তারা রেললাইনের ওপর গাছ ও কাঠ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ফলে ট্রেনটি থেমে যায়। এ সময় হাজার হাজার মানুষ ট্রেনটি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ওই সময় ট্রেনের ভেতরে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় উত্তেজিত জনতা প্রথমে যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়। পরে তারা ট্রেনে ব্যাপক ভাংচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। অগি্নকা ে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ ১৪টি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দুপুর ১টার দিকে ট্রেনের আগুন নেভায়। বেলা ২টার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনটিকে নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী জিনারদী স্টেশনে সরিয়ে নেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর কিছু লোককে ভস্মীভূত ট্রেনের লোহা-লক্কড় নিয়ে যেতে দেখা গেছে। রাত ৯টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নোয়াখালী রেলপথে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
আ'লীগ নেতার বাড়িতে আগুন : মেয়র লোকমান হোসেন নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে মঙ্গলবার রাতেই মেয়র সমর্থক ও উত্তেজিত জনতা নরসিংদী জেলা রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি, মন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত হাজী আবদুস সাত্তারের দাসপাড়াস্থ বাসভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করেছে। হাজী আবদুস সাত্তার জানান, রাত সাড়ে ১০টায় একটি বিশাল মিছিল এসে তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির আসবাবপত্র ভাংচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি ও তার পরিবারের লোকজন বাথরুমে গিয়ে রক্ষা পান। তিনি বলেন, লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল।
বিআরটিসি বাস ভাংচুর : এগার সিন্ধুর ট্রেনে অগি্নসংযোগের আগে সকাল পৌনে ১০টার দিকে ভেলানগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিআরটিসির একটি বাস ভাংচুর করেছে উত্তেজিত জনতা। তারা বাসটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাসটি ঢাকা থেকে আসছিল।
এদিকে নরসিংদী রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মরণ দাস জানান, মঙ্গলবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা আপাতত সম্ভব নয়। তবে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত টিমের রিপোর্ট পাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
শহরে থমথমে অবস্থা : শোকের নগরী নরসিংদীর সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লোকমান হোসেন হত্যাকা্রেদ্ধা জানাতে সবাই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছেন। শোকাহত মানুষ বাকরুদ্ধ।
শহরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। ভোর থেকে শহরের মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। রাতেও এ টহল অব্যাহত ছিল। সন্ধ্যার পর পুরো শহরে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দেখে মনে হয়েছে, এটা যেন মৃতের নগরী। এক ধরনের আতঙ্ক আর অজানা আশঙ্কায় ভুগছে মানুষ।
জেলা ছাত্রলীগ তিন দিনের হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করলেও জানাজা এবং দাফনের জন্য বিকেল ৫টা পর্যন্ত হরতাল স্থগিত ছিল। তারপরও শহরে কোনো যানবাহন চলেনি।
বাস চলাচল পরিস্থিতি : সকাল থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ আশপাশ এলাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। যার কারণে বিভিন্ন স্থানে আটকেপড়া বাসযাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দুপুরের পর থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও তা ছিল সীমিত।
দু'দিনের কর্মসূচি : আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত নরসিংদীর প্রতিটি বাড়ি এবং সব প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিল, বিশেষ দোয়া, বাদ জুমা জেলার সব মসজিদে মিলাদ, মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আজ থেকে দু'দিন কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ করবে। এর আগে সকালে নরসিংদী আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে জরুরি সভা করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এ সময় অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, আবদুল মতিন ভূঁইয়া, আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, আসাদুজ্জামান খোকন, অ্যাডভোকেট এসএ হাদী, অ্যাডভোকেট ফজলুল হক, আতাউর রহমান পিয়াল, বিজয় গোস্বামী, রঞ্জন সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মেয়র অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, আজ বৃহস্পতিবার দেশের ৩১১টি পৌরসভায় কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করা হবে।
লোকমান হোসেনের কর্মস্থল নরসিংদী পৌরসভায় গতকাল সকালে প্যানেল পৌর মেয়র জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠক করেছে পৌর পরিষদ। পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির জানিয়েছেন, আজ বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ১৫ দিন শোক দিবস পালন করা হবে। আগামী ১৬ নভেম্বর পৌরসভা মিলনায়তনে শোকসভা, জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ ও মানববন্ধন করা হবে। এ ছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে শোকের প্রতীক কালো ব্যানার টাঙ্গানো হবে।
