নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডঃ কেন খুন, কারা করিয়েছে তা-ই এখন বড় প্রশ্ন by সেলিম জাহিদ
জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে কারা, কেন নৃশংসভাবে হত্যা করেছে—চরম শোকের মধ্যেও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে নরসিংদীবাসী। হত্যার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ এখানকার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষের আলোচনায় উঠে এসেছে। লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তা, দলের ভেতরে তাঁকে নিয়ে কয়েকজন নেতার অস্বস্তি, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বিরোধ, আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য লোকমানের প্রস্তুতি, দলের বাইরের কোনো পক্ষের সুযোগ নেওয়ার মতো বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হচ্ছে।
সরল ব্যাখ্যায়, স্থানীয় রাজনীতিতে লোকমান হোসেনের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এবং নরসিংদীতে সম্প্রতি সংঘটিত কিছু ঘটনা হত্যাকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটনে কাজে লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, লোকমান হোসেনের পরিবারের সদস্যরা একবাক্যে বলেছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু কারা এটি ঘটিয়েছে, সে ব্যাপারে কেউ সরাসরি কিছু বলতে পারছে না।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা অবশ্যই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দলের কেউ বা অন্য কোনো পক্ষ জড়িত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা কঠিন।’
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি অংশ ঘটনার জন্য নরসিংদী-৫ আসনের সাংসদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, তাঁর ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদের দিকে আঙুল তুলেছে।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ এ ধরনের ইঙ্গিতকে অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঝে সমস্যা থাকলেও বর্তমানে নরসিংদীর সব সাংসদ ও মন্ত্রীর মধ্যে একতা আছে। শুধু লোকমান ছাত্রলীগের একটি ঘটনায় একটু আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) ছিল। আমার ধারণা, তৃতীয় কোনো পক্ষ এ সুযোগটা নিতে পারে।’
এই তৃতীয় পক্ষ বিরোধী দল বা বিএনপির কেউ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যেও কেউ হতে পারে।’
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, গুলি করার আগমুহূর্তে লোকমান হোসেন দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলেন। এত নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা গুলি করে কীভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো, তাও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের অন্তত দেড় শ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। অথচ কেউ এগিয়ে এল না, এটা অবাক করা বিষয়।’ এর সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে, জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লোকমানের কারণে যাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে উঠছিল, এর সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দলের (আওয়ামী লীগ) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
লোকমান হোসেনের ভাই কামরুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এখনই আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। মামলা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ তবে লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ দুপুরের দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থাকতে পারে। আমরা বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি।’
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, অল্প দিনের মধ্যে লোকমান হোসেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই জনপ্রিয়তার নিচে নিজ দলের ও অন্য দলের অনেক নেতার স্বপ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কারও কারও প্রভাব-প্রতিপত্তিও কমে যাচ্ছিল। এটাই লোকমান হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার জনপ্রিয়তাই ওনার প্রধান প্রতিপক্ষ। তাঁর এই জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।’ একই কথা বলেন নরসিংদী সদর আসনের আওয়ামী লীগ সাংসদ নজরুল ইসলাম। লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এই সাংসদ বলেন, ‘নরসিংদীতে তাঁর চেয়ে জনপ্রিয় নেতা কেউ আছেন কি না, আমার জানা নেই।’
এই জনপ্রিয় নেতাকে কারা হত্যা করেছে, জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের সব সংস্থা সক্রিয়ভাবে তদন্তে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি নজরদারি করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে।
লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের একাধিক নেতা বলেন, মেয়র হিসেবে ব্যাপক সাফল্য এবং সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে কার্যত তিনি জেলার প্রভাবশালী নেতার ভূমিকায় উপনীত হন। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নরসিংদীর চারজন দলীয় সাংসদ এবং একজন মন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
আলোচনায় মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত করার ঘটনা: লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর বিরোধের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৫ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও মামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২২ অক্টোবর টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক লোকমানের পক্ষে। সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ লোকমান হোসেনের ছোট ভাই।
দলীয় সূত্র জানায়, মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে রায়পুরায় প্রতিবাদ-সমাবেশ করে ছাত্রলীগের রায়পুরা শাখার একটি অংশ। রায়পুরা থানা আওয়ামী লীগ গত ২৬ অক্টোবর বৈঠক করে আগামী ৪ নভেম্বর (শুক্রবার) রায়পুরা বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদ-সমাবেশের ডাক দেয়। এসব বিশ্লেষণ করে নেতা-কর্মীরা বলছেন, অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি মন্ত্রী ও তাঁর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
জানতে চাইলে মন্ত্রীর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পাল্টা কোনো কর্মসূচি আমরা নিইনি। আমরা মন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামনে রেখে একটি জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা তো আওয়ামী লীগ করেনি, ছাত্রলীগ করেছে। তাই ওটাকে আমরা গুরুত্ব দিইনি।’
