রিপোর্টারের ডায়েরি- ব্রিটিনির কান্না
২০ জুন, বুধবার। আজ রিও সম্মেলনের হাইলেভেল সেগমেন্ট অর্থাৎ সম্মেলনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শুরু হচ্ছে। এই বৈঠকেই যোগ দেবেন বিশ্বের ১৯৫টি দেশ থেকে আগত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা বা তাঁদের প্রতিনিধিরা। আন্তর্জাতিক সব সম্মেলনই দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম শুরু হয় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক।
ওই বৈঠকে কর্মকর্তারা আলোচনার মাধ্যমে সম্মেলনে খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরি করেন। দ্বিতীয় পর্বে থাকে শীর্ষ বৈঠক, যেখানে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা যোগ দেন এবং সম্মেলনের খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করেন। তবে হাইলেভেল সেগমেন্টে একদিকে যেমন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের বক্তৃতা চলতে থাকে, অন্যদিকে পর্দার আড়ালে খসড়া ঘোষণা চূড়ান্তকরণ নিয়ে চলে দরকষাকষি।
অবশ্য যতটা সহজে ব্যাপারটা বলে দিলাম, ততটা সহজে সম্মেলনের ঘোষণা চূড়ান্ত হয় না। এই ঘোষণা চূড়ান্ত করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে অনেক দরকষাকষি করতে হয় তাদের দাবি-দাওয়া ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে। অনেক সময় সম্মেলন শেষ হওয়ার সময় পেরিয়ে রাতের পর রাত চলে যায়, এই ঘোষণা চূড়ান্ত করতে। যেটা আমরা বালি, কোপেনহেগেন কিংবা ডারবান জলবায়ু সম্মেলনে দেখেছি।
এ অভিজ্ঞতা থেকে রিও সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিল আগেভাগেই বেশ সতর্ক। তারা যখন দেখল ১৫ জুন সম্মেলনের খসড়া ঘোষণা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও ১৭ জুন পর্যন্ত ২০ ভাগও অগ্রগতি হয়নি, তখনই ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করে। তারা আয়োজক দেশ হিসেবে ১৮ জুন একটি খসড়া ঘোষণা উপস্থাপন করে, যা ১৯ জুন কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়। এটি অবশ্য অনেকটা চাপ সৃষ্টির মাধ্যমেই করা হয়েছে। ফলে ১৯ জুন সন্ধ্যায় যখন রিও শহরে পা রাখার পর রয়্যাল প্যালেস হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান ও পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বললেন, তোমরা এমন সময় এসেছ যখন সম্মেলনের সব উত্তেজনা শেষ হয়ে গেছে। এইমাত্র আমরা সম্মেলনের খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করে দিয়ে এসেছি। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
আর্থ সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন উপলক্ষে সুন্দর ছিমছাম পরিচ্ছন্ন নগরী রিও যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রতিনিধিদের পাশাপাশি পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এসে ভিড় করেছেন। সব আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই বিশেষ করে জাতিসংঘের সম্মেলনগুলোতে এই পরিবেশবাদী বা সুশীল সমাজের সরব উপস্থিতি সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তাঁরা এখন এসব সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছেন। সম্মেলনের পাশাপাশি চলে তাঁদের সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-মিটিং-মিছিল। তাঁরা বিশ্বনেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। জাতিসংঘও তাঁদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তাঁদের কর্মকা- অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যায়। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে কিংবা হংকংয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে হয়েছিল। এই পরিবেশবাদীরা তো শেষ পর্যন্ত সিয়াটল সম্মেলনকে ভ-ুলই করে দিয়েছিলেন।
