হুমায়ূন, ভাটির পুরুষ ও কিছু মুগ্ধতার গল্প by শাকুর মজিদ
শাহ আবদুল করিম শুধু নয় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আরও অনেক বাউল-শিল্পীর সমঝদার ২০০৪ সালের অক্টোবর মাস। সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলগ্রামে শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে ভাটির পুরুষ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্রের চতুর্থ দফার শুটিং করে এসেছি। করিম সাহেব হুমায়ূন আহমেদের খুব প্রশংসা করলেন।
বললেন, ‘বড় একটা বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে এসেছি। অনেক লোকজন ছিল, ক্যামেরা ছিল।’ করিম সাহেব বেশি কিছু মনে করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর ছেলে শাহ নূর জালাল হুমায়ূন আহমেদের ওপর খুব নাখোশ। বললেন, ‘বিদায়ের সময় ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, তিনি নিজে একবার বাবার সঙ্গে দেখাও করলেন না।’
আমি ঢাকা এসে ঠিক করি, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যে করেই হোক দেখা করে বিষয়টা আমার জেনে নিতে হবে।
গায়ক সেলিম চৌধুরীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আমি ফোন করি একটা টিঅ্যান্ডটি নম্বরে এবং আমার দেখা করার কারণ জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যে আমি তাঁর সামনে হাজির হয়ে যাই। ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ছয়তলার একটা ফ্ল্যাটের প্রায় সব কামরাই ফাঁকা। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগানো গেস্টরুম থেকে এক তরুণ বেরিয়ে এলেন। তাঁকে আমি কিছু নাটকে দেখেছি। লন্ডন থেকে এই ভদ্রলোক চলে এসেছেন মূলত হুমায়ূন আহমেদের সংস্পর্শে থেকে নাটক-সিনেমা বানাবেন, এমন আশায়। তাঁর নাম স্বাধীন খসরু। হুমায়ূন আহমেদ চন্দ্রকথা নামক একটি সিনেমা বানিয়েছেন, সেই ছবিতে তিনি অর্ধেক মূলধন লগ্নি করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। স্বাধীন খসরুর ব্রিটিশ স্কুল অব অ্যাকটিংয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু শেষমেশ হুমায়ূন আহমেদকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু হিসেবে। সে কারণে বিলেতের পাট প্রায় চুকিয়েই তিনি ভরসা করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের ওপর। ঢাকায় তাঁর নিজের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে প্রায় নিঃসঙ্গ লোকটি এই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ধানমন্ডির এই বাড়িতেই থাকেন। রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই, পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। কখনো নিজেরা চা বানিয়ে খাওয়ান পরস্পরকে এবং তার ভাগ আমিও পেয়ে যাই।
ধানমন্ডি ৩/এ ‘দখিন হাওয়া’র ছয়তলার ফ্ল্যাটের যে কামরায় হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিতে বসি, সেখানে সে অর্থে কোনো আসবাবপত্রই নেই। একটা তোশকের এক পাশে মহাজনি একটা ডেস্ক। বোঝার বাকি থাকে না, এটা লেখকের লেখার ডেস্ক। তিনি লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে বসে লেখেন এই ডেস্কে, লিখতে লিখতে ক্লান্ত হলে শরীর এলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রমাণ সাইজের তোশক আছে পেছনে। তার পেছনে একটা অসমাপ্ত পেইন্টিং। একজন লেখকের একান্ত নিজস্ব এমন আঙিনা আমাকে মুগ্ধ করে।
এই তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটের আরেকটি ঘর দেখে মনে হয় একটা লাইব্রেরি। ছাদ থেকে দেয়াল অবদি টানা বুকশেলফ। মাঝখানের জায়গায় কতগুলো ইজেল দাঁড় করানো। ইজেলে ছবি আঁকা হয়েছে। অয়েল পেইন্টিং। কয়েকটা শেষ পর্যায়ে, কয়েকটা অর্ধেক, কিছু ইজেল সাদা, পেনসিলের দাগ। এলোমেলো পড়ে আছে রং, তুলি, প্যালেট। আমার ক্যামেরা প্যান করে পুরো ঘর। এক জায়গায় এসে স্থির হয় হুমায়ূন আহমেদের ওপর এবং তিনি খালি গা ঢাকার জন্য একটা কুঁচকানো হাফ শার্ট গায়ে দিয়ে তৈরি হয়ে যান আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য।
শুটিং শুরু করব। ক্যামেরা তাক করে আছি। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ‘তোমার ক্যামেরাম্যান কোথায়?’
