মিসর-গণতন্ত্রকামীদের যা করতে হবে by মোহাম্মদ এলবারাদি

আমি যখন যুবক ছিলাম, তখন কায়রোতে আমাদের রাজনৈতিক কথাবার্তা হতো ফিসফিসিয়ে। কথাবার্তা আসলে কমই হতো এবং হতো কেবল বিশ্বস্ত বন্ধুদের সঙ্গে। ভয় ও দমনের পরিবেশে আমরা বাস করতাম। যত দূর মনে পড়ে, দেখতে পাই, কীভাবে মিসরীয়রা টেবিলে খাবার জোগানোর জন্য, মাথার ওপরে ছাদ পাওয়ার জন্য, চিকিৎসা পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।


সেই জীবন আমাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, দারিদ্র্য আর স্বাধীনতাহীনতা কীভাবে মূল্যবোধ ধ্বংস করে এবং গুঁড়িয়ে দেয় আত্মসম্মান, আশা ও ইচ্ছাশক্তি।
মিসরের জনগণ যে তিমিরে ছিল, অর্ধশতাব্দী পরেও সেই তিমিরেই আছে। যে মিসর আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারের দেশ; গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র ও বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটানো সংস্কৃতির দেশ; সেই মিসর আজ অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। আমাদের জনগণের ৪০ শতাংশেরও বেশি মাত্র দুই ডলারেরও কমে দিনাতিপাত করে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর এবং মিসর ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত।
হোসনি মোবারকের ৩০ বছর মিসর দমনমূলক জরুরি আইনে শাসিত হয়েছে। এই আইন মিসরীয়দের মত প্রকাশ, সংগঠন করা ও জমায়েত হওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং বন্দী করেছে হাজার হাজার রাজনৈতিক অসন্তোষ প্রকাশকারীকে। অথচ কিনা এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনই মিসরের কিছু কিছু পশ্চিমা মিত্রের চোখে ‘স্থিতিশীলতার’ শর্ত। তারা কেবল মিসরের সম্পদই নেয়নি, মিসরকে বানিয়েছে তাদের বেআইনি নির্যাতনের বন্দিশিবির। বাস্তবে এসব আচরণ মানুষের মনে ক্রোধ পুঞ্জীভূত করেছে, সৃষ্টি করেছে এক ফুটন্ত বোমা। এসবের প্রতিক্রিয়ায় চরমপন্থাও দানা বেঁধেছে।
এসব কিছু সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে মিসরীয় সমাজের একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ইন্টারনেটের জানালা দিয়ে দেখে দেখে তরুণ মিসরীয়দের মনে এমন এক স্বাধীনতার চেতনার জন্ম হয়েছে, যে চেতনা তাদের পূর্ব প্রজন্মের মধ্যে ততটা জোরালো ছিল না। সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে তারা মতবিনিময় করে, যোগাযোগ করে। এভাবে বাস্তব দুনিয়ায় যোগাযোগ ও সমাবেশের বাধানিষেধ তারা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।
গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ব এই তারুণ্যের সাহস ও সংকল্পের প্রকাশ দেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তাদের লড়াই গত ২৫ জানুয়ারিতেই শুরু হয়নি; গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য তারা অনেক আগে থেকেই সক্রিয়। যে পরিবর্তন অনিবার্য বলে তাদের বিশ্বাস, তার ভিত তারা দিনে দিনে রচনা করে যাচ্ছিল।
এরই চরম মুহূর্ত হলো তিউনিসীয় বিপ্লব। এই ঘটনার শক্তিশালী বার্তা তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলল যে ‘হ্যাঁ, আমরা পারি’। এই তরুণ নেতৃত্বই মিসরের ভবিষ্যৎ। তারা চৌকস, উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন, দীর্ঘদিন ধরে অপূরিত থাকা প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে ক্লান্ত। পুরোনো এই ব্যবস্থার বদল ছাড়া তারা এখন আর কিছু চায় না। তাদের সাহসিকতা ও অটলতাকে আমি সমীহ করি।