রিও সেন্টারে যেতে গিয়ে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা শুনে আঁৎকে উঠলাম। আমরা যে সৈকত এলাকা কোপাকোবানায় থাকি সেখান থেকে রিও সেন্টার অনেক দূর। বাসে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। রাস্তায় নেমে অবশ্য সেটা টের পেলাম। এ শহরে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। সব রাস্তা ওয়ানওয়ে বা একমুখী করে দেয়ার পরও প্রতিদিন সকালবেলা তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে রাস্তায় নামলে দেখা যায়, শুধু গাড়ি আর গাড়ি। তবে ট্রাফিক পুলিশ খুব সক্রিয়। এ কারণে বিদেশী অতিথিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্রাজিল সরকার হাইলেভেল সেগমেন্টের তিন দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছে। ফলে রাস্তাঘাটে তুলনামূলকভাবে যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে।
ব্রাজিল সরকার বিদেশী অতিথিদের রিও সেন্টারে যাওয়া-আসার জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করে। ভিড় ঠেলে সেই বাসে করেই রওনা হলাম রিও সেন্টারের উদ্দেশে। বাস আটলান্টিক সৈকতের তীর ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে উত্তরদিকে ছুটে চলল।
রিও শহরের একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, অন্যদিকে পাহাড়। অনেকটা আমাদের কক্সবাজারের মতো। তবে কক্সবাজারের মতো অপরিকল্পিত নয়। বেশ পরিকল্পিত শহর। সমুদ্রসৈকতের পর বেশ প্রশস্ত ওয়াকওয়ে। তারপর চার লেনের রাস্তা। রাস্তার পর বেশ খোলা জায়গা। ওই জায়গায় কাঠবাদামসহ নানা জাতের গাছ। তারপর সারি সারি সুউচ্চ হোটেল। আর সৈকতটাও চাঁদের মতো বাঁক নিয়েছে।
পেছনের পাহাড়গুলো বেশ উঁচু উঁচু। প্রতিটি পাহাড় সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। কোন কোন পাহাড়ে বাড়িঘর। পাহাড়গুলোতে প্রচুর কলাগাছ দেখা গেল। কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার জন্য সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। আমাদের বাস সেই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের এপাশে চলে এলো।
রিও শহরে প্রচুর গাছপালা। এমনিতেই ব্রাজিল হচ্ছে চিরহরিৎ আমাজান বনের দেশ। সেই দেশের গাছপালাগুলোর সঙ্গে আমাদের গাছপালার অনেক মিল আছে। ওখানে শহরে কাঠবাদাম, কড়ই, বটগাছ, কলাগাছ, নারকেলগাছ প্রচুর। এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। আবহাওয়াও বেশ চমৎকার। তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। কখনও কখনও ৩০ ডিগ্রীতে ওঠে। প্রায়ই হাল্কা বৃষ্টি হয়। ভারি বর্ষণ খুব কমই হয়।
এখানে এসেই প্রথমে খোঁজ করেছিলাম বাংলাদেশী আছে কিনা? কাল রাতে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আব্দুল মোমেন জানালেন, এখানে বাংলাদেশী নেই। কারণ এখানকার পুলিশ খুব তৎপর। অবৈধভাবে এখানে থাকা যায় না। ফলে বাংলাদেশীরা এখানে এসে থাকতে পারে না। পাঁচ-ছয় বছর আগে এক গ্রুপ বাংলাদেশী এখানে থাকতে এসেছিল। কিন্তু পুলিশের কড়াকড়ির কারণে তারা এখানে থাকতে পারেনি। এখান থেকে প্রতিবেশী দেশ চিলিতে চলে গেছে। ওখানকার পুলিশ আবার অত তৎপর নয়। ফলে চিলিতে বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট দিয়ে বেশ ভালই আছে। অনেকেই এখন চিলির নাগরিক হয়ে গেছে। তিনি জানালেন, এমনিতেও চিলিতে বাংলাদেশীদের অনেক সুযোগ আছে। সেই সঙ্গে সুযোগ আছে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও।
রিও কনভেনশন সেন্টারে আসতে আমাদের এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগল, যা আগে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগত। তবে এ শহরটি বেশ আধুনিক। ভবনগুলো সব নতুন। আমরা যে এলাকায় থাকি সেই এলাকাটা পুরনো রিও। এই এলাকায় নতুন করে তৈরি করেছে। এখানেই ২০১৬ অলিম্পিকের ভিলেজ হবে।
বিশাল এলাকা নিয়ে রিও কনভেনশন সেন্টার। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। তার মাঝেই বাস আমাদের গেটে নামিয়ে দিল। নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে মূল সেন্টারে যেতে অনেক দূর হাঁটতে হলো। মূল সেন্টারে এসে একদিকে প্ল্যানারি অধিবেশন কক্ষ, অন্যদিকে মিডিয়া সেন্টার ও সেমিনার কক্ষ। তবে মিডিয়া সেন্টারটি অনেক ভেতরে সেমিনার কক্ষ পেরিয়ে যেতে হয়। মিডিয়া সেন্টারটি অত জাঁকজমকপূর্ণ নয়। তবে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিডিয়া সেন্টারে এক চক্কর দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ঢাকার সঙ্গে রিওর সময়ের ব্যবধান নয় ঘণ্টা। ফলে ওখানে দিনের বেলা নিউজ পাঠানোর কোন তাড়া নেই। এখানে যখন সন্ধ্যা হবে ঢাকায় তখন সকাল হবে। ফলে এখান থেকে সারাদিনের খবর সংগ্রহ করে রাতে নিউজ পাঠালেই ঢাকায় সকালে নিউজ পৌঁছে যাবে। সময়ের এই ব্যবধানের কারণে এখানে এসে কাজ করতে বেশ সুবিধাই হলো।
রিও সেন্টারের সবচেয়ে দেখার মতো ফুডকোর্টটি। এত বিশাল ফুডকোর্ট আগে কখনও দেখিনি। আমাদের শেরেবাংলানগরের পুরো বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারের সমান হবে। চারদিকে খাবারের দোকান আর মাঝখানে সব টেবিল-চেয়ার। সামনে বিশাল টিভি পর্দা। যাতে এখানে বসে খেতে খেতেই সম্মেলনের কি কি হচ্ছে তা দেখা যায়।
এখানে এসে দেখলাম উল্টো নিয়ম। সম্মেলন অনুষ্ঠান এলাকায় সাংবাদিকদের ঢোকার অনুমতি নেই। শুধু পাসধারী সরকারী প্রতিনিধিরাই সেই এলাকায় যেতে পারবেন। এর বাইরে সব এলাকায় সাংবাদিকরা যেতে পারবেন। ফলে মিডিয়া সেন্টারে বসেই সম্মেলন কভার করতে হবে। অবশ্য মূল অনুষ্ঠানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরাম্যানদের ঢোকার সুযোগ আছে। আর লটারির ভিত্তিতে কিছু পাসধারী সাংবাদিককে ঢোকার সুযোগ দিয়েছে। ফলে আমাদের মতো আমসাংবাদিকদের টিভি মনিটরের সামনে বসেই অনুষ্ঠান কভার করতে হলো।
এবারের হাইলেভেল সেগমেন্ট নিউজিল্যান্ডের ১৭ বছর বয়সী এক মেয়ের অবেগঘন বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শুরু হলো। মেয়েটির নাম ব্রিটিনি ট্রিলফোর্ড। ইয়থ ভিডিও স্পীচ প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে সে এই রিও সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছে। বিশ্বব্যাপী ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সে তরুণ প্রজম্মের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছে।
ব্রিটিনি এবার তার স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। তারা এ পৃথিবীটা কিভাবে দেখতে চায় সেই আর্তিই ফুটে ওঠে তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায়। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে সে যখন বক্তৃতা শুরু করে তখন পুরো প্ল্যানারি অধিবেশনে পিনপতন নীরবতা। ভবিষ্যত প্রজম্মের প্রতীক ব্রিটিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেই বক্তৃতা শুরু করে, ‘তোমরা কি এখানে এসেছ তোমাদের মুখ রক্ষা করতে, না আমাদের বাঁচাতে?’
সে বলে, আমি ১৭ বছরের শিশু। আজ এই বিশেষ মুহূর্তে আমি সকল শিশু, তোমাদের শিশুসন্তান ও বিশ্বের তিনশ’ কোটি শিশুর প্রতিনিধি হয়ে এসেছি। এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমি এখানে বেশ আনন্দচিত্তেই এসেছি। কিন্তু আমি এই পৃথিবীর অবস্থা দেখে বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ। আমরা এখানে পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে এসেছি। আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত আছে। সেই ভবিষ্যত বিনির্মানে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে’।
সে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘তোমরা এখানে এই পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করবে, যা সারা বিশ্বে উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশ্যা। আমি এখানে এসেছি আমার ভবিষ্যতের জন্য যুদ্ধ করতে চাই। এ কারণেই আমি এখানে এসেছি। তোমরা একবার বিবেচনা কর, তোমরা কেন এবং কি করতে এখানে এসেছে?’
সবশেষে ব্রিটনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আমরা অনেক আশা নিয়ে এই উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে এসেছি। আমরা ভবিষ্যত প্রজম্ম পরিবর্তন চাই। আমরা পৃথিবীতের রক্ষার জন্য উদ্যোগ দেখতে চাই। আমাদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতেই এটা প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, তোমরা পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে ত্যাগ করে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে এবং বলিষ্ঠভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে’।
কাওসার রহমান
অবশ্য যতটা সহজে ব্যাপারটা বলে দিলাম, ততটা সহজে সম্মেলনের ঘোষণা চূড়ান্ত হয় না। এই ঘোষণা চূড়ান্ত করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে অনেক দরকষাকষি করতে হয় তাদের দাবি-দাওয়া ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে। অনেক সময় সম্মেলন শেষ হওয়ার সময় পেরিয়ে রাতের পর রাত চলে যায়, এই ঘোষণা চূড়ান্ত করতে। যেটা আমরা বালি, কোপেনহেগেন কিংবা ডারবান জলবায়ু সম্মেলনে দেখেছি।
এ অভিজ্ঞতা থেকে রিও সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিল আগেভাগেই বেশ সতর্ক। তারা যখন দেখল ১৫ জুন সম্মেলনের খসড়া ঘোষণা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও ১৭ জুন পর্যন্ত ২০ ভাগও অগ্রগতি হয়নি, তখনই ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করে। তারা আয়োজক দেশ হিসেবে ১৮ জুন একটি খসড়া ঘোষণা উপস্থাপন করে, যা ১৯ জুন কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়। এটি অবশ্য অনেকটা চাপ সৃষ্টির মাধ্যমেই করা হয়েছে। ফলে ১৯ জুন সন্ধ্যায় যখন রিও শহরে পা রাখার পর রয়্যাল প্যালেস হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান ও পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বললেন, তোমরা এমন সময় এসেছ যখন সম্মেলনের সব উত্তেজনা শেষ হয়ে গেছে। এইমাত্র আমরা সম্মেলনের খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করে দিয়ে এসেছি। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
আর্থ সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন উপলক্ষে সুন্দর ছিমছাম পরিচ্ছন্ন নগরী রিও যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রতিনিধিদের পাশাপাশি পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এসে ভিড় করেছেন। সব আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই বিশেষ করে জাতিসংঘের সম্মেলনগুলোতে এই পরিবেশবাদী বা সুশীল সমাজের সরব উপস্থিতি সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তাঁরা এখন এসব সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছেন। সম্মেলনের পাশাপাশি চলে তাঁদের সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-মিটিং-মিছিল। তাঁরা বিশ্বনেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। জাতিসংঘও তাঁদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তাঁদের কর্মকা- অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যায়। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে কিংবা হংকংয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে হয়েছিল। এই পরিবেশবাদীরা তো শেষ পর্যন্ত সিয়াটল সম্মেলনকে ভ-ুলই করে দিয়েছিলেন।
রিও সেন্টারে যেতে গিয়ে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা শুনে আঁৎকে উঠলাম। আমরা যে সৈকত এলাকা কোপাকোবানায় থাকি সেখান থেকে রিও সেন্টার অনেক দূর। বাসে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। রাস্তায় নেমে অবশ্য সেটা টের পেলাম। এ শহরে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। সব রাস্তা ওয়ানওয়ে বা একমুখী করে দেয়ার পরও প্রতিদিন সকালবেলা তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে রাস্তায় নামলে দেখা যায়, শুধু গাড়ি আর গাড়ি। তবে ট্রাফিক পুলিশ খুব সক্রিয়। এ কারণে বিদেশী অতিথিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্রাজিল সরকার হাইলেভেল সেগমেন্টের তিন দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছে। ফলে রাস্তাঘাটে তুলনামূলকভাবে যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে।
