একাই সামলাই সংসার সন্তান by খন্দকার মর্জিনা সাঈদ
নিশির কান্নার শব্দে সকালের ঘুম ভাঙে প্রতিবেশীসহ ঘরের সব সদ্যদের, যা
ইতোমধ্যে সবার অভ্যাস হয়ে গেছে। নিশির কান্না, কিশোরী গৃহপরিচারিকার তাকে
জোর করে জাপটে ধরা, মা লায়লা নাজনীনের মলিন মুখে দরজা লক করে দ্রুত পায়ে
নিজস্ব কর্মস্থলের উদ্দেশে ছুটে চলা।
এ
সবই এখন নিত্যদিনের বিষয় হলেও মা লায়লা নাজনীনের কাছে বিষয়টা খুবই
দুঃখের। তিনি বলেন, নিশির দুই বছর ৮ মাস বয়স। তার বড় ছেলে নাবিল এবার
পাঁচ বছরে পা রাখল। দু’জনই শিশু। এক কিশোরী গৃহপরিচারিকা ছাড়া বলতে গেলে
তাদের দেখার মতো তেমন কেউ নেই। তাদের বাবার সাথে নিশি হওয়ার পরপরই
সম্পর্কের পালা চুকে যায়। কোনো বাগি¦তণ্ডা ছাড়াই আমি আমার সন্তানদের
দায়িত্ব নেই। তাদের বাবা বলেছিলেন, প্রতি মাসে তিনি সন্তানদের দৈনন্দিন
খরচ বাবদ কিছু অর্থ দেবেন। হ্যাঁ বছরখানেক সামান্য কিছু দিয়েছিলেন বটে।
পরে কোনো প্রকার খরচ দেয়া তো দূরের কথা, যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি। একজন মা
হয়ে যতটা সম্ভব সন্তানদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে ভালোভাবে মানুষ করার
জন্য লড়ে যাচ্ছি। আর এ জন্য একটি ট্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়েছি। নিজ
হাতে বাজার, রান্না, সন্তানদের পরিচর্যা করি। ছুটির দিনগুলোতে তাদের নিয়ে
যাচ্ছি বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে, যাতে ওরা কখনো কোনো কিছু থেকে নিজেদের
বঞ্চিত না ভাবে। তবে ঘরে বাহিরে এত এত দায়িত্ব, বিশেষ করে আর্থিক বিষয়টা
সামাল দিতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। দাম্পত্য জীবন ভেঙে যাওয়ার পরও
যদি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সন্তানদের ঘিরে একটি সমঝোতা থাকত, তাহলে
আমাকে এত কষ্ট পেতে হতো না।
সিলবিয়া সাথী। ইউনিসেফের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সাথী জানান, প্রায় ২০-২২ বছর একমাত্র সন্তান সজিব রাইয়ানকে নিয়ে একক পরিবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তার পরও মাঝে মধ্যে সন্তান, সংসার, চাকরি ও সামাজিকতার এই অধ্যায়গুলোকে কেন্দ্র করে সর্বক্ষেত্রে সমান দৃষ্টি দিতে গিয়ে ভীষণ রকমের বেগ পেতে হয় হচ্ছে। থাকে না একান্ত সময় বলতেও কিছু। তবু স্বামীর অনৈতিক জীবনের সঙ্গে আপস করিনি। চালিয়ে যাইনি লোক দেখানো স্বাভাবিক সুখকর দাম্পত্যময় সম্পর্ক। তাই বাধ্য হয়েছি একক পরিবার গঠনে। যদিও আমি চাকরি করছি, আর্থিকভাবে সচ্ছল; তবু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই যেতে হয় বলে সন্তানকে তেমন একটা সময় দিতে পারি না। পারি না সর্বসময়ের জন্য কাছাকাছি ওর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আর এ কারণে মনঃকষ্টে ভুগি, যার বহিঃপ্রকাশ না ঘটলেও রাইয়ান বোধ করি বুঝতে পারে। তবে ছোটবেলায় অবশ্য বলত অন্যদের বাবা আছে, আমার নেই কেন। তাদের বাবারা ওদের জন্য কত কি