যুগের বাণী-সংসদীয় গণতন্ত্রের দর্শন by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

আজকের লেখাটির শিরোনাম পড়ে প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আপনার মনের আয়নায় লেখাটির কারণ-প্রেক্ষাপট দ্রুত হাজির হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত সেগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো কর্তৃক জাতীয় সংসদকে উপেক্ষা করে যত্রতত্র বাগ্বিতণ্ডা, মিছিল-ঘেরাও-হৈচৈ করার কর্মকাণ্ডের খবরের কাগজগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন এবং তাদের চেয়েও বাড়া টিভির পর্দায় দেখা সেসব কর্মকাণ্ড।


বাংলাদেশে যখন সবেমাত্র ইংরেজ ঔপনিবেশিক দুঃশাসন খুঁটি গাড়তে শুরু করেছে, তখন সেই ১৭৬৩ সাল থেকেই বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম করে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। যার সফল চূড়ান্ত সংগ্রামটি হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অতঃপর একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বর্ণশিখরে পেঁৗছার সম্মুখ যাত্রাপথে আমাদের তো এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওই কর্মকাণ্ডগুলো তো পেছন যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং সেটা ভাবতেই ধলু চাচার গল্পটি মনে পড়ল।
ছোটবেলার কথা। বগুড়ায় আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। বাড়ির বাইরের আঙিনার এক ধারে বাঁশবাগানে আমরা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন বিকেলবেলায় জড়ো হতাম খেলা করার জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি ধলু চাচার গল্প শোনার জন্য। বোধ করি তিনিও গল্প বলার নেশায় ওই সময় নিয়মিত আসতেন। বগুড়ার আঞ্চলিক কথ্যভাষায় বলা প্রতিটি গল্পের তিনি নায়ক থাকতেন এবং আমরা তাঁর প্রতিটি গল্পকে মনেপ্রাণে সত্যি ভাবতাম। প্রতিটি গল্প শেষে তিনি একটি বাক্য বলতেন, যার আঞ্চলিক শব্দের আভিধানিক অর্থ ভিন্ন। তিনি 'আমি তো হতাশ'_এ বাক্যটি বলতেন। তাঁর কাছে বাক্যটির অর্থ ছিল 'আমি তো অবাক!'
ধলু চাচার কাছে শোনা একটি গল্প, যা তাঁর কথায় একটি সত্য ঘটনা আমার জবানিতে বলছি। একবার গভীর রাতে ধলু চাচা রক্তদহের বিলে মাছ ধরতে গেছেন। আমাদের গাঁয়ের উত্তরে বহুদূর বিস্তৃত ধানক্ষেত। তার পর রক্তদহ নামের বিরাট বিল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তাঁর ছিপের বড়শিতে একটা প্রকাণ্ড গজার মাছ আটকা পড়ল। মাছটাকে খেলিয়ে ডাঙায় তুলে সেটা থলিতে পুরে হৃষ্টচিত্তে ধলু চাচা বাড়ির পথ ধরলেন। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর সামনে একটা প্রকাণ্ড পাকুড়গাছ, চারধারে ডালপালা মেলে একাকী দাঁড়িয়ে আছে। গাছের তলায় জমাটবাঁধা অন্ধকারে ঢুকতেই কে যেন ধলু চাচার কাঁধে থাকা মাছের থলিতে টান দিল। পরক্ষণেই নাকি সুরে বলল, মাছটা দে। এ নিশ্চয়ই ভূতের দাদা খোক্কস হবে। ধলু চাচা শক্ত হাতে মাছের থলিটা চেপে ধরে প্রাণপণে দৌড় দিলেন এবং পেছনে শুনলেন খোক্কসটার দৌড়ে চলার পায়ের ধুপধাপ শব্দ।
কিন্তু অবাক কাণ্ড। ধলু চাচার মনে হলো, খোক্কসটার পায়ের শব্দ ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। তারপর জলে পড়ে যাওয়ার ঝপাৎ শব্দ হলো। ধলু চাচা দাঁড়িয়ে গেলেন। নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপারটা কী। তারপর বুঝতে পেরে হাঁফ ছাড়লেন। ভূতদের পা পেছনের দিকে। খোক্কসটা ধলু চাচাকে ধরার জন্য দৌড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার পা পেছন দিকে হওয়ায় উল্টো দৌড় দিয়ে রক্তদহের জলে পড়ে গেছে। যদি সে ধলু চাচাকে ধরতে পারত, তাহলে তাকে পিছু দৌড়িয়ে রক্তদহের জলে ডুবিয়ে মারত। ধলু চাচা গল্পটি শেষ করে বলেছিলেন, 'আমি তো হতাশ।'
সংসদীয় গণতন্ত্রের দর্শনের প্রথম সূত্রটি হচ্ছে, সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের দেশের সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। কেননা, সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন। বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল যাকে ঘিরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তফাৎ কোথায়, যার জন্য ভোটার-জনগণ একেক সময় একেক রাজনৈতিক দল কিংবা জোটকে নির্বাচনে জয়ী করে শাসনক্ষমতায় বসায়। তফাতটা এই। সংবিধানের ছত্রচ্ছায়ায় নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের ঘোষিত কর্মপদ্ধতির ভিন্নতা ভোটার-জনগণ বর্তমানের প্রেক্ষাপটে যেটি তাদের বিবেচনায় উত্তম মনে হয়, সে দল কিংবা জোট নির্বাচনে জয়ী হয়।
