কালের পুরাণ-বাজার, শেয়ারবাজার বিএনপি চালায়, সরকার কী করে? by সোহরাব হাসান
আসন্ন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আনন্দ ছাপিয়ে দেশবাসীর কাছে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজার ও শেয়ারবাজার। প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারবাজার নিয়ে মতিঝিলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ ও গাড়ি ভাঙচুর করছেন। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।
কিন্তু তাদের এই জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। তারা আছে কে কাকে কথার বানে ঘায়েল করবে, সেই তালে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজার ও শেয়ারবাজার নিয়ে জাতীয় সংসদে এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুটি বক্তব্য দেন। যাতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো হলেও সরকারের ব্যর্থতা ও অবহেলার কথা স্বীকার করা হয়নি। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিএনপিই দায়ী। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং শেয়ারবাজারকে তারাই ইস্যু করে হরতাল ডাকছে। বিএনপির ব্যবসায়ীরা একদিকে চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে মূল্য বৃদ্ধি করছেন, অন্যদিকে একে ইস্যু বানিয়ে হরতাল ডাকা হচ্ছে।’ মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ তথ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান। (ইত্তেফাক ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১)।
এক দিন পর জাতীয় সংসদে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এর মধ্যে কিছু খেলা নিশ্চয়ই আছে। এ জন্য সব চালের আড়তদার ও মজুদদারদের তালিকা এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।’ প্রয়োজনে উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে খাদ্য আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর তথ্য সংগ্রহ যেমন জনগণকে আশান্বিত করবে না, তেমনি উন্নয়নকাজ বন্ধ করে খাদ্য আমদানির ঘোষণা দেশকে এগিয়ে নেবে না।
আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দুই বছর আগে যাঁর দল বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে, জাতীয় সংসদের ৩৪৫ আসনের মধ্যে ২৩৮টিই যাঁর দলের করায়ত্তে, তাঁর কণ্ঠে এমন হতাশার সুর থাকবে। এর মাধ্যমে তিনি বিরোধী দলের হাতে আরেকটি ইস্যুই তুলে দিলেন না, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ব্যর্থতা এবং দুর্বলতাও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন বিরোধী দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘সবকিছুই যদি বিরোধী দল করে, তা হলে আপনারা ক্ষমতা ছেড়ে দিন, পদত্যাগ করুন।’ অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করলেও যে বিএনপি দেশ সুষ্ঠুভাবে চালাতে ও জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারবে, সেই ভরসা কম। তারাও ২০০১ সালে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে মাত্র তিন মাসের মাথায় সবকিছু লেজে-গোবরে করে ফেলেছিল।
এই মুহূর্তে জনগণ ভীষণ পেরেশানিতে আছে নিত্যপণ্যের দাম ও শেয়ারবাজার নিয়ে। তারা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে আশার বাণী শুনতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিরোধী দল দায়ী।’ বিরোধী দলের কারা দায়ী, সে কথা তিনি খোলাসা করে বলেননি। কিন্তু কারা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিএনপির ব্যবসায়ীরা চাল, তেল, ডালসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন, আবার তার প্রতিবাদে হরতালও ডাকছেন।’ বিএনপিই যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং শেয়ারবাজারে কারসাজি করে, তা হলে সরকার করছে কী? মন্ত্রীরা স্বপদে আছেন কেন?
রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে কিংবা জাতীয় সংসদে কোনো কথা বলেন, তা গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হবে। আমরা ধারণা করি, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। কারা কোথায় খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখছেন, কারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করছে, তাও নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তথা গোয়েন্দাদের অজানা নয়।
প্রশ্ন হলো, সেই বাজার সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার? বিএনপির নেতাদের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য থাকতে পারে, তাঁরা খাদ্যপণ্য গুদামজাত করে দামও বাড়াতে পারেন। কিন্তু পুলিশ, র্যাব তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কি বিএনপির কথায় চলে? যদি না চলে, তাহলে কেন অপরাধীদের চিহ্নিত করছে না? কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? যে র্যাব-পুলিশ মানুষকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুম করে দিতে পারে, ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী ব্যবসায়ীদের ধরতে পারছে না—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে যেসব খবর বের হয়েছে, তা আতঙ্কজনক। বুধবার ইত্তেফাক শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে ‘ফালু ও তাঁর আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী-বন্ধুসহ গোয়েন্দা নজরদারিতে কয়েকজন’ শিরোনামে। এতে বলা হয়, ‘কেলেঙ্কারির হোতাদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ফালু ছাড়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী লুত্ফর রহমান বাদলও রয়েছেন।...বাদল বর্তমান সরকারের সময়ে প্রভাবশালী এক নেতার হাত ধরে বনে যান দেশের অন্যতম ধনকুবের।...আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে কাছে পাওয়ার পর সব সময় ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে আছেন তিনি।’ (ইত্তেফাক, ৯ ফেব্রুয়ারি)
জনগণ জানতে চায়, আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতাটি কে?
