বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৭৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবু মুসলিম, বীর প্রতীক সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথমার্ধে একদিন। রাতে আবু মুসলিমসহ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রওনা হন লক্ষ্যস্থলে। তাঁদের দলনেতা মাহবুব রব সাদী।
মেঘমুক্ত আকাশ। রাতের অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়। আবছা অন্ধকারে দূরের অনেক কিছু চোখে পড়ে। তাই সবাই সতর্ক। তাঁদের সঙ্গে আছেন একজন পথপ্রদর্শক। তিনি সবার আগে। তারপর দলনেতা। তাঁর পেছনে মুক্তিযোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যান।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বলতে দু-তিনটি এলএমজি, বাকি সব স্টেনগান। তাঁরা কানাইঘাট থানা আক্রমণ করবেন। মৌলভীবাজার জেলার একদম উত্তরে এর অবস্থান। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা থেকে একটি পাকা সড়ক কানাইঘাট পর্যন্ত গিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমানায় মিশেছে। থানায় তখন ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ আর কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সব মিলে ৪৫ থেকে ৫০ জন।
চা-বাগানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবু মুসলিমসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে পৌঁছান কানাইঘাটে। পাশেই সুরমা নদী। নদীতে পানিপ্রবাহের হালকা কুলকুল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চারদিক সুনসান। ছোট্ট শহরের সবাই, এমনকি থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরাও ঘুমিয়ে। কেবল দু-তিনজন পুলিশ সদস্য পাহারায়।
দলনেতা সিদ্ধান্ত নেন যারা পাহারায় নিযুক্ত, প্রথমে তাদের বন্দী ও নিরস্ত্র করার। তিনি নিজেই একজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে সেটি করতে যান। তখনই ঘটে বিপত্তি। সেটা আরেক কাহিনি। পাহারারত এক পুলিশ হঠাৎ গুলি ছোড়ে। এর শব্দে পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরা ঘুম থেকে জেগে গোলাগুলি শুরু করে।
আবু মুসলিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা দলনেতার সংকেত বা নির্দেশের অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। নিমেষে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। তাঁদের আক্রমণে প্রথমেই নিহত হয় পাহারারত দুই পুলিশ সদস্য। এরপর আবু মুসলিম ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা গুলি করতে করতে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়েন থানার ভেতরে। তাঁদের আক্রমণে হতাহত হয় কয়েকজন পুলিশ।
আবু মুসলিম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সাহস ও রণমূর্তি দেখে পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা প্রতিরোধ দূরে থাক, দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে থানার পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফের তিন সদস্যকে আটক করেন। পরে জীবিত অবস্থায় তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।
আবু মুসলিম ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষে ভারতে যান। মে মাসে আসামের গোয়াহাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরে, পরে ২ নম্বর সেক্টরে। ২ নম্বর সেক্টরে তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত কানাইঘাট থানা আক্রমণে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু মুসলিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫১।
আবু মুসলিম স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার (ডাক গাঙ্গেরহাট) জারেরা গ্রামে। বর্তমানে এই ঠিকানাতেই অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর বাবার নাম তালেব আলী সরদার। মা পেশকারের নেছা। স্ত্রী ফরিদা বেগম। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: আবু মুসলিম বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ ও ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বলতে দু-তিনটি এলএমজি, বাকি সব স্টেনগান। তাঁরা কানাইঘাট থানা আক্রমণ করবেন। মৌলভীবাজার জেলার একদম উত্তরে এর অবস্থান। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা থেকে একটি পাকা সড়ক কানাইঘাট পর্যন্ত গিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমানায় মিশেছে। থানায় তখন ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ আর কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সব মিলে ৪৫ থেকে ৫০ জন।
চা-বাগানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবু মুসলিমসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে পৌঁছান কানাইঘাটে। পাশেই সুরমা নদী। নদীতে পানিপ্রবাহের হালকা কুলকুল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চারদিক সুনসান। ছোট্ট শহরের সবাই, এমনকি থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরাও ঘুমিয়ে। কেবল দু-তিনজন পুলিশ সদস্য পাহারায়।
দলনেতা সিদ্ধান্ত নেন যারা পাহারায় নিযুক্ত, প্রথমে তাদের বন্দী ও নিরস্ত্র করার। তিনি নিজেই একজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে সেটি করতে যান। তখনই ঘটে বিপত্তি। সেটা আরেক কাহিনি। পাহারারত এক পুলিশ হঠাৎ গুলি ছোড়ে। এর শব্দে পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরা ঘুম থেকে জেগে গোলাগুলি শুরু করে।
আবু মুসলিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা দলনেতার সংকেত বা নির্দেশের অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। নিমেষে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। তাঁদের আক্রমণে প্রথমেই নিহত হয় পাহারারত দুই পুলিশ সদস্য। এরপর আবু মুসলিম ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা গুলি করতে করতে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়েন থানার ভেতরে। তাঁদের আক্রমণে হতাহত হয় কয়েকজন পুলিশ।
আবু মুসলিম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সাহস ও রণমূর্তি দেখে পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও পুলিশ সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা প্রতিরোধ দূরে থাক, দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে থানার পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফের তিন সদস্যকে আটক করেন। পরে জীবিত অবস্থায় তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।
আবু মুসলিম ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষে ভারতে যান। মে মাসে আসামের গোয়াহাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরে, পরে ২ নম্বর সেক্টরে। ২ নম্বর সেক্টরে তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত কানাইঘাট থানা আক্রমণে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু মুসলিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫১।
আবু মুসলিম স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার (ডাক গাঙ্গেরহাট) জারেরা গ্রামে। বর্তমানে এই ঠিকানাতেই অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর বাবার নাম তালেব আলী সরদার। মা পেশকারের নেছা। স্ত্রী ফরিদা বেগম। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: আবু মুসলিম বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ ও ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments