পদ্মা সেতু প্রকল্প-সরকার কী চায়? by পার্থ সারথি দাস

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বারবার সরকারের মধ্যকার নানা অস্থিরতাই প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বয়ের অভাব, প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতার অনুপস্থিতি- সর্বোপরি অদূরদর্শিতার কারণেই এই প্রকল্প সরকারের সাড়ে তিন বছরের মাথায়ও অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে।


বরং বড় মাপের এই প্রকল্পটিকে অনেকে সরকারের জন্য 'ক্ষত' হিসেবেই দেখছে।
জানা গেছে, মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের এই বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো সমন্বয় নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সময় দেশীয় অর্থায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন, দেখা গেছে ওই সময় অর্থমন্ত্রী আবার বিশ্বব্যাংকমুখী সুর তুলছেন। মন্ত্রিসভায় প্রকল্পটি মূলত দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আবার বিশ্বব্যাংকের কাছে এ নিয়ে পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে আর ধরনা নয়। অন্যদিকে মালয়েশিয়া সরকারের একটি প্রতিনিধিদল আগামী মাসের প্রথম দিকে প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যখন প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে নানাভাবে সরব, তখন প্রকল্প বাস্তবায়নের মুখ্য চরিত্রে থাকা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে এই মুহূর্তে খুব একটা কথা বলতে চাইছেন না। প্রায় এক মাস ধরে তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে কথা বলছেন না বললেই চলে। অথচ মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় প্রতিদিনই এ ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ও উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী এখন পদ্মা সেতু নিয়ে প্রশ্ন করলেই সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এদিকে প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান যেন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অথচ প্রকল্পে স্বচ্ছতা রক্ষার জন্য ২০০৯ সালে তাঁকে ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার পদে বসিয়েছিল সরকার।
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে সরকারের সাড়ে তিন বছরে কথা হয়েছে বেশি। একজন স্পোকসম্যান (মুখপাত্র) থাকলে ভালো হতো। কিন্তু এখানে যার দায়িত্ব নেই সে-ও কথা বলেছে। বেশি কথার জন্যই প্রকল্পের এই অবস্থা। সরকারের কর্মকৌশল ঠিক থাকলে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াত না। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং আবার তাদের কাছেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা চাইতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি।
যোগাযোগমন্ত্রী কেন নীরব : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে কখন কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রী কিছু জানতে পারছেন না। গত ২৪ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একাধিক সদস্য এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সভায় জানানো হয়, প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, গওহর রিজভীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়; কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রীকে জানানো হয় না। ওই সভায় উপস্থিত কমিটির এক সদস্য গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে সরকারের অবস্থান বারবার বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে কেন- এ নিয়েও সেদিন প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য গোলাম মাওলা রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিটির সভায় দেশীয় অর্থায়ন বাদ দিয়ে আবার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের দিকে ঝুঁকে যাওয়া, প্রকল্পের কাজে সমন্বয় না থাকা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রাতে মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে সমন্বয়হীনতার যে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি বলে কমিটির সভাপতি বলেছেন। আমি এ বিষয়ে এতটুকুই বলতে পারি।' এ ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বর্তমানে তাঁর নীরবতার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, 'এই সেতু নির্মাণে দিন-ক্ষণ ঠিক না হলে আমি কোনো কথা বলব না।'
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, সরকার এই প্রকল্প নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত সরকার মেনে নিয়েছে সত্য; কিন্তু তত দিনে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে, সময়েরও অপচয় হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে- তা এখনো নিশ্চিত নয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়েছে। তা না হলে আগামী নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে কমিটির সদস্যরা বারবার বলে আসছেন। গত ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায়ও এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল।
বিব্রত সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা : প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ জোগাড় করতে সরকার একেক সময় একেক দিকে ঝুঁকছে। এই অবস্থায় প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এ নিয়ে বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সেতু বিভাগ রয়েছে বিব্রতকর অবস্থায়। জানা গেছে, সেতু বিভাগ এরই মধ্যে চলতি বছর চার হাজার কোটি টাকা, পরের দুই বছর পাঁচ হাজার ও চতুর্থ বছর আট হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় এ অর্থের ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, 'মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পর সে অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু করেছি।'
মন্ত্রিসভায় মূলত দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কাজেই সেতু বিভাগ সে লক্ষ্য সামনে রেখে এগোচ্ছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, 'এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগই বলতে পারে। আমি বলতে পারব না।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অনেক পদস্থ কর্মকর্তা অবশ্য এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছেন। এ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আরাস্ত খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে কথা বলছি না।'
সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য : পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে তা প্রকাশ পাচ্ছে বারবার। অনেক ঘটনার ঘনঘটা শেষে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবকে। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়াকে হটিয়ে দিয়ে আবার সামনে চলে এসেছে বিশ্বব্যাংক। ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বিশ্বব্যাংককে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলা হলেও অর্থমন্ত্রী আবার গতকাল সে কথা অস্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীকে চিঠি পাঠানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ ধরনের কোনো চিঠি পাঠায়নি।
এর আগে গত ১০ জুলাই পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের কাছে আর ধরনা দেওয়া হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেও অর্থমন্ত্রী ওই দিনই বলেন, বিশ্বব্যাংককে অর্থায়নের বিষয়ে অনুরোধ করা হবে না- এটি ঠিক নয়। ওই দিন সন্ধ্যায় সচিবালয়ে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, 'আমরা এটির (ঋণচুক্তি) পুনর্বিবেচনা চাই। তবে কোন সময়ে চাই, সেটা হলো বিষয়। আপাতত বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করা হবে না, আমরা টেস্ট করে দেখতে চাই।'
অথচ একই দিন সকালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নিজেরাই পদ্মা সেতু করব। কোনো ডোনার (দাতা) আসলে ভালো, আর কারো কাছে ধরনা দেব না।'
সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নিয়ে যখন প্রকল্পে তাদের অর্থায়নই বড় করে দেখা হচ্ছে, তখনো প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরকার সরে আসেনি বলে জানিয়েছেন। গত বুধবার তিনি বলেছেন, 'নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হচ্ছে। আমাদের যে উদ্যোগ, তাতে ভাটা পড়েনি।' এদিন লন্ডনে হোটেল সেন্ট প্যানক্রসে স্থানীয় বাংলা প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইফতারের পর তিনি এ কথা বলেন। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পাল্টে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করলে সেটা তারা 'নিজেদের বিবেচনায়' করবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী গত ২২ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চারটি বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছে, যার প্রথমটি হলো বিশ্বব্যাংককে ফেরানো এবং সর্বশেষ পথ নিজস্ব অর্থায়ন।
সারচার্জের উদ্যোগে ভাটা পড়বে : গত ৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানত অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে অর্থ জোগাড়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সারচার্জ গ্রহণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের জন্য এরশাদ সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশ বলে সারচার্জ আদায়ের মাধ্যমে ৫০৮ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল। যমুনা নদীর ওপর ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন হওয়া বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে যেভাবে সারচার্জ নেওয়া হয়েছিল সেভাবেই পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের বিশ্বব্যাংক ঘরানার আমলারা বাদ সাধছেন বলে জানা গেছে।
গত বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নাসির আহমেদ বলেছেন, সারচার্জ কিভাবে নেওয়া হতে পারে তার জন্য ৩১ জুলাই বৈঠক ডাকা হয়েছে। গতকাল অর্থমন্ত্রী অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, চলতি বছরই সারচার্জ নেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার দেওয়ার চুক্তি করে।

No comments

Powered by Blogger.