বাঙালির ইলিশ-বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না

বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতায় লিখেছেন, 'রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/জলের উজ্জ্বল শস্য রাশি রাশি ইলিশের শব।/তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে থরে থরে/ ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানি গিন্নির ভাঁড়ার/সরস সর্ষের ঝাঁজে।' এলো বর্ষা ইলিশ উৎসব। বর্ষার দ্বিতীয় মাসেরও প্রায় অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেল।


কিন্তু কবির ভাষায় 'জলের উজ্জ্বল শস্য' ইলিশের দেখা মিলছে না। জেলেরা অনেক আশা নিয়ে নৌকা ভাসালেও জালে উঠছে না রুপালি ইলিশ। বর্ষাকালকে বলা হয়ে থাকে বাঙালির ইলিশ পার্বণ। কিন্তু এই মধ্য শ্রাবণেও বাঙালির ইলিশ-স্বপ্ন থেকে যাচ্ছে অধরা।
মানতেই হবে, ইলিশের নামে জিভে জল আসে না, এমন বাঙালি একজনও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রুপালি ইলিশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত জয় করেছে অনেক আগেই। ইলিশ এখন দূতিয়ালিরও মাধ্যম হয়েছে। আর বাঙালির কাছে ইলিশ মানেই পদ্মার ইলিশ। ইলিশ নিয়ে নস্টালজিয়াও রয়েছে বাঙালির। বাঙালি মাত্রই ইলিশপ্রেমী। পদ্মার ইলিশের উত্তরাধিকার নিয়ে গর্বিত বাঙালির কাছে ইলিশের অর্থ চিরকাল অন্য রকম। বাঙালির কাছে পদ্মার ইলিশ মানেই অন্য আভিজাত্য। এত কিছুর পরও ইলিশ নিয়ে আমাদের আক্ষেপের অন্ত নেই। জাটকা নিধনের কারণে এমনিতেই কমে যাচ্ছে ইলিশ। যা পাওয়া যাচ্ছে, তারও দাম আকাশছোঁয়া। ফলে এই ইলিশ পার্বণের সময়ও ইলিশ অনেকের কাছে অধরা।
যে ইলিশ বাঙালির এত প্রিয়, কেন এই ভরা মৌসুমে সেই ইলিশ অধরা থেকে যাচ্ছে? কেন সারা বছর অপেক্ষার পর জেলেদের ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে? গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পানিতে রাসায়নিক ও শিল্প বর্জ্যের মিশ্রণ, পদ্মা-মেঘনার পানিতে লবণাক্ততা, ডুবো চর সৃষ্টি, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন। একই কারণে সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের নদী অঞ্চলে মা ইলিশের আগমন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক ও আইনি নজরদারির অভাব, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং অবাধে জাটকা নিধন। এসব কারণে ইলিশ মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইলিশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে। বাংলাদেশের নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী মাছ ইলিশ। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে না পারলে ২০ বছর পর দেশের নদীতে আর ইলিশ মিলবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
তাই ইলিশ নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই ইলিশ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করেছে। দুই দেশের মধ্যে সংলাপ হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে ২২টি সুপারিশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে ইলিশের জন্য হাহাকার থাকবে না। জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষা করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। ইলিশ বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.