স্মরণ-স্মরণে বরণে সন্তোষদা by বেলাল চৌধুরী
সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আমার তিন পর্যায়ে দেখা-সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাৎ বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে কুখ্যাত ৯২-ক ধারায় আটকাবস্থায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। তাঁর সম্পর্কে প্রথম থেকেই নানা গল্প। বরিশালে জন্ম হলেও ঢাকার সূত্রাপুরের তৎকালীন বাসিন্দা সন্তোষদা যখন গ্রেপ্তার হন, তখন তিনি আইজি প্রিজন অফিসে কর্মরত ছিলেন।
তাঁর গ্রেপ্তার পর্বও ছিল নানা নাটকীয়তায় ভরা। জেলখানায় তখন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই প্রায় নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমী আর সাম্যবাদে বিশ্বাসী। সন্তোষদার যে জিনিসটা আমার সেই তরুণ বয়সে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছিল, সেটা তাঁর অধ্যয়ন, অধ্যবসায়, পঠন-পাঠন আর অচলা মাতৃভক্তি।
কথিত আছে যে, গ্রেপ্তারের মুহূর্তে তাঁর কাছে নাকি পাওয়া গিয়েছিল খাতাভর্তি কবিতা। এই না হলে কি আমাদের সন্তোষদা হন?
জেলজীবনেও তিনি যে অক্লান্তভাবে পড়াশোনো আর লেখালেখির কাজ চালিয়ে যেতেন, সে তো আমি স্বচক্ষেই দেখেছি। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল অসাধারণ। দেখেছি কীভাবে তিনি পালগ্রেভের সোনালি কাব্য সংকলন থেকে কাব্যানুবাদ করে চলেছেন। অনেকটা যেন মকশো করার মতো। এলিয়ট, অডেন, ডিলান টমাস ছাড়াও অনেক স্বল্প পরিচিত কবি কিন্তু কাব্যগুণে উল্লেখযোগ্য এমন কবির সংখ্যাও কম ছিল না। তা ছাড়া আমাদের দেশের পাশ্চাত্য প্রভাবিত ত্রিশের কবিকুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরিধি দেখে অবাক হয়েছিলাম। একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে কী করে তাঁদের কবিতার পুঙ্খানুপুঙ্খ অবলীলায় সারাক্ষণ আউড়ে যাচ্ছেন। বিষ্ণু দে, সমর সেন ছিলেন তাঁর পছন্দের তালিকায় সর্বাগ্রে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাহিত্য রুচির একান্ত ভক্ত হয়ে উঠি। একবার তো আমরা ঠিক করেছিলাম মার্কিন লেখক আপটন সিনক্লেয়ারের ফ্লিভার কিং বইটি যৌথভাবে তরজমার কাজে হাত দেব। আপটন সিনক্লেয়ার ছিলেন প্রথম দিককার প্রগতিবাদী হাওয়ার্ড ফাস্টের সমগোত্রীয়। জেলজীবনে আরও যাঁরা আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, জ্ঞানে-গুণে, সাহসে নিবেদিতপ্রাণ আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সে কথা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সন্তোষদার ধ্যান-ধারণায় মানুষের কল্যাণ সাধন সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত; এ ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকিঝুঁকি যে চলবে না, এ কথা স্পষ্ট করে বলতে তাঁর মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি কখনোই ধর্মবিরোধী ছিলেন না। জ্ঞানবিজ্ঞানের সপক্ষেই আমৃত্যু কলম চালিয়ে গেছেন।
জেল থেকে বেরোনোর পর প্রায় বছর খানেক আমাকে আমাদের গ্রামে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। সে সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে আমি প্রায় নিয়মিতভাবেই সন্তোষদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম চিঠির মারফত। সন্তোষদাও প্রত্যুত্তর দিতেন একটু দেরি করে হলেও পোস্টকার্ডে। আমার মন্দভাগ্য যে, সেসব অমূল্য চিঠি আমি হারিয়ে ফেলেছি। এভাবে সন্তোষদার সঙ্গে আমার অনিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হলেও তাতে উভয়পক্ষেই আন্তরিকতার অভাব ছিল না। এরপর দীর্ঘদিনের অদেখার পর একদিন সেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর হঠাৎ একদিন পার্ক সার্কাসে সন্তোষদার সঙ্গে দেখা। আমি সেই ১৯৬১-৬২ সালের দিকে জীবনের নানা ঘূর্ণিপাকে ভাসতে ভাসতে কলকাতায় থিতু হয়েছি। সন্তোষদাকে