মৃদু মানুষের দ্রষ্টা by ফারুক ওয়াসিফ
হুমায়ূনেরই প্রিয় ছিল গানটা, ‘উইড়া যায়রে শুয়া পঙ্খি, পইড়া থাকে ছায়া।’ হুমায়ূন আর ছায়া ফেলবেন না, মায়া ফেলবেন। মায়াই তাঁর ছায়া। মায়ার পাখি হয়ে এসেছিলেন, মানুষের মনে মায়াই বুনে গেছেন। যা ছুঁয়েছেন, মায়ার স্পর্শে তা-ই সুন্দর হয়ে ফুটেছে। এই মায়ার ফুল দেখা যায়, রাখা যায় না।
আমরা যারা শহর-নিমশহরে মানুষ, আমাদের শৈশব-কৈশোরটা কোনোভাবেই পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার মতো হওয়ার নয়। অপরাজিতর তরুণ অপুর কলকাতাবাসের গল্প আমাদের নয়। আমাদের উদাস দুপুর, আমাদের অকারণ মন খারাপের কথা কেউ তো বলেনি। আমাদের অসচ্ছল সংসারের এইসব দিনরাত্রিতে কত ছোট ছোট অনুভূতির ফুল ফোটে আর ঝরে, কে তা খেয়াল করে? এসব মৃদু মানুষের মৃদু জীবনের নন্দিত নরকের কথা বলবেন কোন ঈশ্বর? কে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের মায়াকে আমাদেরই একজন হয়ে, আমাদেরই মতো করে, আমাদেরই ভাষায় প্রকাশ করবেন? নগর-উপনগর আর মফস্বলে আমরা সামান্য হয়ে ছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের তুলে নিয়ে তাঁর জগৎ সাজালেন, মনের আয়নায় বড় করে দেখালেন। আজ সেই আয়নাখানা হারিয়ে গেল। মায়ার পাখি উড়াল দিল।
আমাদের বেড়ে ওঠার একেকটি অধ্যায়ের হাতে, টেবিলে, বালিশের নিচে, ব্যাগের ভেতর হুমায়ূনের একেকটা বই। মন খারাপের বিকেল, জ্বরতাপিত রাত, নিঃসঙ্গ দুপুর, নিশিবৃষ্টির ক্ষণ, মন দেওয়া-নেওয়ার লগ্নগুলোর স্মারক হয়ে আছে হুমায়ূনের একেকটা বই। হুমায়ূনের খোকা, আনিস, পরী, নীলা, রুনু, রাবেয়া ও মন্টুদের সঙ্গ পেয়ে আমরা বড় হয়ে উঠি। তাঁর উপন্যাসের মা-বাবা, ভাইবোনদের মধ্যে আমরা আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়ে যাই। পাড়ার মাস্তানটি তাঁর কাহিনিতে ভালোবাসার রাজপুত্তুর হয়ে ওঠে। হুমায়ূনের মায়ার ছোঁয়ায় সবই কত মানবিক, কত আপন আর চেনা। এভাবে হুমায়ূন আমাদের গত তিন-চার দশকের জীবনীর অংশ হয়ে ওঠেন। তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমরা তাই আমাদের অতীতকেই ফিরে দেখি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হুমায়ূন একবার আমাদের শহরে এলেন। ভোরবেলা দেখা করার সময় পাওয়া গেল। স্থানীয় পর্যটন মোটেলে উঠেছেন। প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। শীতের ভোরে সেখানে গিয়ে দেখি, মোটেলের বারান্দায় পায়চারি করছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটছেন, আর শীতের কুয়াশা বারবার তাঁকে ঢেকে ফেলছে। সেই কুয়াশা ফুঁড়ে আবার তিনি বেরিয়ে আসছেন। আজ তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, চিরটা কালই ভেতরের মানুষটা কুয়াশাঘেরা হয়েই ছিলেন। মৃত্যুতে সেই কুয়াশা যেন আরও ঘন হয়ে এল, ব্যক্তিমানুষটা সেই কুয়াশার ভেতরে আরও বেশি করে যেন ঢুকে যাচ্ছেন; আর ফিরছেন না।
দুই.
