ট্রাইব্যুনাল বাতিল না হলে কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারি- সকালে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বিকেলে মিছিলে গুলি
রাজধানীতে গতকাল সোমবার শান্তিপূর্ণ বিশাল শোডাউন করেছে বাংলাদেশ
জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। সকাল ১০টায় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল
শাপলা চত্বরে সমাবেশও করেন তারা।
এ সময় হাজার হাজার
নেতাকর্মীর পদভারে পুরানা পল্টন থেকে দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর ও আরামবাগ
এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড
মিছিল নিয়ে মতিঝিলে জড়ো হন তারা। সমাবেশ শেষে মতিঝিল থেকে দৈনিক বাংলা,
ফকিরাপুল মোড় ও নয়া পল্টন হয়ে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত সাম্প্রতিক কালের
সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ মিছিল করে সংগঠনটি। বিুব্ধ নেতাকর্মীদের কেউ কেউ
বুকে-পিঠে ‘সাঈদীর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’Ñ এমন স্লোগান লিখে
কর্মসূচিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সবার মুখে ছিল ‘অবৈধ ট্রাইব্যুনাল, ভেঙে দাও
গুঁড়িয়ে দাও’ ‘শিবির-পুলিশ ভাই ভাই, খুনি হাসিনার রক্ষা নাই ইত্যাদি
স্লোগান। র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য রাস্তার দুই
পাশে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকে। এ সময় রাস্তার দু’পাশ থেকে বিপুলসংখ্যক
উৎসুক জনতাকে দাঁড়িয়ে মিছিল পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়। মিছিল ও সমাবেশে
অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাটি।
এর আগে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে জামায়াত নেতারা সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে রাজনৈতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের মাধ্যমে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবেন না। কারণ কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক নয়। কসাই কাদেরের কোনো কর্মকাণ্ড কাদের মোল্লার ওপর চাপানো হলে এই সরকারের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। আর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দীর্ঘ দিন ইসলাম প্রচার করেছেন। মুসলিম জনতার এ নয়নমণির ব্যাপারেও কিছু করার আগে ভেবে দেখা দরকার সরকারের।’
তারা আরো বলেন, মতিঝিলে সমাবেশের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেয়া হয়েছে। এটি সরকার বা কারো করুণা নয়, ২০ নেতাকর্মীর জীবনের বিনিময়ে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। প্রয়োজনে হাজার হাজার কর্মী জীবন দিয়ে ‘প্রহসনের ট্রাইব্যুনাল’ বন্ধ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মিথ্যা’ অভিযোগে আটক নেতাদের মুক্ত করবে।
বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের চার নেতাকর্মী নিহত এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ, নির্দলীয়-নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, জনদুর্ভোগ লাঘব ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত এই কর্মসূচির আয়োজন করে ঢাকা মহানগর জামায়াত। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এই কর্মসূচির অনুমতি চাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত মতিঝিলে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ প্রশাসন। এতে সভাপতিত্ব করেন জামায়াতের ঢাকা মহানগর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো: সেলিম উদ্দিন। বক্তব্য দেন জামায়াত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, ঢাকা মহানগর কর্মপরিষদ সদস্য মশিউল আলম ও লুৎফুর রহমান এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত। সঞ্চালক ছিলেন জামায়াত ঢাকা মহানগর সহকারী সেক্রেটারি মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
সমাবেশে হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেন, মতিঝিলে সমাবেশের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেয়া হয়েছে। তবে এটি সরকার বা কারো করুণা নয়, বর্তমান সরকারের সময়ে শিবিরের ১৪ এবং জামায়াতের ৬ নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। তাদের ২০ জনের জীবনের বিনিময়ে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই অর্জনকে ধারণ করে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের চার বছরের তিন বছরই আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা যেভাবে নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে দেশে বসবাস করেন আমরাও সেভাবে বসবাস করছি। কিন্তু সরকার কেন আমাদের সাংবিধানিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে? আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে রাজি। কিন্তু শান্তিশৃঙ্খলা রার দায়িত্ব সরকারের। আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে বিগত তিন বছর সরকারের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
‘কথিত যুদ্ধাপরাধের’ মিথ্যা অভিযোগে জামায়াত নেতাদের সরকার আটকে রেখেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জনের বিচারের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন করেছিল। কিন্তু তাদের বিনা বিচারে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে এই বিচার হতে পারে না। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমাদের নিরপরাধ নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেও বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো রায় হলে জাতির কপালে আরেকটি কলঙ্ক লেপন করা হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জামায়াতের এই নেতা বলেন, এখনো আমাদের অনেক পথচলা বাকি আছে। কুচক্রীমহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইবে। দূর থেকে উসকানি দিয়ে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। পুলিশের ভেতরে থাকা কুচক্রীরাও উসকানি দিতে পারে। কিন্তু তাদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
