ধর্ম- মাহে রমজানের অন্যতম অনুষঙ্গ ইতিকাফ by আবদুস সবুর খান
আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাধ্যমে আত্মোন্নয়নের মাস মাহে রমজান। খতমে তারাবিহ্র মতো ইতিকাফও মাহে রমজানের ইবাদতের আরেকটি অন্যতম অনুষঙ্গ। এ মাসে মোমিন বান্দারা যেমনি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বপ্রকার পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে রিবত থেকে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের প্রত্যাশা করেন, তেমনি গুনাহ্
মাফ ও অধিকতর সওয়াব লাভের প্রত্যাশায় এ মাসের শেষ ১০ দিন পার্থিব সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করে খোদার একান্ত সান্নিধ্য অন্বেষণ করেন।
ইতিকাফ বলা হয় পুরুষের ক্ষেত্রে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন কোনো মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করা। আর নারীদের ক্ষেত্রে, নিজ গৃহের নামাজ আদায়ের স্থানে অথবা নির্জন কোণে অবস্থান গ্রহণ করা। মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম এবং লেনদেন পরিত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করে সার্বক্ষণিক আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগি, তসবিহ-তাহলিল, তিলাওয়াত-জিকির ইত্যাদি কাজে নিমগ্ন থাকার নাম ইতিকাফ।
ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, রমজান মাসের শেষ ১০ দিন পার্থিব সব কাজকর্ম, লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে সার্বক্ষণিকভাবে মসজিদে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকার নিয়তে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ একটি মসজিদের সঙ্গে যত মুসল্লি নিয়মিতভাবে সংযুক্ত, তাঁদের মধ্য থেকে যেকোনো একজন ইতিকাফ আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। তবে কোনো একজনও যদি ইতিকাফ আদায় না করেন, সে জন্য ওই মুসল্লিদের সবাইকে সুন্নত ইবাদত ত্যাগের গুনাহ্র অংশীদার হতে হবে।
ইতিকাফকালে মুতাকিফ ব্যক্তির অপ্রয়োজনে মসজিদের বাইরে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয় নয়। শুধু প্রাকৃতিক কর্মাদি সম্পাদন ও ওজু-গোসল ছাড়া তাঁর বাইরে অবস্থান করা যাবে না। ইতিকাফকারী ব্যক্তি খাওয়াদাওয়া, ঘুম ইত্যাকার কাজ মসজিদের ভেতরই সম্পন্ন করবেন। ভালো, জনকল্যাণকর ও সওয়াব পাওয়া যায় এমন কথাবার্তার বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে কথাবার্তা বলা উচিত নয়। ইতিকাফকারী ব্যক্তি ইতিকাফকালীন স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গেও মেলামেশায় লিপ্ত হতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন, ‘যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা কোরো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৭)
সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো ফজিলতপূর্ণ মসজিদে গিয়ে, যেমন মক্কা শরিফ কিংবা মদিনা শরিফে গিয়ে ইতিকাফ করা উত্তম। মহিলারা ঘরের কোনো একটি কোণে কাপড় অথবা চাদর দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করে সেখানেই সার্বক্ষণিক অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। মহিলাদের ইতিকাফকালীন সাংসারিক কর্মকাণ্ড, পার্থিব কথাবার্তায় যত দূর সম্ভব কম অংশ নেওয়া উচিত।
ইতিকাফকারী ইতিকাফরত অবস্থায় জাগতিক কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত করে সার্বক্ষণিক ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছে দেন। তাই তাঁর ইতিকাফকালীন পুরো সময়টিই (ঘুমসহ) ইবাদতে অতিবাহিত হয়েছে বলে গণ্য হয়। রাসুল (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফে কাটাতেন। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর অভ্যাস ছিল তিনি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণীরাও সেই সুন্নত পালন করতেন। (বুখারি) ইতিকাফের গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন সওয়াবের প্রত্যাশায় ইবাদতের নিয়তে ইতিকাফ করল, সে যেন ওই দিনের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে গেল, যেদিন সে প্রথম পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’
হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) ইতিকাফকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ইতিকাফকারীরা পাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার জন্য তার আমলনামায় সম্ভাব্য সব রকমের নেক আমলের সওয়াব লিখে দেওয়া হয়।’ (ইবনে মাজা)
রোজাদার ব্যক্তি যেমন দিনভর পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার সাধনা করবেন, তেমনি তারাবিহ্, তাহাজ্জুদ, কিয়ামুল লাইল ও ইতিকাফের মতো বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে কৃত পাপ মোচন করে নিষ্পাপ আত্মার ইনসানে কামেল তথা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হওয়ার সাধনাও করবেন। এটিই মাহে রমজানের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে রোজাদার ব্যক্তির জন্য মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ উত্তম নিয়ামত। আমাদের যাঁদের রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে গিয়ে ইতিকাফ করার সুযোগ রয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। ব্যস্ততার কারণে যাঁদের ১০ দিন সময় বের করা কঠিন, তাঁরা শেষ তিন দিন অথবা অন্তত এক দিন ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককেই এই সৌভাগ্য নসিব করুন।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
ইতিকাফ বলা হয় পুরুষের ক্ষেত্রে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন কোনো মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করা। আর নারীদের ক্ষেত্রে, নিজ গৃহের নামাজ আদায়ের স্থানে অথবা নির্জন কোণে অবস্থান গ্রহণ করা। মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম এবং লেনদেন পরিত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করে সার্বক্ষণিক আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগি, তসবিহ-তাহলিল, তিলাওয়াত-জিকির ইত্যাদি কাজে নিমগ্ন থাকার নাম ইতিকাফ।
ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, রমজান মাসের শেষ ১০ দিন পার্থিব সব কাজকর্ম, লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে সার্বক্ষণিকভাবে মসজিদে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকার নিয়তে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ একটি মসজিদের সঙ্গে যত মুসল্লি নিয়মিতভাবে সংযুক্ত, তাঁদের মধ্য থেকে যেকোনো একজন ইতিকাফ আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। তবে কোনো একজনও যদি ইতিকাফ আদায় না করেন, সে জন্য ওই মুসল্লিদের সবাইকে সুন্নত ইবাদত ত্যাগের গুনাহ্র অংশীদার হতে হবে।
ইতিকাফকালে মুতাকিফ ব্যক্তির অপ্রয়োজনে মসজিদের বাইরে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয় নয়। শুধু প্রাকৃতিক কর্মাদি সম্পাদন ও ওজু-গোসল ছাড়া তাঁর বাইরে অবস্থান করা যাবে না। ইতিকাফকারী ব্যক্তি খাওয়াদাওয়া, ঘুম ইত্যাকার কাজ মসজিদের ভেতরই সম্পন্ন করবেন। ভালো, জনকল্যাণকর ও সওয়াব পাওয়া যায় এমন কথাবার্তার বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে কথাবার্তা বলা উচিত নয়। ইতিকাফকারী ব্যক্তি ইতিকাফকালীন স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গেও মেলামেশায় লিপ্ত হতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন, ‘যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা কোরো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৭)
সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো ফজিলতপূর্ণ মসজিদে গিয়ে, যেমন মক্কা শরিফ কিংবা মদিনা শরিফে গিয়ে ইতিকাফ করা উত্তম। মহিলারা ঘরের কোনো একটি কোণে কাপড় অথবা চাদর দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করে সেখানেই সার্বক্ষণিক অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। মহিলাদের ইতিকাফকালীন সাংসারিক কর্মকাণ্ড, পার্থিব কথাবার্তায় যত দূর সম্ভব কম অংশ নেওয়া উচিত।
ইতিকাফকারী ইতিকাফরত অবস্থায় জাগতিক কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত করে সার্বক্ষণিক ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছে দেন। তাই তাঁর ইতিকাফকালীন পুরো সময়টিই (ঘুমসহ) ইবাদতে অতিবাহিত হয়েছে বলে গণ্য হয়। রাসুল (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফে কাটাতেন। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর অভ্যাস ছিল তিনি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণীরাও সেই সুন্নত পালন করতেন। (বুখারি) ইতিকাফের গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন সওয়াবের প্রত্যাশায় ইবাদতের নিয়তে ইতিকাফ করল, সে যেন ওই দিনের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে গেল, যেদিন সে প্রথম পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’
হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) ইতিকাফকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ইতিকাফকারীরা পাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার জন্য তার আমলনামায় সম্ভাব্য সব রকমের নেক আমলের সওয়াব লিখে দেওয়া হয়।’ (ইবনে মাজা)
রোজাদার ব্যক্তি যেমন দিনভর পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার সাধনা করবেন, তেমনি তারাবিহ্, তাহাজ্জুদ, কিয়ামুল লাইল ও ইতিকাফের মতো বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে কৃত পাপ মোচন করে নিষ্পাপ আত্মার ইনসানে কামেল তথা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হওয়ার সাধনাও করবেন। এটিই মাহে রমজানের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে রোজাদার ব্যক্তির জন্য মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ উত্তম নিয়ামত। আমাদের যাঁদের রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে গিয়ে ইতিকাফ করার সুযোগ রয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। ব্যস্ততার কারণে যাঁদের ১০ দিন সময় বের করা কঠিন, তাঁরা শেষ তিন দিন অথবা অন্তত এক দিন ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককেই এই সৌভাগ্য নসিব করুন।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
No comments