একাত্তরের পরের জঙ্গম সময়ে ঠান্ডা নিরুচ্চার বেদনার ধাক্কা নিয়ে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। কোথায় পেলেন এই গল্প? এই গল্পের কোথাও বোঝার উপায় নেই, দেশ-ভূগোল-মন থেঁতলানো একটা যুদ্ধসময় পার করে করেও ত্বরাতে পারছে না নতুন দেশটা। এ রকম গোলমালে একাত্তরের সাত কোটি মানুষের সাত কোটি গল্প হঠাৎ মুখ বুজে ফেলল। এ রকম সময় লোকে মায়াকভস্কি চায়, গোর্কি-নেরুদা-নাজিম হিকমতকে চায়। কেননা, বিপ্লব শেষ হয়নি, সোনার বাংলার সাধ তখনো মেটেনি। জীবনবাদ্য তখন চড়া তালে বাজছে। তার ভেতরে বসে গুণগুণ করে এক সামান্য পরিবারের তৎসামান্য আলেখ্য বলতে বসলেন এই লেখক। নন্দিত নরকের জন্ম হলো।
সংগ্রামের উত্তাপ তখনো শুকায়নি। জাসদ-সর্বহারা-রক্ষীবাহিনীর যুগ। দুঃশাসন-নৈরাজ্য-অনাহারের দিন। সেটাও একরকম নন্দিত নরক। কিন্তু হুমায়ূনের সেই নরকে উত্তাপ নেই। সেখানে ঠান্ডা-স্যাঁতসেঁতে দিশাহীন এক পরিবেশে মৃদু মানুষেরা জীবন অতিবাহিত করছে। সেসব সামান্য মানুষের স্বপ্নহীনতা দিয়েই তাঁর শুরু। ছোট ছোট কেরানিপ্রতিম স্বপ্ন তারা দেখে বটে, সেও স্বপ্নহীনতার শঙ্খনীল কারাগার ভালোবাসার জন্যই। তারা ইতিহাস গড়বে না। তারা কেবল একটু ভালো করে জীবনের আস্বাদন চায়। হঠাৎ কোনো সুসংবাদে দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু দিনশেষে তারা অতি সাধারণ। অসাধারণ কিছুই ঘটে না তাদের জীবনে। মামুলি খুটখাটে ভরা তাদের কর্মকাণ্ড। সব আহ্লাদ সব সুখসাধ বিসর্জনে গেলেও শান্ত মনে পরের দিনটি শুরু করার অধ্যবসায়ে কোনো কমতি নেই তাদের। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে এক কৃষককে দেখেছিলাম, ভর সন্ধ্যায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাটখেতের গোড়ার অন্ধকারে বসে নীরবে কাজ করছে, কোথাও কেউ নেই, পাটের গোড়ার মাটি ছাড়া আর কোনো দিকে নজরও নেই। হুমায়ূনের মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা এভাবে জীবনের গোড়া বাঁধতে বাঁধতেই জীবন শেষ করে দেয়। শেষাবধি তারা পারিবারিক-সাংসারিক-অযান্ত্রিক। তারা সীমা ডিঙায় না, বিদ্রোহ করে না। নিজের ভেতরের দেব ও দানবকে অনায়াসেই নিস্তেজ করে রাখতে তারা পারঙ্গম।
সারা জীবন এসব অযান্ত্রিক মৃদু মানুষদের নিস্তেজ জীবনের বিস্তারিত দেখিয়ে যেতে যেতে তাদের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এসব মানুষ জানে, তাদের ঈশ্বর তাদের স্বর্গ বা নরকে কোথাও পাঠাবেন না। এই পার্থিবতাতেই তিনি তাদের রাখবেন এবং ভালোবাসবেন। সেই ঈশ্বর তাদের একের পর এক আয়না জুগিয়ে গেছেন। সেই আয়না সামান্য মায়াবী অধিকটা দুনিয়াবি। মায়ার এই মিশেলের জন্যই আয়না তাদের আত্মদহনে ঠেলে না। তাদের চেতনের আকুতি, অচেতনের বিকার এই আয়নার