এবারে ঈদ বাজারে লেনদেন ॥ ৩৫ হাজার কোটি টাকা এদের বাজেটের হিসাব কি কেউ রাখে?-০ ধনীদের বাজেট প্রতিজনে ২০ লাখ -০ আড়াই কোটি সামর্থ্যবানের স্বতঃস্ফূর্ত কেনাকাটা ০ সাধ ও সাধ্যের টানাপোড়েনে ৯ কোটি মানুষ- ০ ঈদ পণ্যের মূল্য বেড়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ by শাহ্ আলম খান
ঈদকেন্দ্রিক ধনীদের অস্বাভাবিক আর মধ্যবিত্তের বাড়তি ব্যয়ের জুড়ি নেই। আবার ঘরে টানাপোড়েন থাকলেও সাধ আর সাধ্যের লড়াইয়ের ঈদ কেনাকাটায় পিছিয়ে নেই নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষও। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন ঈদ কেনাকাটায় শামিল হতে।
এতদসত্ত্বে¡ও দেশের প্রায় ৯ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের এ উৎসবের কেনাকাটায় যোগ দেয়ার সামর্থ্য নেই। যদিও বাধ্য হয়েই এদের অনেকে ধারকর্জ করে হলেও শেষ পর্যন্ত ঈদ কেনাকাটায় যোগ দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন।
জানা গেছে, দেশে ১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ধনীর সংখ্যা মাত্র ৪১ লাখ। ঈদবাজারে মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশই ব্যয় হয় এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কেনাকাটায়। এর বাইরে ঈদ কেনাকাটায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় আরও ২ কোটি ১৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৭০ লাখ উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ১ কোটি ৪৬ লাখ মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এই হিসাবে ধনী শ্রেণীর মানুষ মিলে মূলত সারাদেশে ২ কোটি ৫৭ লাখ লোক ঈদ কেনাকাটার মহাসমারোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যোগ দেয়। অপরদিকে ১২ কোটি ৪৩ লাখ দরিদ্র্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে ৯ কোটি ৮৯ লাখই হচ্ছে দরিদ্র। দারিদ্র্যের কারণে এরা দুর্মূল্যের ঈদের বাজারে প্রবেশ করতে পারেন না। যদিও কেউ কেউ বাধ্য হয়েই ঈদ কেনাকাটায় যোগ দেন। তবে এ কেনাকাটা মূলত পরিবারের সদস্যদের মন রক্ষার জন্য। আর ২ কোটি ৫৪ লাখ নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ এই রোজায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে বাধ্য হয়েই কেনাকাটা করেন।
ওদিকে ব্যবসায়ীদের থোক হিসাব অনুযায়ী এবার ঈদ লেনদেন শেষ পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারাদেশে ঈদকেন্দ্রিক প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। গত বছর ঈদ বাজারে সব মিলে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন এই লেনদেন শেষ পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সারাদেশে ছোটবড় মিলিয়ে স্থায়ী ২০ লাখ ও ফুটপাথের আড়াই লাখেরও বেশি দোকান এবং কয়েক লাখ মৌসুমী স্টলে এবারের ঈদ কেনাকাটায় এ পরিমাণ লেনদেন হবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সূত্র মতে, দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহ ঠা-াভাব থাকায় মানুষের ব্যবসাবাণিজ্যে গতি ফিরেছে। তাই জমে উঠেছে ঈদ শপিং। বিগত কয়েক বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থাকার কারণে ঈদ শপিংয়ে সেভাবে জোয়ার দেখা যায়নি। এ বছর প্রত্যেক মার্কেটে ক্রেতার ঢল পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও ঈদ মার্কেটে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন।
ঈদ মার্কেটে বেচাকেনার ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ আমির হোসেন খান জানান, সারাদেশের দোকানগুলোতে এবারের ঈদে ২২-২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হবে। এছাড়া স্থায়ী দোকানের বাইরে ফুটপাথ ও মৌসুমী দোকানসহ অন্যান্য খাতে আরও প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে আমির হোসেন খান বলেন, পোশাকের দাম দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে গতবারের তুলনায় কিছুটা বেশি। তাঁর মতে, এ বছর সামগ্রিক লেনদেনের অঙ্ক যেটুকু বাড়বে সেটি মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণেই বাড়বে।