পাশ্চাত্যের অনেকেই এখন মোবারকের ধাপ্পায় বিশ্বাস করছেন যে তিনি না থাকলে মিসরে নৈরাজ্য নামবে, পরিণত হবে ধর্মীয় রাষ্ট্রে, ইসরায়েলের সঙ্গে ভঙ্গুর শান্তি ভেঙে যাবে এবং হয়ে পড়বে পাশ্চাত্যবিরোধী। কিন্তু মিসরের জনগণকে—বোরকা পরা যে দাদিমারা তাহরির চত্বরে ট্যাংকের হুমকি উপেক্ষা করে অবস্থান করছেন কিংবা যে উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা স্বাধীনতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে—এত সহজে বোকা বানানো যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গত এক দশকের অর্ধেকেরও বেশি সময় ইরাক ও আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোটি কোটি ডলার এবং অজস্র জীবন ধ্বংস করেছে। কিন্তু সবই বৃথা গেছে। অন্যদিকে কায়রোর তারুণ্য কেবল সংকল্পে ভর করে লাখ লাখ মানুষকে পথে নামিয়েছে সত্যিকার মিসরীয় গণতন্ত্রের দাবিতে। এ অবস্থায় পাশ্চাত্য জনগণের দ্বারা ঘৃণিত শাসককে টিকিয়ে রাখতে ছলেবলে চেষ্টা করলে সেটা হবে উদ্ভট।
মিসর অনন্তকাল ধরে সেই বধির শাসকের বোধোদয়ের জন্য অপেক্ষা করবে না, যিনি জনগণের কথা শুনতে পান না। গত পরশু সন্ধ্যায় টেলিভিশনে তাঁকে আমরা দেখলাম, মোহগ্রস্তের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। অথচ কোনো নৈতিক বৈধতা তাঁর নেই।
এখন দরকার ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক হস্তান্তর। বিপ্লবী উদ্দীপনাকে নতুন মিসর গঠনে ব্যবহার করা দরকার, যে মিসর দাঁড়াবে ন্যায়বিচার ও মুক্তির ভিতের ওপর। সব মিসরীয়র অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে নতুন নেতাদের। যে সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, সেই সংসদও বাতিল করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানও বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে। কেননা, এটিই এখন দমন-পীড়নের হাতিয়ার। এর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান, তিন সদস্যের প্রেসিডেন্টশিয়াল পরিষদ এবং জাতীয় ঐকমত্যের অস্থায়ী সরকার।
প্রেসিডেন্টশিয়াল পরিষদের একজন সদস্য আসবেন সেনাবাহিনী থেকে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদারি নিশ্চিত হবে এবং এই জটিল সময়ে তারা ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার নিশ্চয়তা দেবে। প্রেসিডেন্টশিয়াল পরিষদ এবং অস্থায়ী সরকারের কাজ হবে মিসরকে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চালু রাখা। তাদের কাজ হবে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন এবং গণভোটের মাধ্যমে সেই সংবিধান পাস করা এবং এক বছরের মধ্যে সুষ্ঠু ও মুক্ত নির্বাচন।
আমরা এখন নতুন মিসরের জন্মমুহূর্ত পার করছি। একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজই পারে দেশের ভেতরে ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তির নিশ্চয়তা তৈরি করতে। এবং সেটাই হবে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অংশীদারির রক্ষাকবচ। মিসরের পুনর্জন্ম এক নতুন যুগের আবির্ভাবের আশা তৈরি করেছে, যে যুগ আরব সমাজ, মুসলিম সংস্কৃতি এবং মধ্যপ্রাচ্যকে আর যুদ্ধ ও চরমপন্থার চশমা দিয়ে দেখাবে না। বরং তা মানবতার অগ্রযাত্রায় অবদান রাখবে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বলে আধুনিকায়িত হবে। আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে তা যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি মানবতার সর্বজনীন মূল্যবোধে তা হবে ঐক্যবদ্ধ। অতীতের দুঃশাসনের ছায়া ছাড়া আমাদের ভয় পাওয়ার আর কিছুই নেই।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
মোহাম্মদ এলবারাদি: আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক পরিচালক হিসেবে ২০০৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, মিসরের ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.