জাতীয় সংসদকে কলতলা বানানো চলবে না by আবদুল মান্নান
ডেটলাইন ৩ মার্চ ২০১০। ঢাকা। বাংলাদেশের
জাতীয় সংসদ। মাগরিবের নামাজের বিরতির পর বিএনপির সংরতি আসনের সংসদ সদস্য
শাম্মি আখতার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানকে 'ফেরাউন-নমরূদ'-এর সঙ্গে তুলনা করলে সংসদে শুরু হয়
তুমুল হৈ-হট্টগোল।
এই হৈ-হট্টগোলে অবধারিতভাবে জড়িয়ে যায়
সরকারী দল ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য। হৈ-হট্টগোল ঝগড়া-বিবাদ গড়াতে
গড়াতে শেষ পর্যন্ত 'তুই তোকারি', 'চুপ ব্যাটা বস', 'শালা' ইত্যাদিতে গিয়ে
ঠেকে। একাধিক সংসদ সদস্য দাঁড়িয়ে টেবিল চাপড়িয়ে ফাইল ছুড়ে হট্টগোলে যোগ
দেয়। দু'একজন জামার আস্তিন গুটিয়ে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যায়। পুরো
হৈ-হট্টগোল পর্বে এগিয়ে ছিলেন বিএনপিদলীয় সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ
সদস্যরা। এক পর্যায়ে তারা সংসদ অধিবেশন হতে ওয়াকআউট করেন। ৪ মার্চ বিভিন্ন
সংবাদমাধ্যমে এ সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ।
ডেটলাইন ৮ মার্চ ২০১০। নতুন দিল্লী। ভারতের রাজ্যসভার অধিবেশন। সোনিয়া গান্ধী মনে করলেন প্রায় চৌদ্দ বছর ঝুলে থাকা মহিলা আসন সংরক্ষণ বিলটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শত বর্ষপূর্তির দিন রাজ্যসভায় পাস করিয়ে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন। বিলটিতে ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভায় এক তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটি উত্থাপনের চার দিন আগেই বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজিডি) নেতা লালু প্রসাদ যাদব হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন সরকার বিলটি পাস করাতে গেলে 'যুদ্ধ হোগা'। ৮ তারিখ যুদ্ধ হলো ভারতের রাজ্যসভায়। তবে সেই যুদ্ধে লালু একা ছিলেন না। সঙ্গে পেলেন তার আরেক জ্ঞাতি ভাই উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির মুলায়াম সিং যাদব। তাদের সঙ্গে ছিলেন তাদের দলীয় সদস্যরা যারা ময়দানের সৈনিক হিসেবে লড়াই করেছেন। কেমন ছিল সে লড়াই? সে দিন রাতে ভারতের এনডিটিভি ও অন্যান্য টিভি চ্যানেলের সংবাদে তা দেখার সুযোগ বাংলাদেশের অনেক দর্শকের হয়েছে।
সংক্ষেপে দৃশ্যটি এ রকম। বেলা এগারোটায় রাজ্যসভার অধিবেশন চেয়ারম্যান ও ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সভাপতিত্বে শুরু হয়। বেলা দু'টায় সভাপতি ভারতের আইনমন্ত্রী ভিরাপ্পা মোইলিকে বিলটি উত্থাপনের আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গেই লালু প্রসাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। লালু আর মুলায়াম সিং এবং তাদের অনুসারীরা বিলের সব কাগজপত্র ছিঁড়ে চেয়ারম্যানের দিকে ছুড়ে মারেন। সকলে এক জোট হয়ে করে মাঝখানে এসে তুমুল হৈ-হট্টগোল শুরু করেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন পুরুষ শাসিত সমাজে এই আইন চলতে পারে না। অভাবনীয় কাজটি করেছেন সমাজবাদী পার্টির সদস্য নন্দ কিশোর যাদব। তিনি দৌড়ে গিয়ে সংসদের চেয়ারম্যান হামিদ আনসারির সামনে থেকে মাইক স্ট্যান্ড ও কলমদানী তুলে নিয়ে যান। একই দলের কামাল আখতার সংসদের রিপোর্টারদের টেবিলে উঠে কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করেন। এই ফাঁকে আর দু'জন সতীর্থ রাজ্যসভার মহাসচিবের মাইক্রোফোন আর কলমদানী তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। লালু-মুলায়ামের এবং তাদের অনুসারীদের এই উন্মাদনা থামানোর জন্য কংগ্রেস দলীয় কয়েক সদস্য এবং সংসদের মার্শলরা ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অধিবেশনের চেয়ারম্যান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে অধিবেশন ঐ দিনের জন্য মুলতবি করেন। বিলটি পাস করানোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারী দল কংগ্রেসের আছে। তারা ধারণা করেনি লালু-মুলায়াম বিলটি নিয়ে আরিক অর্থেই যুদ্ধ করবেন। দু'জনই কংগ্রেসকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছেন। এবার বলেছেন এ বিল পাস হলে তারা তাদের এই সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। বিলটি যখন ৯ মার্চ রাজ্যসভায় পাস হয় তখন লালু-মুলায়াম ইউপিএ সরকার হতে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ।
ঘটনার পরদিন অসদাচরণের দায়ে রাজ্যসভা হতে সাত সদস্যকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাকা-দিল্লীতে কয়েক দিনের ব্যবধানে যা ঘটল তা কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্রমনা মানুষ সমর্থন করতে পারে না। দুটো ঘটনার মধ্যে মিল থাকলেও একটি জায়গায় অমিল আছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কিছু সংসদ সদস্য যে অশালীন ও অশোভন ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং যেভাবে একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন তা ভারতের রাজ্যসভায় ঘটেনি। ঘটনার পর লালু উপ-রাষ্ট্রপতি ও অধিবেশনের সভাপতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে কোন সংসদ সদস্য তাদের আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেননি যদিও তাঁদের উচিত ছিল জাতির কাছে মা প্রার্থনা করা।
১৯৯৬ সনের অক্টোবর মাসে নতুন দিল্লীর কনোট প্রেসের অভিজাত বিপণিকেন্দ্রে 'বুকওয়ার্ম' নামক এক বইয়ের দোকানে একটি বই খুঁজতে গিয়েছিলাম। বইটি এমএন কাউলের Practice and Procedure of Parliament এমএন কাউল ভারতের লোকসভার সচিবালয়ের সঙ্গে ভারত বিভাগ পূর্ব সময় হতে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমাপের পণ্ডিত এবং আইন বিশারদ। ১৯৫২ সন হতে ১৯৬৪ সন পর্যন্ত তিনি লোকসভার সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন এবং সে পদে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার দীর্ঘদিনের ভারতের লোকসভার কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুবাধে এই অসাধারণ গ্রন্থটি রচনা করেন যা পরবর্তীকালে শুধু ভারত নয়, অন্যান্য অনেক দেশেও সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আবশ্যিক পুস্তক হিসেবে সমাদৃত। বইটিতে মোটামুটি একটি সংসদ কীভাবে চলবে, তার সদস্যদের আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত এবং তাদের দায়িত্ব ও মতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
'বুকওয়ার্মের' মালিক একজন পাঞ্জাবী শিখ। বয়স চল্লিশের কোটায় হবে। আমাকে চোস্ত ইংরেজীতে প্রশ্ন করলেন, আমি কী লোকসভার কোন সদস্য বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি? তাকে জানালাম_ এর কোনটাই না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বইটি আমার নিজের সংগ্রহের জন্য কিনতে চাই। এ রকম অনেক বই আমার সংগ্রহে আছে। তিনি আমাকে জানালেন বইটি তার সংগ্রহে নেই, কারণ এখন এই বই খুব একটা বিক্রয় হয় না। লোকসভার সদস্যরা চাইলে তা পার্লামেন্টের সচিবালয় থেকে বিনামূল্যে নিতে পারেন। তবে আমি চাইলে পর দিন তিনি তা এনে দিতে পারবেন। 