বগুড়ায় নিহত চার নেতাকর্মীর খুনিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নয়তো জনগণই তাদের গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দেবে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কোরির মাধ্যমে ল-কোটি টাকা লুট এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে সেলিম উদ্দিন বলেন, বগুড়ায় জামায়াত নেতা খুনিদের আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। নয়তো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘রোববার মাগরিবের পর জানলাম সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। সে হিসাবে ২৪ ঘণ্টা সময়ও আমরা পাইনি। তাতেই মতিঝিল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। তিন দিন সময় পেলে লাখ লাখ কর্মী আমরা রাজপথে নামাতে পারব ইনশাল্লাহ।’
জামায়াতের এই নেতা আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেন, ‘একটা রায় শেষ নয়। একটির পর আরো অনেক রায় হবে। আপনারদেরও এ দেশে থাকতে হবে, আমরাও থাকব। আমাদের উচ্ছৃঙ্খল বানানোর চেষ্টা করলে সেটি সফল হবে না। দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাবেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন শেষ নয়, সমাবেশের মাধ্যমে বিজয়ের শুরু হয়েছে। তিন-তিনশ’ নয়, প্রয়োজনে তিন হাজারের বেশি জীবনের বিনিময়ে নেতাদের মুক্ত করা হবে ইনশাল্লাহ।’
কারওয়ানবাজারে বৃষ্টির মতো গুলি
এ দিকে আজ দেশজুড়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গতকাল শিবিরের মিছিলে হামলা চালিয়েছে পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুলিশের গুলি ও যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বেধড়ক মারধরে বেশ কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিবিরের এক নেতাকে ধরে নির্মমভাবে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে য্বুলীগ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কারওয়ানবাজারে শিবিরের মিছিলে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা হরতালের সমর্থনে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর আন্ডারপাসের কাছে পৌঁছলে পুলিশ অতর্কিত মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। পরে মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। পুলিশ এ সময় প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন। ঘটনার সময় সেখানে ১০-১২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এসব ঘটনায় অন্তত পাঁচজন শিবিরকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছে শিবির। পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিবিরকর্মীরা ধ্বংসাত্মক কাজের চেষ্টা করলে পুলিশ শটগানের গুলি ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিবির মহানগর দক্ষিণ শাখার সেক্রেটারি মুঈনুদ্দিন মৃধাকে নির্মমভাবে পেটায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুলিশের সামনেই তারা ওই যুবককে মারধর করতে থাকে। পরে ওই যুবক অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় আল বারাকা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
প্রায় একই সময়ে হরতালের সমর্থনে বাড্ডায় মিছিল বের করেন স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি প্রধান সড়ক দিয়ে কিছুদূর এগোলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লে মিছিলকারীরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করলে পুলিশ সেখানেও বাধা দেয়। পরে পুলিশের সাথে সেখানেও মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে মিছিলকারীরা। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওপরের নির্দেশেই তাদের অনেক কিছু করতে হচ্ছে।
এর আগে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে জামায়াত নেতারা সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে রাজনৈতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের মাধ্যমে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবেন না। কারণ কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক নয়। কসাই কাদেরের কোনো কর্মকাণ্ড কাদের মোল্লার ওপর চাপানো হলে এই সরকারের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। আর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দীর্ঘ দিন ইসলাম প্রচার করেছেন। মুসলিম জনতার এ নয়নমণির ব্যাপারেও কিছু করার আগে ভেবে দেখা দরকার সরকারের।’
তারা আরো বলেন, মতিঝিলে সমাবেশের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেয়া হয়েছে। এটি সরকার বা কারো করুণা নয়, ২০ নেতাকর্মীর জীবনের বিনিময়ে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। প্রয়োজনে হাজার হাজার কর্মী জীবন দিয়ে ‘প্রহসনের ট্রাইব্যুনাল’ বন্ধ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মিথ্যা’ অভিযোগে আটক নেতাদের মুক্ত করবে।
বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের চার নেতাকর্মী নিহত এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ, নির্দলীয়-নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, জনদুর্ভোগ লাঘব ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত এই কর্মসূচির আয়োজন করে ঢাকা মহানগর জামায়াত। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এই কর্মসূচির অনুমতি চাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত মতিঝিলে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ প্রশাসন। এতে সভাপতিত্ব করেন জামায়াতের ঢাকা মহানগর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো: সেলিম উদ্দিন। বক্তব্য দেন জামায়াত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, ঢাকা মহানগর কর্মপরিষদ সদস্য মশিউল আলম ও লুৎফুর রহমান এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত। সঞ্চালক ছিলেন জামায়াত ঢাকা মহানগর সহকারী সেক্রেটারি মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
সমাবেশে হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেন, মতিঝিলে সমাবেশের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেয়া হয়েছে। তবে এটি সরকার বা কারো করুণা নয়, বর্তমান সরকারের সময়ে শিবিরের ১৪ এবং জামায়াতের ৬ নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। তাদের ২০ জনের জীবনের বিনিময়ে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই অর্জনকে ধারণ করে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের চার বছরের তিন বছরই আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা যেভাবে নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে দেশে বসবাস করেন আমরাও সেভাবে বসবাস করছি। কিন্তু সরকার কেন আমাদের সাংবিধানিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে? আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে রাজি। কিন্তু শান্তিশৃঙ্খলা রার দায়িত্ব সরকারের। আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে বিগত তিন বছর সরকারের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
‘কথিত যুদ্ধাপরাধের’ মিথ্যা অভিযোগে জামায়াত নেতাদের সরকার আটকে রেখেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জনের বিচারের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন করেছিল। কিন্তু তাদের বিনা বিচারে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে এই বিচার হতে পারে না। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমাদের নিরপরাধ নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেও বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো রায় হলে জাতির কপালে আরেকটি কলঙ্ক লেপন করা হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জামায়াতের এই নেতা বলেন, এখনো আমাদের অনেক পথচলা বাকি আছে। কুচক্রীমহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইবে। দূর থেকে উসকানি দিয়ে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। পুলিশের ভেতরে থাকা কুচক্রীরাও উসকানি দিতে পারে। কিন্তু তাদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
বগুড়ায় নিহত চার নেতাকর্মীর খুনিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নয়তো জনগণই তাদের গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দেবে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কোরির মাধ্যমে ল-কোটি টাকা লুট এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে সেলিম উদ্দিন বলেন, বগুড়ায় জামায়াত নেতা খুনিদের আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। নয়তো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘রোববার মাগরিবের পর জানলাম সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। সে হিসাবে ২৪ ঘণ্টা সময়ও আমরা পাইনি। তাতেই মতিঝিল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। তিন দিন সময় পেলে লাখ লাখ কর্মী আমরা রাজপথে নামাতে পারব ইনশাল্লাহ।’
জামায়াতের এই নেতা আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেন, ‘একটা রায় শেষ নয়। একটির পর আরো অনেক রায় হবে। আপনারদেরও এ দেশে থাকতে হবে, আমরাও থাকব। আমাদের উচ্ছৃঙ্খল বানানোর চেষ্টা করলে সেটি সফল হবে না। দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাবেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন শেষ নয়, সমাবেশের মাধ্যমে বিজয়ের শুরু হয়েছে। তিন-তিনশ’ নয়, প্রয়োজনে তিন হাজারের বেশি জীবনের বিনিময়ে নেতাদের মুক্ত করা হবে ইনশাল্লাহ।’
কারওয়ানবাজারে বৃষ্টির মতো গুলি
এ দিকে আজ দেশজুড়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গতকাল শিবিরের মিছিলে হামলা চালিয়েছে পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুলিশের গুলি ও যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বেধড়ক মারধরে বেশ কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিবিরের এক নেতাকে ধরে নির্মমভাবে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে য্বুলীগ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কারওয়ানবাজারে শিবিরের মিছিলে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা হরতালের সমর্থনে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর আন্ডারপাসের কাছে পৌঁছলে পুলিশ অতর্কিত মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। পরে মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। পুলিশ এ সময় প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন। ঘটনার সময় সেখানে ১০-১২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এসব ঘটনায় অন্তত পাঁচজন শিবিরকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছে শিবির। পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিবিরকর্মীরা ধ্বংসাত্মক কাজের চেষ্টা করলে পুলিশ শটগানের গুলি ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিবির মহানগর দক্ষিণ শাখার সেক্রেটারি মুঈনুদ্দিন মৃধাকে নির্মমভাবে পেটায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুলিশের সামনেই তারা ওই যুবককে মারধর করতে থাকে। পরে ওই যুবক অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় আল বারাকা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
প্রায় একই সময়ে হরতালের সমর্থনে বাড্ডায় মিছিল বের করেন স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি প্রধান সড়ক দিয়ে কিছুদূর এগোলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লে মিছিলকারীরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করলে পুলিশ সেখানেও বাধা দেয়। পরে পুলিশের সাথে সেখানেও মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে মিছিলকারীরা। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওপরের নির্দেশেই তাদের অনেক কিছু করতে হচ্ছে।
No comments