দেখে মনে হলো সেই আগেকার মতোই আছেন। একটুও বদলাননি। তাঁর মুখেই শোনা গেল পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার কেচ্ছা। আমি কলকাতায় থাকলেও আমার মা-বাবা, ভাইবোন—সবই ছিল ঢাকায়, কিংবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পর আমি যখন সুদীর্ঘ ১৪ বছরের প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম, তখন আবার সন্তোষদাকে দেখলাম সংবাদ-এর চেয়ারে সমাসীন। জুতা থেকে চণ্ডীপাঠ একসময় সংবাদের জন্য তাই করেছেন সন্তোষদা। যখন যা লিখতে হবে তা লিখেছেন। অনিরুদ্ধ নামের আড়ালে যে কলাম লিখতেন, তাতে তাঁর মতাদর্শ, রাষ্ট্রের উন্নতির পথে যত বাধা-বিপত্তি, অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল সোচ্চার। আর জীবনে ধ্রুবতারা হিসেবে গণ্য করতেন রবীন্দ্রনাথকে। যার জন্য তাঁর অনেক লেখালেখিতে বিভিন্ন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি জড়িয়ে থাকত।
আর একটামাত্রই শখ বলি বা প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার জন্যই হবে হয়তো মুষ্টিবদ্ধ শক্ত হাতে চেপে ধরে সিগারেট টানার ভঙ্গিটা ছিল দর্শনীয়। মনে হতো এই সুখটান তাঁকে এক অতীন্দ্রিয়লোকে নিয়ে যেত। একবার সন্ধানী প্রকাশিত আমার একটি অকিঞ্চিৎকর কবিতার বইয়ের তিনি যে সমালোচনা লিখেছিলেন, আমার মনে হয়েছিল জীবনে এক মহাপ্রাপ্তি।
জীবিকার প্রয়োজনে, যখন তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন, তখন সাংবাদিকতার জগতের এক দিকপাল কাজী মোহাম্মদ ইদিরস, যাঁর রসবোধ আর সাহিত্যপ্রেম কখনো ভোলার নয়, এমন মানুষটি তাঁর দুই কন্যার গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন সন্তোষদাকে।
কাজী মদিনা আর কাজী তামান্না। তাদের এই মাস্টারমশাই সম্পর্কে তারা যে পরিমাণ উচ্ছ্বসিত ছিল তা শুধু বলে বোঝানোর নয়। এই হলো সন্তোষদা, যাঁর মুখে তাঁর অসম সাহসী মায়ের কথা ছাড়া কখনো আর কারোর কথা শুনিনি। ভটভটিয়ায় চেপে যমুনা নদী পার হতে গিয়ে যখন তাঁর বড় ছেলে দুর্ঘটনায় পড়ে এবং জলমগ্ন হয়ে তাঁর সলিল সমাধি ঘটে (১৯৮৮ সালে) তখনই আমি সর্বপ্রথম তাঁর পরিবারের কথা শুনি। এই ঘটনার সময়ও দেখিছি সন্তোষদার কী কঠিন মনোবল! এ এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হয়েছিল আমার।
সন্তোষদা, আপনি আজ যেখানেই থাকুন না কেন মনে করবেন, আপনার একান্ত অনুগত এক অনুজ আপনাকে সর্বাধিক শ্রদ্ধা সম্ভাষণ নিবেদন করছে।
কথিত আছে যে, গ্রেপ্তারের মুহূর্তে তাঁর কাছে নাকি পাওয়া গিয়েছিল খাতাভর্তি কবিতা। এই না হলে কি আমাদের সন্তোষদা হন?
জেলজীবনেও তিনি যে অক্লান্তভাবে পড়াশোনো আর লেখালেখির কাজ চালিয়ে যেতেন, সে তো আমি স্বচক্ষেই দেখেছি। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল অসাধারণ। দেখেছি কীভাবে তিনি পালগ্রেভের সোনালি কাব্য সংকলন থেকে কাব্যানুবাদ করে চলেছেন। অনেকটা যেন মকশো করার মতো। এলিয়ট, অডেন, ডিলান টমাস ছাড়াও অনেক স্বল্প পরিচিত কবি কিন্তু কাব্যগুণে উল্লেখযোগ্য এমন কবির সংখ্যাও কম ছিল না। তা ছাড়া আমাদের দেশের পাশ্চাত্য প্রভাবিত ত্রিশের কবিকুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরিধি দেখে অবাক হয়েছিলাম। একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে কী করে তাঁদের কবিতার পুঙ্খানুপুঙ্খ অবলীলায় সারাক্ষণ আউড়ে যাচ্ছেন। বিষ্ণু দে, সমর সেন ছিলেন তাঁর পছন্দের তালিকায় সর্বাগ্রে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাহিত্য রুচির একান্ত ভক্ত হয়ে উঠি। একবার তো আমরা ঠিক করেছিলাম মার্কিন লেখক আপটন সিনক্লেয়ারের ফ্লিভার কিং বইটি যৌথভাবে তরজমার কাজে হাত দেব। আপটন সিনক্লেয়ার ছিলেন প্রথম দিককার প্রগতিবাদী হাওয়ার্ড ফাস্টের সমগোত্রীয়। জেলজীবনে আরও যাঁরা আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, জ্ঞানে-গুণে, সাহসে নিবেদিতপ্রাণ আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সে কথা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সন্তোষদার ধ্যান-ধারণায় মানুষের কল্যাণ সাধন সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত; এ ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকিঝুঁকি যে চলবে না, এ কথা স্পষ্ট করে বলতে তাঁর মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি কখনোই ধর্মবিরোধী ছিলেন না। জ্ঞানবিজ্ঞানের সপক্ষেই আমৃত্যু কলম চালিয়ে গেছেন।