প্রতিবছরই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য গতিশীল হয়ে ওঠে। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এ ধর্মীয় উৎসবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি পরিবারেই থাকে বাড়তি আয়োজন। ফলে এ সময় খরচের পরিমাণও অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, প্রতিটি পরিবারে বছরের অন্য সময় এক মাসে যে ব্যয় হয় রোজার মাসে ঈদকে ঘিরে ব্যয় হয় তার চেয়ে তিনগুণ। তবে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ মনে করেন, ঈদবাজারে পারিবারিক ব্যয়ের পরিমাণ অন্য যে কোন মাসের দ্বিগুণ।
ঈদের আগে দেশের প্রতিটি বিপণিবিতানে ক্রেতাদের প্রচ- ভিড় থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটা। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে সারাবছরে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হয়, ঈদের আগের ১৫ দিনে বিক্রি হয় তার চেয়েও বেশি, এমনকি শুধু ঈদ কেন্দ্র করেই টিকে আছে অনেক শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, সারাদেশে ২০ লাখ স্থায়ী দোকানের অর্ধেকই ঈদের কেনাকাটার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাকিগুলোতেও ঈদ মৌসুমের প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর ফুটপাথের আড়াই লাখ দোকানেও ঈদের আগে জমজমাট কেনাকাটা চলে। এছাড়া শুধু ঈদ কেন্দ্র করে পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠে উপহার সামগ্রী, পোশাক ও খাদ্যদ্রব্যের মৌসুমী স্টল। এছাড়া ঈদ ঘিরে পরিবহন খাতে সৃষ্টি হয় বিরাট প্রাণচাঞ্চল্য। ঈদ সামনে রেখে জমে ওঠে ঈদকার্ড, অডিও-ভিডিও এবং সিনেমার ব্যবসা। অন্যান্য বিনোদনেও ব্যয় হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ।
এদিকে ঈদ বাজারের এই বিশাল লেনদেনযজ্ঞে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সর্বশেষ হালনাগাদ (২০১১) গবেষণা মতে, দেশে ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১২ কোটি ৪৩ লাখ লোকই হচ্ছে দরিদ্র্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এর মধ্যে ২ কোটি ৫৪ লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এরা তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঈদ কেনাকাটায় শামিল হয়। তবে এই গোষ্ঠীর পিরামিডের নিচে থাকা ৯ কোটি ৮৯ লাখ দরিদ্র শ্রেণীর অধিকাংশেরই সামর্থ্য না থাকায় ঈদ কেনাকাটার বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পারে না। এরপরও যারা ঈদ কেনাকাটায় অংশ নেয় তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত। এদের সবারই মূলত লক্ষ্য থাকে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে হাইভলিউম এবং লো-কস্ট পারচেজের কেনাকাটার।
অপরদিকে দেশে ধনী শ্রেণীর সংখ্যা ৪১ লাখ। ঈদ বাজারে মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশই ব্যয় হয় এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কেনাকাটায়। এর বাইরে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্তের এই তিন শ্রেণীর মোট ২ কোটি ১৬ লাখ লোকই মূলত ঈদ কেনাকাটায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে।
তবে ড. আবুল বারকাতের ২০০৫ সালে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ওই সময় দেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে ৯ কোটি ১০ লাখই দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত। দারিদ্র্যের কারণে এরা ঈদের বাজারে যেতে পারে না। বাকি ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ধনী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ। বাকিরা উচ্চমধ্যবিত্ত এবং মধ্যমধ্যবিত্ত। এই তিন শ্রেণীর মানুষই মূলত ঈদবাজারে যায়।
জানা গেছে, ঈদকে কেন্দ্র করে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে। কোন কোন পরিবারের ব্যয় এর চেয়েও বেশি। অন্যদিকে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা। মধ্য মধ্যবিত্তের ঈদ বাজেট সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা ধরা হয়। আর নিম্নমধ্যবিত্তের ব্যয় ১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ঈদবাজারের মোট লেনদেনের ৬০ শতাংশই ৬০ লাখ ধনী মানুষ ব্যয় করে বলে অর্থনীতিবিদরা অভিমত দিয়েছেন। সেই হিসাবে সব খাত মিলিয়ে এদের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ঈদ সবার জন্য আনন্দের হলেও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এটি বাড়তি চাপ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশের মতে, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো খুবই অসম। অধিকাংশ মানুষই সঞ্চয়হীন এবং দিন আনে দিন খায় অবস্থায় দিন যাপন করছে। এ কারণে নিচের দিকে যে ৫০ শতাংশ পরিবার রয়েছে ঈদের অতিরিক্ত খরচ তাদের জন্য বাড়তি চাপ। পরিবারের সবার চাহিদা মেটানোর আকাক্সক্ষা থাকলেও সামর্থ্য নেই তাদের। এ কারণে এক অর্থে ঈদ তাদের জন্য খুশি নয়, এক ধরনের ভয়। মূলত মধ্যবিত্ত ও ধনীদের বাড়তি ব্যয়ের কারণেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে ঈদবাজার।
