চারদিক-বসন্তে ভালোবাসা by শারমিন নাহার

পড়ন্ত বিকেলে চারুকলার সামনে থেকে মেয়েটিকে একগোছা চুড়ি কিনে দেয় ছেলেটি। মেয়েটির পরনে হলুদ শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি। গালে হালকা মিষ্টি রোদ মেখে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এগিয়ে চলে ওরা। রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য, টিএসসি পেরিয়ে বইমেলার মূল ফটক, আর একটু পেরিয়ে বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢোকে ওরা।


অনুমতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করি ওদের সঙ্গে। ধরে নিই ওদের নাম অমিত আর লাবণ্য। ওরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়ছে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে। ফাল্গুনের দ্বিতীয় দিন ভালোবাসা দিবস, আর এই দিবস নিয়ে ওদেরই বা কী ভাবনা? উত্তরটা প্রথমে দেয় অমিত, ‘আসলে ভালোবাসা তো এক দিনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে আমাদের ভালোবাসাবাসির পর্ব শুরু হয়েছে, যা কখনো থামেনি। ভালো তো সারাদিনমানই বাসি।’
একটু লাজুক হেসে লাবণ্য বলল, ‘প্রতিদিনই আরও একটু নতুনভাবে ভালোবাসি।’
বসন্তের দ্বিতীয় দিন ভালোবাসা দিবস হওয়ায় দিনটি অনেক বেশি রঙিন মনে হয় এই যুগলের কাছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তার বলেন, ‘বসন্ত ঋতুতে ভালোবাসা দিবস হওয়ায় একটা সুবাসিত আবেশ টের পাওয়া যায়। ফাল্গুনের রং হলুদ আর ভালোবাসার রং লাল, তাই ভালোবাসা দিবসে লাল আর হলুদের ছড়াছড়ি বেশ ভালো লাগে।’
বিশেষ জনের জন্য কী কিনলেন?
উত্তরটা দেওয়ার সময় আবার হাসি, ‘যেহেতু বইমেলা চলছে, তাই ইচ্ছে বই কিনে দেব। সৈয়দ মুজতবা আলীর বই ওর পছন্দ, তাই এবার মুজতবা আলী সমগ্র কিনে দেব। বিশেষ দিনে কাছের মানুষকে খুশি দেখতে কার না ভালো লাগে!’
বইমেলা, ফাল্গুন মাস আর ভালোবাসা দিবস যেন একসঙ্গে মিলে একাকার হয়ে গেছে—এমনটা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শর্মিষ্ঠা পণ্ডিত। তিনি আরও বলেন, ‘বসন্ত ঋতু যেন তারুণ্যের ঋতু আর ভালোবাসা দিবস তো তরুণ প্রজন্মের জন্য উন্মাদনার বিষয়। আর এর সঙ্গে বইমেলা দিনগুলোকে যে কত বেশি বর্ণিল আর জমকালো করে তোলে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।’
উৎসবের ঢলটা মূলত বইমেলাকেন্দ্রিক। অনেকেই প্রিয়জনের জন্য বই কেনে। প্রশ্নটা এবার তার দিকে। আপনার প্রিয়জনের জন্য কী কিনলেন? ‘বইয়ের চেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে? কাছের মানুষ কাছে নেই। সে সুদূরে, তবুও কিনলাম কবিতার বই। হয়তো তাকে দেওয়া হবে না, তাতে কী? কিনেই ভালোলাগা।’ তবে কারো কাছে ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের লাইনের মতো ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।’
রবীন্দ্রনাথের পঙিক্তগুলো ভালো লাগলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বন্যা বললেন, ‘ভালোবাসা নিছক যাতনা বা বেদনা পাওয়ার জায়গা নয়। সুখের মাঝে এক চিলতে বেদনা তো থাকবেই।’
ভালোবাসা দিবস কি কেবল দুজনের মধ্যেই আবদ্ধ? উত্তরটা দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থী ইভা। ‘মোটেই তা নয়, ভালোবাসা দিবস হলো সব মানুষকে ভালোবাসার। ভালোবাসা দিবসে পরিবারের সবাইকে আরও বেশি করে ভালোবাসব। সঙ্গে ভালোবাসব পথশিশুদের, যারা সুবিধাবঞ্চিত, পায়নি একটু ভালোবাসা।’
ভালোবাসা দিবস বলি আমরা। আসলে প্রতিটি দিনই তো ভালোবাসার দিন। প্রতিটি নতুন ভোর আমাদের জানিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতে আমাদের এই যে ক্ষণিকের অবস্থান, তা ভরিয়ে দিতে হবে ভালোবাসায়।
এ কথা তো সবাই জানে, মানুষ পাগলের মতো ভালোবাসে, বোকার মতো নয়।
সে ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? ফাগুনের আগুন লেগেছে বনে বনে, সে কথা ঠিক। এই আগুন পোড়ায় না, ভালোবাসাকে আরও সংহত করে।
বসন্তকালের শুরুতে উড়ু উড়ু মন নিয়ে পথ চলেছে যারা, তারা সবাই বুঝতে পারছে, ঋতু-বৈচিত্র্যে এই সময়টি ভিন্নতর।
রোমের দ্বিতীয় সম্রাট ক্লডিয়াসের সময় যুবক-যুবতীদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, যোদ্ধাদের কোনো প্রকার পিছুটান থাকবে না। আর এই আইন অমান্য করে বিদ্রোহী যাজক ভ্যালেন্টাইন লুকিয়ে যুবক-যুবতীদের বিয়ে দিতেন। পরিণাম খুব ভালো ছিল না, ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় ভ্যালেন্টাইনকে। আর ফাঁসির দিনই ভ্যালেন্টাইন চিরকুট লেখেন তাঁর প্রেয়সী জেলারের মেয়ের উদ্দেশে। এর পর থেকে ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়।
এ তো গেল ইতিহাসের কথা। ভালোবাসার জন্য এ ধরনের ইতিহাসের পথ ধরে না হাঁটলেও কিছু আসে-যায় না। আমাদের বসন্তকালই বলে দিচ্ছে, এসব ভালোবাসাবাসির জন্য ইতিহাস লাগে না। আমরা ভালোবাসব, বাসতেই থাকব। আজ ভালোবাসব গতকালের চেয়ে একটু বেশি, আগামীকালের চেয়ে একটু কম।
বাংলা মাসের হিসাবে ফাল্গুনের দ্বিতীয় দিন ভালোবাসা দিবস হওয়ায় দিনটি হয় অনেক বেশি বর্ণিল। ফাল্গুনের প্রথম দিনের আমেজটা থাকে ভালোবাসা দিবস পর্যন্ত। ফাল্গুনের পাতাঝরা সময়ের মতো সব জীর্ণতা ঝরে যায়, আসে নতুন সময় নতুন করে শুরু করার। ফাল্গুনকে অনুভব করা যায় হূদয় দিয়ে। আর ভালোবাসার এই দিনে ছোট কোনো উপহার কিংবা একটা ফুল দিয়ে আরেকবার বলা যায়, ‘শোনো, তোমাকে বলি, প্রতিদিন তোমাকে আমি আরেকটু বেশি ভালোবাসি। আজ ভালোবাসি গতকালের চেয়ে একটু বেশি, আগামীকালের চেয়ে একটু কম।’
কিংবা রবীন্দ্রনাথের সেই লাইনগুলো আওড়ানো যায়—
‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।’

No comments

Powered by Blogger.