জেল থেকে বেরোনোর পর প্রায় বছর খানেক আমাকে আমাদের গ্রামে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। সে সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে আমি প্রায় নিয়মিতভাবেই সন্তোষদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম চিঠির মারফত। সন্তোষদাও প্রত্যুত্তর দিতেন একটু দেরি করে হলেও পোস্টকার্ডে। আমার মন্দভাগ্য যে, সেসব অমূল্য চিঠি আমি হারিয়ে ফেলেছি। এভাবে সন্তোষদার সঙ্গে আমার অনিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হলেও তাতে উভয়পক্ষেই আন্তরিকতার অভাব ছিল না। এরপর দীর্ঘদিনের অদেখার পর একদিন সেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর হঠাৎ একদিন পার্ক সার্কাসে সন্তোষদার সঙ্গে দেখা। আমি সেই ১৯৬১-৬২ সালের দিকে জীবনের নানা ঘূর্ণিপাকে ভাসতে ভাসতে কলকাতায় থিতু হয়েছি। সন্তোষদাকে দেখে মনে হলো সেই আগেকার মতোই আছেন। একটুও বদলাননি। তাঁর মুখেই শোনা গেল পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার কেচ্ছা। আমি কলকাতায় থাকলেও আমার মা-বাবা, ভাইবোন—সবই ছিল ঢাকায়, কিংবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পর আমি যখন সুদীর্ঘ ১৪ বছরের প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম, তখন আবার সন্তোষদাকে দেখলাম সংবাদ-এর চেয়ারে সমাসীন। জুতা থেকে চণ্ডীপাঠ একসময় সংবাদের জন্য তাই করেছেন সন্তোষদা। যখন যা লিখতে হবে তা লিখেছেন। অনিরুদ্ধ নামের আড়ালে যে কলাম লিখতেন, তাতে তাঁর মতাদর্শ, রাষ্ট্রের উন্নতির পথে যত বাধা-বিপত্তি, অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল সোচ্চার। আর জীবনে ধ্রুবতারা হিসেবে গণ্য করতেন রবীন্দ্রনাথকে। যার জন্য তাঁর অনেক লেখালেখিতে বিভিন্ন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি জড়িয়ে থাকত।
আর একটামাত্রই শখ বলি বা প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার জন্যই হবে হয়তো মুষ্টিবদ্ধ শক্ত হাতে চেপে ধরে সিগারেট টানার ভঙ্গিটা ছিল দর্শনীয়। মনে হতো এই সুখটান তাঁকে এক অতীন্দ্রিয়লোকে নিয়ে যেত। একবার সন্ধানী প্রকাশিত আমার একটি অকিঞ্চিৎকর কবিতার বইয়ের তিনি যে সমালোচনা লিখেছিলেন, আমার মনে হয়েছিল জীবনে এক মহাপ্রাপ্তি।
জীবিকার প্রয়োজনে, যখন তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন, তখন সাংবাদিকতার জগতের এক দিকপাল কাজী মোহাম্মদ ইদিরস, যাঁর রসবোধ আর সাহিত্যপ্রেম কখনো ভোলার নয়, এমন মানুষটি তাঁর দুই কন্যার গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন সন্তোষদাকে।
কাজী মদিনা আর কাজী তামান্না। তাদের এই মাস্টারমশাই সম্পর্কে তারা যে পরিমাণ উচ্ছ্বসিত ছিল তা শুধু বলে বোঝানোর নয়। এই হলো সন্তোষদা, যাঁর মুখে তাঁর অসম সাহসী মায়ের কথা ছাড়া কখনো আর কারোর কথা শুনিনি। ভটভটিয়ায় চেপে যমুনা নদী পার হতে গিয়ে যখন তাঁর বড় ছেলে দুর্ঘটনায় পড়ে এবং জলমগ্ন হয়ে তাঁর সলিল সমাধি ঘটে (১৯৮৮ সালে) তখনই আমি সর্বপ্রথম তাঁর পরিবারের কথা শুনি। এই ঘটনার সময়ও দেখিছি সন্তোষদার কী কঠিন মনোবল! এ এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হয়েছিল আমার।
সন্তোষদা, আপনি আজ যেখানেই থাকুন না কেন মনে করবেন, আপনার একান্ত অনুগত এক অনুজ আপনাকে সর্বাধিক শ্রদ্ধা সম্ভাষণ নিবেদন করছে।
No comments