গরুর হাট-বেপারিরা হয়রানির শিকার আছে জাল টাকার আতঙ্ক by ওমর ফারুক ও এস এম আজাদ

রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে ভিড় বেড়েছে। শুরু হয়ে গেছে অস্থায়ী ১৭টি হাটের কার্যক্রম। তবে গরু বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, রাজধানীর পথে পথে তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে। জাল টাকার আতঙ্কও তাড়া করছে তাঁদের। গতকাল বুধবার সরেজমিনে ৯টি হাট ঘুরে একটি ছাড়া অন্য কোনো হাটে জাল টাকার যন্ত্র বসাতে দেখা যায়নি। অবশ্য নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যেই কোনো কোনো হাটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ গরুর হাট উচ্ছেদসহ অনিয়ম রোধে অভিযান শুরু করেছেন।


গতকাল রাজধানীর সায়েদাবাদ বালুর মাঠে অবৈধ পশুর হাট উচ্ছেদ করা হয় বলে ডিসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খলিল আহমেদ জানিয়েছেন।
হয়রানিতে গরু ব্যবসায়ীরা : কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা ও গরু ব্যবসায়ী হাফিজ উদ্দিন ট্রাকে করে ১৫টি গরু নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকার লাল মসজিদ রোডের হাটে যাচ্ছিলেন। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে পুরান
ঢাকার সাদেক হোসেন খোকা মাঠের কাছে দুটি মোটরসাইকেলে করে চার যুবক ট্রাকটির গতি রোধ করে। তারা জানায়, এই গরু সাদেক হোসেন খোকা মাঠে বিক্রি করতে হবে। এ সময় গরু ব্যবসায়ী হাফিজ উদ্দিন ও তাঁর সঙ্গীরা অনুনয়-বিনয় করলেও যুবকরা কান দেয়নি। একপর্যায়ে তারা ট্রাকচালককেও মারধর করতে উদ্যত হয়। এ অবস্থায় গরু ব্যবসায়ী সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের কাছে গিয়ে বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু পুলিশও হাটের লোকজনের পক্ষ নেয়। গতকাল বিকেলে গরু ব্যবসায়ী হাফিজ ছলছল চোখে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেশে কোনো বিচার নাই। আশা করছিলাম, পুলিশকে বললে কাজ হবে। কিন্তু কিছুই হলো না।'
সাদেক হোসেন খোকা মঠে দায়িত্বরত গেণ্ডারিয়া থানার এএসআই জাহিদ স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একটি ট্রাক থামিয়ে জোর করে গরু নামানোর সময় ব্যবসায়ীরা আমার কাছে এসেছিল। আমি তখন হাট কমিটির লোকজনকে নিষেধ করি। কিন্তু তারা আমার কথা শুনতে না চাইলে আমি টহল দলকে ফোন করি। এ সময় ট্রাক ছেড়ে দিলে ট্রাক চলে যায়।' পুলিশ এ দাবি করলেও ওই গরু ব্যবসায়ী সাদেক হোসেন খোকা মাঠে দাঁড়িয়েই অভিযোগ করছিলেন।
সাদেক হোসেন খোকা মাঠের ইজারাদার হাজি সারোয়ার হোসেন আলো বলেন, 'রাতে আমি ছিলাম না। বিষয়টা বলতে পারব না।' একপর্যায়ে তিনি বলেন, 'আমাদের লোকজন ট্রাককে থামাতে বলতেই পারে।'
একই ধরনের অভিযোগ করলেন গরু ব্যবসায়ী ওহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার ঘরচাপড়া গ্রাম থেকে কয়েকটি গরু ট্রাকে করে ঢাকার নয়াবাজার আরমানিটোলা হাটে নিয়ে যাচ্ছিলেন। গতকাল বুধবার ভোর রাতে ট্রাকটি বারিধারা নতুন বাজার হাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক যুবক ট্রাকটির গতি রোধ করে জোর করে গরু নামিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা আরো সাতজন বাধা দেয়। টানা-হেঁচড়ার একপর্যায়ে ঘটনাস্থলের দিকে র‌্যাবের গাড়ি আসতে দেখে যুবকরা পালিয়ে যায়। পরে তিনি নির্বিঘ্নে ট্রাক নিয়ে আরমানিটোলায় পেঁৗছান। ওহিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাত বছর ধরে গরুর ব্যবসা করি। তখন থেকেই আরমানিটোলা বাজারে গরু নিয়া আসি। অন্য হাটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নাই।' এ সময় ওহিদুলের সঙ্গে থাকা এক যুবক বলেন, 'র‌্যাবের গাড়ি না এলে জান দিয়ে দিতাম, তবে গরু দিতাম না।'
বসেনি যন্ত্র ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা : গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠ, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ, আরমানিটোলা (নয়াবাজার), বারিধারা নতুন বাজার, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন বালুর মাঠ বাজারে গিয়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও জাল টাকা চিহ্নিতকরণ মেশিন দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, পুরোদমে হাট না জমার কারণে মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে না। তবে বৃহস্পতিবার থেকে ব্যবহার শুরু হবে।