বলি, ‘স্যার, আমিই ক্যামেরাম্যান।’
ও, ড্রাইভার কাম কন্ডাকটর! বিদেশে এমন কিছু বাস আছে। সেই বাসগুলোতে যিনি গাড়ি চালান, তিনি টিকিটও চেক করেন। ড্রাইভার কাম কন্ডাকটর। তুমিও তাই দেখছি! ঠিক আছে, চলো শুরু করি। প্রথম প্রশ্ন কি তোমার?
আমি শুরু করি। এবং সেই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরেই বলছি। শাহ আবদুল করিমের নাম হুমায়ূন আহমেদ শুনেছিলেন ১৯৯৪ সালে, একবার যখন সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন হাসন উৎসবে। তিন দিনের এই উৎসবের এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিশেষ অতিথি। ঢাকা থেকে গায়ক সেলিম চৌধুরী আয়োজন করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে সেখানে। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক ও কবি হাসান হাফিজ, সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান, গায়ক মলয় কুমার গাঙ্গুলী আর ফজলুর রহমান তুহীন ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই উৎসবে হাসন রাজার গানের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু বাউলের গানও শুনতে গিয়ে একসময় একটা গান শোনেন, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। গায়ক সেলিম চৌধুরী গানটি গেয়ে শোনালেন। গানটি শুনেই তাঁর মনে হয়েছিল, যে লোকটি এই গান লিখেছে, সে কে? কোথায় থাকে? বাড়ি কত দূর? সেলিম চৌধুরী জানান, এই লোকের নাম আবদুল করিম, বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজান ধল গ্রামে, এবং তিনি এখনো বেঁচে আছেন, বয়স প্রায় ৮০ বছর।
সেলিম চৌধুরীই পরে পরিচয় করিয়ে দেন আবদুল করিমের সঙ্গে। এর বেশ কয়েক মাস পর হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় যথারীতি আগমন ঘটে আবদুল করিমের। হুমায়ূন আহমেদ দেখলেন, লোকটার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাঁর ইচ্ছা হলো, এই লোকটার কিছু কথা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন।
যথারীতি আয়োজন হলো শুটিংয়ের। হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির ১০ নম্বর রোডের বাড়ির লাইব্রেরি রুমেই তাঁকে বসানো হলো। সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ডাকা হলো আরেক প্রবীণ অভিনেতা আবুল খায়েরকে। সেদিন রাতে হুমায়ূন আহমেদের বাসায়ই আবদুল করিম ছিলেন। ‘এই গুণী মানুষটিকে আমার সাধ্যমতো সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি আমি।’ বললেন হুমায়ূন আহমেদ।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্যাকেজ প্রোগামের আওতায় নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে ‘জলসা ঘর’ নামে একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
শাহ আবদুল করিমের গানগুলো নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ যখন ‘জলসা ঘর’ নামের প্যাকেজ অনুষ্ঠান বিটিভিতে জমা দেন, তখন বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে যান। যে গীতিকারের লেখা গানগুলো নিয়ে অনুষ্ঠান তৈরি, তিনি বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার নন। সুতরাং বিটিভি তাঁর গান প্রচার করতে পারবে না। এ সময় বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন বরকতউল্লাহ। তাঁর পরামর্শে শাহ আবদুল করিমকে প্রথমে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার করা হয় এবং অনুষ্ঠানটি প্রচারের অনুমতি পায়।
তবে শাহ আবদুল করিমকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম দেখানো হয় মুস্তাফা জামান আব্বাসীর উপাস্থাপনায় ‘ভরা নদীর বাঁকে’ নামের এক অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেই আয়োজনটি ছিল ভিন্ন। এবার এই ‘জলসা ঘর’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাউল শাহ আবদুল করিম পেলেন তালিকাভুক্ত গীতিকারের মর্যাদা।
সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে হাসন উৎসবে সুনামগঞ্জে যাওয়ার ঘটনা হুমায়ূন আহমেদের অন্য একটা চোখকে খুলে দেয়। পরে তাঁর বেশ কিছু নাটকে হাসন রাজা, রাধারমন আর আবদুল করিমের গান সংযুক্ত হয়। একই ভৌগোলিক এলাকা নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বাউলদের গানও বিশাল একটা ভূমিকা রাখে। ভাটি বাংলার মানুষের জীবনচরিত্র নিয়ে শ্রাবণ মেঘের দিন নামের যে চলচ্চিত্রটি বানিয়েছিলেন, তার বেশ কয়েকটি গানও নিয়েছিলেন ভাটি বাংলার বাউল রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সির কাছ থেকে। শাহ আবদুল করিমও ছিলেন একই বলয়ের বাউল।
শাহ আবদুল করিম একুশে পদক পেয়েছিলেন। এই সংবাদটি শুনে কী মনে হয়েছিল আপনার? প্রশ্ন করি হুমায়ূন আহমেদকে।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ২০০১ সালে শাহ আবদুল করিম যখন এই পুরস্কার পান, তখন মনে হয়েছিল একুশে পদকটি একটি যোগ্য লোকের কাছে গেল। শাহ আবদুল করিম ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ সিলেট অঞ্চলের অনেক বাউল বা গীতিকবির গানের ভক্ত ছিলেন। প্রয়াত গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি তাঁর এতই প্রিয় ছিল যে তিনি তিনজন শিল্পীকে দিয়ে তিনবারে গানটি রেকর্ড করিয়েছিলেন। শেষমেশ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া গানটি তিনি রেখেছিলেন ব্যবহারের জন্য।
শাহ আবদুল করিমের মতো একজন স্বশিক্ষিত লেখাপড়া না জানা গীতিকবির গান সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই লোকটি প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের মিশ্রণ। তাঁর গানে সুরের যে ব্যবহার, তা খুবই বৈচিত্র্যময়।’
ভাটির পুরুষ তথ্যচিত্রের জন্য হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড শেষে আমি বিদায় নেওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়াই। কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল কিছু মুগ্ধ হওয়ার মুহূর্ত।
স্যার খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। তিনি বিদায় না দিয়ে আমাকে এ ঘর-ও ঘর দেখান, আঁকা ছবিগুলো নিয়ে কথা বলেন।
একসময় একটা ড্রয়ার খুলে কতগুলো পাথর বের করেন। মার্বেলের মতোই পাথর, কিন্তু আকার ও আয়তনে বিশাল। আমি এত বিশাল আকারের মার্বেল কখনো দেখিনি। তিনি একটি একটি করে বের করেন। আমাকে হাতের মধ্যে ধরে রাখতে বলেন। কোনোটি আমি এক হাতে ধরি, কোনটি ধরতে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়।
আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বলো তো, একেকটা পাথরের দাম কত?’
আমি বলতে পারি না। আমার কোনো ধারণাই নেই এসব পাথরের মূল্য সম্পর্কে। স্যার আমাকে দাম শোনান। দাম শুনে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। পাঁচ-ছয় হাজার ডলার খরচ করে এ রকম গোলক মানুষ কেন কিনবে, আমি বুঝতে পারি না!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, এত দাম দিয়ে এসব পাথর কেন কিনেছেন?’
তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
আমি মানুষের মুগ্ধতা দেখে আনন্দ পাই। তুমি মুগ্ধ হওনি?
জি স্যার, হয়েছি।
তোমার মুগ্ধতার কাছে এর মূল্য অনেক কম। মানুষকে মুগ্ধ করা আমার আরেকটা কাজ। আসো, তোমাকে এবার আরেকটা জিনিস দেব, এটা তুমি নিয়ে যাবে।
এবার তিনি ক্যাসেটের শেলফ খুঁজতে শুরু করেন এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ভিএইচএস ক্যাসেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘নাও, এটা তোমার, নিয়ে যাও।’
আমি তাকিয়ে দেখি, ক্যাসেটের গায়ে আমারই হাতে লেখা একটা নাটকের নাম লন্ডনী কইন্যা।
এবার আমার সত্যি সত্যি মুগ্ধ হওয়ার পালা।
আমি প্রশ্ন করি, ‘স্যার, এটা তো ১৯৯৯ সালের, পাঁচ বছর আগের ক্যাসেট। আপনার হাতে এল কী করে? আমি তো আপনাকে দিইনি?’
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দেন না। আমাকে বলেন,
- তুমি মুগ্ধ হওনি?