জেলা আওয়ামী লীগ এবং বেপারীপাড়া: স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘকাল থেকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছিল শহরের বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক। জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত ছিলেন বেপারীপাড়ার নেতারা। এমনকি নরসিংদী পৌরসভার মেয়রের পদটিতেও এ এলাকার নেতারা মনোনয়ন পেতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলীর বাসিন্দা লোকমান হোসেন বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক এই নেতৃত্ব ভেঙে দেন। আধিপত্য ভেঙে দিয়ে নিজে মেয়র নির্বাচিত হন। গত পৌরসভা নির্বাচনেও তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বেপারীপাড়ার মতিন সরকার। মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় দলীয় কর্তৃত্ব অনেকটা তাঁর হাতে চলে আসে। এ কারণে আওয়ামী লীগের বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে।
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি লোকমানের: একাধিক সূত্র জানায়, লোকমান হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রার্থী রাজিউদ্দিন আহমেদের ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ। দুজনের বাড়িই নরসিংদীর রায়পুরা থানায়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ঠান্ডা লড়াই ছিল বলে জানান লোকমানের ঘনিষ্ঠজনেরা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, লোকমান হোসেন আগামী নির্বাচনে নরসিংদী সদর আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রার্থী হলে তাঁর বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল বলেও মনে করেন জেলার রাজনীতিকেরা।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি এস এম কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রীর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও হাজি সাত্তারকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের মুঠোফোনের কললিস্ট বের করলেই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। এখন সরকার সদিচ্ছা নিয়ে তদন্ত করলেই হয়।’ তিনি বলেন, ‘নরসিংদীতে অনেক জাতীয় নেতা আছেন, লোকমান ভাই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, এটাই তাঁর জন্য কাল হয়েছে।’
কাইয়ুম নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তিনি রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতি: গতকাল লোকমান হোসেনের জানাজায় নরসিংদীর লাখো মানুষ অংশ নেন। কিন্তু মন্ত্রীর ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেননি। বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকেও জানাজায় দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন নরসিংদীতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একটা পক্ষ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আমি যেহেতু মন্ত্রীর ভাই, সেখানে গেলে নতুন ইস্যু তৈরি হয় কি না, সে জন্য যাইনি।’ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন দেশের বাইরে আছেন বলে তিনি জানান।
খোকনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা কথা: এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেছেন, ‘খোকনকে প্রশাসন কী কারণে গ্রেপ্তার করেছে, সেটা তারাই জানে। আমরা কারও বিরুদ্ধে নালিশ দিইনি।’
তবে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বলেন, খোকন সন্ত্রাসী লালন করেন, খুনি লোকজন তাঁর সঙ্গে চলে। তাই এ ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা স্বাভাবিক।
তবে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘খোকনের গ্রেপ্তারের খবরে আমিও অবাক হয়েছি। বোঝা যাচ্ছে, এটা রাজনীতির ন্যাস্টি গেম (নোংরা খেলা)।’ তবে ছাত্রলীগের একজন নেতা দাবি করেন, মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কয়েকজন বিএনপি নেতার বাড়িতে গিয়েও তাঁদের পাওয়া যায়নি। তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, আজ লোকমান হত্যার ঘটনায় মামলা করা হতে পারে।
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা অবশ্যই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দলের কেউ বা অন্য কোনো পক্ষ জড়িত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা কঠিন।’
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি অংশ ঘটনার জন্য নরসিংদী-৫ আসনের সাংসদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, তাঁর ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদের দিকে আঙুল তুলেছে।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ এ ধরনের ইঙ্গিতকে অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঝে সমস্যা থাকলেও বর্তমানে নরসিংদীর সব সাংসদ ও মন্ত্রীর মধ্যে একতা আছে। শুধু লোকমান ছাত্রলীগের একটি ঘটনায় একটু আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) ছিল। আমার ধারণা, তৃতীয় কোনো পক্ষ এ সুযোগটা নিতে পারে।’
এই তৃতীয় পক্ষ বিরোধী দল বা বিএনপির কেউ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যেও কেউ হতে পারে।’
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, গুলি করার আগমুহূর্তে লোকমান হোসেন দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলেন। এত নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা গুলি করে কীভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো, তাও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের অন্তত দেড় শ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। অথচ কেউ এগিয়ে এল না, এটা অবাক করা বিষয়।’ এর সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে, জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লোকমানের কারণে যাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে উঠছিল, এর সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দলের (আওয়ামী লীগ) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
লোকমান হোসেনের ভাই কামরুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এখনই আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। মামলা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ তবে লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ দুপুরের দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থাকতে পারে। আমরা বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি।’