ঈদ কেন্দ্র করে বাজারে দেশী-বিদেশী পণ্যের বিপুল সমাহার ঘটলেও উচ্চবিত্তদের অনেকেই ঈদের বাজার করেন দেশের বাইরে গিয়ে। রোজার মাসের শুরু থেকেই এরা সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সফরে যান। মূলত আভিজাত্য বজায় রাখতেই এরা বিদেশের বাজার থেকে হাল-ফ্যাশনের পোশাক ও অন্যান্য বিলাসসামগ্রী নিয়ে আসেন। এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণও প্রায় হাজার কোটি টাকা বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদবাজারের মোট লেনদেনের সিংহভাগই যায় বস্ত্র ও পোশাক খাতে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য, জুয়েলারি, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র, বিনোদন ও প্রকাশনা খাত। এসব খাতই ঈদবাজারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এছাড়া এগুলোর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য খাতও ঈদের আগে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এমন অনেক শিল্প খাত রয়েছে, যেগুলো শুধু ঈদ মৌসুমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে টিকে আছে। সারাবছর ঝিমিয়ে থাকলেও ঈদের আগে চাঙ্গা হয়ে ওঠে পাঞ্জাবি-টুপিসহ কিছু পোশাকের ব্যবসা।
রাজধানীর সদরঘাটের শরিফ মার্কেটের কয়েকটি পাঞ্জাবির কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান সারাবছর যে ব্যবসা করে তার ৮০ শতাংশই হয় ঈদের সময়। অনেক কারখানা শুধু ঈদবাজারের বাকি-বকেয়া আদায় করেই সারাবছর টিকে থাকে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এছাড়া সেমাই, টুপি, ঈদকার্ড, আতরসহ কিছু শিল্প ও ব্যবসার সিংহভাগই ঈদ কেন্দ্র করে টিকে থাকে।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঈদ কেন্দ্র করেই টিকে থাকে। ক্রেতার অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের অন্যান্য সময় উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ শতাংশও কাজে লাগাতে পারে না। ঈদবাজারে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সেসব প্রতিষ্ঠান মোট ক্ষমতার শতভাগ উৎপাদন করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে যে হারে উৎপাদনশীলতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সে হারে বাড়ছে না। বাজারে পণ্যের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও তার অধিকাংশই আসছে বিদেশ থেকে। আর সরবরাহ যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে বেশি বাড়ে দাম। আর বাড়তি এ দামের চাপে ‘স্যান্ডউইচ’ হচ্ছে সামর্থ্যহীন মানুষ।
এদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা সঙ্কটে এবার ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত পরিবারের সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর। এই সময়ে বেসরকারী খাত দ্রুত এগিয়েছে। দেশে শিল্পায়ন প্রসারিত হয়েছে। ৭০ ডলারের মাথাপিছু আয় ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে। এই সময়ে রফতানিতে সর্বোচ্চ উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন সূচকগুলোরও উন্নতি ঘটেছে। অর্থাৎ সর্বত্র উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জোয়ার বইছে। তবে ভাগ্য ফেরেনি দরিদ্রের। ‘দেশে সব উচ্চতর প্রবৃদ্ধিগুলো বড়লোককে আরও বড়লোক করে তুলছে। কিন্তু তা গরিবের কোন উপকারে আসছে না, বরং গরিবের ঘামে শিল্পপতিরা আরও সম্পদশালী হচ্ছে। এতে করে সম্পদের বিরাট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও। শিল্পপতিদের এতে কোন কষ্ট না হলেও হাপিত্যেশ বাড়ছে গরিবের। নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে মানুষ। কিন্তু নীরব নাগরিকের নিভৃত কান্না কেউ শুনতে পায় না। দারিদ্র্যেরও অবসান হয় না।