বুয়েট-বিব্রত হওয়া শিক্ষামন্ত্রীর কাজ নয় by বদিউল আলম মজুমদার
নুরুল ইসলাম নাহিদ মহাজোট মন্ত্রিসভার এক সৎ, যোগ্য এবং জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তি। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এবং করছেন। তাই তিনি আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ।
তবুও বুয়েট-সমস্যা নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য—আন্দোলনকারীরা তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে কর্মসূচি স্থগিত করায় তিনি বিব্রত— আমাকে হতাশ করেছে।
আমি মনে করি যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিব্রত বা ক্ষুব্ধ হওয়া তাঁর কাজ নয়, তাঁর কাজ সমস্যার সমাধান করা। বুয়েটসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই জনগণ ভোট দিয়ে মহাজোটকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছেন, সমস্যাকে জিইয়ে রাখা বা সমস্যার ‘রাজনীতিকীকরণের’ জন্য নয়। সরকারবিরোধীরা অবশ্য ক্ষমতাসীনদের জন্য বিপদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্যার আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করতেই পারে, কিন্তু সরকারের কাজ দ্রুততার সঙ্গে তা সমাধান করা। কারণ, সমস্যা রেখে দিলে তা থেকে নতুন ডালপালা গজায় এবং আরও জটিল আকার ধারণ করে।
আর সমস্যার জন্য অজুহাত সৃষ্টি করা বা অন্য উদ্দেশ্য খোঁজা (অর্থাৎ চক্রান্তের অভিযোগ তোলাও) মন্ত্রীর কাজ নয়। তবে চক্রান্ত যদি থেকেই থাকে, তাহলে চক্রান্তকারীদের খুঁজে বের করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তাঁর কাজ হলো সমস্যার ত্বরিত সমাধান করা। আর অজুহাত সমস্যার সমাধান করে না বরং তা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেয় এবং নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
আমি এক আমেরিকান দম্পতিকে চিনতাম, যাঁরা ছিলেন দাম্পত্য জীবনে অত্যন্ত সুখী। আমি একদিন তাঁদের ‘সিক্রেট’ জানতে চাইলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁদের মধ্যেও ঝগড়া-বিবাদ হয়, কিন্তু তাঁরা কোনো সমস্যারই, যত ক্ষুদ্রই হোক, সমাধান না করে রাতে ঘুমান না। আজীবন এ চর্চার ফলেই নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়নি এবং তাঁরা সমস্যার ভারে নুয়ে পড়েননি। ব্যক্তির জীবনে যা সত্য, সরকারের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
মনে হয়, আমাদের বর্তমান সরকার সমস্যা সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে জুড়িহীন। উদাহরণস্বরূপ, সরকার নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে নিয়ে অহেতুক একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’কে তুলোধুনো করে আমেরিকান কংগ্রেসে এ বিষয়ে শুনানির ইন্ধন জুগিয়েছে। এমনকি নীরবে সমাধানের চেষ্টা না করে বেসামাল কথাবার্তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে, যা ভালো করার লক্ষ্যে আবার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জানি না এতে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত বদলাবে কি না।
বুয়েটের উদ্ভূত পরিস্থিতিও সরকারেরই সৃষ্টি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও সরকারদলীয় বিবেচনায় অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে বুয়েটের উপাচার্য ও দৃষ্টিকটুভাবে জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে সহ-উপাচার্য পদে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। আর উপাচার্যের গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড শুধু বুয়েট পরিবারেরই নয়, অনেক সচেতন নাগরিকের জন্যই ছিল বিব্রতকর। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও শিক্ষার মান রক্ষার ব্যাপারে তাঁর ডাকা সভায় বুয়েট পরিবারের সদস্যদের আবেগ ও উদ্বেগের গভীরতা শিক্ষা মন্ত্রী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন।
এটা ঠিক যে আন্দোলনকারীদের হয়তো আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁরা তো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে এ কাজ করেননি। বরং তাঁরা দলবাজির অবসান ঘটাতেই আন্দোলনে নেমেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাক সেটাই তাদের চাওয়া।
আর বর্তমান সরকারই বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের তথাকথিত রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে দেশের প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করেই। অনেকেরই জানা যে বর্তমান সরকারের আমলে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি।
