সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা দুর্নীতি ও ভোগান্তির কারণ- নতুন গ্যাস-সংযোগে বিভ্রাট

নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়ায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আগ্রহী হলেও জ্বালানি উপদেষ্টা নারাজ এবং জ্বালানিমন্ত্রী নির্বিকার। অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির বিবিধ মত সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে। এদিকে সরকারিভাবে সংযোগ বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়া চলছে।


সরকারের এই সিদ্ধান্তহীনতায় সংযোগ-দুর্নীতি, গ্যাসের বিলে দুর্নীতি এবং আবাসিক গ্রাহকদের ভোগান্তি উভয়ই বেড়েছে। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান যুক্তিযুক্ত ও জনবান্ধব হওয়া চাই।
জ্বালানি খাতের প্রধান সমস্যা গ্যাসের ঘাটতি এবং অপরিণামদর্শিতা উভয়ই। এ খাতের নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অদূরদর্শিতার কারণে সংকট কাটছে না। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষিত হয়। ঠিক এক বছর পর আবাসিক খাতেও নতুন সংযোগ বন্ধ করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, গ্যাসের উৎপাদন ২২০ কোটি ঘনফুটে না ওঠা পর্যন্ত এ ব্যবস্থা চলবে। সে সূত্রেই রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস ও খনিজ করপোরেশন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর সম্প্রতি রাজধানীর একটি কর্মশালায় সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাসের উৎপাদন ২২০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছানোয় নতুন সংযোগ দেওয়ায় তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত। ওই সভায়ই প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, চাহিদার তুলনায় এখনো ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকায় নতুন সংযোগ হবে না। তিনি আবাসিক খাতের চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্পোৎপাদনে গ্যাস-সংযোগে অগ্রাধিকার দেন। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান দৈনিক উৎপাদন ২২৪ কোটি ঘনফুট। এ ছাড়া শ্রীকাইলে নতুন একটি গ্যাসকূপ খনন করা হয়েছে, সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রেও খনন শুরু হওয়ার পথে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, আবাসিক খাতে নতুন সংযোগের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ১০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই পরিমাণ গ্যাসের জোগান দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ঘাটতি যত না বড়, তার চেয়ে ভোগান্তি ও দুর্নীতির মাত্রাটাই বরং বেশি। সম্প্রতি তিতাস গ্যাসের নামে ৪৫০ কোটি টাকা কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাবে জমা পড়লেও বিলদাতারা অজ্ঞাত। সুতরাং, অবৈধ বা গোপন সংযোগে গ্যাস ঠিকই যাচ্ছে, কিন্তু বিল অপরিশোধিত অথবা অচিহ্নিত রয়ে যাচ্ছে। আবার গ্যাস না পেয়ে বৈদ্যুতিক চুল্লি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ বাড়াচ্ছেন অনেকে।
জ্বালানি উপদেষ্টা বিদ্যুতের জন্য গ্যাস বাঁচাতে চাইলেও চোরাই পথে গ্যাস আর চুল্লিপথে ঠিকই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এ জন্যই প্রবাদে বলে, সামনে দিয়ে সুঁই আটকায়, কিন্তু আড়ালে হাতি পাচার হয়ে যায়। গ্যাস খাতে নৈরাজ্যের আরেক নজির হলো এলপি গ্যাস। সিলিন্ডারে সরবরাহ করা এই গ্যাসের দাম যেমন অনেক বেশি, এর বাজার ও সরবরাহের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে অসাধু সিন্ডিকেট। সুতরাং, গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রেখে কার্যত গ্যাস বা বিদ্যুৎ কোনোটারই সাশ্রয় হচ্ছে না, কিন্তু ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষত, বস্তি ও নিম্নবিত্তের পরিবারগুলোর জ্বালানি খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় তাদের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে।
গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত যখন ফলপ্রসূ হচ্ছে না, তখন সিদ্ধান্তটি তুলে নেওয়াই ভালো। আরও ভালো হলো, সমস্যার গোড়া তথা গ্যাস উৎপাদনে গতি আনা এবং বণ্টন ও বিলিং-ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করা। গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে সমন্বয়ও জরুরি। আরও জরুরি হলো, এ খাতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যুক্তিযুক্ত মতৈক্য। বোধোদয় যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.