কবি গুলগেলাশের ‘পদ্ম্য’ ভাবনা by মাশুদুল হক

কবি গুলগেলাশ ঠাকুর একখান গামছা পরিধান করে বসে ছিলেন। প্রচণ্ড গরম, তার ওপর লোডশেডিং—তাই এই দশা বুঝতে পারলাম। আমি কাছে যেতেই গামছাখানা গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে বললেন—
ধুম করিয়া প্রবেশ করো ক্যান? অ্যাটলিস্ট গলাখাঁকারি তো দিবা!


বুঝলাম, স্বল্পবসনে কবি কিছুটা বিব্রত।
কবি কদিন ধরে এমনিতেই আমার ওপর যারপরনাই বিরক্ত, এত দিন তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করা সত্ত্বেও একটা কবিতা ডেলিভারি দিতে পারলাম না।
‘বাহির হইছে কিছু?’ কবি সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন, কোনো ভূমিকা কিংবা কুশলাদি জিজ্ঞাসা ছাড়াই।
আমি বললাম, ‘গুরু, কবিতা আমারে দিয়া হবে না। অ্যান্টেনায় ধরা পড়ে না।’
কবি মনে হলো কথাটা শুনতে পান নাই। উদাস ভঙ্গিতে নিজ কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এক কাজ করো, আপাতত ছড়া লিখিয়া মাঠে অবতরণ করো, কবিতা ধীরে ধীরে আসিবে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘শিশুকালে ছড়া পড়তাম, কীভাবে লিখতে হয় সেইটা তো...!’
কবি ভুরু কুঁচকে বললেন, ছন্দ মিলাইতে পারিলেই ছড়া হয়। মিলাও দেখি—
যখন লাগে গরম...
তারপরের লাইন কী হবে?
আমি কবির দিকে তাকিয়ে বললাম, তখন লাগে শরম!
তারপর?
আমি নিরুত্তর রইলাম। মাথায় আর কোনো ছন্দ আসছে না।
কবি বিরক্ত হলেন, মিলাইলেই তো হইবে না, কার্যকারণ লাগবে, শরম ক্যান লাগে, সেইটা ব্যাখ্যা করিতে হইবে।
খানিক পরে কবি হঠাৎ বললেন, দেশের খবর-টবর কীহে?
আমি স্বভাবতই ভিরমি খেলাম। গুলগেলাশ ঠাকুর দেশের খবর জিজ্ঞাসা করার লোক না। তার মানে নতুন কিছু ঘটছে।
পদ্মা লইয়া কী এক ঝামেলা হইছে শুনিলাম।
আমি বিস্ময় চেপে জবাব দিলাম, পদ্মা সেতু আরেকটু হইলেই হইয়া যাবে।
আমি অবশ্য নিশ্চিত ছিলাম না পদ্মা সেতুর ব্যাপারে এদ্দিনকার ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছু কবির জানা আছে কি না। ভরদুপুরে পূর্ণ পূর্ণিমাস্নাত জ্যোৎস্না নিয়া যাদের কবিতা লিখতে হয় তাদের এত খবর রাখা উচিত না। কবি সে ঔচিত্য বজায় রেখে আসছেন।
কবি বলিলেন, আবুলদ্বয় নতুন কিছু করিয়াছে?
করবার বাকি আর কী রাখছে, পত্রপত্রিকায় অর্ধেক পাতা জুড়িয়া চিঠি লিখল নিজের সাফাই গাইয়া, পদত্যাগ পর্যন্ত করছে বলে জানতে পারলাম, তার পরও ওই বিশ্বব্যাংক...
পদত্যাগ নয় বাছা, উহাকে বলে পদচ্যুত...কবি আমাকে থামালেন।
শাস্ত্রমতে ইহা যে হবে, তা তো অবশ্যম্ভাবী!
অবশ্যম্ভাবী? শাস্ত্রমতে? আমি না বলে পারলাম না।
নিশ্চয়ই, পদ্মা ভাঙিলে কী হয় সেইটা তোমরা খেয়াল করো না কেন, বুঝি না?
কী রকম?
পদ্মা হইল পদ আর দা, এইখানে ‘দা’-এর দুইটা অর্থ হইতে পারে।
আমি শিশুকালের ব্যাকরণ মনে করতে চাইলাম, বললাম, গুরু পদ্মা তো বোধ হইতেছে ‘পদ’-এর সঙ্গে একখানা ‘ম’ও আছে।