আইনের ৯০বি ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র, বিভিন্ন পেশার সদস্য এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন’ গঠন করার বা রাখার বিধান থাকতে পারবে না। আইনের উদ্দেশ্য হলো লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক রাজনীতির অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আইনের এ বিধান কার্যকর করার পরিবর্তে তাদের গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের বিধান শুধু বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে নীরব। এটি শাসনের প্রতি শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনই নয়, পুরো জাতির সঙ্গেও মশকরা করার সমতূল্য। প্রসঙ্গত, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ/বিএনপির মতো দলের বৈদেশিক শাখা থাকাও বেআইনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি শুধু আইনেরই লঙ্ঘন নয়, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেরও পরিপন্থী। দিন বদলের সনদে আওয়ামী লীগ ‘শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত’ রাখার অঙ্গীকার করেছে। দলীয় বিবেচনায় অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমানকে বুয়েটে নিয়োগ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বরখেলাপ।
বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতিবাদের মুখেও উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগে অস্বীকৃতি বোধগম্য নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা মূলত এর ছাত্র-অভিভাবক-শিক্ষকদের কাছে। একজন উপাচার্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তিনি যখন এর নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন, তখন তাঁর সরে দাঁড়ানোই সমীচীন। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষের থেকে সহকর্মীদের সমর্থন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যার একটি দৃষ্টান্ত সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় (ইউওভি)।
দুই বছর আগে ইউওভির বোর্ড অব গভর্নরস অধ্যাপক থেরেসা সলেভানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। (পশ্চিমা বিশ্বে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গবেষণা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়।) তাঁর কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ গত জুন মাসে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও এলামনাইয়ের সম্মিলিত প্রবল প্রতিবাদের মুখে কর্তৃপক্ষ দুই সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাপক সলেভানকে সর্বসম্মতিক্রমে স্বপদে পুনর্বহাল করেন। প্রসঙ্গত, গোঁ না ধরে ভুল স্বীকার করতে এবং প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে বলেই পশ্চিমারা সামনে এগিয়ে গেছে।
প্রতিবাদীরা পদত্যাগ করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাইরে থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন—অধ্যাপক নজরুল ইসলামের এমন খেদোক্তিও অগ্রহণযোগ্য। বস্তুত, এ বক্তব্য শুধু তাঁর স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণেরই নয়, বুয়েটের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অযোগ্যতারই প্রতিফলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ মূলত তিনটি: পাঠদান, গবেষণা ও পাবলিক সার্ভিস বা জনসেবা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যত বেশি গবেষণা করেন—খণ্ডকালীন শিক্ষকদের কাছ থেকে গবেষণা আশা করা যায় না—সেসব বিশ্ববিদ্যালয় তত বেশি সফল ও বিখ্যাত। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম হয় এটি জানেন না, না হয় ব্যক্তি স্বার্থ ও দলতন্ত্রের প্রতি অন্ধত্বের কারণে এটি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রসঙ্গত, সমস্যা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেই নয়, অহেতুক শত্রুতা সৃষ্টি করার ব্যাপারেও বর্তমান সরকার যেন অদ্বিতীয়। সরকার সাধারণত নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। কিন্তু কিছু কর্তাব্যক্তি যেন আদাজল খেয়ে লেগেছেন সরকারের শুভানুধ্যায়ীদেরও শত্রুতে পরিণত করতে। দুর্ভাগ্যবশত এরই মধ্যে তাঁরা বেশ সফলতাও অর্জন করেছেন। দিন বদলের সনদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার উপেক্ষা করে এবং রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার শপথ ভঙ্গ করে দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের নগ্ন চর্চাও এ ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে। ফলে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ী সরকার এখন কট্টর আওয়ামী লীগারদের সরকারে পরিণত হয়েছে।
পরিশেষে, আশা করি সরকার দ্রুততার সঙ্গে বুয়েটের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে। আর বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের অপসারণের মাধ্যমেই একমাত্র তা সম্ভব। আরও আশা করি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সরকার ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক রাজনীতির অবসান ঘটাবে, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনবে এবং দলতন্ত্র-ফায়দাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণহীন ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরবে। তাহলেই সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের সৃষ্ট সন্ত্রাস-দখলদারি-চাঁদাবাজি-খুনখারাবির অবসান ঘটবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শান্তি ফিরে আসবে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের অমিত সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারব। কারণ, শিক্ষক-ছাত্র (অপ)রাজনীতির ফলে সৃষ্ট বর্তমান অরাজকতা আমাদের তরুণদের মেধা-মননশীল বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সে সম্ভাবনাকে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