পোস্তগোলা শ্মশানঘাট হাটটি পরিচালনা করছে বুড়িগঙ্গা সমাজকল্যাণ সংঘ। এ সংগঠনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান নিজস্ব উদ্যোগে জাল টাকা চিহ্নিত করার যন্ত্র কিনে কাউন্টারে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। আগারগাঁও হাটের দুই পাশেই বাঁশের বেড়ায় হাজার হাজার গরু-ছাগল জড়ো করা হয়েছে। ইজারাদার নূর মোহাম্মদ হাজির হদিস নেই কয়েক দিন ধরেই। তাঁর প্রতিনিধি আকরাম হোসেন ও আবদুর রহিম জানান, হাটে তিনটি জাল টাকা পরীক্ষার মেশিন বসানো হবে। থাকছে ছয়টি হাসিলঘর। তবে গতকাল বিকেল পর্যন্ত এগুলো কার্যকর হয়নি। কাকলী-বনানী হাটেও অনেক গরু উঠেছে। ইজারাদার আকতারুজ্জামানের প্রতিনিধি বশির আহমেদ জানান, নিজেরা আটটি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দুটিসহ মোট চারটি জাল টাকা পরীক্ষার মেশির বসানোর কাজ করছেন। কাজ করছে ১০০ স্বেচ্ছাসেবী।
জানা গেছে, গাবতলী পশুর হাটে ৯টি হাসিলঘর স্থাপন করা হয়েছে। এসব ঘরে থাকছে টাকা পরীক্ষার যন্ত্র। হাটের প্রবেশমুখে পুলিশ ও র‌্যাবের কন্ট্রোলরুম বসানো হয়েছে। দারুস সালাম থানার ওসি আবদুল মালেক বলেন, হাটে সাতটি কন্ট্রোলরুম, ১৬টি সিসি ক্যামেরা ও আটটি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া একজন ডিসির নেতৃত্বে সাড়ে ৫০০ পুলিশ সদস্য এখানে নিরাপত্তায় কাজ করছেন।
হাটে গরু রাখতে লাগে টাকা : গতকাল দুপুর পৌনে ২টা। গাবতলী পশুর হাটে গোয়ালন্দ থেকে চারটি গরু নিয়ে আসেন বেপারি গোলাপ। বাঁশের সঙ্গে গরু বাঁধতে গেলেই বাধা দেন এক যুবক। 'এই মিয়া চার হাজার ট্যাকা লাগব। না হইলে বাঁইধেন না।' যুবকের কথা শুনে 'থাক রাখমু না ভাই' বলে গোলাপ সরে যাচ্ছিলেন। পরে গোলাপসহ কয়েকজন গরু বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গাবতলী হাটের বর্ধিত অংশে পশু রাখতে টাকা দেওয়া লাগে। পশুর হাটের বাঁ পাশে বালুর আড়তদাররা অস্থায়ী বাঁশের বেড়া দিয়ে সেখান থেকে ইচ্ছেমতোই টাকা আদায় করেন। মূল হাটে জায়গা না পেলে ওই স্থানে গরু রাখতে যান বিক্রেতারা। সাহাবুল নামের এক টাকা আদায়কারী জানান, তাঁরা তিন লাখ টাকা খরচ করে কিছু জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। তাই প্রতিটি গরুর জন্য তাঁরা চার হাজার টাকা করে আদায় করেন। হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমানের প্রতিনিধি রাকিব ইমরান বলেন, 'হাটে জায়গা না হওয়ায় বিক্রেতারা গরু নিয়ে বাইরে যান। এই সুযোগ কাজে লাগায় ওই স্থান ইজারা নেওয়া বালু ব্যবসায়ীরা। তবে পুরো এলাকা থেকে আমরা হাসিল আদায় করি। হয়রানির বিষয়টি প্রশাসন না দেখলে আমাদের কী করার আছে?'
নৌপুলিশের দেখা মেলেনি : পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গরু ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার জন্য নৌপুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। গতকাল দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৩টা নাগাদ সদরঘাট থেকে কেরানীগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতে কোনো পুলিশকে দেখতে পাওয়া যায়নি। পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন বালুর মাঠের হাটে দুপুরের দিকে গিয়ে দেখা যায়, হাট কমিটির বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাইকে বলা হচ্ছে, যদি কারো কাছে জাল টাকা পাওয়া যায় তা হলে যেন তারা ১ নম্বর কাউন্টারে যোগাযোগ করে। বাজারের আশপাশে বুড়িগঙ্গা নদীতে কোনো পুলিশ দেখতে পাওয়া যায়নি।
এদিকে পূর্বঘোষিত ১৩টি অস্থায়ী পশুর হাটের বাইরে আরো চারটি নতুন হাটের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ডিসিসি। হাটগুলো হচ্ছে বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, বারিধারা জি ব্লকের মাঠ ও পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন মাঠ। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আগামীকাল শুক্রবার থেকে হাট বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অথচ নির্ধারিত এ সময়ের আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে বসানো হচ্ছে হাট।
ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদন না নিয়ে নগরীর বারিধারা জে ব্লকের নূরের চালা, কুড়িল বিশ্বরোডসহ ইতিমধ্যে নগরীর বেশ কিছু স্থানে অবৈধভাবে পশুর হাট বসিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। পাশাপাশি অনুমোদন দেওয়া হাটগুলোতেও প্রস্তুতির নামে পশু আনতে শুরু করেছেন ইজারাদাররা।
গতকাল সায়েদাবাদের বালুর মাঠে ৫০০ গরু জড়ো করার পর অবৈধ পশুর হাটটি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ডিসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খলিল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হাটে বেশি টাকা হাসিল আদায়, রোগা গরু বিক্রি, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।'

No comments

Powered by Blogger.