'বুকওয়ার্মে'র মালিক সেদিন একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন। তার মতে, কাউল যখন এই গ্রন্থটি রচনা করেন তখন তিনি মনে করেছিলেন ভারতের রাজনীতিতে এবং পার্লামেন্টে শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিবান মানুষের বেশি করে পদার্পণ ঘটবে। কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে উল্টো। এ ধরনের মানুষ আর রাজনীতিতে আসছেন না। সে কারণে ভারতের রাজনীতির বেহাল দশা। বুঝলাম ভদ্রলোক লেখাপড়া করেন এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ওঠার সময় আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কী? যেহেতু বিদেশে গেলে আমি কখনও নিজ দেশ সম্পর্কে সরাসরি কোন নেতিবাচক মন্তব্য করি না সেহেতু বললাম খারাপ নয়। কায়দা করে বললাম আরও ভাল হওয়ার সুযোগ আছে। পরদিন তিনি বইটি আমাকে এনে দিয়েছিলেন। চিন্তা করি, এখন ক'জন সংসদ সদস্য কাউলের নাম শুনেছেন বা তার বই পড়েন বা পড়ার প্রয়োজন মনে করেন। সরকারের উচিত বইটি এনে সকল সংসদ সদস্যের মাঝে বিলি করা এবং তাদের তা পড়তে অনুরোধ করা । তবে তা হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখি না ।
১৯৭২ সনে একবার আমার সুযোগ হয়েছিল বাবার সঙ্গে বাংলাদেশের গণপরিষদের অধিবেশনে যাওয়ার। চট্টগ্রাম হতে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য জহুর আহম্মদ চৌধুরী আর আমাদের বাসা একই পাড়ায়। বাবা প্রায়শ ব্যবসা ও মামলা মোকদ্দমার কাজে ঢাকায় আসেন। ওঠেন আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের কক্ষে। তখন তা স্বাভাবিক ছিল। আমার শেষ পর্বের পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। মাঝে মাঝে বাবা চট্টগ্রাম হতে জহুর আহম্মদ চৌধুরীর জন্য চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট আনতেন। চৌধুরী সাহেব তখন স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা মন্ত্রী। থাকেন বেইলী রোডে মন্ত্রীপাড়ায়। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন দেখা করে বললেন, সংসদ অধিবেশন দেখতে চান। তার পিএস-কে বলে তিনি আমাদের জন্য দু'টি পাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৭২ সনে সংসদ বসত বর্তমানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বাহাত্তরের গণপরিষদে কোন বিরোধী দল ছিল না। বিরোধী দল বলতে সিলেট হতে নির্বাচিত ন্যাপ-এর শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যে দিনের কথা বলছি সে দিন গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া চারশ' সদস্য। সবাই উপস্থিত থাকলে কারও পক্ষে সহজে নড়াচড়া সম্ভব হয় না। অনেকের মনে হতে পারে, একদলীয় একটি সংসদে এমন কী আর আকর্ষণ থাকতে পারে। ছিল। ওইদিন পরিষদে বেশ উত্তাপই ছিল। কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তা এতদিন পরে মনে নেই। তবে এটি মনে আছে, সেদিন অধিবেশনে কোন একটি বিষয় নিয়ে সদস্যদের মাঝে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। যাদের কথা মনে আছে তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজে একাধিকবার বক্তব্য রেখেছিলেন। আসাদুজ্জামান খান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও বক্তব্য দিতে শুনেছি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে সে বিতর্ক চললেও কখনও তা কোনভাবেই অশ্রবণযোগ্য হয়নি। বরং সদস্যরা তো বটেই দর্শকরাও তা বেশ উপভোগ করেছে, কারণ যারা কথা বলছিলেন তাদের লেখাপড়া ছিল, রুচি ছিল এবং সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা ছিল। এতদিন পর এই কথাগুলো বর্তমান সংসদ সদস্যদের অনেকের সম্পর্কেই বলা যাবে না। এমন মন্তব্য সংসদের মাননীয় স্পিকার আব্দুল হামিদও করেছেন। একই কথা সম্ভবত ভারতের পার্লামেন্টের বেলায় ও প্রযোজ্য। এমএন কাউল এখন কেউ পড়েন না। ভারতেও না বাংলাদেশে তো নয়ই। সকলে বুঝে গেছেন এখন অর্থ আর সম্পর্ক থাকলে সংসদ সদস্য হওয়া যায়। অন্য যোগ্যতা বলতে কিছু থাকতে নেই।
সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের ব্যয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এক ঘণ্টায় ২১ লাখ। এগুলো গরিব জনগণের টাকা। খেটে খাওয়া মানুষের টাকা। সংসদ নাকি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে যা কিছু হবে তা জনগণের কল্যাণের জন্য। বর্তমান সংসদে এ যাবত যা কিছু হয়েছে তাতে জনগণ ও তাদের কল্যাণের তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমান যদি আগামী দিনের প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে আশার কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর সেটি যদি না হয় তাহলে গণতন্ত্র তো আবারও নির্বাসনে যেতে পারে। খুলে যেতে পারে আর একটি এক-এগারোর দ্বার। গণতন্ত্র এবার নির্বাসনে গেলে আর সহজে নাও তো ফিরতে পারে। ১৯৫৮ সালে পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদের ভিতর কিছু সদস্য মাইকের স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সেই ঘটনার ওপর ভর করেই আয়ুব খান মতা দখল করে দশ বছর পাকিস্তানকে শাসন করেছে। কামনা করি এ রকম আর একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে না ঘটুক ।
যে সকল সংসদ সদস্য কোমর বেঁধে হরদিন সংসদে হৈ-হট্টগোল করতে পছন্দ করেন তারা যদি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'মৃতু্যুধা' উপন্যাসটি না পড়ে থাকেন তা পড়ার অনুরোধ করি। উপন্যাসের শুরুতে একটি কলতলার দৃশ্য আছে। সঙ্গে কিছু চরিত্র আছে। তাদের কিছু ভাষা আছে। বর্তমানে কিছু সংসদ সদস্যের আচরণের কারণে জাতীয় সংসদকে 'মৃতু্যুধার' কলতলার মতো মনে হওয়া স্বাভাবিক। দেশের মানুষ তো সংসদকে কলতলা বানানোর জন্য ভোট দিয়ে সদস্যদের সংসদে পাঠায়নি ।
লেখক : শিক্ষাবিদ । ১০ মার্চ , ২০১০
ডেটলাইন ৮ মার্চ ২০১০। নতুন দিল্লী। ভারতের রাজ্যসভার অধিবেশন। সোনিয়া গান্ধী মনে করলেন প্রায় চৌদ্দ বছর ঝুলে থাকা মহিলা আসন সংরক্ষণ বিলটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শত বর্ষপূর্তির দিন রাজ্যসভায় পাস করিয়ে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন। বিলটিতে ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভায় এক তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটি উত্থাপনের চার দিন আগেই বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজিডি) নেতা লালু প্রসাদ যাদব হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন সরকার বিলটি পাস করাতে গেলে 'যুদ্ধ হোগা'। ৮ তারিখ যুদ্ধ হলো ভারতের রাজ্যসভায়। তবে সেই যুদ্ধে লালু একা ছিলেন না। সঙ্গে পেলেন তার আরেক জ্ঞাতি ভাই উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির মুলায়াম সিং যাদব। তাদের সঙ্গে ছিলেন তাদের দলীয় সদস্যরা যারা ময়দানের সৈনিক হিসেবে লড়াই করেছেন। কেমন ছিল সে লড়াই? সে দিন রাতে ভারতের এনডিটিভি ও অন্যান্য টিভি চ্যানেলের সংবাদে তা দেখার সুযোগ বাংলাদেশের অনেক দর্শকের হয়েছে।
সংক্ষেপে দৃশ্যটি এ রকম। বেলা এগারোটায় রাজ্যসভার অধিবেশন চেয়ারম্যান ও ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সভাপতিত্বে শুরু হয়। বেলা দু'টায় সভাপতি ভারতের আইনমন্ত্রী ভিরাপ্পা মোইলিকে বিলটি উত্থাপনের আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গেই লালু প্রসাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। লালু আর মুলায়াম সিং এবং তাদের অনুসারীরা বিলের সব কাগজপত্র ছিঁড়ে চেয়ারম্যানের দিকে ছুড়ে মারেন। সকলে এক জোট হয়ে করে মাঝখানে এসে তুমুল হৈ-হট্টগোল শুরু করেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন পুরুষ শাসিত সমাজে এই আইন চলতে পারে না। অভাবনীয় কাজটি করেছেন সমাজবাদী পার্টির সদস্য নন্দ কিশোর যাদব। তিনি দৌড়ে গিয়ে সংসদের চেয়ারম্যান হামিদ আনসারির সামনে থেকে মাইক স্ট্যান্ড ও কলমদানী তুলে নিয়ে যান। একই দলের কামাল আখতার সংসদের রিপোর্টারদের টেবিলে উঠে কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করেন। এই ফাঁকে আর দু'জন সতীর্থ রাজ্যসভার মহাসচিবের মাইক্রোফোন আর কলমদানী তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। লালু-মুলায়ামের এবং তাদের অনুসারীদের এই উন্মাদনা থামানোর জন্য কংগ্রেস দলীয় কয়েক সদস্য এবং সংসদের মার্শলরা ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অধিবেশনের চেয়ারম্যান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে অধিবেশন ঐ দিনের জন্য মুলতবি করেন। বিলটি পাস করানোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারী দল কংগ্রেসের আছে। তারা ধারণা করেনি লালু-মুলায়াম বিলটি নিয়ে আরিক অর্থেই যুদ্ধ করবেন। দু'জনই কংগ্রেসকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছেন। এবার বলেছেন এ বিল পাস হলে তারা তাদের এই সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। বিলটি যখন ৯ মার্চ রাজ্যসভায় পাস হয় তখন লালু-মুলায়াম ইউপিএ সরকার হতে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ।
ঘটনার পরদিন অসদাচরণের দায়ে রাজ্যসভা হতে সাত সদস্যকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাকা-দিল্লীতে কয়েক দিনের ব্যবধানে যা ঘটল তা কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্রমনা মানুষ সমর্থন করতে পারে না। দুটো ঘটনার মধ্যে মিল থাকলেও একটি জায়গায় অমিল আছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কিছু সংসদ সদস্য যে অশালীন ও অশোভন ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং যেভাবে একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন তা ভারতের রাজ্যসভায় ঘটেনি। ঘটনার পর লালু উপ-রাষ্ট্রপতি ও অধিবেশনের সভাপতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে কোন সংসদ সদস্য তাদের আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেননি যদিও তাঁদের উচিত ছিল জাতির কাছে মা প্রার্থনা করা।
১৯৯৬ সনের অক্টোবর মাসে নতুন দিল্লীর কনোট প্রেসের অভিজাত বিপণিকেন্দ্রে 'বুকওয়ার্ম' নামক এক বইয়ের দোকানে একটি বই খুঁজতে গিয়েছিলাম। বইটি এমএন কাউলের Practice and Procedure of Parliament এমএন কাউল ভারতের লোকসভার সচিবালয়ের সঙ্গে ভারত বিভাগ পূর্ব সময় হতে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমাপের পণ্ডিত এবং আইন বিশারদ। ১৯৫২ সন হতে ১৯৬৪ সন পর্যন্ত তিনি লোকসভার সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন এবং সে