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, অল্প দিনের মধ্যে লোকমান হোসেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই জনপ্রিয়তার নিচে নিজ দলের ও অন্য দলের অনেক নেতার স্বপ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কারও কারও প্রভাব-প্রতিপত্তিও কমে যাচ্ছিল। এটাই লোকমান হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার জনপ্রিয়তাই ওনার প্রধান প্রতিপক্ষ। তাঁর এই জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।’ একই কথা বলেন নরসিংদী সদর আসনের আওয়ামী লীগ সাংসদ নজরুল ইসলাম। লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এই সাংসদ বলেন, ‘নরসিংদীতে তাঁর চেয়ে জনপ্রিয় নেতা কেউ আছেন কি না, আমার জানা নেই।’
এই জনপ্রিয় নেতাকে কারা হত্যা করেছে, জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের সব সংস্থা সক্রিয়ভাবে তদন্তে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি নজরদারি করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে।
লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের একাধিক নেতা বলেন, মেয়র হিসেবে ব্যাপক সাফল্য এবং সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে কার্যত তিনি জেলার প্রভাবশালী নেতার ভূমিকায় উপনীত হন। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নরসিংদীর চারজন দলীয় সাংসদ এবং একজন মন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
আলোচনায় মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত করার ঘটনা: লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর বিরোধের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৫ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও মামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২২ অক্টোবর টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক লোকমানের পক্ষে। সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ লোকমান হোসেনের ছোট ভাই।
দলীয় সূত্র জানায়, মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে রায়পুরায় প্রতিবাদ-সমাবেশ করে ছাত্রলীগের রায়পুরা শাখার একটি অংশ। রায়পুরা থানা আওয়ামী লীগ গত ২৬ অক্টোবর বৈঠক করে আগামী ৪ নভেম্বর (শুক্রবার) রায়পুরা বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদ-সমাবেশের ডাক দেয়। এসব বিশ্লেষণ করে নেতা-কর্মীরা বলছেন, অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি মন্ত্রী ও তাঁর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
জানতে চাইলে মন্ত্রীর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পাল্টা কোনো কর্মসূচি আমরা নিইনি। আমরা মন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামনে রেখে একটি জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা তো আওয়ামী লীগ করেনি, ছাত্রলীগ করেছে। তাই ওটাকে আমরা গুরুত্ব দিইনি।’
জেলা আওয়ামী লীগ এবং বেপারীপাড়া: স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘকাল থেকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছিল শহরের বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক। জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত ছিলেন বেপারীপাড়ার নেতারা। এমনকি নরসিংদী পৌরসভার মেয়রের পদটিতেও এ এলাকার নেতারা মনোনয়ন পেতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলীর বাসিন্দা লোকমান হোসেন বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক এই নেতৃত্ব ভেঙে দেন। আধিপত্য ভেঙে দিয়ে নিজে মেয়র নির্বাচিত হন। গত পৌরসভা নির্বাচনেও তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বেপারীপাড়ার মতিন সরকার। মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় দলীয় কর্তৃত্ব অনেকটা তাঁর হাতে চলে আসে। এ কারণে আওয়ামী লীগের বেপারীপাড়াকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে।
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি লোকমানের: একাধিক সূত্র জানায়, লোকমান হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রার্থী রাজিউদ্দিন আহমেদের ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ। দুজনের বাড়িই নরসিংদীর রায়পুরা থানায়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ঠান্ডা লড়াই ছিল বলে জানান লোকমানের ঘনিষ্ঠজনেরা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, লোকমান হোসেন আগামী নির্বাচনে নরসিংদী সদর আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রার্থী হলে তাঁর বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল বলেও মনে করেন জেলার রাজনীতিকেরা।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি এস এম কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রীর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও হাজি সাত্তারকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের মুঠোফোনের কললিস্ট বের করলেই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। এখন সরকার সদিচ্ছা নিয়ে তদন্ত করলেই হয়।’ তিনি বলেন, ‘নরসিংদীতে অনেক জাতীয় নেতা আছেন, লোকমান ভাই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, এটাই তাঁর জন্য কাল হয়েছে।’
কাইয়ুম নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তিনি রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতি: গতকাল লোকমান হোসেনের জানাজায় নরসিংদীর লাখো মানুষ অংশ নেন। কিন্তু মন্ত্রীর ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেননি। বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকেও জানাজায় দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন নরসিংদীতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একটা পক্ষ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আমি যেহেতু মন্ত্রীর ভাই, সেখানে গেলে নতুন ইস্যু তৈরি হয় কি না, সে জন্য যাইনি।’ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন দেশের বাইরে আছেন বলে তিনি জানান।
খোকনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা কথা: এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেছেন, ‘খোকনকে প্রশাসন কী কারণে গ্রেপ্তার করেছে, সেটা তারাই জানে। আমরা কারও বিরুদ্ধে নালিশ দিইনি।’
তবে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বলেন, খোকন সন্ত্রাসী লালন করেন, খুনি লোকজন তাঁর সঙ্গে চলে। তাই এ ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা স্বাভাবিক।
তবে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘খোকনের গ্রেপ্তারের খবরে আমিও অবাক হয়েছি। বোঝা যাচ্ছে, এটা রাজনীতির ন্যাস্টি গেম (নোংরা খেলা)।’ তবে ছাত্রলীগের একজন নেতা দাবি করেন, মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কয়েকজন বিএনপি নেতার বাড়িতে গিয়েও তাঁদের পাওয়া যায়নি। তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, আজ লোকমান হত্যার ঘটনায় মামলা করা হতে পারে।
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।
No comments