শুশ্রূষা পায়। এভাবে তিনি এবং তাঁর চরিত্ররা একই সমতলে একই মানস-আবহের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। এভাবে তাঁর সাহিত্যে সত্তর-আশির দশকের ঢাকাই মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য সংরক্ষিত হয়ে আছে স্মৃতিপুঞ্জের আকারে। স্মৃতির ছবিতে কথায় ঘটনায় যেমন সন-তারিখ দাগানো থাকে না, তেমনি হুমায়ূনের চরিত্ররাও সময়হীন এক মায়াপুরীর বাসিন্দা।
আশির দশকে এই মধ্যবিত্ত বড় স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে। ঘর-সংসার-চাকরি-প্রেম এবং হঠাৎ গরিমার মধ্যে নিজেকে দেখার সাধ ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। এদের কথা পশ্চিমবঙ্গের নিমাই-শংকর-সুনীল-শীর্ষেন্দুরা কোনো দিন বলেননি। বলার কথাও নয়। মহান কথাশিল্পীরা চিরটা কাল এদের শ্লেষভরা রসকষ উপেক্ষা করে মানবতার প্রবাহ খুঁজেছেন আরও তলার মানুষের জীবনে। অথচ এরা আছে, একটু একটু করে জীবন গোছাচ্ছে, জগৎ-সংসারের মধ্যে আরও ঘন হয়ে লেপ্টে থাকতে চাচ্ছে। এই বিরাট মধ্যবিত্ত সমাজের সাংসারিক আর অলীক আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসী জীবনীকার তিনি। আর কিছু না হোক, উঠতি বাঙালি মুসলমান সমাজের আটপৌরে জীবনী খুঁজতে হুমায়ূনকে আমাদের লাগবেই।
এই মহিমাহীন মধ্যবিত্তের মনেই তো হিমুর মতো বাঁধনছেঁড়া দীনতামুক্ত অকপট তরুণের প্রতি আসক্তি জন্মে। নৈতিকতার দেহবন্ধনী আর অসামর্থ্যের শাসানিতে আটক বাসনা ও বিকারের নিদান পাওয়ার মিসির আলিকে দরকার হয়। তারা যা পারে না, হিমু তা পারে। মনের যে ধন্ধ তাদের জবরজং করে রাখে, মিসির আলি সেসব জট ছুটিয়ে দেন। হিমুর অযুক্তির উচ্ছ্বাস আর মিসির আলির যুক্তির স্থিরশীতলতায় মধ্যবিত্তের আত্মদর্শন হয়। নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের আত্মা পরম কিছুর জন্য ক্ষুধার্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রদের দেখি নানা রকম অতীন্দ্রিয়বাদী ঘোরে ডুবে সেই ক্ষুধা মেটায়। হুমায়ূন সে পথে নেন না পাঠককে, হিমু আর মিসির আলির মতো মানবিক ইহবাদী চরিত্রের সঙ্গ দিয়ে তাদের আত্মিক তৃষ্ণা মেটানোর উপায় করেন।
ষাটের দশকের মধ্যবিত্তের তেমন আত্মিক সংকটের দেখা পাওয়া যায় না সে সময়ের উপন্যাসে। সবই তখন জাতীয় সমাজের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লক্ষ্য খুঁজছে। কিছু অস্তিত্ববাদী নড়াচড়া কারও কারও মধ্যে দেখা দিলেও তা ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য উপভোগ কিংবা তদনুযায়ী জীবনযাপনের পার্শ্বফল। তখনো তাদের গ্রাম আছে, সমাজ আছে, ঐতিহ্য আছে; ফলে শূন্যতা কম। কিন্তু যুদ্ধ পেরোনো সমাজ এক ধাক্কায় সাবালক হয়ে মাটি-ভবন কামড়ে থাকার উপায় খুঁজতে হয়রান। গ্রাম