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, গত অর্ধ দশকে দেশের দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বেড়েছে। ফলে অনেক পরিবারেরই ঈদের বাড়তি খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই। পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য অনেকেই ধারকর্জ করছে, না হয় কোন আয়োজনই করছে না।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, প্রতিবছরই ঈদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে এর প্রতিক্রিয়া অব্যাহতভাবে বহন করতে হয়। বস্তুত, অর্থনৈতিক বৈষম্যই ঈদের আনন্দকে অনেকখানি ম্লান করে দিচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে ১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ধনীর সংখ্যা মাত্র ৪১ লাখ। ঈদবাজারে মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশই ব্যয় হয় এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কেনাকাটায়। এর বাইরে ঈদ কেনাকাটায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় আরও ২ কোটি ১৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৭০ লাখ উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ১ কোটি ৪৬ লাখ মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এই হিসাবে ধনী শ্রেণীর মানুষ মিলে মূলত সারাদেশে ২ কোটি ৫৭ লাখ লোক ঈদ কেনাকাটার মহাসমারোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যোগ দেয়। অপরদিকে ১২ কোটি ৪৩ লাখ দরিদ্র্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে ৯ কোটি ৮৯ লাখই হচ্ছে দরিদ্র। দারিদ্র্যের কারণে এরা দুর্মূল্যের ঈদের বাজারে প্রবেশ করতে পারেন না। যদিও কেউ কেউ বাধ্য হয়েই ঈদ কেনাকাটায় যোগ দেন। তবে এ কেনাকাটা মূলত পরিবারের সদস্যদের মন রক্ষার জন্য। আর ২ কোটি ৫৪ লাখ নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ এই রোজায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে বাধ্য হয়েই কেনাকাটা করেন।
ওদিকে ব্যবসায়ীদের থোক হিসাব অনুযায়ী এবার ঈদ লেনদেন শেষ পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারাদেশে ঈদকেন্দ্রিক প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। গত বছর ঈদ বাজারে সব মিলে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন এই লেনদেন শেষ পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সারাদেশে ছোটবড় মিলিয়ে স্থায়ী ২০ লাখ ও ফুটপাথের আড়াই লাখেরও বেশি দোকান এবং কয়েক লাখ মৌসুমী স্টলে এবারের ঈদ কেনাকাটায় এ পরিমাণ লেনদেন হবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সূত্র মতে, দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহ ঠা-াভাব থাকায় মানুষের ব্যবসাবাণিজ্যে গতি ফিরেছে। তাই জমে উঠেছে ঈদ শপিং। বিগত কয়েক বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থাকার কারণে ঈদ শপিংয়ে সেভাবে জোয়ার দেখা যায়নি। এ বছর প্রত্যেক মার্কেটে ক্রেতার ঢল পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও ঈদ মার্কেটে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন।
ঈদ মার্কেটে বেচাকেনার ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ আমির হোসেন খান জানান, সারাদেশের দোকানগুলোতে এবারের ঈদে ২২-২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হবে। এছাড়া স্থায়ী দোকানের বাইরে ফুটপাথ ও মৌসুমী দোকানসহ অন্যান্য খাতে আরও প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে আমির হোসেন খান বলেন, পোশাকের দাম দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে গতবারের তুলনায় কিছুটা বেশি। তাঁর মতে, এ বছর সামগ্রিক লেনদেনের অঙ্ক যেটুকু বাড়বে সেটি মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণেই বাড়বে।
প্রতিবছরই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য গতিশীল হয়ে ওঠে। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এ ধর্মীয় উৎসবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি পরিবারেই থাকে বাড়তি আয়োজন। ফলে এ সময় খরচের পরিমাণও অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, প্রতিটি পরিবারে বছরের অন্য সময় এক মাসে যে ব্যয় হয় রোজার মাসে ঈদকে ঘিরে ব্যয় হয় তার চেয়ে তিনগুণ। তবে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ মনে করেন, ঈদবাজারে পারিবারিক ব্যয়ের পরিমাণ অন্য যে কোন মাসের দ্বিগুণ।