নির্বাচনে জয়ী কোনো এলাকার দলীয় প্রার্থী কিন্তু যারা তাঁকে ভোট দেননি তাঁদেরও তিনি জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন_এই বোধটি প্রবল থাকা একটি জরুরি বিষয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের সুতিকাগার ইংল্যান্ড। এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭) ৩০ বছর যাবৎ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। তিনি একজন উদারপন্থী ও প্রগতিবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। পার্লামেন্টে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা ভাব ও ভাষায় এমন সমৃদ্ধ ছিল যে এখনো তাঁর বক্তৃতাগুলোর নির্বাচিত সংকলন গ্রন্থ বিক্রি হয়। তিনি ক্রীতদাস ব্যবসার বিরুদ্ধে, ভারতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও আমেরিকার ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে সোচ্চার ছিলেন। এডমন্ড বার্ক পার্লামেন্ট কী এ বিষয়ে বলেছেন, 'পার্লামেন্ট বিভিন্ন ও বৈরী স্বার্থের দূতদের মহাসভা নয়, যেখানে স্বার্থগুলো অবশ্যই তিনি বজায় রাখবেন একজন এজেন্ট ও সমর্থক হিসেবে, অন্য স্বার্থের এজেন্ট ও সমর্থকের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রকৃত পার্লামেন্ট হচ্ছে সুচিন্তিত বিচার-বিবেচনার জন্য নির্বাচিত বহুজাতিক জনসমষ্টির দেশের একক বিধানসভা, যার স্বপূর্ণাঙ্গ একটিই স্বার্থ, যেটা কোনো সংকীর্ণ স্বার্থ কিংবা অযৌক্তিক পক্ষপাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রিত হয় সর্বজনের স্বার্থে।' এডমন্ড বার্ক একজন সংসদের পার্লামেন্টে কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেছেন, 'তাঁর থাকবে ঐশ্বরীয় বিধানের প্রতি প্রশ্নাতীত প্রত্যয়, যার মর্যাদার জন্য তিনি গভীরভাবে দায়বদ্ধ।'
প্রিয় পাঠক, এ লেখাটি যদি একজন বিরোধীয় সাংসদকে পড়তে অনুরোধ করা হয়, তিনি যদি অনুরোধটি রক্ষা করেন সে ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় সংসদে গরহাজির থাকার কোনো যুক্তিযুক্ত কৈফিয়ত কি দিতে পারবেন? যে কেউ যুক্তিশীল ব্যক্তি তিনি একজন সাধারণ ভোটার কিংবা একজন রাজনীতিবিদ কিংবা জাতীয় সংসদের একজন সদস্য কিংবা বুদ্ধিজীবী হন না কেন, তাঁর উত্তর অবশ্যই হবে না, অবশ্যই না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতি কিছু দল আদৌ বিশ্বস্ত কিংবা আস্থাশীল নয়। অথচ ইতিপূর্বে বলেছি, দুই শতাধিক বছরের বাংলাদেশের নির্যাতিত শোষিত জনগণের সংগ্রামের চূড়ান্ত সফল সংগ্রাম হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে চরিত্রের বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল, তেমনি রাষ্ট্রের নকশা প্রণীত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে, আহমদ ছফার ভাষায়, 'মার্কসবাদীরা নির্যাতিত শ্রেণীর রাষ্ট্র বলতে যে জিনিসটি বুঝিয়ে থাকেন অত কড়াকড়িভাবে না হলেও বাংলাদেশকে সে ধরনের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, শুরু থেকেই এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে। সে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তারা মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী হোক_সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।'
এই সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি একজন সাংসদের। এ কারণে বলা হয়ে থাকে, 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়' এবং দলের চেয়ে বড় স্বদেশ। এ প্রেক্ষাপটে ইসলামের নবীর অমর বচনটির উদ্ধৃতি দিতে হয় : 'স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ইমানের অংশ।' আমাদের স্বদেশ একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র, যেহেতু এখানে বহু জাতির বাস। আমাদের স্বদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেহেতু এখানে বহু ধর্মাবলম্বীর বাস। আমাদের স্বদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেহেতু এখানে নির্যাতিত জনগণের বাস। যাঁরা বংশপরম্পরায় সমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম ও অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
লেখক : বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট

No comments

Powered by Blogger.