স্মরণ-একটু দাঁড়া, আসছি আমি... by তাবাস্সুম জসীম
আবিদ, মুত্তাকিন ও আশিকের প্রথম মৃত্যুদিবস ২৯ জুলাই। ওই দিন তাঁরা কক্সবাজারে সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’য় কাজ করতেন তাঁরা। দিনটি স্মরণে মাত্রা নিয়েছে নানা কর্মসূচি। ‘কক্সবাজার সিবিচ কমিটি’কে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সৌজন্যে তারা একটি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আজ শুক্রবার বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সটি হস্তান্তর করা হবে। ওঁদের স্মরণে লেখাটি ছাপা হলো:
আবিদ, তোর কত মজা, না? জন্মদিন আসবে, যাবে; কিন্তু তোর আর কখনো বয়স বাড়বে না। তুই বুড়া হবি না, তোর চুল পাকবে না, শরীর ভাঙবে না। বয়স বাড়লে তোকে কেমন দেখাবে—তা তো আমরা জানতেই পারব না। জন্মদিনে তোকে কী গিফট দেব, কোনো টেনশন ছিল না। সব টেনশন থেকে তুই রেহাই দিয়ে গেছিস সবাইকে! কে তোর কাছে এত শান্তি চেয়েছিল, বল তো?
হরহামেশাই তুই বলতি, ‘এমবিএ করেই অফিস জয়েন করলাম, আমি তো ছুটিই পেলাম না। প্রতিদিন অফিসে আসি, বাসায় গিয়ে খেয়ে ঘুমাই, আবার অফিস! একঘেয়ে লাগতেছে সব! আমার এক মাস ছুটি দরকার।’ তোর ছুটি কাটানো এখনো শেষ হয়নি? এক মাসকে তো এক বছর বানিয়ে ফেললি!
তোর সেই লাল স্যান্ডেল জোড়া আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। বারবার চাইছিলাম তোর কাছে। যখন তুই পানিতে নামতে গেলি স্যান্ডেল আমার কাছে রেখে, আমি তখন তোকে বলেছিলাম, ‘এবার তো আর তুই স্যান্ডেল ফেরত পাবি না। এগুলো এখন আমার।’ তোর শেষ কথাটা, ‘যা, তুই নে গা, যা’ এখনো কানে বাজে! চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করে তোকে দেখতেও পাই, কিন্তু চোখ খুললেই আর দেখি না! কেন? তুই কি এতই বেশি দূরে?
আমি জানি, অফিসটাকে তুই কত ভালোবাসিস; আরেফিন স্যারকে তুই কত ভালোবাসিস। তোর সেই এসএমএস ‘তুই তো জানিস, হোয়াট আই ফিল ফর মাত্রা, হোয়াট আই ফিল ফর আরেফিন স্যার,’ তারই তো সাক্ষী। তোর কথামতো আমি স্যারকে বলেছিলাম, আসলে তুই যা বলতে চেয়েছিস, সেটা ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারিসনি। স্যার বুঝেছিলেন, কিন্তু উনি কী বলেছিলেন, সেটা তো তুই জেনে গেলি না! মার্কেটে যাওয়ার সময়, রাতে খেতে বসে, ভোরে সমুদ্রসৈকতে, সকালে নাশতার টেবিলে—বারবার তোর কথা বলছিলেন স্যার। উনিও যে তোকে কত বেশি ভালোবাসেন, সেটা আমি তোকে জানাতে পারলাম না!
যখন আমি, রীতু আপু আর আরেফিন স্যার সৈকত থেকে হাসপাতালে যাচ্ছি, তখনো আমি ভাবছি—পানি থেকে ওদের তুলে আনা হয়েছে, আর তো কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ডাক্তার পানি বের করে দেবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন রীতু আপুকে কেউ একজন ফোন করে জানাল, ডাক্তার মুত্তাকিনকে মৃত বলে দিয়েছেন। আবিদকে ভেতরে নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তখন আমার জ্ঞান ফিরল! এতক্ষণ যেন আমি অজ্ঞান ছিলাম!
চলচ্চিত্র নির্মাণ করা শিখতে চেয়েছিলি। আলম স্যারের কাছে বলেছিলি, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাস, কাজ করতে চাস। উনিও চলে গেলেন কিছুদিন আগে। তুই যাওয়ার কিছুদিন পর তারেক মাসুদ চলে গেছেন। এখন তো তুই ছবি বানানো শিখতে পারিস ওনাদের কাছ থেকে। এখন তো আর অফিসের রুটিন জীবনটা নেই, তোর হাতে নিশ্চয়ই অফুরন্ত সময়। কী করিস সারা দিন? ঘুম থেকে ওঠারও তো কোনো তাড়া নেই। কোনো এক সকালে তোর এসএমএস ‘আমার ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয় না’, শান্তিমতো এখন ঘুমাতে পারিস তো?
