কাদের মোল্লার রায় আজ জামায়াতের হরতাল
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় আজ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করা হবে।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে এই তারিখ
ঘোষণা করেন। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি পলাতক অবস্থায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন একই ট্রাইব্যুনাল।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে, এর প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান গতকাল এক বিবৃতির মাধ্যমে এ হরতালের ডাক দেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশী-বিদেশী আইনবিদ, মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচারের এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বারবার বলেছেন এটি একটি ভ্রান্ত প্রক্রিয়া। দ্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্কিং গ্রুপসহ সবাই এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য এই বিচারকার্য পরিচালনা করছে।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপি ও সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হবে এবং সরকারের চলতি মেয়াদেই তা কার্যকর করা হবে। স্বরাষ্টমন্ত্রী মিসরে গিয়ে বলেছেন, এই সপ্তাহে যুদ্ধাপরাধের দ্বিতীয় রায় ও ১৪ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় রায় ঘোষণা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত আব্দুল কাদের মোল্লার রায় আগামীকাল নির্ধারিত হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিফলন ঘটেছে এবং সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী এ রায় দেয়া হচ্ছে বলে জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সরকার যখন ফাঁসির কথা বলে ও রায়ের দিন-তারিখ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয় তখন জনগণের বুঝতে আর কষ্ট হয় না যে, সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পন্ন হচ্ছে এবং এই বিচারে সরকারের প্রতিহিংসারই প্রতিফলন ঘটবে। আর বিচারের নামে যখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য প্রকাশ্যে অবিচার করা হয় এবং জনগণের সামনে তা দৃশ্যমান হয়, তখন জনগণ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সরকারি পরিকল্পনায় বিচারের নামে এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চক্রান্ত তাই দেশবাসী প্রতিহত করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিতর্কিত রাজনৈতিক ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে যদি সরকারের নীলনকশার শাস্তি বিধানের কোনো প্রতিফলন ঘটে, তাহলে হরতাল বর্ধিত হয়ে বুধবার থেকে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে বিচারের নামে অবিচারের বিরুদ্ধে এই হরতাল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আহ্বান জানান জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল।
তবে সংবাদপত্রের গাড়ি, সাংবাদিক, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি ওষুধ সরবরাহের কাজে নিয়োজিত গাড়ি এই হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
নিরাপত্তা বলয় : এ দিকে আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালের চার দিকে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। গতকাল বেলা ১টায় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার চিফ প্রসিকিউটর বনাম আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষিত হবে। ট্রাইব্যুনাল আজ এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য আদেশ দিয়েছেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালে যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের সবগুলো প্রবেশপথ ও আশপাশের পুরো এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের চার পাশে র্যাব-পুলিশের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি এলিট ফোর্স সোয়াত বাহিনীকেও মোতায়েন করা হয়েছে। রায়ের তারিখ ঘোষণার আগে রাজধানীর কদম ফোয়ারা থেকে দোয়েল চত্বর এবং সচিবালয়সংলগ্ন আবদুল গনি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনের সামনে পুলিশের গাড়ি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়। এলিট ফোর্স সোয়াত বাহিনী ও গোয়েন্দা সদস্যরা ট্রাইব্যুনালে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। গতকাল ট্রাইব্যুনালের মূল প্রবেশপথ সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান করছেন সোয়াত বাহিনীর সদস্যরা। আর র্যাব-পুলিশ রয়েছে শিশু একাডেমীর সামনে দিয়ে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় গেটসহ সংলগ্ন এলাকা, শিা ভবন, কদম ফোয়ারা, পুরনো হাইকোর্ট ও দোয়েল চত্বরসহ পুরো এলাকায়।
প্রতিক্রিয়াঃ রায়ের তারিখ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, আগামীকাল প্রত্যাশিত রায় ঘোষণা করা হবে। আমরা আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করেছি। এ মামলায় ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটি শোনা সাক্ষী ও তিনটি প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আতঙ্কিত নই, আশা করি জামায়াত-শিবির ও ঘাতক দালালেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবে।
ট্রাইব্যুনালের ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক মামলার রায় ঘোষণার জন্য রাখার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণের সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এমন কোনো এভিডেন্স ও ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি, যার ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে ন্যূনতম শাস্তি দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা ছাত্র ছিলেন এবং ৯ মাস ঢাকার বাইরে ফরিদপুরে নিজ গ্রামে ছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ একজন সাধারণ ছাত্রকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা। এখানে প্রসিকিউশন দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
মামলার বিবরণঃ গত ১৭ জানুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার শেষ ধাপে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন (আর্গুমেন্ট) শেষ হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল রায়ের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করে সিএভি (কোর্ট অ্যাডজর্ন্ড ফর ভারডিট বা রায়ের জন্য মুলতবি) করেন। ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছিলেন, আমরা রায়ের তারিখ ঘোষণা করছি না। ট্রাইব্যুনালের নতুন আইনে রায় দিতে সময় লাগবে।
গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মোজাফ্ফর আহমেদ খানের জবানবন্দীর মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর শহিদুল হক মামাসহ ১০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে একজন নারী সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। প্রসিকিউশনে লিস্টের ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এ মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১২ জন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
অন্য দিকে গত ১৫ নভেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে তার নিজের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে ছয়জন ডিফেন্স সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
কাদের মোল্লার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ৪০ বছরের ইমাম হাফেজ এ আই এম লোকমান ও ৮২ বছরের বৃদ্ধ সুশীল চন্দ্র মণ্ডল সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তিনি একজন ভালো মানুষ। উভয়পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গত ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি ২৭ ডিসেম্বর তার যুক্তি উপস্থাপন শেষ করলে ট্রাইব্যুনাল ৭ জানুয়ারি থেকে আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করে দেন।
গত ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর প্রসিকিউশনের আবেদনে গত ১৬ এপ্রিল মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ৭ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ও ছয়জন সাীকে এ মামলায় অর্ন্তভুক্ত করা এবং ফরমাল চার্জে কিছু শব্দের সংশোধনী চেয়ে আনা আবেদনের ওপর শুনানি হয়। গত ২৮ মে তার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ এনে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২।
একটি রাজনৈতিক মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ছয় অভিযোগঃ১. পল্লব হত্যা : মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
২. কবি মেহেরুননিসা হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কবি মেহেরুননিসা, তার মা ও দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। ৩. সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা : ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ বিকেলে আরামবাগ থেকে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসস্ট্যান্ডে গেলে তাকে ধরে জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
৪. ঘাটার চরে শতাধিক মানুষ হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কাদের মোল্লাকে অভিযুক্ত করা হয়।
৫.মিরপুরে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলুপদি গ্রামের পূর্ব দিকে নামে। সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
৬. হজরত আলী হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে হজরত আলীর বাসায় ঢুকে হজরত আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সাথে তার স্ত্রী আমিনা ও দুই মেয়ে খাদিজা ও তাহমিনা, দুই বছরের ছেলে বাবুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন কাদের মোল্লাঃ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা গত ১৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে নিজেই ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে নিজের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যান এবং মুক্তিযদ্ধের পুরো সময়ই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। গ্রামে অবস্থান কালে আবদুল কাদের মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেন। ২৩ মার্চ থেকে ১ মে ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত অন্যদের সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান কাদের মোল্লা ও অন্যদের ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেন।
কাদের মোল্লা বলেন, গ্রামে অবস্থানকালে মৌলভী মোঃ ইসহাক ওরফে ধলা মিয়া পীর সাহেবের বাড়িতে যেতাম এবং উনার দুই মেয়েকে পড়াতাম ওই পীর সাহেবের এক জামাতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল বলে পরে জানতে পেরেছি এবং পীর সাহেবের ছেলেরা সবাই স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিলেন। পীর সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে কিছু টাকা দেন তার বাজারের ঘরটি ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে চালু করতে। পুরো ১৯৭১ সাল এবং ১৯৭২ সালের প্রায় পুরো সময় আমি প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবারে বাজারে যেতাম, বাজারের পীর সাহেবের ঘরে বসতাম এবং ব্যবসায় করতাম। কাদের মোল্লা আরো বলেন, ১৯৭১ সালে তৎকালীন সদরপুর-ভাঙ্গা নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ও সদরপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহজাহান তালুকদারের সাথে আমার নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হতো। তখন সদরপুর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লৎফুল করিমের সাথেও আমার পরিচয় হয় এবং তার পর থেকে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল।
আবদুল কাদের মোল্লার পরিচিতিঃ নাম আবদুল কাদের মোল্লা, বাবার নাম মো: সানাউল্লাহ মোল্লা। জন্ম তারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮। জন্মস্থান জরিপের ডাংগি, ইউনিয়ন চরবিষ্ণুপুর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা গ্রাম আমিরাবাদ, ইউপি ভাষানচর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। কাদের মোল্লা ১৯৫৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তি পান। তিনি ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। এরপর প্রায় এক বছর চার মাস বাইশরশি শিবসুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসি কাসে ভর্তি হন এবং ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
