স্মরণ-প্রিয় হাবিবুর রহমান স্যার by ড. তুলসী কুমার দাস

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য প্রফেসর হাবিবুর রহমানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ছয়টি বছর কেটে গেল। এখনো মনে হয়, তিনি বোধ হয় আমাদের মধ্যেই আছেন। সেই তেজোদীপ্ত, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান, হার না-মানা মানুষটি কত কিছু যে বদলে দিয়েছেন এবং আরো কত কিছু যে বদলাতে চেয়েছিলেন- তা হয়তো


আমাদের অনেকেরই আজ আর স্মরণ নেই। দৃঢ়চেতা, সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছোটখাটো সেই মানুষটির বুকের মধ্যে ছিল চাপা আগুন। সে জন্যই তিনি যা বলতেন, তা তিনি করতেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে দীর্ঘ ২৬ বছর শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের পুরোটা সময়ই আমি তাঁকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তিনি অসম্ভব রকম জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ক্লাসে তাঁর বক্তৃতা ছিল চুম্বকের মতো আকর্ষণকারী। আমি যখন ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি, তখন তিনি ওই বিভাগেরই বিভাগীয় প্রধান। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথমদিকে এই ভেবে মনের মধ্যে অনেক আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে সহকর্মী হিসেবে স্যারের সঙ্গে আমি আদৌ কাজ করতে সক্ষম হব কি না। কিছুদিনের মধ্যেই সহকর্মী হাবিবুর রহমান স্যারকে আমরা আবিষ্কার করলাম একজন বন্ধু হিসেবে। সহানুভূতিশীল ও স্নেহপরায়ণ হাবিবুর রহমান স্যার অতি দ্রুত নিজ পরিবারের সদস্যদের মতো আমাদের আপন করে নিলেন। তাঁর একটিই চাওয়া আমাদের কাছে। একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিভাগকে একটি আধুনিক ও মানসম্মত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাঁর অনুপ্রেরণায় ও তদারকিতে আমরাও পূর্ণোদ্যমে কাজে নেমে গেলাম। শুরু হলো নিরলস পরিশ্রম। লক্ষ্য একটাই- স্যারের নেতৃত্বে তাঁরই স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজে হাত দিলেন। একই সঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহযোগিতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার সিস্টেম ও গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করলেন। কিছুদিনের মধ্যে অপটিক ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করলেন। এ ক্ষেত্রেও মুহম্মদ জাফর ইকবাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্রমশ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু দুটি ঘটনা তার দুর্দান্ত গতিকে শ্লথ করে দিল। ছাত্রলীগের ১৭ জন শিক্ষার্থীকে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলো। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেকে এ ঘটনার জন্য উপাচার্যের ওপর নাখোশ হলেন। উপাচার্যকে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার অনুরোধ করলেন। উপাচার্য হাবিবুর রহমান সিন্ডিকেটের নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে একবিন্দু বিচ্যুত হলেন না। আরেকটি ঘটনা সে সময় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবনকে দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী-দার্শনিক ও খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের নামে নামকরণ করা হবে। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা শুরু করে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাও ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য উপাচার্য হাবিবুর রহমানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সেদিন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং তাঁর পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নামকরণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা তৈরি হলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আচার্যের ক্ষমতাবলে নামকরণের সিদ্ধান্তটি স্থগিত করেন। তবে সরকারপ্রধান প্রফেসর হাবিবুর রহমানের সাহসিকতা, দৃঢ়তা এবং আপসহীনতায় মুগ্ধ হন। তাঁকে পূর্ণ মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হয়।
উপাচার্য হিসেবে চার বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে বীরদর্পে প্রফেসর হাবিবুর রহমান ফিরে আসেন তাঁর অতি প্রিয় সমাজকর্ম বিভাগে। পূর্ণোদ্যমে আবারও শুরু করেন অধ্যাপনা। ২০০২ সালে এই মহান শিক্ষক শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। যোগদান করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও তাঁকে দেওয়া হয় উপাচার্যের দায়িত্ব। উপাচার্য থাকা অবস্থায় মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নেয় আমাদের কাছ থেকে। এমন উপাচার্য, এমন শিক্ষক আমরা আর কবে পাব?
ড. তুলসী কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.