চরাচর-সীতাকোট বৌদ্ধবিহার by আলম শাইন
আমাদের দেশে এ পর্যন্ত যত বৌদ্ধবিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সীতাকোট বৌদ্ধবিহার সবচেয়ে প্রাচীন। এটি দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। নবাবগঞ্জ সদর থেকে আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় এক একর জমির ওপর সীতাকোট বৌদ্ধবিহারের অবস্থান। এ বিহারের নামকরণ নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
এ মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিথটি হচ্ছে, লঙ্কাদ্বীপ থেকে সীতাকে উদ্ধারের পর যখন রাজা নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন, তখন বাধ্য হয়ে তিনি সীতাকে দ্বিতীয়বার বনবাসে পাঠালেন। সেখানে সীতা এক বাল্মিকী মুনির আশ্রয়ে আশ্রিত হন। সে আশ্রিত স্থানটিকে পরবর্তী সময়ে নামকরণ করা হয় 'সীতাকোট'। আর এ সীতাকোটেই স্থাপিত হয় প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি। এ বিহারের চারপাশে রয়েছে নিরাপত্তা প্রাচীর। আগে প্রাচীরটি সাড়ে আট ফুট উঁচু ছিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও বর্তমানে বিহারের প্রাচীর চার ফুট ছয় ইঞ্চি টিকে আছে। প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে আবার পরিখা। নিরাপত্তা জোরদার করতে এ বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিহারটিতে মোট কক্ষ ছিল ৪১টি। সব কক্ষই সমআয়তনের এবং দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ছিল। কক্ষগুলোর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩.৬৬ এবং প্রস্থে ৩.৩৫ মিটার। তবে ভেতরে বাতাস চলাচলের জন্যে ছিল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। অধ্যয়নরত ছাত্রদের শোয়ার ব্যবস্থাসহ পুস্তকাদি রাখার জন্য বড়বড় তাকও ছিল। বিহারের ভেতর দিকে ২.৫৯ মিটারের প্রশস্ত বারান্দা থাকলেও তার ওপর কোন ছাদের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শুধু বারান্দার শেষ প্রান্তে চার ফুট পুরু ও তিন ফুট উঁচু দেয়াল ছিল। উল্লেখ্য, সীতাকোট বৌদ্ধবিহারটি অনেকটা দুর্গের আকারে তৈরি। বিহারের উত্তরাংশের মাঝ বরাবর ছিল ঢোকার প্রধান ফটক। যত দূর জানা যায়, বিহারের দক্ষিণ দিকে একটি মন্দিরও ছিল। মন্দিরের সামনে একটি উপাসনাকক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। সে কক্ষটিতে ছিল ১২টি স্তম্ভ, তার ওপর মজবুত ছাদের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। বিহারের দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি কূপ ছিল। কূপটির নাম 'শ্বেতকূপ'। ওটার নাম কেন শ্বেতকূপ হয়েছে তা জানা যায়নি। বিহারে বসবাসরত লোকজনের গোসলের জন্য একটি দিঘি খনন করা হয়েছিল। যত দূর জানা যায়, সীতাকোট বৌদ্ধবিহার খনন করা হয় ১৯৬৮ সালে। বিস্তর তৈজসপত্র পাওয়া যায় খননকালে। যা পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। এ ছাড়াও পাওয়া যায় বেশ কিছু মূল্যবান সামগ্রী। এর মধ্যে ব্রোঞ্জের বিভিন্ন ধরনের মূর্তিও রয়েছে। মূর্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে 'বোধিসত্ব পদ্মপানি' এবং 'বোধিসত্ব মঞ্জুশ্রী' মূর্তি। অনুমান করা হয়, এগুলো সপ্তম-অষ্টম শতকের তৈরি। তবে এখানে কোনো তাম্রলিপি বা শিলালিপি পাওয়া যায়নি। যার ফলে বিহার স্থাপনের প্রকৃত সন-তারিখ বের করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বিহারটির অবস্থা বেশ নাজুক। সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে দ্রুত হারিয়ে যাবে সীতাকোট বৌদ্ধবিহারটি। ফলে আমরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হব। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে আমাদের জন্য, তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে আশা করি।
আলম শাইন
আলম শাইন
No comments