যে কারও কাছ থেকে আদর বা ভালোবাসা আদায় করার তোর যে অস্বাভাবিক চমৎকার দক্ষতা, তার প্রভাব থেকে আমার মাও মুক্ত না। তাই তো তোর জন্মদিনে তোর জন্য নিজে শখ করে তোর প্রিয় সেই দুধের মিষ্টি বানিয়ে দিয়েছিল, ‘ঐধঢ়ঢ়ু ইরৎঃযফধু ঞড় অনরফ’ লিখে আমাকে বারবার বলেছিল—একটা প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে তোকে যেন সারপ্রাইজ দিই। করেছিলামও তাই। আর সারপ্রাইজড হয়ে তোর সেই যে লজ্জা পাওয়া হাসি, সেটা কী করে ভুলব? তারপর তোর সেই থ্যাংক ইউ এসএমএস, ‘আমি ভীষণ সারপ্রাইজড। ইট ইজ দ্য বেস্ট গিফট টু মি ফর দিস বার্থডে। আন্টিকে অনেক থ্যাংকস যে, উনি এত কষ্ট করেছেন। আর তুই যে এত কষ্ট করেছিস আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, সে জন্য তোকে কিছুই বলতে পারছি না। একটু কেঁদে দেখালে ভালো হতো...থ্যাংকস ফর মেকিং মাই ডে।’ এত বেশি জায়গাজুড়ে তুই, এত এত স্মৃতি তোর সঙ্গে, সেগুলো কি কোনো দিনও, কোনোমতেও ভুলে যাওয়া সম্ভব? একান্ত যদি আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট না হয়? না রে, কখনোই সম্ভব না, কক্ষনো না।
এক বছর হয়ে গেল, তোকে দেখি না! তোকে শেষ দেখেছি এক বছর আগে ঠিকই, আবার তোকে যত দিন পরে দেখব, সেখান থেকে এক বছর সময় কিন্তু শেষ হয়ে গেল। জীবন-মরণের এই খেলায় আমরা সবাই তোর পথেরই যাত্রী। সবাই একদিন এসেছিলাম, একদিন চলেও যাব! তাই—
‘একটু দাঁড়া, আসছি আমি,
না হয় হচ্ছে একটু দেরি।’
তাবাস্সুম জসীম
আবিদের সহকর্মী
আবিদ, তোর কত মজা, না? জন্মদিন আসবে, যাবে; কিন্তু তোর আর কখনো বয়স বাড়বে না। তুই বুড়া হবি না, তোর চুল পাকবে না, শরীর ভাঙবে না। বয়স বাড়লে তোকে কেমন দেখাবে—তা তো আমরা জানতেই পারব না। জন্মদিনে তোকে কী গিফট দেব, কোনো টেনশন ছিল না। সব টেনশন থেকে তুই রেহাই দিয়ে গেছিস সবাইকে! কে তোর কাছে এত শান্তি চেয়েছিল, বল তো?
হরহামেশাই তুই বলতি, ‘এমবিএ করেই অফিস জয়েন করলাম, আমি তো ছুটিই পেলাম না। প্রতিদিন অফিসে আসি, বাসায় গিয়ে খেয়ে ঘুমাই, আবার অফিস! একঘেয়ে লাগতেছে সব! আমার এক মাস ছুটি দরকার।’ তোর ছুটি কাটানো এখনো শেষ হয়নি? এক মাসকে তো এক বছর বানিয়ে ফেললি!
তোর সেই লাল স্যান্ডেল জোড়া আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। বারবার চাইছিলাম তোর কাছে। যখন তুই পানিতে নামতে গেলি স্যান্ডেল আমার কাছে রেখে, আমি তখন তোকে বলেছিলাম, ‘এবার তো আর তুই স্যান্ডেল ফেরত পাবি না। এগুলো এখন আমার।’ তোর শেষ কথাটা, ‘যা, তুই নে গা, যা’ এখনো কানে বাজে! চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করে তোকে দেখতেও পাই, কিন্তু চোখ খুললেই আর দেখি না! কেন? তুই কি এতই বেশি দূরে?