দূরে চলে গেছে, পরিবারের বাঁধন আলগা হচ্ছে, সংস্কৃতির রস পানসে লাগছে, ভবিষ্যৎ ভরসা দিচ্ছে না। আশির দশকে এসে এই নগরজীবন বিচ্ছিন্নতার দেখা পায়। এই বিচ্ছিন্নতার ঘের কাটানোর মতো বড় প্রেরণাও তখন সমাজে অনুপস্থিত; বিশেষ করে উঠতি তরুণ-তরুণীর মনের তৃষ্ণা মেটানোর কিছু ছিল না। হুমায়ূনের সামাজিক আখ্যানের ভেতরে এই নাগরিক চাপা হাহাকার বদ্ধ ঘরের পাখির মতো ছটফট করে। তাই হিমু আর মিসির আলি চরিত্র তাদের মনের তলাকার ফাঁপর আর গুমরের মানবিক বিহিতের দায়িত্ব নেয়। তাঁর তোমাদের জন্য ভালবাসা, ইরিনা, বা নির মতো সায়েন্স ফিকশনগুলোও যতটা না বিজ্ঞান, তার থেকে বেশি মানবীয় সম্ভাবনার দিগন্তকে দেখায়। বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত এক রসের জন্ম হয়। বাদবাকিটা অসম্ভব প্রতিভাধর এক রসরাজের রসের খেলা, ভাষা আর বাক্যের লীলা।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তার চরিত্রেরা ভাবে না, কেবল কথা বলে আর কাজ করে। হুমায়ূন অবলীলায় কয়েকটি বাক্যে এদের জীবনটা এঁকে ফেলেন। কিন্তু এতটুকুতেই তাদের অন্তরাত্মার খবর পাওয়া যায়। তাদের নানা রকম ইচ্ছা হয়, খামখেয়াল হয়, আর তারা সেসব করে ফেলে কিংবা করতে পারে না। আত্মচিন্তা ছাড়া উপন্যাস হয় না, কিন্তু হুমায়ূনের উপন্যাসে তেমন চিন্তা নেই। এদের মনের তলায় অন্য মন যেন নেই, তারা একমনা একটানা মৃদু মানুষের মৃদু জীবন কাটিয়ে দেয়।
এরই মধ্যে নব্বই সাল আসে। সত্তরের ধুঁকতে থাকা অনিশ্চয়তা, আশিতে সামলে নিয়ে গোছগাছে মন দেওয়ার পর নব্বইয়ে সে মুক্ত হতে চায়। যে সেনাশাসনের ধাঁচের মধ্যে সাবেকি জীবনধারা, অন্তর্মুখী সময়, বাঁধো বাঁধো নাগরিকতা একধরনের স্থিতির মধ্যে ছিল; বিশ্বায়িত গণতন্ত্র আর মুক্তবাজারের যুগল ডানায় এবার তা উড়তে শুরু করে। বহিরাগত বাসনা আর ভেতরগত তাড়নার তোড়ে পুরোনো জগৎ, পুরোনো ঘরগেরস্থালি, পুরোনো দেহমন সাততাড়াতাড়ি বদলাতে শুরু করে। হুমায়ূনের পাত্রপাত্রীরা পলাশী থেকে দূরে সিরাজউদ্দৌলার কৃষকের মতো ভবিতব্যজ্ঞানহীনই থেকে যায়। বদলের এই ছবি হুমায়ূনীয় আয়নায় ততটা ধরা পড়ে না।
শূন্য দশকে মৃদু মানুষের অনেকেই প্রবল হওয়া শুরু করে। অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ভাসতে থাকে। তরুণদের সামনে আসে নতুন উত্তেজনা। কেনাকাটার হাত খোলা, মেলামেশায় শরীরখোলা, যোগাযোগে অজড়িত থাকার এই নতুন পরিবেশে হুমায়ূনের আনিস, সাবেত, পরী, নীলারা এক পাশে সরে যায় তাদের নিদাগ হূদয়সহ। তিনি তখন আরও পেছনে তাকাতে শুরু করেন, আরও আগের গল্প বুনতে থাকেন, ইতিহাসের জমিন হাতড়াতে থাকেন এই মাতাল হাওয়ায়। চক্র পূর্ণ হয়, মৃদু মানুষের ঈশ্বর আরও একা হতে শুরু করেন। হয়তো তাঁর সাহিত্যিক ক্ষয়ও শুরু হয়।
তিন.
