শেকড়ের ডাক-উপকূলের জনজীবন ও আমাদের উন্নয়ন ভাবনা by ফরহাদ মাহমুদ

২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছিল। তছনছ করে দেয় উপকূলীয় জনজীবন। মারা গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষ, আহত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি। ২০০৯ সালে আঘাত হেনেছিল আইলা নামের আরেক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস।


সুন্দরবনের কারণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও উপকূলীয় জনজীবন এখনো তার ধ্বংসের স্বাক্ষর বহন করে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অনেক জায়গায় বাঁধের চিহ্নও ছিল না। সিডরেও অনুরূপভাবে ভোলা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত এলাকার বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এসব বেড়িবাঁধ এখনো সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। তার ওপর কেবল এ বছরই উপকূলীয় বেড়িবাঁধের দুই ডজনেরও বেশি জায়গা ভেঙে গেছে। জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়েছে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ। কোথাও কোথাও কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত এই ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এসব ভাঙন দিয়ে অবাধে ঢুকছে জোয়ারের পানি। ফসলি জমি তো বটেই, বাড়িঘরেও ঢুকে যাচ্ছে পানি। এসব এলাকায় লবণাক্ততা এত বেশি বেড়ে গেছে যে তিন ফসলি জমি সব এক ফসলি হয়ে গেছে। ফলে এলাকার দরিদ্র কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণীর লোকজন বাঁচার তাগিদে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। সিডর ও আইলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত উপকূলীয় জীবনযাত্রা পারবে কি আরেকটি জলোচ্ছ্বাসের ধকল সামলাতে? অথচ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। সাগর ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে উঠছে। বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৭০১ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছিল মাত্র দুই সেন্টিমিটার। ১৮০১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বেড়েছিল ছয় সেন্টিমিটার। আর ১৯০১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে কমপক্ষে দেড় মিটার বা ১৫০ সেন্টিমিটার। অথচ আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৬ শতাংশ মানুষই বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। এই ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতা বাড়তে কত দিন লাগবে? সাধারণ পাটিগণিতের হিসাবে মাত্র ছয় বছর। কিন্তু না, এই বৃদ্ধি শেষদিকে যতটা দ্রুত হবে, প্রথমদিকে ততটা দ্রুত হবে না। সেদিক থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতা বাড়তে ২০ বছরের মতো লাগতে পারে। তখন এই ৪৬ শতাংশ মানুষের ভাগ্যে কী ঘটবে? এর মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে হয়তো তারা অনেক দ্রুত ও কম কষ্টে ঢাকায় এসে পৌঁছতে পারবে।
শুধু কি তা-ই? সাগরের উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে গেলে সারা দেশে বন্যার প্রকোপ এখনকার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নেমে আসবে অনেক ধরনের বিপর্যয়। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কলেরা-ডায়রিয়ার প্রকোপ। উপকূলের যেসব মানুষ আশ্রয়হীন হবে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে স্থানান্তরিত হবে। ফলে কমে যাবে কৃষিজমির পরিমাণ। কমে যাবে খাদ্য উৎপাদনও। কিন্তু মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। উপকূলীয় এলাকার সম্ভাব্য এই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য আমাদের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও উন্নয়নপ্রক্রিয়া যথাযথভাবে এগোচ্ছে কি? এক কথায় জবাব, না।
১৯৯২ সালে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রফেসর আইনুন নিশাতসহ আরো অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই এই কমিটিতে ছিলেন। তাঁরা দীর্ঘ সময় নিয়ে উপকূলীয় এলাকা ঘুরে নানা ধরনের সমীক্ষা পরিচালনা করেন এবং একটি দীর্ঘ সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেন। এসব সুপারিশের মধ্যে ছিল বেড়িবাঁধের উচ্চতা বাড়ানো এবং তা কোথায় কেমন হবে, উপকূলীয় এলাকায় কত দূরে দূরে ও কী ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, গবাদিপশু ও সম্পদ রক্ষার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এ পর্যন্ত সেসব সুপারিশের খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। অনেক জায়গায় অতীতে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান আমলে নির্মিত বেড়িবাঁধ অনেকাংশেই তার উপযোগিতা হারিয়েছে। তদুপরি সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন সময়ের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সেই বেড়িবাঁধ কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। ফলে উপকূলীয় জনজীবন আগের চেয়ে অনেক বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
আমরা ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছি। হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করে ইতিমধ্যে আমরা জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করেছি। মুন্সীগঞ্জ এলাকার মানুষ এমন প্রতিবাদী না হলে হয়তো এত দিনে আমরা নতুন বিমানবন্দরের জন্যও জায়গাজমি অধিগ্রহণের কাজটি সম্পন্ন করতাম। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু খুবই প্রয়োজনীয়- তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু উপকূলের এক কোটিরও বেশি অতি দরিদ্র মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাটাও কম প্রয়োজনীয় নয়। তাহলে গত ২০ বছরেও কেন আমরা বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হইনি বা হচ্ছি না? কেন সেখানে বাস্তবে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কমছে? কেন বেড়িবাঁধ উঁচু করার কাজে কোনো সরকারই হাত দিচ্ছে না? সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ কেন সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি? কেন ক্রমেই বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে? উপকূলীয় জনজীবনের এই দুর্দশার প্রতি আমাদের পরিকল্পনাবিদদের দৃষ্টি কেন পড়ে না? কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এ বছরও অনেক বিপর্যয় মোকাবিলা করেছে। পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাটের মতো উপকূলীয় শহরগুলো ঝুঁকির মুখে এসে পড়েছে। চট্টগ্রামও ক্রমে চলে আসছে ঝুঁকির মধ্যে। অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতার উদাসীনতার কারণে আসন্ন মহাবিপর্যয়ও বন্ধ থাকবে না।
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর লক্ষ্যে অসফল আলোচনা চলছেই। এ ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি আশা করা নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় বহন করে। কাজেই সমুদ্রপৃষ্ঠের যে উচ্চতা বাড়ছে, তাও রোধ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন আমাদের একমাত্র করণীয় হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নানা কৌশল উদ্ভাবন ও সেগুলো প্রয়োগ করা। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। নোনা পানির থাবা থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা। অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নোনা পানি সহনশীল কৃষিপদ্ধতি উদ্ভাবন করা। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত ধ্যানধারণা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং তাদের এই গবেষণায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। তদুপরি কোন কাজটা আগে এবং কোন কাজটা পরে করলেও চলবে, সেই হিসাবটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সম্পন্ন করতে হবে। ফেরিব্যবস্থা উন্নত করে আমরা কি আরো এক-দুই দশক পদ্মা সেতুর প্রয়োজন মেটাতে পারতাম না? কিন্তু এ বছর বা আগামী বছর আরেকটি ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হলে যে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে, তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করাটা কি আমাদের জন্য আগে করণীয় ছিল না? উপকূলীয় জনজীবন রক্ষায় আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। অন্যথায় আমরা কেবল এক মহাবিপর্যয়ের পথেই এগিয়ে যেতে থাকব।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.