-জি স্যার, আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছি।
-আমি আনন্দ পেয়েছি তোমার মুগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখে। এই ক্যাসেটটি আমি অন্যভাবেও তোমার কাছে ফেরত দিতে পারতাম, তাতে আমি আমার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম। আজ তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে, যাওয়ার সময় তোমাকে আমি একটা সারপ্রাইজ দেব।
-স্যার, আমি সারপ্রাইজড।
-যাও এবার। ভালো থেকো।
আমি মুগ্ধতার স্মৃতি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। এরপর বেশ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয় না।
আমি ঢাকা এসে ঠিক করি, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যে করেই হোক দেখা করে বিষয়টা আমার জেনে নিতে হবে।
গায়ক সেলিম চৌধুরীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আমি ফোন করি একটা টিঅ্যান্ডটি নম্বরে এবং আমার দেখা করার কারণ জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যে আমি তাঁর সামনে হাজির হয়ে যাই। ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ছয়তলার একটা ফ্ল্যাটের প্রায় সব কামরাই ফাঁকা। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগানো গেস্টরুম থেকে এক তরুণ বেরিয়ে এলেন। তাঁকে আমি কিছু নাটকে দেখেছি। লন্ডন থেকে এই ভদ্রলোক চলে এসেছেন মূলত হুমায়ূন আহমেদের সংস্পর্শে থেকে নাটক-সিনেমা বানাবেন, এমন আশায়। তাঁর নাম স্বাধীন খসরু। হুমায়ূন আহমেদ চন্দ্রকথা নামক একটি সিনেমা বানিয়েছেন, সেই ছবিতে তিনি অর্ধেক মূলধন লগ্নি করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। স্বাধীন খসরুর ব্রিটিশ স্কুল অব অ্যাকটিংয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু শেষমেশ হুমায়ূন আহমেদকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু হিসেবে। সে কারণে বিলেতের পাট প্রায় চুকিয়েই তিনি ভরসা করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের ওপর। ঢাকায় তাঁর নিজের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে প্রায় নিঃসঙ্গ লোকটি এই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ধানমন্ডির এই বাড়িতেই থাকেন। রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই, পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। কখনো নিজেরা চা বানিয়ে খাওয়ান পরস্পরকে এবং তার ভাগ আমিও পেয়ে যাই।
ধানমন্ডি ৩/এ ‘দখিন হাওয়া’র ছয়তলার ফ্ল্যাটের যে কামরায় হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিতে বসি, সেখানে সে অর্থে কোনো আসবাবপত্রই নেই। একটা তোশকের এক পাশে মহাজনি একটা ডেস্ক। বোঝার বাকি থাকে না, এটা লেখকের লেখার ডেস্ক। তিনি লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে বসে লেখেন এই ডেস্কে, লিখতে লিখতে ক্লান্ত হলে শরীর এলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রমাণ সাইজের তোশক আছে পেছনে। তার পেছনে একটা অসমাপ্ত পেইন্টিং। একজন লেখকের একান্ত নিজস্ব এমন আঙিনা আমাকে মুগ্ধ করে।
এই তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটের আরেকটি ঘর দেখে মনে হয় একটা লাইব্রেরি। ছাদ থেকে দেয়াল অবদি টানা বুকশেলফ। মাঝখানের জায়গায় কতগুলো ইজেল দাঁড় করানো। ইজেলে ছবি আঁকা হয়েছে। অয়েল পেইন্টিং। কয়েকটা শেষ পর্যায়ে, কয়েকটা অর্ধেক, কিছু ইজেল সাদা, পেনসিলের দাগ। এলোমেলো পড়ে আছে রং, তুলি, প্যালেট। আমার ক্যামেরা প্যান করে পুরো ঘর। এক জায়গায় এসে স্থির হয় হুমায়ূন আহমেদের ওপর এবং তিনি খালি গা ঢাকার জন্য একটা কুঁচকানো হাফ শার্ট গায়ে দিয়ে তৈরি হয়ে যান আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য।
শুটিং শুরু করব। ক্যামেরা তাক করে আছি। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ‘তোমার ক্যামেরাম্যান কোথায়?’
বলি, ‘স্যার, আমিই ক্যামেরাম্যান।’
ও, ড্রাইভার কাম কন্ডাকটর! বিদেশে এমন কিছু বাস আছে। সেই বাসগুলোতে যিনি গাড়ি চালান, তিনি টিকিটও চেক করেন। ড্রাইভার কাম কন্ডাকটর। তুমিও তাই দেখছি! ঠিক আছে, চলো শুরু করি। প্রথম প্রশ্ন কি তোমার?