পদে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার দীর্ঘদিনের ভারতের লোকসভার কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুবাধে এই অসাধারণ গ্রন্থটি রচনা করেন যা পরবর্তীকালে শুধু ভারত নয়, অন্যান্য অনেক দেশেও সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আবশ্যিক পুস্তক হিসেবে সমাদৃত। বইটিতে মোটামুটি একটি সংসদ কীভাবে চলবে, তার সদস্যদের আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত এবং তাদের দায়িত্ব ও মতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
'বুকওয়ার্মের' মালিক একজন পাঞ্জাবী শিখ। বয়স চল্লিশের কোটায় হবে। আমাকে চোস্ত ইংরেজীতে প্রশ্ন করলেন, আমি কী লোকসভার কোন সদস্য বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি? তাকে জানালাম_ এর কোনটাই না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বইটি আমার নিজের সংগ্রহের জন্য কিনতে চাই। এ রকম অনেক বই আমার সংগ্রহে আছে। তিনি আমাকে জানালেন বইটি তার সংগ্রহে নেই, কারণ এখন এই বই খুব একটা বিক্রয় হয় না। লোকসভার সদস্যরা চাইলে তা পার্লামেন্টের সচিবালয় থেকে বিনামূল্যে নিতে পারেন। তবে আমি চাইলে পর দিন তিনি তা এনে দিতে পারবেন। 'বুকওয়ার্মে'র মালিক সেদিন একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন। তার মতে, কাউল যখন এই গ্রন্থটি রচনা করেন তখন তিনি মনে করেছিলেন ভারতের রাজনীতিতে এবং পার্লামেন্টে শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিবান মানুষের বেশি করে পদার্পণ ঘটবে। কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে উল্টো। এ ধরনের মানুষ আর রাজনীতিতে আসছেন না। সে কারণে ভারতের রাজনীতির বেহাল দশা। বুঝলাম ভদ্রলোক লেখাপড়া করেন এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ওঠার সময় আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কী? যেহেতু বিদেশে গেলে আমি কখনও নিজ দেশ সম্পর্কে সরাসরি কোন নেতিবাচক মন্তব্য করি না সেহেতু বললাম খারাপ নয়। কায়দা করে বললাম আরও ভাল হওয়ার সুযোগ আছে। পরদিন তিনি বইটি আমাকে এনে দিয়েছিলেন। চিন্তা করি, এখন ক'জন সংসদ সদস্য কাউলের নাম শুনেছেন বা তার বই পড়েন বা পড়ার প্রয়োজন মনে করেন। সরকারের উচিত বইটি এনে সকল সংসদ সদস্যের মাঝে বিলি করা এবং তাদের তা পড়তে অনুরোধ করা । তবে তা হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখি না ।
১৯৭২ সনে একবার আমার সুযোগ হয়েছিল বাবার সঙ্গে বাংলাদেশের গণপরিষদের অধিবেশনে যাওয়ার। চট্টগ্রাম হতে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য জহুর আহম্মদ চৌধুরী আর আমাদের বাসা একই পাড়ায়। বাবা প্রায়শ ব্যবসা ও মামলা মোকদ্দমার কাজে ঢাকায় আসেন। ওঠেন আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের কক্ষে। তখন তা স্বাভাবিক ছিল। আমার শেষ পর্বের পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। মাঝে মাঝে বাবা চট্টগ্রাম হতে জহুর আহম্মদ চৌধুরীর জন্য চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট আনতেন। চৌধুরী সাহেব তখন স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা মন্ত্রী। থাকেন বেইলী রোডে মন্ত্রীপাড়ায়। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন দেখা করে বললেন, সংসদ অধিবেশন দেখতে চান। তার পিএস-কে বলে তিনি আমাদের জন্য দু'টি পাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৭২ সনে সংসদ বসত বর্তমানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বাহাত্তরের গণপরিষদে কোন বিরোধী দল ছিল না। বিরোধী দল বলতে সিলেট হতে নির্বাচিত ন্যাপ-এর শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যে দিনের কথা বলছি সে দিন গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া চারশ' সদস্য। সবাই উপস্থিত থাকলে কারও পক্ষে সহজে নড়াচড়া সম্ভব হয় না। অনেকের মনে হতে পারে, একদলীয় একটি সংসদে এমন কী আর আকর্ষণ থাকতে পারে। ছিল। ওইদিন পরিষদে বেশ উত্তাপই ছিল। কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তা এতদিন পরে মনে নেই। তবে এটি মনে আছে, সেদিন অধিবেশনে কোন একটি বিষয় নিয়ে সদস্যদের মাঝে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। যাদের কথা মনে আছে তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজে একাধিকবার বক্তব্য রেখেছিলেন। আসাদুজ্জামান খান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও বক্তব্য দিতে শুনেছি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে সে বিতর্ক চললেও কখনও তা কোনভাবেই অশ্রবণযোগ্য হয়নি। বরং সদস্যরা তো বটেই দর্শকরাও তা বেশ উপভোগ করেছে, কারণ যারা কথা বলছিলেন তাদের লেখাপড়া ছিল, রুচি ছিল এবং সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা ছিল। এতদিন পর এই কথাগুলো বর্তমান সংসদ সদস্যদের অনেকের সম্পর্কেই বলা যাবে না। এমন মন্তব্য সংসদের মাননীয় স্পিকার আব্দুল হামিদও করেছেন। একই কথা সম্ভবত ভারতের পার্লামেন্টের বেলায় ও প্রযোজ্য। এমএন কাউল এখন কেউ পড়েন না। ভারতেও না বাংলাদেশে তো নয়ই। সকলে বুঝে গেছেন এখন অর্থ আর সম্পর্ক থাকলে সংসদ সদস্য হওয়া যায়। অন্য যোগ্যতা বলতে কিছু থাকতে নেই।
সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের ব্যয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এক ঘণ্টায় ২১ লাখ। এগুলো গরিব জনগণের টাকা। খেটে খাওয়া মানুষের টাকা। সংসদ নাকি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে যা কিছু হবে তা জনগণের কল্যাণের জন্য। বর্তমান সংসদে এ যাবত যা কিছু হয়েছে তাতে জনগণ ও তাদের কল্যাণের তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমান যদি আগামী দিনের প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে আশার কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর সেটি যদি না হয় তাহলে গণতন্ত্র তো আবারও নির্বাসনে যেতে পারে। খুলে যেতে পারে আর একটি এক-এগারোর দ্বার। গণতন্ত্র এবার নির্বাসনে গেলে আর সহজে নাও তো ফিরতে পারে। ১৯৫৮ সালে পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদের ভিতর কিছু সদস্য মাইকের স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সেই ঘটনার ওপর ভর করেই আয়ুব খান মতা দখল করে দশ বছর পাকিস্তানকে শাসন করেছে। কামনা করি এ রকম আর একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে না ঘটুক ।
যে সকল সংসদ সদস্য কোমর বেঁধে হরদিন সংসদে হৈ-হট্টগোল করতে পছন্দ করেন তারা যদি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'মৃতু্যুধা' উপন্যাসটি না পড়ে থাকেন তা পড়ার অনুরোধ করি। উপন্যাসের শুরুতে একটি কলতলার দৃশ্য আছে। সঙ্গে কিছু চরিত্র আছে। তাদের কিছু ভাষা আছে। বর্তমানে কিছু সংসদ সদস্যের আচরণের কারণে জাতীয় সংসদকে 'মৃতু্যুধার' কলতলার মতো মনে হওয়া স্বাভাবিক। দেশের মানুষ তো সংসদকে কলতলা বানানোর জন্য ভোট দিয়ে সদস্যদের সংসদে পাঠায়নি ।
লেখক : শিক্ষাবিদ । ১০ মার্চ , ২০১০
No comments