আনে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরে, আমার বাবা আসে না কেন। এ ধরনের অনেক প্রশ্ন করত, যা সময়ের সাথে সাথে রাইয়ান নিজ থেকেই উত্তর নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারে তার বাবার শূন্যতা পূরণে আমার যথাসাধ্য চেষ্টা আন্তরিকতা। তাই এখন আর কোনো অভিযোগ করে না। স্কুল, কলেজের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে আমাকেই দাঁড় করিয়েছে। যদিও ওর বাবা একই শহরেই থাকে। বেশ ভালো পজিশনে আছে। তবু তিনি বাবা হিসেবে তার সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। যার জন্য আমাকে একক দায়িত্ব পালনে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। হয় মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ বহন করতে।
মারিয়া মুনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র পিন্সিপাল অফিসার। তিন মেয়েকে নিয়ে তার একক পরিবার। মেয়েরা ইতোমধ্যে স্কুলের পাট শেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। মারিয়া বলেন, পর পর তিন মেয়ে হওয়ায় স্বামী আমার ওপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেন। দেন দ্বিতীয় বিয়ের হুমকি। বিষয়টি ঠাণ্ডা মাথায় মীমাংসা করতে চাইলাম। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো না। ভেঙে গেল দাম্পত্য জীবন। ভালোর মন্দ যে, আমি উচ্চ শিক্ষিত ছিলাম এবং সরকারি চাকরির বয়স ছিল। ছিল প্রবীণ মা-বাবা, ভাই-বোনদের সহযোগিতা। যে কারণে ছোট ছোট তিন মেয়েকে রেখে অফিস করতে পারছি। তবে প্রায়ই অফিসে যাওয়ার সময় তাদের কান্না, আর্তচিৎকার আমাকে বিমর্ষ করে ফেলত। অফিসে কদাচিৎ প্রকাশ ঘটলেই পুরুষ সহকর্মীরা টিপ্পনি করতে ছাড়তেন না। সরাসরিই বলতেন, অফিসের কাজে তো ভুল হবেই। মন পড়ে থাকে তো বাড়িতে। দু’চোখে সন্তানদের অশ্রুপ্লাবিত চোখ ভাসে। কান পাতলেই শুনতে পান ওদের চিৎকার চেঁচামেচি। তাই বাধ্য হয়েছি মুখ বন্ধ রাখতে। শত অভাব মনঃকষ্টের মধ্যে থাকলেও মুখে প্রকাশ করিনি। সন্তানদের দায়িত্বের ব্যাপারেও ছিলাম অনঢ়। স্নেহ-ভালোবাসা, সাহচর্যে কোনো ত্রুটি ঘটতে দেইনি। অকাতরে বিসর্জন দিতে হয় নিজস্ব সুখ, চাওয়া পাওয়া। সন্তানদের চাওয়া-পাওয়াকে বড় করে দেখি। মারিয়া বলেন, তবে কষ্ট হয় যখন কাঁচাবাজারে যাই, যানজট পূর্ণ রাস্তায় পথ চলি এবং চলমান পথে কিছু কুরুচিপূর্ণ মানুষের কথা শুনে। যাদের বেশির ভাগেরই ভাষ্য, ঘরে স্বামী রেখে কাঁচাবাজারে যানজটে লোকজনের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি খেতে বেশি ভালোবাসে। এ কারণেই মেয়েরা বাজারে আসে। ভিড়ে ঢুকে পড়ে ভিড় বাড়ায়। অথচ এই কুরুচিপূর্ণ মানুষ একটু ভাবে না বা ভাবতে চায় না এ দেশের বেশির ভাগ নারীই ধর্মভীরু। যারা সহজে ঘরের বাইরে পা রাখতে চান না।