আমি মনে করি যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিব্রত বা ক্ষুব্ধ হওয়া তাঁর কাজ নয়, তাঁর কাজ সমস্যার সমাধান করা। বুয়েটসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই জনগণ ভোট দিয়ে মহাজোটকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছেন, সমস্যাকে জিইয়ে রাখা বা সমস্যার ‘রাজনীতিকীকরণের’ জন্য নয়। সরকারবিরোধীরা অবশ্য ক্ষমতাসীনদের জন্য বিপদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্যার আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করতেই পারে, কিন্তু সরকারের কাজ দ্রুততার সঙ্গে তা সমাধান করা। কারণ, সমস্যা রেখে দিলে তা থেকে নতুন ডালপালা গজায় এবং আরও জটিল আকার ধারণ করে।
আর সমস্যার জন্য অজুহাত সৃষ্টি করা বা অন্য উদ্দেশ্য খোঁজা (অর্থাৎ চক্রান্তের অভিযোগ তোলাও) মন্ত্রীর কাজ নয়। তবে চক্রান্ত যদি থেকেই থাকে, তাহলে চক্রান্তকারীদের খুঁজে বের করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তাঁর কাজ হলো সমস্যার ত্বরিত সমাধান করা। আর অজুহাত সমস্যার সমাধান করে না বরং তা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেয় এবং নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
আমি এক আমেরিকান দম্পতিকে চিনতাম, যাঁরা ছিলেন দাম্পত্য জীবনে অত্যন্ত সুখী। আমি একদিন তাঁদের ‘সিক্রেট’ জানতে চাইলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁদের মধ্যেও ঝগড়া-বিবাদ হয়, কিন্তু তাঁরা কোনো সমস্যারই, যত ক্ষুদ্রই হোক, সমাধান না করে রাতে ঘুমান না। আজীবন এ চর্চার ফলেই নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়নি এবং তাঁরা সমস্যার ভারে নুয়ে পড়েননি। ব্যক্তির জীবনে যা সত্য, সরকারের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
মনে হয়, আমাদের বর্তমান সরকার সমস্যা সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে জুড়িহীন। উদাহরণস্বরূপ, সরকার নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে নিয়ে অহেতুক একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’কে তুলোধুনো করে আমেরিকান কংগ্রেসে এ বিষয়ে শুনানির ইন্ধন জুগিয়েছে। এমনকি নীরবে সমাধানের চেষ্টা না করে বেসামাল কথাবার্তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে, যা ভালো করার লক্ষ্যে আবার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জানি না এতে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত বদলাবে কি না।
বুয়েটের উদ্ভূত পরিস্থিতিও সরকারেরই সৃষ্টি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও সরকারদলীয় বিবেচনায় অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে বুয়েটের উপাচার্য ও দৃষ্টিকটুভাবে জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে সহ-উপাচার্য পদে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। আর উপাচার্যের গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড শুধু বুয়েট পরিবারেরই নয়, অনেক সচেতন নাগরিকের জন্যই ছিল বিব্রতকর। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও শিক্ষার মান রক্ষার ব্যাপারে তাঁর ডাকা সভায় বুয়েট পরিবারের সদস্যদের আবেগ ও উদ্বেগের গভীরতা শিক্ষা মন্ত্রী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন।
এটা ঠিক যে আন্দোলনকারীদের হয়তো আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁরা তো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে এ কাজ করেননি। বরং তাঁরা দলবাজির অবসান ঘটাতেই আন্দোলনে নেমেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাক সেটাই তাদের চাওয়া।
আর বর্তমান সরকারই বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের তথাকথিত রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে দেশের প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করেই। অনেকেরই জানা যে বর্তমান সরকারের আমলে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি।
আইনের ৯০বি ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র, বিভিন্ন পেশার সদস্য এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন’ গঠন করার বা রাখার বিধান থাকতে পারবে না। আইনের উদ্দেশ্য হলো লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক রাজনীতির অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আইনের এ বিধান কার্যকর করার পরিবর্তে তাদের গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের বিধান শুধু বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে নীরব। এটি শাসনের প্রতি শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনই নয়, পুরো জাতির সঙ্গেও মশকরা করার সমতূল্য। প্রসঙ্গত, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ/বিএনপির মতো দলের বৈদেশিক শাখা থাকাও বেআইনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি শুধু আইনেরই লঙ্ঘন নয়, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেরও পরিপন্থী। দিন বদলের সনদে আওয়ামী লীগ ‘শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত’ রাখার অঙ্গীকার করেছে। দলীয় বিবেচনায় অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমানকে বুয়েটে নিয়োগ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বরখেলাপ।
বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতিবাদের মুখেও উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগে অস্বীকৃতি বোধগম্য নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা মূলত এর ছাত্র-অভিভাবক-শিক্ষকদের কাছে। একজন উপাচার্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তিনি যখন এর নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন, তখন তাঁর সরে দাঁড়ানোই সমীচীন। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষের থেকে সহকর্মীদের সমর্থন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যার একটি দৃষ্টান্ত সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় (ইউওভি)।
দুই বছর আগে ইউওভির বোর্ড অব গভর্নরস অধ্যাপক থেরেসা সলেভানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। (পশ্চিমা বিশ্বে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গবেষণা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়।) তাঁর কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ গত জুন মাসে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও এলামনাইয়ের সম্মিলিত প্রবল প্রতিবাদের মুখে কর্তৃপক্ষ দুই সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাপক সলেভানকে সর্বসম্মতিক্রমে স্বপদে পুনর্বহাল করেন। প্রসঙ্গত, গোঁ না ধরে ভুল স্বীকার করতে এবং প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে বলেই পশ্চিমারা সামনে এগিয়ে গেছে।
প্রতিবাদীরা পদত্যাগ করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাইরে থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন—অধ্যাপক নজরুল ইসলামের এমন খেদোক্তিও অগ্রহণযোগ্য। বস্তুত, এ বক্তব্য শুধু তাঁর স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণেরই নয়, বুয়েটের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অযোগ্যতারই প্রতিফলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ মূলত তিনটি: পাঠদান, গবেষণা ও পাবলিক সার্ভিস বা জনসেবা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যত বেশি গবেষণা করেন—খণ্ডকালীন শিক্ষকদের কাছ থেকে গবেষণা আশা করা যায় না—সেসব বিশ্ববিদ্যালয় তত বেশি সফল ও বিখ্যাত। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম হয় এটি জানেন না, না হয় ব্যক্তি স্বার্থ ও দলতন্ত্রের প্রতি অন্ধত্বের কারণে এটি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রসঙ্গত, সমস্যা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেই নয়, অহেতুক শত্রুতা সৃষ্টি করার ব্যাপারেও বর্তমান সরকার যেন অদ্বিতীয়। সরকার সাধারণত নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। কিন্তু কিছু কর্তাব্যক্তি যেন আদাজল খেয়ে লেগেছেন সরকারের শুভানুধ্যায়ীদেরও শত্রুতে পরিণত করতে। দুর্ভাগ্যবশত এরই মধ্যে তাঁরা বেশ সফলতাও অর্জন করেছেন। দিন বদলের সনদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার উপেক্ষা করে এবং রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার শপথ ভঙ্গ করে দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের নগ্ন চর্চাও এ ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে। ফলে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ী সরকার এখন কট্টর আওয়ামী লীগারদের সরকারে পরিণত হয়েছে।
পরিশেষে, আশা করি সরকার দ্রুততার সঙ্গে বুয়েটের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে। আর বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের অপসারণের মাধ্যমেই একমাত্র তা সম্ভব। আরও আশা করি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সরকার ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক রাজনীতির অবসান ঘটাবে, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনবে এবং দলতন্ত্র-ফায়দাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণহীন ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরবে। তাহলেই সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের সৃষ্ট সন্ত্রাস-দখলদারি-চাঁদাবাজি-খুনখারাবির অবসান ঘটবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শান্তি ফিরে আসবে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের অমিত সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারব। কারণ, শিক্ষক-ছাত্র (অপ)রাজনীতির ফলে সৃষ্ট বর্তমান অরাজকতা আমাদের তরুণদের মেধা-মননশীল বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সে সম্ভাবনাকে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments