ইসিজি পেপারের নাম করে আনা হচ্ছে সাদা কাগজ-শুল্ক হারায় সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত দেশি শিল্প

মদানি শুল্ক ফাঁকি দিতে এক শ্রেণীর অসাধু কাগজ আমদানিকারক হৃদরোগ পরীক্ষার ইসিজি (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম) রিপোর্ট তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজের নামে বিদেশ থেকে সাদা কাগজ আনছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানি খাতে ব্যবহারের জন্য আনা কাগজও বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। আর এসব কাগজের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশীয় কাগজ শিল্প। সরকারও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।


রোগীদের স্বার্থে সরকার ইসিজি পেপার আমদানিতে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক আদায় করে। অন্যদিকে সাদা কাগজ আমদানির শুল্কহার ২৫ শতাংশ। ২০ শতাংশ শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই অসাধু আমদানিকারকরা ইসিজি পেপারের আড়ালে সাদা কাগজ আমদানি করছে।
ইসিজি পেপারের আড়ালে সাদা কাগজ আমদানি ঠেকাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে ইতিমধ্যে আবেদন করেছে বাংলাদেশ
পেপার মিল্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ২৩ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি এনবিআরের সদস্য (শুল্ক), চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ও বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমদানি বন্ধ নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য (শুল্ক) মো. শাহ আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআর এ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। এ বিষয়ে কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সুবিধায় কাগজ আমদানি করে বাজারে বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এটা যাতে না হয় সেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কহারের সাদা কাগজ কম শুল্কে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস করা হচ্ছে_এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সূত্র মতে, কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই কাজ দীর্ঘদিন ধরে চললেও কোনো চালান এখন পর্যন্ত আটক করা যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাস্টমস আমদানি গোয়েন্দা দলের প্রধান ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ রকম চালান আটকের খবর আমাদের কাছে নেই। তবে গত রবিবার বিল অব এন্ট্রি দাখিলের সময় সন্দেহবশত একটি চালান আমরা আটক করেছি। এখন চালানটির কায়িক পরীক্ষা চলছে। এর পরই জানা যাবে এতে রাজস্ব ফাঁকি আছে কি না।'
বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৫টি কাগজের মিল আছে। এসব মিলের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১০ লাখ টন। কিন্তু দেশে চাহিদা আছে সাত লাখ টন কাগজের। ফলে এমনিতেই মিলগুলো উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। দেশীয় কাগজ বর্তমানে রপ্তানি হচ্ছে বলে উল্লেখ করে মিল মালিকরা বলছেন, দেশে কাগজ আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই।
ইসিজি পেপার কয়েক ইঞ্চি লম্বা ছোট ছোট রোল করে আমদানি করা হয়। আর সাদা কাগজ আমদানি হয় বড় বড় রোল করে। আবার ইসিজি পেপারে একটু তাপ দিলেই সেটি কালো হয়ে যায়। ফলে এ কাগজের নাম করে অন্য কাগজ আমদানি করলে তা সহজেই ধরা সম্ভব। অভিযোগ রয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার কনকর্ড ও এপ্রিল প্রিমিয়াম নামের দুটি কম্পানির কাছ থেকে মূলত এই কাগজগুলো আমদানি করা হচ্ছে। আর আমদানিকারকদের মধ্যে অন্যতম পল্টনের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
পেপার মিল্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে মাত্র ১০ টন ইসিজি পেপারের চাহিদা আছে। যার এইচএস কোড : ৪৮০২.৫৫.১০/০০। এই কোডের মাধ্যমে আমদানি করা ইসিজি কাগজ শুধু হাসপাতালে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু একই কোডে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন সাদা কাগজ আমদানি করছেন। গত কয়েক মাসে দেশে কী পরিমাণ ইসিজি পেপার আমদানি হয়েছে এবং তা কোথায় বিক্রি করা হয়েছে এর খোঁজ নিলেই শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি ধরা পড়বে বলে মনে করে অ্যাসোসিয়েশন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কাগজ ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সমিতির এক নেতা ইসিজি পেপারের নামে কাগজ আমদানির বিষয়টি স্বীকার করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, গুটিকয়েক কাগজ ব্যবসায়ী এ কাজটি করছেন। এতে সৎ ব্যবসায়ীরা তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারছেন না। পাশাপাশি সব কাগজ ব্যবসায়ীর বদনাম হচ্ছে। তিনি ইসিজি পেপারের আড়ালে কাগজ আমদানি বন্ধ করে প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির দাবি জানান। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাগজ আমদানিতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পেপার মিল্স অ্যাসোসিয়েশন এনবিআরের কাছে পাঠানো চিঠিতে ইসিজি কাগজের আড়ালে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাগজ আমদানি বন্ধের দাবি জানায়। পাশাপাশি তারা ইজিসি পেপারের নামে আমদানি করা কাগজ কেবল যথাযথ নিরীক্ষার পর ছাড় করার দাবি জানায়।
এদিকে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য কাগজ আমদানি করে তা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। মিল মালিকরা অভিযোগ করেছেন, মাঝখানে এই প্রবণতা কিছুদিন কম থাকলেও তদারকির দুর্বলতায় আবার সক্রিয় হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

No comments

Powered by Blogger.