অবশেষে একদিন মৃত্যু আসে। আর মধ্যবিত্ত তার হারানো মন আর সময়ের স্মৃতিপুঞ্জসমেত এক বৃষ্টির দিনে তাঁদের নায়ককে কবর দিতে যায়। ফিরে আসার সময় তাদের খেয়াল হয়, তাদের প্রথম যৌবন থেকে প্রতিটি যৌবনাগত নতুন যুবক-যুবতী হুমায়ূনি জোছনার কুহকধরায় ধরা ছিল। সেই সময়, সেসব মানুষ আর সেসব কুহক অবসিত হলে পরে, হুমায়ূনের সাহিত্যিক জীবনীর আজ প্রথম প্রহর। ইহকাল শেষে হুমায়ূন সাহিত্যের মহাকালে উঠে বসলেন। সেই কাল ইতিমধ্যে তাঁর সাহিত্যে দাঁত বসানো শুরু করে দিয়েছে। কতটা খেয়ে কতটা রাখে, দেখা যাক।
আমাদের বেড়ে ওঠার একেকটি অধ্যায়ের হাতে, টেবিলে, বালিশের নিচে, ব্যাগের ভেতর হুমায়ূনের একেকটা বই। মন খারাপের বিকেল, জ্বরতাপিত রাত, নিঃসঙ্গ দুপুর, নিশিবৃষ্টির ক্ষণ, মন দেওয়া-নেওয়ার লগ্নগুলোর স্মারক হয়ে আছে হুমায়ূনের একেকটা বই। হুমায়ূনের খোকা, আনিস, পরী, নীলা, রুনু, রাবেয়া ও মন্টুদের সঙ্গ পেয়ে আমরা বড় হয়ে উঠি। তাঁর উপন্যাসের মা-বাবা, ভাইবোনদের মধ্যে আমরা আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়ে যাই। পাড়ার মাস্তানটি তাঁর কাহিনিতে ভালোবাসার রাজপুত্তুর হয়ে ওঠে। হুমায়ূনের মায়ার ছোঁয়ায় সবই কত মানবিক, কত আপন আর চেনা। এভাবে হুমায়ূন আমাদের গত তিন-চার দশকের জীবনীর অংশ হয়ে ওঠেন। তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমরা তাই আমাদের অতীতকেই ফিরে দেখি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হুমায়ূন একবার আমাদের শহরে এলেন। ভোরবেলা দেখা করার সময় পাওয়া গেল। স্থানীয় পর্যটন মোটেলে উঠেছেন। প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। শীতের ভোরে সেখানে গিয়ে দেখি, মোটেলের বারান্দায় পায়চারি করছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটছেন, আর শীতের কুয়াশা বারবার তাঁকে ঢেকে ফেলছে। সেই কুয়াশা ফুঁড়ে আবার তিনি বেরিয়ে আসছেন। আজ তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, চিরটা কালই ভেতরের মানুষটা কুয়াশাঘেরা হয়েই ছিলেন। মৃত্যুতে সেই কুয়াশা যেন আরও ঘন হয়ে এল, ব্যক্তিমানুষটা সেই কুয়াশার ভেতরে আরও বেশি করে যেন ঢুকে যাচ্ছেন; আর ফিরছেন না।
দুই.