১৯৭৪ সালে কাদের মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশনে (সোস্যাল সাইন্স) ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন পাস করেন। কাদের মোল্লা অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এরপর ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়াশোনার সময় ইসলামি ছাত্রসঙ্ঘে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন। এরপর বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দু’বার নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকা ১মহানগর জামায়াতে আমির নির্বাচিত হন।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে, এর প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান গতকাল এক বিবৃতির মাধ্যমে এ হরতালের ডাক দেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশী-বিদেশী আইনবিদ, মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচারের এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বারবার বলেছেন এটি একটি ভ্রান্ত প্রক্রিয়া। দ্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্কিং গ্রুপসহ সবাই এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য এই বিচারকার্য পরিচালনা করছে।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপি ও সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হবে এবং সরকারের চলতি মেয়াদেই তা কার্যকর করা হবে। স্বরাষ্টমন্ত্রী মিসরে গিয়ে বলেছেন, এই সপ্তাহে যুদ্ধাপরাধের দ্বিতীয় রায় ও ১৪ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় রায় ঘোষণা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত আব্দুল কাদের মোল্লার রায় আগামীকাল নির্ধারিত হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিফলন ঘটেছে এবং সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী এ রায় দেয়া হচ্ছে বলে জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সরকার যখন ফাঁসির কথা বলে ও রায়ের দিন-তারিখ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয় তখন জনগণের বুঝতে আর কষ্ট হয় না যে, সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পন্ন হচ্ছে এবং এই বিচারে সরকারের প্রতিহিংসারই প্রতিফলন ঘটবে। আর বিচারের নামে যখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য প্রকাশ্যে অবিচার করা হয় এবং জনগণের সামনে তা দৃশ্যমান হয়, তখন জনগণ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সরকারি পরিকল্পনায় বিচারের নামে এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চক্রান্ত তাই দেশবাসী প্রতিহত করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিতর্কিত রাজনৈতিক ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে যদি সরকারের নীলনকশার শাস্তি বিধানের কোনো প্রতিফলন ঘটে, তাহলে হরতাল বর্ধিত হয়ে বুধবার থেকে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে বিচারের নামে অবিচারের বিরুদ্ধে এই হরতাল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আহ্বান জানান জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল।
তবে সংবাদপত্রের গাড়ি, সাংবাদিক, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি ওষুধ সরবরাহের কাজে নিয়োজিত গাড়ি এই হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
নিরাপত্তা বলয় : এ দিকে আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালের চার দিকে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। গতকাল বেলা ১টায় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার চিফ প্রসিকিউটর বনাম আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষিত হবে। ট্রাইব্যুনাল আজ এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য আদেশ দিয়েছেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালে যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের সবগুলো প্রবেশপথ ও আশপাশের পুরো এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের চার পাশে র্যাব-পুলিশের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি এলিট ফোর্স সোয়াত বাহিনীকেও মোতায়েন করা হয়েছে। রায়ের তারিখ ঘোষণার আগে রাজধানীর কদম ফোয়ারা থেকে দোয়েল চত্বর এবং সচিবালয়সংলগ্ন আবদুল গনি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনের সামনে পুলিশের গাড়ি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়। এলিট ফোর্স সোয়াত বাহিনী ও গোয়েন্দা সদস্যরা ট্রাইব্যুনালে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। গতকাল ট্রাইব্যুনালের মূল প্রবেশপথ সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান করছেন সোয়াত বাহিনীর সদস্যরা। আর র্যাব-পুলিশ রয়েছে শিশু একাডেমীর সামনে দিয়ে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় গেটসহ সংলগ্ন এলাকা, শিা ভবন, কদম ফোয়ারা, পুরনো হাইকোর্ট ও দোয়েল চত্বরসহ পুরো এলাকায়।
প্রতিক্রিয়াঃ রায়ের তারিখ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, আগামীকাল প্রত্যাশিত রায় ঘোষণা করা হবে। আমরা আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করেছি। এ মামলায় ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটি শোনা সাক্ষী ও তিনটি প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আতঙ্কিত নই, আশা করি জামায়াত-শিবির ও ঘাতক দালালেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবে।
ট্রাইব্যুনালের ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক মামলার রায় ঘোষণার জন্য রাখার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণের সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এমন কোনো এভিডেন্স ও ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি, যার ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে ন্যূনতম শাস্তি দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা ছাত্র ছিলেন এবং ৯ মাস ঢাকার বাইরে ফরিদপুরে নিজ গ্রামে ছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ একজন সাধারণ ছাত্রকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা। এখানে প্রসিকিউশন দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
মামলার বিবরণঃ গত ১৭ জানুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার শেষ ধাপে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন (আর্গুমেন্ট) শেষ হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল রায়ের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করে সিএভি (কোর্ট অ্যাডজর্ন্ড ফর ভারডিট বা রায়ের জন্য মুলতবি) করেন। ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছিলেন, আমরা রায়ের তারিখ ঘোষণা করছি না। ট্রাইব্যুনালের নতুন আইনে রায় দিতে সময় লাগবে।
গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মোজাফ্ফর আহমেদ খানের জবানবন্দীর মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর শহিদুল হক মামাসহ ১০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে একজন নারী সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। প্রসিকিউশনে লিস্টের ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এ মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১২ জন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
অন্য দিকে গত ১৫ নভেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে তার নিজের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে ছয়জন ডিফেন্স সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
কাদের মোল্লার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ৪০ বছরের ইমাম হাফেজ এ আই এম লোকমান ও ৮২ বছরের বৃদ্ধ সুশীল চন্দ্র মণ্ডল সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তিনি একজন ভালো মানুষ। উভয়পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গত ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি ২৭ ডিসেম্বর তার যুক্তি উপস্থাপন শেষ করলে ট্রাইব্যুনাল ৭ জানুয়ারি থেকে আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করে দেন।
গত ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর প্রসিকিউশনের আবেদনে গত ১৬ এপ্রিল মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ৭ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ও ছয়জন সাীকে এ মামলায় অর্ন্তভুক্ত করা এবং ফরমাল চার্জে কিছু শব্দের সংশোধনী চেয়ে আনা আবেদনের ওপর শুনানি হয়। গত ২৮ মে তার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ এনে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২।
একটি রাজনৈতিক মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ছয় অভিযোগঃ১. পল্লব হত্যা : মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
২. কবি মেহেরুননিসা হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কবি মেহেরুননিসা, তার মা ও দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। ৩. সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা : ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ বিকেলে আরামবাগ থেকে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসস্ট্যান্ডে গেলে তাকে ধরে জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
৪. ঘাটার চরে শতাধিক মানুষ হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কাদের মোল্লাকে অভিযুক্ত করা হয়।
৫.মিরপুরে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলুপদি গ্রামের পূর্ব দিকে নামে। সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
৬. হজরত আলী হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে হজরত আলীর বাসায় ঢুকে হজরত আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সাথে তার স্ত্রী আমিনা ও দুই মেয়ে খাদিজা ও তাহমিনা, দুই বছরের ছেলে বাবুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন কাদের মোল্লাঃ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা গত ১৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে নিজেই ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে নিজের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যান এবং মুক্তিযদ্ধের পুরো সময়ই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। গ্রামে অবস্থান কালে আবদুল কাদের মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেন। ২৩ মার্চ থেকে ১ মে ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত অন্যদের সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান কাদের মোল্লা ও অন্যদের ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেন।
কাদের মোল্লা বলেন, গ্রামে অবস্থানকালে মৌলভী মোঃ ইসহাক ওরফে ধলা মিয়া পীর সাহেবের বাড়িতে যেতাম এবং উনার দুই মেয়েকে পড়াতাম ওই পীর সাহেবের এক জামাতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল বলে পরে জানতে পেরেছি এবং পীর সাহেবের ছেলেরা সবাই স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিলেন। পীর সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে কিছু টাকা দেন তার বাজারের ঘরটি ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে চালু করতে। পুরো ১৯৭১ সাল এবং ১৯৭২ সালের প্রায় পুরো সময় আমি প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবারে বাজারে যেতাম, বাজারের পীর সাহেবের ঘরে বসতাম এবং ব্যবসায় করতাম। কাদের মোল্লা আরো বলেন, ১৯৭১ সালে তৎকালীন সদরপুর-ভাঙ্গা নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ও সদরপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহজাহান তালুকদারের সাথে আমার নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হতো। তখন সদরপুর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লৎফুল করিমের সাথেও আমার পরিচয় হয় এবং তার পর থেকে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল।
আবদুল কাদের মোল্লার পরিচিতিঃ নাম আবদুল কাদের মোল্লা, বাবার নাম মো: সানাউল্লাহ মোল্লা। জন্ম তারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮। জন্মস্থান জরিপের ডাংগি, ইউনিয়ন চরবিষ্ণুপুর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা গ্রাম আমিরাবাদ, ইউপি ভাষানচর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। কাদের মোল্লা ১৯৫৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তি পান। তিনি ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। এরপর প্রায় এক বছর চার মাস বাইশরশি শিবসুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসি কাসে ভর্তি হন এবং ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
১৯৭৪ সালে কাদের মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশনে (সোস্যাল সাইন্স) ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন পাস করেন। কাদের মোল্লা অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এরপর ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়াশোনার সময় ইসলামি ছাত্রসঙ্ঘে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন। এরপর বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দু’বার নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকা ১মহানগর জামায়াতে আমির নির্বাচিত হন।
No comments