ঈদের আগে দেশের প্রতিটি বিপণিবিতানে ক্রেতাদের প্রচ- ভিড় থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটা। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে সারাবছরে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হয়, ঈদের আগের ১৫ দিনে বিক্রি হয় তার চেয়েও বেশি, এমনকি শুধু ঈদ কেন্দ্র করেই টিকে আছে অনেক শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, সারাদেশে ২০ লাখ স্থায়ী দোকানের অর্ধেকই ঈদের কেনাকাটার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাকিগুলোতেও ঈদ মৌসুমের প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর ফুটপাথের আড়াই লাখ দোকানেও ঈদের আগে জমজমাট কেনাকাটা চলে। এছাড়া শুধু ঈদ কেন্দ্র করে পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠে উপহার সামগ্রী, পোশাক ও খাদ্যদ্রব্যের মৌসুমী স্টল। এছাড়া ঈদ ঘিরে পরিবহন খাতে সৃষ্টি হয় বিরাট প্রাণচাঞ্চল্য। ঈদ সামনে রেখে জমে ওঠে ঈদকার্ড, অডিও-ভিডিও এবং সিনেমার ব্যবসা। অন্যান্য বিনোদনেও ব্যয় হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ।
এদিকে ঈদ বাজারের এই বিশাল লেনদেনযজ্ঞে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সর্বশেষ হালনাগাদ (২০১১) গবেষণা মতে, দেশে ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১২ কোটি ৪৩ লাখ লোকই হচ্ছে দরিদ্র্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এর মধ্যে ২ কোটি ৫৪ লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এরা তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঈদ কেনাকাটায় শামিল হয়। তবে এই গোষ্ঠীর পিরামিডের নিচে থাকা ৯ কোটি ৮৯ লাখ দরিদ্র শ্রেণীর অধিকাংশেরই সামর্থ্য না থাকায় ঈদ কেনাকাটার বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পারে না। এরপরও যারা ঈদ কেনাকাটায় অংশ নেয় তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত। এদের সবারই মূলত লক্ষ্য থাকে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে হাইভলিউম এবং লো-কস্ট পারচেজের কেনাকাটার।
অপরদিকে দেশে ধনী শ্রেণীর সংখ্যা ৪১ লাখ। ঈদ বাজারে মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশই ব্যয় হয় এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কেনাকাটায়। এর বাইরে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্তের এই তিন শ্রেণীর মোট ২ কোটি ১৬ লাখ লোকই মূলত ঈদ কেনাকাটায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে।
তবে ড. আবুল বারকাতের ২০০৫ সালে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ওই সময় দেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে ৯ কোটি ১০ লাখই দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত। দারিদ্র্যের কারণে এরা ঈদের বাজারে যেতে পারে না। বাকি ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ধনী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ। বাকিরা উচ্চমধ্যবিত্ত এবং মধ্যমধ্যবিত্ত। এই তিন শ্রেণীর মানুষই মূলত ঈদবাজারে যায়।
জানা গেছে, ঈদকে কেন্দ্র করে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে। কোন কোন পরিবারের ব্যয় এর চেয়েও বেশি। অন্যদিকে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা। মধ্য মধ্যবিত্তের ঈদ বাজেট সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা ধরা হয়। আর নিম্নমধ্যবিত্তের ব্যয় ১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ঈদবাজারের মোট লেনদেনের ৬০ শতাংশই ৬০ লাখ ধনী মানুষ ব্যয় করে বলে অর্থনীতিবিদরা অভিমত দিয়েছেন। সেই হিসাবে সব খাত মিলিয়ে এদের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ঈদ সবার জন্য আনন্দের হলেও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এটি বাড়তি চাপ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশের মতে, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো খুবই অসম। অধিকাংশ মানুষই সঞ্চয়হীন এবং দিন আনে দিন খায় অবস্থায় দিন যাপন করছে। এ কারণে নিচের দিকে যে ৫০ শতাংশ পরিবার রয়েছে ঈদের অতিরিক্ত খরচ তাদের জন্য বাড়তি চাপ। পরিবারের সবার চাহিদা মেটানোর আকাক্সক্ষা থাকলেও সামর্থ্য নেই তাদের। এ কারণে এক অর্থে ঈদ তাদের জন্য খুশি নয়, এক ধরনের ভয়। মূলত মধ্যবিত্ত ও ধনীদের বাড়তি ব্যয়ের কারণেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে ঈদবাজার।
