আদমশুমারি ২০১১-'শুমার করিয়া দেখিল...'

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান এতদিন জনসংখ্যা সম্পর্কে যে ধারণা দিয়ে এসেছে তাতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৫ কোটি ছাড়িয়ে ১৬ কোটির কোঠা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনার যে ফল শনিবার প্রকাশিত হলো তাতে বেশ ভিন্ন রকমের একটি চিত্রই পাওয়া গেল।


এ বছরের ১৫ থেকে ১৯ মার্চে আয়োজিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা এখন ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। আদমশুমারির এই ফল স্বাভাবিকভাবে অনেককেই বিস্মিত করেছে। এতকাল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা যে সংখ্যা প্রাক্কলন করেছিলেন তা থেকে দুই কোটি মানুষ রীতিমতো নিখোঁজ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষজ্ঞদের এতদিনের হিসাব নাকি সদ্য সমাপ্ত আদমশুমারি, কোনটি সঠিক? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস-বিবিএস) প্রাথমিকভাবে যে ফল তৈরি করেছে তা নমুনা যাচাই-বাছাই করবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-বিআইডিএস)। নমুনা জরিপের মাধ্যমে জরিপের ভুলভ্রান্তিগুলো যাচাই করবে প্রতিষ্ঠানটি। এই যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হবে। তাই বর্তমান হিসাবটিকে খসড়া বা প্রাথমিক হিসাব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ও বিবিএসের ফলের মধ্যে বিস্তর ফারাক হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা তাগিদ দিচ্ছেন যেন বিআইডিএসের জরিপ যথাযথ হয় এবং সে জরিপের ফল বিবেচনা করার সময় যেন প্রতিটি ভুলভ্রান্তি আমলে নেওয়া হয়। একটি দেশে শুধু রাষ্ট্রীয় নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার বেলাতেই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, দারিদ্র্য নিরসন, বৈদেশিক সাহায্য, কর্মসংস্থান, আবাসন, নগর উন্নয়ন, খাদ্য ও স্বাস্থ্য পরিকল্পনা পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে সঠিক লোকগণনা বা আদমশুমারির গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী, সঠিক ও কার্যকর লক্ষ্য গ্রহণ করতে হলে সঠিক ও যথাযথ আদমশুমারির বিকল্প নেই। পাশ্চাত্যের বহু দেশেই নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুঙ্খানুপুঙ্খ শুমারির রীতি প্রচলিত আছে। উন্নত দেশগুলো তো বটেই, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে সাম্প্রতিককালে যে আদমশুমারি হয়েছে তাকে আদর্শ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু আদমশুমারির জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষিত লোকবল আমাদের দেশে এখনও তৈরি হয়নি। এটি যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য, আন্তরিকতা ও সততা থাকলে সীমিত অবকাঠামো ও লোকবল নিয়েও একটি জরিপকে সফল করা সম্ভব। এবারের আদমশুমারির আগে প্রচার-প্রচারণার স্বল্পতা ছিল। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে। মাঠকর্মীদের কাজ সঠিকভাবে মনিটরিং হয়নি। অভিযোগ আছে, যাচাই-বাছাই ছাড়া অদক্ষ মাঠকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বহু বাড়িতে মাঠকর্মীরা যাননি, বহু মানুষ গণনার আওতায় আসেননি। প্রাথমিক জরিপের এ দুর্বলতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী যাচাই-বাছাইগুলো সম্পন্ন হলে চূড়ান্ত বিচারে আদমশুমারি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে জনসংখ্যার সঠিক সংখ্যা জানাটাই জরিপের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ সংখ্যার কিছু গুরুত্ব থাকলেও চূড়ান্ত বিচারে এ ধরনের জরিপ কতটা ফল আনতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাবে। জনগণের অর্থনেতিক, সামাজিক অবস্থানের বিস্তারিত প্রতিবেদন একটি জরিপ থেকে পাওয়া গেলে সেটিই এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারত। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, উচ্চবিত্তের সঠিক সংখ্যা, গ্রাম থেকে শহরে আসার হার কিংবা নগরবাসী মানুষের ঘনত্বের তারতম্য দূরের কথা এবারের আদমশুমারি থেকে ঢাকা শহরের সঠিক জনসংখ্যার হিসাবই মিলছে না। প্রশ্ন হলো, এ জরিপ থেকে রাজধানীর জন্য কোনো অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ কি সম্ভব? খোদ রাজধানীর ক্ষেত্রেই যখন এমন তখন সারাদেশের ক্ষেত্রে এর ফল কী কাজে লাগবে সে প্রশ্ন সঙ্গত। তাই এ জরিপের সঠিক ও চূড়ান্ত ফল যেমন দরকার তেমনি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে, প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়ে আরও একটি বিস্তারিত জরিপ হওয়া দরকার।
 

No comments

Powered by Blogger.