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপিকা আনোয়ারা বেগম বলেন, সব ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সাথে বাড়ছে নারীর সচেতনতা। ঘরে-বাইরে যেখানেই হোক, তারা তাদের পূর্বসূরিদের মতো অন্যায়-অবিচার দেখেও না দেখার ভান করতে চান না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে হচ্ছেন সোচ্চার। এমনকি বিলাস বৈভব দাম্পত্য জীবনকেও নৈতিকতার প্রশ্নে অগ্রাহ্য করছেন। দাম্পত্য জীবনে নৈতিকতার মিল না হলে অনেক সচেতন, বিশেষ করে শিক্ষিত নারী আগাম কষ্টকে মেনে নিয়ে একক পরিবার গড়ছেন। একক পরিবার গঠনে এটাও একটি অন্যতম কারণ, যা বহির্বিশ্বে বহু আগে থেকেই ছিল, আছে এবং আমাদের দেশে শতকরা হারে ৮-১০ জন ছিল। বর্তমানে অনেক গুণ বেড় গেছে। ফলে নারীর দায়িত্ব বাড়ছে।
কোনো কারণে যদি বাধ্য হয়ে নারীকে একক পরিবার গড়তেই হয় তাহলে সমঝোতার ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের দায়িত্বের বিষয়ে সুষ্ঠু মীমাংসা করে নেয়া ভালো, যাতে সম্পর্ক ভাঙার পরেও বাবা-মা হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব ঠিক ঠিক পালন করতে পারেন।
সিলবিয়া সাথী। ইউনিসেফের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সাথী জানান, প্রায় ২০-২২ বছর একমাত্র সন্তান সজিব রাইয়ানকে নিয়ে একক পরিবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তার পরও মাঝে মধ্যে সন্তান, সংসার, চাকরি ও সামাজিকতার এই অধ্যায়গুলোকে কেন্দ্র করে সর্বক্ষেত্রে সমান দৃষ্টি দিতে গিয়ে ভীষণ রকমের বেগ পেতে হয় হচ্ছে। থাকে না একান্ত সময় বলতেও কিছু। তবু স্বামীর অনৈতিক জীবনের সঙ্গে আপস করিনি। চালিয়ে যাইনি লোক দেখানো স্বাভাবিক সুখকর দাম্পত্যময় সম্পর্ক। তাই বাধ্য হয়েছি একক পরিবার গঠনে। যদিও আমি চাকরি করছি, আর্থিকভাবে সচ্ছল; তবু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই যেতে হয় বলে সন্তানকে তেমন একটা সময় দিতে পারি না। পারি না সর্বসময়ের জন্য কাছাকাছি ওর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আর এ কারণে মনঃকষ্টে ভুগি, যার বহিঃপ্রকাশ না ঘটলেও রাইয়ান বোধ করি বুঝতে পারে। তবে ছোটবেলায় অবশ্য বলত অন্যদের বাবা আছে, আমার নেই কেন। তাদের বাবারা ওদের জন্য কত কি আনে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরে, আমার বাবা আসে না কেন। এ ধরনের অনেক প্রশ্ন করত, যা সময়ের সাথে সাথে রাইয়ান নিজ থেকেই উত্তর নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারে তার বাবার শূন্যতা পূরণে আমার যথাসাধ্য চেষ্টা আন্তরিকতা। তাই এখন আর কোনো অভিযোগ করে না। স্কুল, কলেজের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে আমাকেই দাঁড় করিয়েছে। যদিও ওর বাবা একই শহরেই থাকে। বেশ ভালো পজিশনে আছে। তবু তিনি বাবা হিসেবে তার সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। যার জন্য আমাকে একক দায়িত্ব পালনে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। হয় মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ বহন করতে।