আমি শুরু করি। এবং সেই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরেই বলছি। শাহ আবদুল করিমের নাম হুমায়ূন আহমেদ শুনেছিলেন ১৯৯৪ সালে, একবার যখন সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন হাসন উৎসবে। তিন দিনের এই উৎসবের এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিশেষ অতিথি। ঢাকা থেকে গায়ক সেলিম চৌধুরী আয়োজন করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে সেখানে। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক ও কবি হাসান হাফিজ, সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান, গায়ক মলয় কুমার গাঙ্গুলী আর ফজলুর রহমান তুহীন ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই উৎসবে হাসন রাজার গানের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু বাউলের গানও শুনতে গিয়ে একসময় একটা গান শোনেন, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। গায়ক সেলিম চৌধুরী গানটি গেয়ে শোনালেন। গানটি শুনেই তাঁর মনে হয়েছিল, যে লোকটি এই গান লিখেছে, সে কে? কোথায় থাকে? বাড়ি কত দূর? সেলিম চৌধুরী জানান, এই লোকের নাম আবদুল করিম, বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজান ধল গ্রামে, এবং তিনি এখনো বেঁচে আছেন, বয়স প্রায় ৮০ বছর।
সেলিম চৌধুরীই পরে পরিচয় করিয়ে দেন আবদুল করিমের সঙ্গে। এর বেশ কয়েক মাস পর হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় যথারীতি আগমন ঘটে আবদুল করিমের। হুমায়ূন আহমেদ দেখলেন, লোকটার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাঁর ইচ্ছা হলো, এই লোকটার কিছু কথা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন।
যথারীতি আয়োজন হলো শুটিংয়ের। হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির ১০ নম্বর রোডের বাড়ির লাইব্রেরি রুমেই তাঁকে বসানো হলো। সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ডাকা হলো আরেক প্রবীণ অভিনেতা আবুল খায়েরকে। সেদিন রাতে হুমায়ূন আহমেদের বাসায়ই আবদুল করিম ছিলেন। ‘এই গুণী মানুষটিকে আমার সাধ্যমতো সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি আমি।’ বললেন হুমায়ূন আহমেদ।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্যাকেজ প্রোগামের আওতায় নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে ‘জলসা ঘর’ নামে একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
শাহ আবদুল করিমের গানগুলো নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ যখন ‘জলসা ঘর’ নামের প্যাকেজ অনুষ্ঠান বিটিভিতে জমা দেন, তখন বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে যান। যে গীতিকারের লেখা গানগুলো নিয়ে অনুষ্ঠান তৈরি, তিনি বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার নন। সুতরাং বিটিভি তাঁর গান প্রচার করতে পারবে না। এ সময় বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন বরকতউল্লাহ। তাঁর পরামর্শে শাহ আবদুল করিমকে প্রথমে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার করা হয় এবং অনুষ্ঠানটি প্রচারের অনুমতি পায়।
তবে শাহ আবদুল করিমকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম দেখানো হয় মুস্তাফা জামান আব্বাসীর উপাস্থাপনায় ‘ভরা নদীর বাঁকে’ নামের এক অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেই আয়োজনটি ছিল ভিন্ন। এবার এই ‘জলসা ঘর’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাউল শাহ আবদুল করিম পেলেন তালিকাভুক্ত গীতিকারের মর্যাদা।
সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে হাসন উৎসবে সুনামগঞ্জে যাওয়ার ঘটনা হুমায়ূন আহমেদের অন্য একটা চোখকে খুলে দেয়। পরে তাঁর বেশ কিছু নাটকে হাসন রাজা, রাধারমন আর আবদুল করিমের গান সংযুক্ত হয়। একই ভৌগোলিক এলাকা নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বাউলদের গানও বিশাল একটা ভূমিকা রাখে। ভাটি বাংলার মানুষের জীবনচরিত্র নিয়ে শ্রাবণ মেঘের দিন নামের যে চলচ্চিত্রটি বানিয়েছিলেন, তার বেশ কয়েকটি গানও নিয়েছিলেন ভাটি বাংলার বাউল রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সির কাছ থেকে। শাহ আবদুল করিমও ছিলেন একই বলয়ের বাউল।