আমি জানি, অফিসটাকে তুই কত ভালোবাসিস; আরেফিন স্যারকে তুই কত ভালোবাসিস। তোর সেই এসএমএস ‘তুই তো জানিস, হোয়াট আই ফিল ফর মাত্রা, হোয়াট আই ফিল ফর আরেফিন স্যার,’ তারই তো সাক্ষী। তোর কথামতো আমি স্যারকে বলেছিলাম, আসলে তুই যা বলতে চেয়েছিস, সেটা ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারিসনি। স্যার বুঝেছিলেন, কিন্তু উনি কী বলেছিলেন, সেটা তো তুই জেনে গেলি না! মার্কেটে যাওয়ার সময়, রাতে খেতে বসে, ভোরে সমুদ্রসৈকতে, সকালে নাশতার টেবিলে—বারবার তোর কথা বলছিলেন স্যার। উনিও যে তোকে কত বেশি ভালোবাসেন, সেটা আমি তোকে জানাতে পারলাম না!
যখন আমি, রীতু আপু আর আরেফিন স্যার সৈকত থেকে হাসপাতালে যাচ্ছি, তখনো আমি ভাবছি—পানি থেকে ওদের তুলে আনা হয়েছে, আর তো কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ডাক্তার পানি বের করে দেবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন রীতু আপুকে কেউ একজন ফোন করে জানাল, ডাক্তার মুত্তাকিনকে মৃত বলে দিয়েছেন। আবিদকে ভেতরে নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তখন আমার জ্ঞান ফিরল! এতক্ষণ যেন আমি অজ্ঞান ছিলাম!
চলচ্চিত্র নির্মাণ করা শিখতে চেয়েছিলি। আলম স্যারের কাছে বলেছিলি, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাস, কাজ করতে চাস। উনিও চলে গেলেন কিছুদিন আগে। তুই যাওয়ার কিছুদিন পর তারেক মাসুদ চলে গেছেন। এখন তো তুই ছবি বানানো শিখতে পারিস ওনাদের কাছ থেকে। এখন তো আর অফিসের রুটিন জীবনটা নেই, তোর হাতে নিশ্চয়ই অফুরন্ত সময়। কী করিস সারা দিন? ঘুম থেকে ওঠারও তো কোনো তাড়া নেই। কোনো এক সকালে তোর এসএমএস ‘আমার ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয় না’, শান্তিমতো এখন ঘুমাতে পারিস তো?
যে কারও কাছ থেকে আদর বা ভালোবাসা আদায় করার তোর যে অস্বাভাবিক চমৎকার দক্ষতা, তার প্রভাব থেকে আমার মাও মুক্ত না। তাই তো তোর জন্মদিনে তোর জন্য নিজে শখ করে তোর প্রিয় সেই দুধের মিষ্টি বানিয়ে দিয়েছিল, ‘ঐধঢ়ঢ়ু ইরৎঃযফধু ঞড় অনরফ’ লিখে আমাকে বারবার বলেছিল—একটা প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে তোকে যেন সারপ্রাইজ দিই। করেছিলামও তাই। আর সারপ্রাইজড হয়ে তোর সেই যে লজ্জা পাওয়া হাসি, সেটা কী করে ভুলব? তারপর তোর সেই থ্যাংক ইউ এসএমএস, ‘আমি ভীষণ সারপ্রাইজড। ইট ইজ দ্য বেস্ট গিফট টু মি ফর দিস বার্থডে। আন্টিকে অনেক থ্যাংকস যে, উনি এত কষ্ট করেছেন। আর তুই যে এত কষ্ট করেছিস আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, সে জন্য তোকে কিছুই বলতে পারছি না। একটু কেঁদে দেখালে ভালো হতো...থ্যাংকস ফর মেকিং মাই ডে।’ এত বেশি জায়গাজুড়ে তুই, এত এত স্মৃতি তোর সঙ্গে, সেগুলো কি কোনো দিনও, কোনোমতেও ভুলে যাওয়া সম্ভব? একান্ত যদি আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট না হয়? না রে, কখনোই সম্ভব না, কক্ষনো না।
এক বছর হয়ে গেল, তোকে দেখি না! তোকে শেষ দেখেছি এক বছর আগে ঠিকই, আবার তোকে যত দিন পরে দেখব, সেখান থেকে এক বছর সময় কিন্তু শেষ হয়ে গেল। জীবন-মরণের এই খেলায় আমরা সবাই তোর পথেরই যাত্রী। সবাই একদিন এসেছিলাম, একদিন চলেও যাব! তাই—
‘একটু দাঁড়া, আসছি আমি,
না হয় হচ্ছে একটু দেরি।’
তাবাস্সুম জসীম
আবিদের সহকর্মী
No comments