মারিয়া মুনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র পিন্সিপাল অফিসার। তিন মেয়েকে নিয়ে তার একক পরিবার। মেয়েরা ইতোমধ্যে স্কুলের পাট শেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। মারিয়া বলেন, পর পর তিন মেয়ে হওয়ায় স্বামী আমার ওপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেন। দেন দ্বিতীয় বিয়ের হুমকি। বিষয়টি ঠাণ্ডা মাথায় মীমাংসা করতে চাইলাম। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো না। ভেঙে গেল দাম্পত্য জীবন। ভালোর মন্দ যে, আমি উচ্চ শিক্ষিত ছিলাম এবং সরকারি চাকরির বয়স ছিল। ছিল প্রবীণ মা-বাবা, ভাই-বোনদের সহযোগিতা। যে কারণে ছোট ছোট তিন মেয়েকে রেখে অফিস করতে পারছি। তবে প্রায়ই অফিসে যাওয়ার সময় তাদের কান্না, আর্তচিৎকার আমাকে বিমর্ষ করে ফেলত। অফিসে কদাচিৎ প্রকাশ ঘটলেই পুরুষ সহকর্মীরা টিপ্পনি করতে ছাড়তেন না। সরাসরিই বলতেন, অফিসের কাজে তো ভুল হবেই। মন পড়ে থাকে তো বাড়িতে। দু’চোখে সন্তানদের অশ্রুপ্লাবিত চোখ ভাসে। কান পাতলেই শুনতে পান ওদের চিৎকার চেঁচামেচি। তাই বাধ্য হয়েছি মুখ বন্ধ রাখতে। শত অভাব মনঃকষ্টের মধ্যে থাকলেও মুখে প্রকাশ করিনি। সন্তানদের দায়িত্বের ব্যাপারেও ছিলাম অনঢ়। স্নেহ-ভালোবাসা, সাহচর্যে কোনো ত্রুটি ঘটতে দেইনি। অকাতরে বিসর্জন দিতে হয় নিজস্ব সুখ, চাওয়া পাওয়া। সন্তানদের চাওয়া-পাওয়াকে বড় করে দেখি। মারিয়া বলেন, তবে কষ্ট হয় যখন কাঁচাবাজারে যাই, যানজট পূর্ণ রাস্তায় পথ চলি এবং চলমান পথে কিছু কুরুচিপূর্ণ মানুষের কথা শুনে। যাদের বেশির ভাগেরই ভাষ্য, ঘরে স্বামী রেখে কাঁচাবাজারে যানজটে লোকজনের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি খেতে বেশি ভালোবাসে। এ কারণেই মেয়েরা বাজারে আসে। ভিড়ে ঢুকে পড়ে ভিড় বাড়ায়। অথচ এই কুরুচিপূর্ণ মানুষ একটু ভাবে না বা ভাবতে চায় না এ দেশের বেশির ভাগ নারীই ধর্মভীরু। যারা সহজে ঘরের বাইরে পা রাখতে চান না।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপিকা আনোয়ারা বেগম বলেন, সব ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সাথে বাড়ছে নারীর সচেতনতা। ঘরে-বাইরে যেখানেই হোক, তারা তাদের পূর্বসূরিদের মতো অন্যায়-অবিচার দেখেও না দেখার ভান করতে চান না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে হচ্ছেন সোচ্চার। এমনকি বিলাস বৈভব দাম্পত্য জীবনকেও নৈতিকতার প্রশ্নে অগ্রাহ্য করছেন। দাম্পত্য জীবনে নৈতিকতার মিল না হলে অনেক সচেতন, বিশেষ করে শিক্ষিত নারী আগাম কষ্টকে মেনে নিয়ে একক পরিবার গড়ছেন। একক পরিবার গঠনে এটাও একটি অন্যতম কারণ, যা বহির্বিশ্বে বহু আগে থেকেই ছিল, আছে এবং আমাদের দেশে শতকরা হারে ৮-১০ জন ছিল। বর্তমানে অনেক গুণ বেড় গেছে। ফলে নারীর দায়িত্ব বাড়ছে।
কোনো কারণে যদি বাধ্য হয়ে নারীকে একক পরিবার গড়তেই হয় তাহলে সমঝোতার ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের দায়িত্বের বিষয়ে সুষ্ঠু মীমাংসা করে নেয়া ভালো, যাতে সম্পর্ক ভাঙার পরেও বাবা-মা হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব ঠিক ঠিক পালন করতে পারেন।
No comments