ব্রাজিল সরকার বিদেশী অতিথিদের রিও সেন্টারে যাওয়া-আসার জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করে। ভিড় ঠেলে সেই বাসে করেই রওনা হলাম রিও সেন্টারের উদ্দেশে। বাস আটলান্টিক সৈকতের তীর ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে উত্তরদিকে ছুটে চলল।
রিও শহরের একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, অন্যদিকে পাহাড়। অনেকটা আমাদের কক্সবাজারের মতো। তবে কক্সবাজারের মতো অপরিকল্পিত নয়। বেশ পরিকল্পিত শহর। সমুদ্রসৈকতের পর বেশ প্রশস্ত ওয়াকওয়ে। তারপর চার লেনের রাস্তা। রাস্তার পর বেশ খোলা জায়গা। ওই জায়গায় কাঠবাদামসহ নানা জাতের গাছ। তারপর সারি সারি সুউচ্চ হোটেল। আর সৈকতটাও চাঁদের মতো বাঁক নিয়েছে।
পেছনের পাহাড়গুলো বেশ উঁচু উঁচু। প্রতিটি পাহাড় সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। কোন কোন পাহাড়ে বাড়িঘর। পাহাড়গুলোতে প্রচুর কলাগাছ দেখা গেল। কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার জন্য সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। আমাদের বাস সেই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের এপাশে চলে এলো।
রিও শহরে প্রচুর গাছপালা। এমনিতেই ব্রাজিল হচ্ছে চিরহরিৎ আমাজান বনের দেশ। সেই দেশের গাছপালাগুলোর সঙ্গে আমাদের গাছপালার অনেক মিল আছে। ওখানে শহরে কাঠবাদাম, কড়ই, বটগাছ, কলাগাছ, নারকেলগাছ প্রচুর। এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। আবহাওয়াও বেশ চমৎকার। তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। কখনও কখনও ৩০ ডিগ্রীতে ওঠে। প্রায়ই হাল্কা বৃষ্টি হয়। ভারি বর্ষণ খুব কমই হয়।
এখানে এসেই প্রথমে খোঁজ করেছিলাম বাংলাদেশী আছে কিনা? কাল রাতে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আব্দুল মোমেন জানালেন, এখানে বাংলাদেশী নেই। কারণ এখানকার পুলিশ খুব তৎপর। অবৈধভাবে এখানে থাকা যায় না। ফলে বাংলাদেশীরা এখানে এসে থাকতে পারে না। পাঁচ-ছয় বছর আগে এক গ্রুপ বাংলাদেশী এখানে থাকতে এসেছিল। কিন্তু পুলিশের কড়াকড়ির কারণে তারা এখানে থাকতে পারেনি। এখান থেকে প্রতিবেশী দেশ চিলিতে চলে গেছে। ওখানকার পুলিশ আবার অত তৎপর নয়। ফলে চিলিতে বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট দিয়ে বেশ ভালই আছে। অনেকেই এখন চিলির নাগরিক হয়ে গেছে। তিনি জানালেন, এমনিতেও চিলিতে বাংলাদেশীদের অনেক সুযোগ আছে। সেই সঙ্গে সুযোগ আছে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও।
রিও কনভেনশন সেন্টারে আসতে আমাদের এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগল, যা আগে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগত। তবে এ শহরটি বেশ আধুনিক। ভবনগুলো সব নতুন। আমরা যে এলাকায় থাকি সেই এলাকাটা পুরনো রিও। এই এলাকায় নতুন করে তৈরি করেছে। এখানেই ২০১৬ অলিম্পিকের ভিলেজ হবে।
বিশাল এলাকা নিয়ে রিও কনভেনশন সেন্টার। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। তার মাঝেই বাস আমাদের গেটে নামিয়ে দিল। নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে মূল সেন্টারে যেতে অনেক দূর হাঁটতে হলো। মূল সেন্টারে এসে একদিকে প্ল্যানারি অধিবেশন কক্ষ, অন্যদিকে মিডিয়া সেন্টার ও সেমিনার কক্ষ। তবে মিডিয়া সেন্টারটি অনেক ভেতরে সেমিনার কক্ষ পেরিয়ে যেতে হয়। মিডিয়া সেন্টারটি অত জাঁকজমকপূর্ণ নয়। তবে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিডিয়া সেন্টারে এক চক্কর দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ঢাকার সঙ্গে রিওর সময়ের ব্যবধান নয় ঘণ্টা। ফলে ওখানে দিনের বেলা নিউজ পাঠানোর কোন তাড়া নেই। এখানে যখন সন্ধ্যা হবে ঢাকায় তখন সকাল হবে। ফলে এখান থেকে সারাদিনের খবর সংগ্রহ করে রাতে নিউজ পাঠালেই ঢাকায় সকালে নিউজ পৌঁছে যাবে। সময়ের এই ব্যবধানের কারণে এখানে এসে কাজ করতে বেশ সুবিধাই হলো।