ঈদ কেন্দ্র করে বাজারে দেশী-বিদেশী পণ্যের বিপুল সমাহার ঘটলেও উচ্চবিত্তদের অনেকেই ঈদের বাজার করেন দেশের বাইরে গিয়ে। রোজার মাসের শুরু থেকেই এরা সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সফরে যান। মূলত আভিজাত্য বজায় রাখতেই এরা বিদেশের বাজার থেকে হাল-ফ্যাশনের পোশাক ও অন্যান্য বিলাসসামগ্রী নিয়ে আসেন। এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণও প্রায় হাজার কোটি টাকা বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদবাজারের মোট লেনদেনের সিংহভাগই যায় বস্ত্র ও পোশাক খাতে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য, জুয়েলারি, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র, বিনোদন ও প্রকাশনা খাত। এসব খাতই ঈদবাজারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এছাড়া এগুলোর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য খাতও ঈদের আগে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এমন অনেক শিল্প খাত রয়েছে, যেগুলো শুধু ঈদ মৌসুমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে টিকে আছে। সারাবছর ঝিমিয়ে থাকলেও ঈদের আগে চাঙ্গা হয়ে ওঠে পাঞ্জাবি-টুপিসহ কিছু পোশাকের ব্যবসা।
রাজধানীর সদরঘাটের শরিফ মার্কেটের কয়েকটি পাঞ্জাবির কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান সারাবছর যে ব্যবসা করে তার ৮০ শতাংশই হয় ঈদের সময়। অনেক কারখানা শুধু ঈদবাজারের বাকি-বকেয়া আদায় করেই সারাবছর টিকে থাকে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এছাড়া সেমাই, টুপি, ঈদকার্ড, আতরসহ কিছু শিল্প ও ব্যবসার সিংহভাগই ঈদ কেন্দ্র করে টিকে থাকে।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঈদ কেন্দ্র করেই টিকে থাকে। ক্রেতার অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের অন্যান্য সময় উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ শতাংশও কাজে লাগাতে পারে না। ঈদবাজারে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সেসব প্রতিষ্ঠান মোট ক্ষমতার শতভাগ উৎপাদন করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে যে হারে উৎপাদনশীলতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সে হারে বাড়ছে না। বাজারে পণ্যের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও তার অধিকাংশই আসছে বিদেশ থেকে। আর সরবরাহ যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে বেশি বাড়ে দাম। আর বাড়তি এ দামের চাপে ‘স্যান্ডউইচ’ হচ্ছে সামর্থ্যহীন মানুষ।
এদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা সঙ্কটে এবার ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত পরিবারের সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর। এই সময়ে বেসরকারী খাত দ্রুত এগিয়েছে। দেশে শিল্পায়ন প্রসারিত হয়েছে। ৭০ ডলারের মাথাপিছু আয় ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে। এই সময়ে রফতানিতে সর্বোচ্চ উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন সূচকগুলোরও উন্নতি ঘটেছে। অর্থাৎ সর্বত্র উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জোয়ার বইছে। তবে ভাগ্য ফেরেনি দরিদ্রের। ‘দেশে সব উচ্চতর প্রবৃদ্ধিগুলো বড়লোককে আরও বড়লোক করে তুলছে। কিন্তু তা গরিবের কোন উপকারে আসছে না, বরং গরিবের ঘামে শিল্পপতিরা আরও সম্পদশালী হচ্ছে। এতে করে সম্পদের বিরাট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও। শিল্পপতিদের এতে কোন কষ্ট না হলেও হাপিত্যেশ বাড়ছে গরিবের। নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে মানুষ। কিন্তু নীরব নাগরিকের নিভৃত কান্না কেউ শুনতে পায় না। দারিদ্র্যেরও অবসান হয় না।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, গত অর্ধ দশকে দেশের দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বেড়েছে। ফলে অনেক পরিবারেরই ঈদের বাড়তি খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই। পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য অনেকেই ধারকর্জ করছে, না হয় কোন আয়োজনই করছে না।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, প্রতিবছরই ঈদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে এর প্রতিক্রিয়া অব্যাহতভাবে বহন করতে হয়। বস্তুত, অর্থনৈতিক বৈষম্যই ঈদের আনন্দকে অনেকখানি ম্লান করে দিচ্ছে।
No comments