যশোর রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন এই লভিনু সঙ্গ তব...- রণেশ মৈত্র

বিগত ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত যশোর টাউন হল ময়দানে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন দেখে এলাম। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ আয়োজন করেছিলেন এই সম্মেলনের।
এটি তাঁদের ঊনত্রিংশ বার্ষিক সম্মেলন। বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের এই জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনটির গঠনতন্ত্র মোতাবেক দু'বছর পর পর তৃণমূল পর্যায় থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতা এবং উপজেলা-জেলা পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠান করে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় সম্মেলন_যার মাধ্যমে নির্বাচিত হয় নতুন কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটি। তেমনই আবার দু'বছর পর পর ঢাকার বাইরে কোন জেলা শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন_সাধারণত তিন দিনব্যাপী। অনেকগুলো অধিবেশনে বিভক্ত এই সম্মেলনে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি, রবীন্দ্র সাহিত্য আলোচনা, সমকালীন জাতীয় পরিস্থিতির ওপর সেমিনার, গুণীজন সংবর্ধনা, বাঙালী সংস্কৃতির অপরাপর কর্ণধারদের সাহিত্য, গান প্রভৃতি পরিবেশন_এগুলো থাকে তিন দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলোতেও গুণীজন সংবর্ধনা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই স্থান পেয়ে থাকে। তবে জেলাগুলোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতা এবং সংগঠনের কর্মকর্তা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। তবে প্রতিনিধি সম্মেলন (সকল জেলা শাখাগুলোতে নির্বাচিত) উভয় সম্মেলনেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূর্ববর্তী বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সম্মেলনটি এবং দু'বছর আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল জয়পুরহাটে।
যশোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের কর্মসূচীতে ছিল ৪ মার্চ : সকাল বোধন সঙ্গীত, জাতীয় সঙ্গীত, অতিথিবৃন্দের মঞ্চে উপবেশন, স্বাগত ভাষণ, প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও সভাপতির ভাষণ। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন শ্রী অমরেশ রায় চৌধুরী এবং এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।
সকালের কর্মসূচী অনুযায়ী, উপরোক্ত অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও রবীন্দ্র চিত্রকলার প্রতিলিপি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, মোহাম্মদ শফির ধারণকৃত যশোরের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ভাস্কর মোঃ হামিদুজ্জামান খান, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ কর্তৃক এ যাবত প্রকাশিত পোস্টার প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন শিল্পী আবদুল মান্নান এবং বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর যশোরে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলায় নিহত ও আহতদের ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন অধ্যাপক জিল্লুর রহামন সিদ্দিকী। অতঃপর ছিল সঙ্গীত অনুষ্ঠান, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠান।
বিকেল ৩-৩০ মিনিটে তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত প্রশিক্ষণ এবং ৪-৩০ মিনিট থেকে শুরু হয় আবৃত্তি, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও নৃত্যানুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে প্রদীপ প্রজ্বলন, অতঃপর সম্মেলন সঙ্গীত, ৬-১৫ মিনিট রবিরশ্মি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন অধ্যাপক সুব্রত মজুমদার এবং তারপর পুনরায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি, নৃত্যানুষ্ঠান ও জাতীয় সঙ্গীত।
তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনের ঠাসা এই কর্মসূচী অধিক রাত পর্যন্ত চলে। শুরু হয় সকাল ১০টায়। উল্লেখিত ওই কর্মসূচীর দিকে চোখ বুলালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিভাবে সকাল থেকে রাত অবধি নাচ-গান এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল এবং বিশেষ করে গানে গানে কিভাবে ভরপুর ছিল যশোর টাউন হল ময়দান। তেমনই ভিড় জমেছিল হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার, পুরুষ-নারী-শিশু নির্বিশেষে।
৫ মার্চ দ্বিতীয় দিন সকাল নয়টায় সম্মেলনে সারাদেশ থেকে আগত শত শত প্রতিনিধি ছুটলেন বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল যশোরের সনতান মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক বাড়ি সাগরদাড়িতে। সেখানে মাইকেলের স্মৃতি জাদুঘর, তাঁর জন্মস্থান পৈতৃক বাড়িসহ বহু কিছু সংরক্ষিত আছে।
এতই চমৎকারভাবে মাইকেলের স্মৃতিগুলো সেখানে সংরতি রয়েছে যা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত বা বাংলার আর কোন বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় জনের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না যদিও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ঐতিহাসিক স্মৃতিবহ স্থানগুলোতে অনুষ্ঠানাদির আয়োজন হয়ে থাকে। এই প্রথম সাগরদাড়ি দেখার সুযোগ আমার জীবনে ঘটল। আমি মুগ্ধ এবং গভীরভাবে আনন্দিত সাগরদাড়ির সব কিছু দেখে। সেখানেই ডাকবাংলো মাঠে অনুষ্ঠিত হলো প্রীতি সম্মেলন_এতে আলোচনা করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ব্যক্তিত্ব সনজীদা খাতুন।