ওইটাই তো নির্দেশনা, তোমরা নির্বোধকুল তাহা বুঝিবে কীসে! আসলে ওই ম হইল মায়ার ম। পদ্মা তাহার মায়াজাল ছড়াইয়া বাঙালিরে বিব্রত রাখিবে উহাই স্বাভাবিক...
যা বলিতেছিলাম, পদের সঙ্গের ওই ‘দা’ দাদাগিরির দা, নয়তো কাটিবার দা। দুই দা-ই সমান তাৎপর্যমণ্ডিত। পদ নিয়া সে দাদাগিরি করিবে কিংবা ‘দা’-এর মতো কাটিয়া পদচ্যুত করবে, চেয়ার কাড়িয়া পদ্মাসনে বসিতে বাধ্য করিবে।
পদচ্যুত হইয়াছে তা নয় বুঝলাম, কিন্তু গুরু আপনি এইসব জাগতিক বস্তু নিয়া ভাবিতেছেন কেন, সেইটা মাথায় ঢুকল না। আমি কাতর হয়ে কবিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
প্রশ্নে কবিকে বিমর্ষ দেখায়, আর বলিও না, পাড়ার গুটিকতক বালক কী এক লিটল ম্যাগ বাহির করিবে, সেই উপলক্ষে একখানা পদ্য দিতে অনুরোধাইল। তো তাহাদের নিবেদন, পদ্যটা যাতে পদ্মা হয়। উহাই নাকি হট টপিক এখনকার।
এতক্ষণে রহস্য উন্মোচিত হলো।
কবি বললেন, তা স্টার্টিং টা শুনিয়া লও, বালকদিগকে তো খালি হাতে ফিরায়া দিতে পারি না, সঙ্গে কিছু চাঁদাও চাহিয়াছে বটে। তবে পদ্যখানাই যে মূলত ওদের প্রয়োজন, সেটা ব্যাকুল আচরণেই ঠাহর করতে পেরেছি।
আমি মনে মনে বলিলাম, উহাদের প্রয়োজন কী তাহা বুঝিতে আর বাকি নাই।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম—তবে শুনান, আইসা পড়ছি যেহেতু কিছু শুনতে তো হবেই
কবি তৎক্ষণাৎ পাঠ করলেন—
তিলোত্তমা পদ্ম্য
তুমি ইহা কী করিলে সদ্য
তোমার মীনক্ষোভাকুল কুবলয় স্নাত আমিষগন্ধা জলে
জলকেলি করিতে ব্যাকুল,
হউক না সে আবুল, অবিমৃষ্যকারী বটে
তোমারই সন্তানসম, থাকুক যাহাই ঘটে
লিখিয়াছে পত্র খোলা, দৌড়াইছে মেলা
ক্ষান্ত দেও তাহারে,
আহা রে!
আমিও যোগ করলাম, আহা রে!
বুঝিলে, বালকদিগের কথা চিন্তা করিয়া মিল দিয়া দিছি, মিত্রাক্ষর। এইটা আত্মস্থ করিয়া নিয়ো। মিল সম্পর্কে ধারণা পাইবে, কার্যকারণ খুঁজিয়া পাইবে।
উঠতে যাব এমন সময় বুঝলাম, মিল সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়েছে কবিতা শ্রবণে, হঠাৎ আমার মাথায় খানিকপূর্বে চেষ্টাকৃত ছড়ার কার্যকারণ খেলে গেল।
আমি কবিকে বললাম, দেখেন তো গুরু ক্যামন হইছে—
‘যখন লাগে গরম
তখন লাগে শরম
কারণ—
তখন আমার কাপড় পরা বারণ!’
কবি গুলগেলাশ, পরনের গামছাখানা ভালোমতো পেঁচাইয়া বললেন—
এই বেলা আসো, বিস্তারিত আলোচনা পরে হইবে। আর কার্যকারণের বেলায় খালি পরিবেশ থেকে উপাত্ত নিলেই হইবে না, মনে রাখিবা—কাব্যরচনায় চোখ মুদিয়া যাহা দেখিবা, উহাই বাস্তব, ফ্যাক্ট। চোখ খুলিলেই মিথ্যা জগৎ।
এই বলিয়া কবি চোখ বুজলেন, আমিও ‘তথাস্তু’ বলিয়া মিথ্যা জগতের পথে পা বাড়াইলাম।
মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল—
ক্ষান্ত দেয় তাহারে
আহা রে!

No comments

Powered by Blogger.