একাত্তরের পরের জঙ্গম সময়ে ঠান্ডা নিরুচ্চার বেদনার ধাক্কা নিয়ে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। কোথায় পেলেন এই গল্প? এই গল্পের কোথাও বোঝার উপায় নেই, দেশ-ভূগোল-মন থেঁতলানো একটা যুদ্ধসময় পার করে করেও ত্বরাতে পারছে না নতুন দেশটা। এ রকম গোলমালে একাত্তরের সাত কোটি মানুষের সাত কোটি গল্প হঠাৎ মুখ বুজে ফেলল। এ রকম সময় লোকে মায়াকভস্কি চায়, গোর্কি-নেরুদা-নাজিম হিকমতকে চায়। কেননা, বিপ্লব শেষ হয়নি, সোনার বাংলার সাধ তখনো মেটেনি। জীবনবাদ্য তখন চড়া তালে বাজছে। তার ভেতরে বসে গুণগুণ করে এক সামান্য পরিবারের তৎসামান্য আলেখ্য বলতে বসলেন এই লেখক। নন্দিত নরকের জন্ম হলো।
সংগ্রামের উত্তাপ তখনো শুকায়নি। জাসদ-সর্বহারা-রক্ষীবাহিনীর যুগ। দুঃশাসন-নৈরাজ্য-অনাহারের দিন। সেটাও একরকম নন্দিত নরক। কিন্তু হুমায়ূনের সেই নরকে উত্তাপ নেই। সেখানে ঠান্ডা-স্যাঁতসেঁতে দিশাহীন এক পরিবেশে মৃদু মানুষেরা জীবন অতিবাহিত করছে। সেসব সামান্য মানুষের স্বপ্নহীনতা দিয়েই তাঁর শুরু। ছোট ছোট কেরানিপ্রতিম স্বপ্ন তারা দেখে বটে, সেও স্বপ্নহীনতার শঙ্খনীল কারাগার ভালোবাসার জন্যই। তারা ইতিহাস গড়বে না। তারা কেবল একটু ভালো করে জীবনের আস্বাদন চায়। হঠাৎ কোনো সুসংবাদে দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু দিনশেষে তারা অতি সাধারণ। অসাধারণ কিছুই ঘটে না তাদের জীবনে। মামুলি খুটখাটে ভরা তাদের কর্মকাণ্ড। সব আহ্লাদ সব সুখসাধ বিসর্জনে গেলেও শান্ত মনে পরের দিনটি শুরু করার অধ্যবসায়ে কোনো কমতি নেই তাদের। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে এক কৃষককে দেখেছিলাম, ভর সন্ধ্যায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাটখেতের গোড়ার অন্ধকারে বসে নীরবে কাজ করছে, কোথাও কেউ নেই, পাটের গোড়ার মাটি ছাড়া আর কোনো দিকে নজরও নেই। হুমায়ূনের মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা এভাবে জীবনের গোড়া বাঁধতে বাঁধতেই জীবন শেষ করে দেয়। শেষাবধি তারা পারিবারিক-সাংসারিক-অযান্ত্রিক। তারা সীমা ডিঙায় না, বিদ্রোহ করে না। নিজের ভেতরের দেব ও দানবকে অনায়াসেই নিস্তেজ করে রাখতে তারা পারঙ্গম।
সারা জীবন এসব অযান্ত্রিক মৃদু মানুষদের নিস্তেজ জীবনের বিস্তারিত দেখিয়ে যেতে যেতে তাদের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এসব মানুষ জানে, তাদের ঈশ্বর তাদের স্বর্গ বা নরকে কোথাও পাঠাবেন না। এই পার্থিবতাতেই তিনি তাদের রাখবেন এবং ভালোবাসবেন। সেই ঈশ্বর তাদের একের পর এক আয়না জুগিয়ে গেছেন। সেই আয়না সামান্য মায়াবী অধিকটা দুনিয়াবি। মায়ার এই মিশেলের জন্যই আয়না তাদের আত্মদহনে ঠেলে না। তাদের চেতনের আকুতি, অচেতনের বিকার এই আয়নার শুশ্রূষা পায়। এভাবে তিনি এবং তাঁর চরিত্ররা একই সমতলে একই মানস-আবহের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। এভাবে তাঁর সাহিত্যে সত্তর-আশির দশকের ঢাকাই মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য সংরক্ষিত হয়ে আছে স্মৃতিপুঞ্জের আকারে। স্মৃতির ছবিতে কথায় ঘটনায় যেমন সন-তারিখ দাগানো থাকে না, তেমনি হুমায়ূনের চরিত্ররাও সময়হীন এক মায়াপুরীর বাসিন্দা।