গ্রেফতার হয়েছেন যারা : লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনকে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে নরসিংদী সদর উপজেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম, স্থানীয় বিএনপির কর্মী তৌহিদ সরকার, সঞ্জীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেনকে।
খায়রুল কবীর খোকনের বাড়ি লোকমান হোসেনের বাড়ির পাশে চিনিশপুরে। গত সংসদ নির্বাচনে খায়রুল কবীর খোকনের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক সমকালকে বলেছেন, খায়রুল কবীর খোকনকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা তার জানা নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ : মঙ্গলবার রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে মেয়র লোকমান হোসেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় তার বাম পাশে বসা ছিলেন নরসিংদী কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, লোকমান হোসেনের ডান পাশে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া ও বাম পাশে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াসহ সাত থেকে আটজন নেতাকর্মী বসা ছিলেন।
অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন। সবাই জীবন বাঁচাতে শুয়ে পড়েন। ওই সময় মেয়রকে জেলা ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি জুবায়ের ভূঁইয়াসহ শ্যামল সাহা ও সুদীপ্ত সাহা রিকশায় করে দ্রুত নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান।
এ সময় সবাইকে নিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলেন লোকমান হোসেন। ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়ে লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় মেয়র উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ওই তরুণ পরপর আরও চার রাউন্ড গুলি ছুড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তরুণটি দেখতে সুন্দর। সে মুখোশধারী ছিল। দু'চোখ ছাড়া তার মুখম লের কিছুই দেখা যায়নি। তার পরনে ছিল নীল রঙের গেঞ্জি ও কালো রঙের জিন্সের প্যান্ট।
অহিভূষণ চক্রবর্তী বলেছেন, গত সাত-আট দিন ধরে নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে আসতেন লোকমান হোসেন। সব সময় তার সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ কর্মী থাকতেন। গতকাল তিনি অফিসে এসে কর্মীদের চা পান করিয়ে বিদায় করে দেন। পরে তিনি নেতাদের জন্য মুড়ি আনেন।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে : নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ ছয় বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকের গ্রেফতারের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় খোকনের চিনিশপুরের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদী জেলা বিএনপি আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক খোকনের স্ত্রী শিরিন সুলতানা, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, সহ-সভাপতি সুলতান উদ্দিন মোল্লা, সাংগঠনিক সম্পাদক দীন মোহাম্মদ দীপু, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সমির ভূঁইয়া, নরসিংদী শহর বিএনপির সভাপতি গোলাম কবির কামাল প্রমুখ। বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। নিজেদের দায় বিএনপির কাঁধে চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলসহ প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করার অসৎ উদ্দেশ্যে খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি নেতা জায়েদুল ইসলাম, তৌহিদ সরকার, সজীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেনকে। বিনা মামলায় বিনা ওয়ারেন্টে বিএনপির এসব নেতাকে গ্রেফতার করে সারাদিন জেল সুপারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। পরে সন্ধ্যায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে সন্দেহে তাদের বিরুদ্ধে ৫৪ ধারায় মামলা করে আদালতে পাঁচদিনের রিমান্ড দাবি করে পুলিশ, যা বিএনপির নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর সরকারি জুলুম। তারা এ ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার ও জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি করেন। এ ছাড়া বক্তারা মেয়র লোকমান হত্যার তীব্র নিন্দা জানান এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তারা অবিলম্বে প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইন আমলে নেওয়ার দাবি জানান।
রাষ্ট্রপতিসহ বিভিন্ন মহলের শোক : রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার রাতে তিনি অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নিহত হন। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রপতি নরসিংদী মেয়রের এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সৈয়দ আশরাফ বুধবার এক শোক বিবৃতিতে মরহুম লোকমান হোসেনের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, গুণগ্রাহী, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীসহ সবার প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
লোকমান হোসেনের মৃত্যুতে এছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন তারা হলেন_ জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নরসিংদী জেলা শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এসএম আলতাফ হোসেন, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম মোঃ শহিদ খান, ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম।
No comments