শেষ দিনে প্রতিরোধেরও স্বপ্নভঙ্গ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৩৫৫ ও ৩৮৩/৫ (ডিক্লে.)-বাংলাদেশ : ২৩১ ও ২৭৮-ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২২৯ রানে জয়ী by মাসুদ পারভেজ

সিরিজের ট্রফিটা পরম মমতায় কোলে নিয়ে 'দিস ইজ মাই বেবি, দিস ইজ মাই বেবি' বলতে বলতে সংবাদ সম্মেলনে এলেন ড্যারেন সামি! প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দই যেন খেলে যাচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের চোখে-মুখে। 'প্রথম'ই তো! নেতৃত্ব পাওয়ার পর এই প্রথম কোনো টেস্ট সিরিজ জিতলেন। তাও আবার এমন সময়ে সাফল্যটা এল, যখন ২০০৩ সালের নভেম্বরের পর থেকে দেশের বাইরে ক্যারিবীয়দের টেস্ট সিরিজ জয়ের আকাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হচ্ছিল কেবল।


আর ওপরে লাল ক্রিকেট বলের রেপ্লিকা বসানো ট্রফিটা তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার আগে বাংলাদেশের শেষ দিনের চ্যালেঞ্জটাও হলো সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর! জিততে হলে ৯০ ওভারে করতে হতো ৩৪৪। অথচ ৩৩.২ ওভারে ১১৪ রান যোগ হতেই সব শেষ। টেস্ট ক্রিকেটে স্বাগতিকদের অতীত বিবেচনায় আগের দিন নাঈম ইসলামের 'জেতার জন্যই নামব' ঘোষণাটা এ জন্য খুব একটা পাত্তাই পায়নি। অবশ্য একই কারণে ড্রয়ের কথা বললেও যে গুরুত্ব পেতেন, তাও নয়। এমন কত আশার রঙে রঙিন সকালই তো ব্যাটসম্যানদের 'নিজ গুণে' বিবর্ণ হয়ে গেছে! তাঁদের সামর্থ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাই প্রশ্ন ছিলই। আর সেটিকে ভুল প্রমাণের সুযোগ পায়ে ঠেলে কী অবলীলায়ই না তাঁরা হার মানলেন!
হার মানার এ পর্বটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। লাঞ্চ বিরতির আগে ও পরে। আগের ২৫ মিনিটে ১৮ বলের মধ্যে সাকিব আল হাসান ও অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের উইকেট হারিয়ে হারের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। আর লাঞ্চের পরে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে ক্যারিবীয়দের লাগে মোটে ৩০ মিনিট। এ আধা ঘণ্টায় ৭.২ ওভারে ১৫ রানে শেষ ৪ উইকেট হারিয়ে লেখা হলো ২২৯ রানের পরাজয়। সে হারের দিনে অধিনায়কের মতো 'প্রথম আনন্দে' ভেসেছেন দেবেন্দ্র বিশুও। সাত টেস্টের ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রবল সম্ভাবনার দীপ্তি তাঁর লেগ স্পিনে। কিন্তু ঢাকা টেস্টের শেষ দিনে এসেই ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার স্বাদ পেলেন প্রথম।
তার পরও বাংলাদেশের জন্য তিনি সত্যিই 'ভয়ংকর বিশু' হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হলো না মুশফিকুর রহিমের কথায়, 'আসলে ওদের বোলাররা আমাদের যত না আউট করেছে, আমরা নিজেরাই নিজেদের আউট করেছি তার চেয়ে বেশি।' এদিন স্বাগতিকদের সাত উইকেটের পাঁচটিই নেওয়ার কৃতিত্বের চেয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ভুলই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। তা পাওয়ার কথাও! তামিম ইকবালকে দিয়েই ভুলের সূচনা। আগের দিন ফিফটির পর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মাঝে এ বাঁ-হাতি ওপেনারের দলের জন্য বড় কিছু করার প্রত্যয়ই ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু এক রাতের মধ্যেই তা উবে যাওয়াটা তাঁর মুখোমুখি হওয়া নবম বলেই প্রমাণিত।
বিশুর করা দিনের তৃতীয় ওভারের শেষ ডেলিভারিটা ক্রিজ ছেড়ে না বেরোলেই হয়ে যেত হাফভলি। কিন্তু আগের দিনের ৮২-র সঙ্গে আর মাত্র ১ রান যোগ করা তামিম সেটা বেরিয়ে এসে কাভারের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গেলেন এবং ব্যাটের কানা নিয়ে বল চলে গেল স্লিপে ড্যারেন সামির হাতে। এরপর তামিমের বিদায়ের ধাক্কা সামলে নিতে শুরু করলেন মুশফিক-সাকিব এবং সেটা রানপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত হতে না দিয়েই। বিশু এক প্রান্ত থেকে ক্রমাগত রাফের ওপর বল ফেলে যাচ্ছিলেন। আর সেখান থেকে অফস্টাম্পের লাইনের বল বেশ কয়েকবারই কাট করে সীমানাছাড়া করলেন তাঁরা দুজন। ফিদেল এডওয়ার্ডসকে পুল করে বাউন্ডারি মেরে সাকিব যে কখন ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় ফিফটিতে পেঁৗছে গেলেন! এরও আগে একই বোলারকে কাভার বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে মুশফিকও তাই। তাঁদের শতরানের (শেষ পর্যন্ত ৮৮ রানের) দিকে এগোতে থাকা পার্টনারশিপে যখন লাঞ্চ পর্যন্ত সময়টা নিরাপদেই পার করে দেওয়ার অবস্থা, তখনই ছন্দপতন।
লাঞ্চের ২৫ মিনিট আগে। সামির বলে 'প্যাডেল' করতে গেলেন সাকিব (৫৫)। আড়াআড়ি খেলে ব্যাটের আলতো ছোঁয়ায় বল সম্ভবত ফাইন লেগ দিয়ে বের করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাটের কানা নিয়ে উল্টো ক্যাচ উঠে গেল উইকেটের বেশ পেছনে। স্লিপ থেকে বেশ খানিকটা দৌড়ে গিয়ে তালুবন্দি করলেন শিবনারায়ণ চন্দরপল। পরিস্থিতি বিবেচনায় ওভাবে আউট হওয়ার জন্য দুই টেস্টে ১০ উইকেট ও ১৬৮ রান করে ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার পরও তাই সমালোচিত হতে হচ্ছে সাকিবকে। সামি জানালেন, ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টে নাকি তাঁর বোলিংয়েই এ শট কয়েকবার খেলেছিলেন ওয়ানডের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। মুশফিকের স্মৃতিশক্তি বোধ হয় অতটা প্রখর নয়, 'ওয়ানডেতে এমন শট অনেককে খেলতে দেখেছি। তবে টেস্টে দেখিনি।'
এবার দেখলেন এবং ১৬ বল পর মুশফিক (৬৯) নিজেও গেলেন। আগের ওভারেই বিশু কয়েকটি ফ্লিপার দিয়েছেন। এবারও তাই দেবেন ভেবে খেলতে গিয়ে দেখলেন লেগস্পিনে বোল্ড! বাংলাদেশের লড়াই জমিয়ে তোলার আশার শেষ সলতেটাও নিভে গেল। লাঞ্চ বিরতির পর বাকিদের আসা-যাওয়ার মিছিলে সামির হাতে 'বেবি'টাও তাই উঠে গেল খুব দ্রুতই!

No comments

Powered by Blogger.