আশির দশকে এই মধ্যবিত্ত বড় স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে। ঘর-সংসার-চাকরি-প্রেম এবং হঠাৎ গরিমার মধ্যে নিজেকে দেখার সাধ ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। এদের কথা পশ্চিমবঙ্গের নিমাই-শংকর-সুনীল-শীর্ষেন্দুরা কোনো দিন বলেননি। বলার কথাও নয়। মহান কথাশিল্পীরা চিরটা কাল এদের শ্লেষভরা রসকষ উপেক্ষা করে মানবতার প্রবাহ খুঁজেছেন আরও তলার মানুষের জীবনে। অথচ এরা আছে, একটু একটু করে জীবন গোছাচ্ছে, জগৎ-সংসারের মধ্যে আরও ঘন হয়ে লেপ্টে থাকতে চাচ্ছে। এই বিরাট মধ্যবিত্ত সমাজের সাংসারিক আর অলীক আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসী জীবনীকার তিনি। আর কিছু না হোক, উঠতি বাঙালি মুসলমান সমাজের আটপৌরে জীবনী খুঁজতে হুমায়ূনকে আমাদের লাগবেই।
এই মহিমাহীন মধ্যবিত্তের মনেই তো হিমুর মতো বাঁধনছেঁড়া দীনতামুক্ত অকপট তরুণের প্রতি আসক্তি জন্মে। নৈতিকতার দেহবন্ধনী আর অসামর্থ্যের শাসানিতে আটক বাসনা ও বিকারের নিদান পাওয়ার মিসির আলিকে দরকার হয়। তারা যা পারে না, হিমু তা পারে। মনের যে ধন্ধ তাদের জবরজং করে রাখে, মিসির আলি সেসব জট ছুটিয়ে দেন। হিমুর অযুক্তির উচ্ছ্বাস আর মিসির আলির যুক্তির স্থিরশীতলতায় মধ্যবিত্তের আত্মদর্শন হয়। নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের আত্মা পরম কিছুর জন্য ক্ষুধার্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রদের দেখি নানা রকম অতীন্দ্রিয়বাদী ঘোরে ডুবে সেই ক্ষুধা মেটায়। হুমায়ূন সে পথে নেন না পাঠককে, হিমু আর মিসির আলির মতো মানবিক ইহবাদী চরিত্রের সঙ্গ দিয়ে তাদের আত্মিক তৃষ্ণা মেটানোর উপায় করেন।
ষাটের দশকের মধ্যবিত্তের তেমন আত্মিক সংকটের দেখা পাওয়া যায় না সে সময়ের উপন্যাসে। সবই তখন জাতীয় সমাজের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লক্ষ্য খুঁজছে। কিছু অস্তিত্ববাদী নড়াচড়া কারও কারও মধ্যে দেখা দিলেও তা ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য উপভোগ কিংবা তদনুযায়ী জীবনযাপনের পার্শ্বফল। তখনো তাদের গ্রাম আছে, সমাজ আছে, ঐতিহ্য আছে; ফলে শূন্যতা কম। কিন্তু যুদ্ধ পেরোনো সমাজ এক ধাক্কায় সাবালক হয়ে মাটি-ভবন কামড়ে থাকার উপায় খুঁজতে হয়রান। গ্রাম দূরে চলে গেছে, পরিবারের বাঁধন আলগা হচ্ছে, সংস্কৃতির রস পানসে লাগছে, ভবিষ্যৎ ভরসা দিচ্ছে না। আশির দশকে এসে এই নগরজীবন বিচ্ছিন্নতার দেখা পায়। এই বিচ্ছিন্নতার ঘের কাটানোর মতো বড় প্রেরণাও তখন সমাজে অনুপস্থিত; বিশেষ করে উঠতি তরুণ-তরুণীর মনের তৃষ্ণা মেটানোর কিছু ছিল না। হুমায়ূনের সামাজিক আখ্যানের ভেতরে এই নাগরিক চাপা হাহাকার বদ্ধ ঘরের পাখির মতো ছটফট করে। তাই হিমু আর মিসির আলি চরিত্র তাদের মনের তলাকার ফাঁপর আর গুমরের মানবিক বিহিতের দায়িত্ব নেয়। তাঁর তোমাদের জন্য ভালবাসা, ইরিনা, বা নির মতো সায়েন্স ফিকশনগুলোও যতটা না বিজ্ঞান, তার থেকে বেশি মানবীয় সম্ভাবনার দিগন্তকে দেখায়। বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত এক রসের জন্ম হয়। বাদবাকিটা অসম্ভব প্রতিভাধর এক রসরাজের রসের খেলা, ভাষা আর বাক্যের লীলা।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তার চরিত্রেরা ভাবে না, কেবল কথা বলে আর কাজ করে। হুমায়ূন অবলীলায় কয়েকটি বাক্যে এদের জীবনটা এঁকে ফেলেন। কিন্তু এতটুকুতেই তাদের অন্তরাত্মার খবর পাওয়া যায়। তাদের নানা রকম ইচ্ছা হয়, খামখেয়াল হয়, আর তারা সেসব করে ফেলে কিংবা করতে পারে না। আত্মচিন্তা ছাড়া উপন্যাস হয় না, কিন্তু হুমায়ূনের উপন্যাসে তেমন চিন্তা নেই। এদের মনের তলায় অন্য মন যেন নেই, তারা একমনা একটানা মৃদু মানুষের মৃদু জীবন কাটিয়ে দেয়।
এরই মধ্যে নব্বই সাল আসে। সত্তরের ধুঁকতে থাকা অনিশ্চয়তা, আশিতে সামলে নিয়ে গোছগাছে মন দেওয়ার পর নব্বইয়ে সে মুক্ত হতে চায়। যে সেনাশাসনের ধাঁচের মধ্যে সাবেকি জীবনধারা, অন্তর্মুখী সময়, বাঁধো বাঁধো নাগরিকতা একধরনের স্থিতির মধ্যে ছিল; বিশ্বায়িত গণতন্ত্র আর মুক্তবাজারের যুগল ডানায় এবার তা উড়তে শুরু করে। বহিরাগত বাসনা আর ভেতরগত তাড়নার তোড়ে পুরোনো জগৎ, পুরোনো ঘরগেরস্থালি, পুরোনো দেহমন সাততাড়াতাড়ি বদলাতে শুরু করে। হুমায়ূনের পাত্রপাত্রীরা পলাশী থেকে দূরে সিরাজউদ্দৌলার কৃষকের মতো ভবিতব্যজ্ঞানহীনই থেকে যায়। বদলের এই ছবি হুমায়ূনীয় আয়নায় ততটা ধরা পড়ে না।
শূন্য দশকে মৃদু মানুষের অনেকেই প্রবল হওয়া শুরু করে। অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ভাসতে থাকে। তরুণদের সামনে আসে নতুন উত্তেজনা। কেনাকাটার হাত খোলা, মেলামেশায় শরীরখোলা, যোগাযোগে অজড়িত থাকার এই নতুন পরিবেশে হুমায়ূনের আনিস, সাবেত, পরী, নীলারা এক পাশে সরে যায় তাদের নিদাগ হূদয়সহ। তিনি তখন আরও পেছনে তাকাতে শুরু করেন, আরও আগের গল্প বুনতে থাকেন, ইতিহাসের জমিন হাতড়াতে থাকেন এই মাতাল হাওয়ায়। চক্র পূর্ণ হয়, মৃদু মানুষের ঈশ্বর আরও একা হতে শুরু করেন। হয়তো তাঁর সাহিত্যিক ক্ষয়ও শুরু হয়।
তিন.
অবশেষে একদিন মৃত্যু আসে। আর মধ্যবিত্ত তার হারানো মন আর সময়ের স্মৃতিপুঞ্জসমেত এক বৃষ্টির দিনে তাঁদের নায়ককে কবর দিতে যায়। ফিরে আসার সময় তাদের খেয়াল হয়, তাদের প্রথম যৌবন থেকে প্রতিটি যৌবনাগত নতুন যুবক-যুবতী হুমায়ূনি জোছনার কুহকধরায় ধরা ছিল। সেই সময়, সেসব মানুষ আর সেসব কুহক অবসিত হলে পরে, হুমায়ূনের সাহিত্যিক জীবনীর আজ প্রথম প্রহর। ইহকাল শেষে হুমায়ূন সাহিত্যের মহাকালে উঠে বসলেন। সেই কাল ইতিমধ্যে তাঁর সাহিত্যে দাঁত বসানো শুরু করে দিয়েছে। কতটা খেয়ে কতটা রাখে, দেখা যাক।
No comments