শাহ আবদুল করিম একুশে পদক পেয়েছিলেন। এই সংবাদটি শুনে কী মনে হয়েছিল আপনার? প্রশ্ন করি হুমায়ূন আহমেদকে।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ২০০১ সালে শাহ আবদুল করিম যখন এই পুরস্কার পান, তখন মনে হয়েছিল একুশে পদকটি একটি যোগ্য লোকের কাছে গেল। শাহ আবদুল করিম ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ সিলেট অঞ্চলের অনেক বাউল বা গীতিকবির গানের ভক্ত ছিলেন। প্রয়াত গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি তাঁর এতই প্রিয় ছিল যে তিনি তিনজন শিল্পীকে দিয়ে তিনবারে গানটি রেকর্ড করিয়েছিলেন। শেষমেশ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া গানটি তিনি রেখেছিলেন ব্যবহারের জন্য।
শাহ আবদুল করিমের মতো একজন স্বশিক্ষিত লেখাপড়া না জানা গীতিকবির গান সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই লোকটি প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের মিশ্রণ। তাঁর গানে সুরের যে ব্যবহার, তা খুবই বৈচিত্র্যময়।’
ভাটির পুরুষ তথ্যচিত্রের জন্য হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড শেষে আমি বিদায় নেওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়াই। কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল কিছু মুগ্ধ হওয়ার মুহূর্ত।
স্যার খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। তিনি বিদায় না দিয়ে আমাকে এ ঘর-ও ঘর দেখান, আঁকা ছবিগুলো নিয়ে কথা বলেন।
একসময় একটা ড্রয়ার খুলে কতগুলো পাথর বের করেন। মার্বেলের মতোই পাথর, কিন্তু আকার ও আয়তনে বিশাল। আমি এত বিশাল আকারের মার্বেল কখনো দেখিনি। তিনি একটি একটি করে বের করেন। আমাকে হাতের মধ্যে ধরে রাখতে বলেন। কোনোটি আমি এক হাতে ধরি, কোনটি ধরতে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়।
আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বলো তো, একেকটা পাথরের দাম কত?’
আমি বলতে পারি না। আমার কোনো ধারণাই নেই এসব পাথরের মূল্য সম্পর্কে। স্যার আমাকে দাম শোনান। দাম শুনে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। পাঁচ-ছয় হাজার ডলার খরচ করে এ রকম গোলক মানুষ কেন কিনবে, আমি বুঝতে পারি না!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, এত দাম দিয়ে এসব পাথর কেন কিনেছেন?’
তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
আমি মানুষের মুগ্ধতা দেখে আনন্দ পাই। তুমি মুগ্ধ হওনি?
জি স্যার, হয়েছি।
তোমার মুগ্ধতার কাছে এর মূল্য অনেক কম। মানুষকে মুগ্ধ করা আমার আরেকটা কাজ। আসো, তোমাকে এবার আরেকটা জিনিস দেব, এটা তুমি নিয়ে যাবে।
এবার তিনি ক্যাসেটের শেলফ খুঁজতে শুরু করেন এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ভিএইচএস ক্যাসেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘নাও, এটা তোমার, নিয়ে যাও।’
আমি তাকিয়ে দেখি, ক্যাসেটের গায়ে আমারই হাতে লেখা একটা নাটকের নাম লন্ডনী কইন্যা।
এবার আমার সত্যি সত্যি মুগ্ধ হওয়ার পালা।
আমি প্রশ্ন করি, ‘স্যার, এটা তো ১৯৯৯ সালের, পাঁচ বছর আগের ক্যাসেট। আপনার হাতে এল কী করে? আমি তো আপনাকে দিইনি?’
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দেন না। আমাকে বলেন,
- তুমি মুগ্ধ হওনি?
-জি স্যার, আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছি।
-আমি আনন্দ পেয়েছি তোমার মুগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখে। এই ক্যাসেটটি আমি অন্যভাবেও তোমার কাছে ফেরত দিতে পারতাম, তাতে আমি আমার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম। আজ তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে, যাওয়ার সময় তোমাকে আমি একটা সারপ্রাইজ দেব।
-স্যার, আমি সারপ্রাইজড।
-যাও এবার। ভালো থেকো।
আমি মুগ্ধতার স্মৃতি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। এরপর বেশ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয় না।
No comments