সাগরদাড়ির মানুষের আন্তরিকতা, আতিথেয়তাও ছিল অপূর্ব। তাঁরাই আয়োজন করেছিলেন প্রতিনিধিদের দ্বিপ্রাহরিক আহারাদির। কিন্তু ওই খাবারের পর দশ মিনিটেরও বিশ্রাম নেই। ছুটতে হলো সবাই মিলে যশোর শহরে সেখানে বিকেল চারটা থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল 'সংস্কৃতি সমন্বিত শিক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারের। সময় ঠিক ঠিক রক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় এই কর্মসূচী শুরু হয় সন্ধ্যা ছয়টায়। মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন অধ্যাপক আহমেদ মুস্তফা কামাল এবং ওই প্রবন্ধের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন অধ্যাপক অমিত বরণ ঘোষ ও অধ্যাপক সতীন্দ্র সরকার।
অতঃপর ৬ মার্চ, সমাপ্তি দিবসের অনুষ্ঠানমালায় ছিল সকাল নয়টায় শোভাযাত্রা সহকারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গমন এবং পুষ্পার্ঘ্য প্রদান, সঙ্গীতানুষ্ঠান (সম্মেলনের মূল ভেন্যু টাউন হল ময়দানে) এবং যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রতিনিধি সম্মেলন। এই প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেন সম্মেলনে উপস্থিত ৪৪টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক পুরুষ ও মহিলা প্রতিনিধি। তাঁরা সাংগঠনিক বিষয়াদির মধ্যেই তাঁদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন। সেখানে ময়মনসিংহ ও পাবনা জেলার প্রতিনিধি তাঁদের বক্তব্য প্রদানকালে ২০১২ সালের জাতীয় সম্মেলন ময়মনসিংহ ও পাবনা জেলায় অনুষ্ঠানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে সেখানে রবীন্দ্র মেলার আয়োজন করা হবে বলেও জানানো হয়। পরবর্তী জাতীয় সম্মেলন কোথায় অনুষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে ২০১২ সালে ঢাকাতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধি সম্মেলনে।
বিকেল ৫টায় শুরু হয় আজ থেকে ১১ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চের অনুষ্ঠিত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও এই মামলার পুনর্তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার অনুষ্ঠানের দাবিতে সমাবেশ। এই সমাবেশে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কার্যকরি সভাপতি অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন, ডা. সরোয়ার আলী নিহতদের পরিবারের কয়েকজন মহিলা সদস্য, আহত একজন বাউল শিল্পীসহ দুজন, পুনর্তদন্ত ও বিচার আন্দোলনের নেতা পৌর মেয়র, যশোর জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর তৎকালীন উপদেষ্টা, প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ কাজী আবদুস শহীদ লাল, জেলা উদীচীর অপরাপর নেতৃবৃন্দ, ডা. রবিউল আলম ও পাবনার রণেশ মৈত্র মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন, সোচ্চার কণ্ঠে উদীচী হত্যালীলার পুনর্তদন্ত জোরদার করে পুনর্বিচার ত্বরান্বিত করার দাবি উত্থাপন করে ওই আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সংহতি জ্ঞাপন করেন। অতঃপর মঞ্চের পেছনে যে স্থানে সেদিনের হত্যাকারীরা ভয়াবহ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল সেখানে গিয়ে নিহত ১০ জনের জন্য ১০টি মশাল জ্বালিয়ে এই ভয়াবহ হত্যালীলাকে অন্ধকারের শক্তির আঘাত বলে আখ্যায়িত করে আলোর সন্ধানে সংস্কৃতিসেবীরা তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন বলে ঘোষণা করা হয়, সমবেত কণ্ঠে "আগুনের পরশমণি" গানটি ধীরলয়ে গেয়ে আলোকোজ্জ্বল দেশের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যে স্থানে ১১ বছর আগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই তিন দিনব্যাপী জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন, ২০১০-এর মঞ্চও নির্মিত হয়।
সন্ধ্যায় রবীন্দ্র পদক ঘোষণা ও গুণীজন সম্মাননা, সম্মেলনের প্রস্তব পেশ ও অনুমোদন করা হয়। এ ছাড়া শোক প্রস্তব পেশ করেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের যশোর জেলা কমিটির সম্পাদক শ্রাবণী সুর এবং ঘোষণা পাঠ করেন ড. সন্জীদা খাতুন। এবারের রবীন্দ্র পদক প্রদান করা হয় যশোরের খ্যাতনামা ও নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক গৌর গোপাল হালদারকে। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা এবং সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।
সন্ধ্যায় যথারীতি "আগুনের পরশমণি" সমবেত কণ্ঠে গাইতে গাইতে প্রদীপ প্রজ্বলন, রবিরশ্মি পর্যায়ে আলোচনাসভা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি, নৃত্যানুষ্ঠান ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী এই মহামিলন মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
যশোরের সন্তান সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন, সম্মেলনের আহ্বায়ক সুকুমার দাশ, জেলা কমিটির সভাপতি অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী সুর, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মীবাহিনী যে বিপুল নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করেছেন, সমন্বিতভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন যশোরবাসী, যশোরের প্রশাসন, পুলিশ ও রব প্রশাসন, নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রী সাধারণ যে বিপুল সহযোগিতা দান করে সম্মেলনটিকে সফল করে তুলেছেন তা সবারই সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যশোরের সাংবাদিক সমাজও এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই যশোরের সম্মেলনটি যথার্থই অন্যতম সফলতম সম্মেলন।
e-mail:raneshmaitra@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.