রিও সেন্টারের সবচেয়ে দেখার মতো ফুডকোর্টটি। এত বিশাল ফুডকোর্ট আগে কখনও দেখিনি। আমাদের শেরেবাংলানগরের পুরো বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারের সমান হবে। চারদিকে খাবারের দোকান আর মাঝখানে সব টেবিল-চেয়ার। সামনে বিশাল টিভি পর্দা। যাতে এখানে বসে খেতে খেতেই সম্মেলনের কি কি হচ্ছে তা দেখা যায়।
এখানে এসে দেখলাম উল্টো নিয়ম। সম্মেলন অনুষ্ঠান এলাকায় সাংবাদিকদের ঢোকার অনুমতি নেই। শুধু পাসধারী সরকারী প্রতিনিধিরাই সেই এলাকায় যেতে পারবেন। এর বাইরে সব এলাকায় সাংবাদিকরা যেতে পারবেন। ফলে মিডিয়া সেন্টারে বসেই সম্মেলন কভার করতে হবে। অবশ্য মূল অনুষ্ঠানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরাম্যানদের ঢোকার সুযোগ আছে। আর লটারির ভিত্তিতে কিছু পাসধারী সাংবাদিককে ঢোকার সুযোগ দিয়েছে। ফলে আমাদের মতো আমসাংবাদিকদের টিভি মনিটরের সামনে বসেই অনুষ্ঠান কভার করতে হলো।
এবারের হাইলেভেল সেগমেন্ট নিউজিল্যান্ডের ১৭ বছর বয়সী এক মেয়ের অবেগঘন বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শুরু হলো। মেয়েটির নাম ব্রিটিনি ট্রিলফোর্ড। ইয়থ ভিডিও স্পীচ প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে সে এই রিও সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছে। বিশ্বব্যাপী ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সে তরুণ প্রজম্মের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছে।
ব্রিটিনি এবার তার স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। তারা এ পৃথিবীটা কিভাবে দেখতে চায় সেই আর্তিই ফুটে ওঠে তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায়। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে সে যখন বক্তৃতা শুরু করে তখন পুরো প্ল্যানারি অধিবেশনে পিনপতন নীরবতা। ভবিষ্যত প্রজম্মের প্রতীক ব্রিটিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেই বক্তৃতা শুরু করে, ‘তোমরা কি এখানে এসেছ তোমাদের মুখ রক্ষা করতে, না আমাদের বাঁচাতে?’
সে বলে, আমি ১৭ বছরের শিশু। আজ এই বিশেষ মুহূর্তে আমি সকল শিশু, তোমাদের শিশুসন্তান ও বিশ্বের তিনশ’ কোটি শিশুর প্রতিনিধি হয়ে এসেছি। এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমি এখানে বেশ আনন্দচিত্তেই এসেছি। কিন্তু আমি এই পৃথিবীর অবস্থা দেখে বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ। আমরা এখানে পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে এসেছি। আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত আছে। সেই ভবিষ্যত বিনির্মানে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে’।
সে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘তোমরা এখানে এই পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করবে, যা সারা বিশ্বে উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশ্যা। আমি এখানে এসেছি আমার ভবিষ্যতের জন্য যুদ্ধ করতে চাই। এ কারণেই আমি এখানে এসেছি। তোমরা একবার বিবেচনা কর, তোমরা কেন এবং কি করতে এখানে এসেছে?’
সবশেষে ব্রিটনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আমরা অনেক আশা নিয়ে এই উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে এসেছি। আমরা ভবিষ্যত প্রজম্ম পরিবর্তন চাই। আমরা পৃথিবীতের রক্ষার জন্য উদ্যোগ দেখতে চাই। আমাদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতেই এটা প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, তোমরা পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে ত্যাগ করে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে এবং বলিষ্ঠভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে’।
কাওসার রহমান
No comments