গত দুই বছরে শেয়ারবাজার নিয়ে যেসব গুঞ্জন চলছিল, এখন দেখা যাচ্ছে, তার সবটাই সত্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি ভিন্ন হলেও, কর্মীরা রাস্তায় মারামারি করলেও দুই দলের রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ীদের মধ্যে দারুণ সখ্য। দিনের বেলায় তাঁদের মধ্যে রেষারেষি যতই থাক, রাতে একসঙ্গে খানাপিনা ঠিকই চলে। দুই দলের ব্যবসায়ীরা মিলে ব্যাংক করেন, কোম্পানি করেন, মিডিয়া করেন, সে খবরও প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কয়েক দিন আগে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। ‘সরকারি ও বিরোধী দলের ১৫ থেকে ১৬ জন ব্যবসায়ী শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এবং তাঁরা ইতিমধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন।’ তাঁর এই কথাকে সূত্র ধরেও সরকার শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের পাকড়াও করতে পারত। করেনি। সরকার এখন তাঁর নেতৃত্বেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, করলেও তাদের সুপারিশ কার্যকর হবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে খুদে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা যতটা বাহাসই করুন না কেন, জনগণের ভোগান্তি লাঘবের কোনো চেষ্টা দেখছি না। বিরোধী দলের ভূমিকা হলো প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার মতো। তারা চায় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হবে এবং সেই সুযোগে তারা আন্দোলন চাঙা করবে, হরতাল করবে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকারের মন্ত্রীরা বলে আসছেন, যেসব ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, তার বিষদাঁত ভেঙে দেবেন কি, সিন্ডিকেট আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার বাজার-সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করতে বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তিনি একবার বলেন ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়, টিসিবিকে সচল করার প্রয়োজন নেই। আবার বলেন টিসিবিকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি একবার ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে ধমক দেন, আরেকবার তাঁদের ঈমানের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেন। সবকিছু ব্যবসায়ীদের ঈমানের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনটা কী?
চালের দামের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কিন্তু মানুষ মোটামুটি মেনে নিয়েছিল, তাদের কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও। এখন সরকারকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, মানুষের আস্থা অর্জন। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও কর্মসংস্থান বাড়ানো। প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুত্-সংযোগ দেওয়া। উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপিও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে এরা অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ। ফলে তাদের প্রতি অনাস্থা জানাতেও সময় লাগেনি। এখন যদি জনগণ দেখতে পায়, আওয়ামী লীগ সরকারও সমানভাবে অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ; সে অবস্থায় সরকার শত চেষ্টা করেও জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারবে না, শেয়ারবাজারের ধসও ঠেকাতে পারবে না।
সরকারের অজানা থাকার কথা নয়, ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা এখনো সক্রিয় এবং সরকারের আশপাশেই আছেন। এসইসি যে ছয়টি ব্রোকার হাউসের লেনদেন স্থগিত রাখল, সেই সিদ্ধান্তটি আগে নিতে বাধা ছিল কোথায়? সন্দেহের তালিকায় কি আরও ব্রোকার হাউস নেই? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
সরকার ভালো কাজ করলে শত অপপ্রচার চালিয়েও কেউ সেটি খারাপ বানাতে পারে না। আবার খারাপ কাজ সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেও ভালো বানানো বা আড়াল করা যাবে না। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেছেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে চায়। কিন্তু বিরোধী দল তো সেই বিচার বানচাল করতে পারেনি। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ও কার্যকর করেছে। একইভাবে বিরোধী দল ও মহলবিশেষের বাধা সত্ত্বেও সরকার একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি করেছে। সরকার চেয়েছে বলেই কৃষকের হাতে সময়মতো সার ও বীজ পৌঁছে গিয়েছে, শহুরে ভদ্রলোকদের গাল খেয়েও কৃষকের চাষাবাদের সেচ নিশ্চিত করেছে।
সরকারের ৩৫-৩৬টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বড় জোর দু-তিনটি মন্ত্রণালয় সাফল্য দেখিয়েছে গত দুই বছরে। বাকি মন্ত্রণালয়গুলো কী করছে? সব ব্যাপারে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। অতীতে দেখা গেছে, সরকার বেকায়দায় পড়লেই বিরোধী দলের ও গণমাধ্যমের ওপর এক হাত নেয়। এই সরকারও নিচ্ছে। যোগাযোগ খাতে যে বেহাল অবস্থা, তা নিয়ে সংসদে কেউ কথা বললে, পত্রিকায় প্রতিবেদন হলে, সেটিকেও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে কিংবা আপন কৃতিত্ব ও মাহাত্ম্যে সদা বিভোর থাকলে দেশ ও জনগণের দুর্ভোগই বাড়বে। প্রতিদিন মতিঝিলে খুদে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের কান্না ও আহাজারি কি মন্ত্রীরা শুনতে পান না? তাঁরা কোনো দলের নন, নিজের শেষ সম্বল হারিয়ে আকাশবিদীর্ণ চিত্কার করছেন। কতটা অসহায় হলে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমাকে গুলি করেন।’
এই লাখ লাখ অসহায় মানুষের কান্নাকে শুধু বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না। আড়াল করা যাবে না ওএমএস এর লাইনে আসা মানুষের দীর্ঘশ্বাসও। শেয়ারবাজারে যারা ধস নামিয়েছে, যারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে, তারা পেশাদার অপরাধী, কেবল আত্মরক্ষার জন্য রাজনৈতিক লেবাস লাগায়—কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি। কিংবা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
এদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কী, সেটাই দেশবাসী জানতে চায়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজার ও শেয়ারবাজার নিয়ে জাতীয় সংসদে এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুটি বক্তব্য দেন। যাতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো হলেও সরকারের ব্যর্থতা ও অবহেলার কথা স্বীকার করা হয়নি। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিএনপিই দায়ী। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং শেয়ারবাজারকে তারাই ইস্যু করে হরতাল ডাকছে। বিএনপির ব্যবসায়ীরা একদিকে চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে মূল্য বৃদ্ধি করছেন, অন্যদিকে একে ইস্যু বানিয়ে হরতাল ডাকা হচ্ছে।’ মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ তথ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান। (ইত্তেফাক ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১)।
এক দিন পর জাতীয় সংসদে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এর মধ্যে কিছু খেলা নিশ্চয়ই আছে। এ জন্য সব চালের আড়তদার ও মজুদদারদের তালিকা এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।’ প্রয়োজনে উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে খাদ্য আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর তথ্য সংগ্রহ যেমন জনগণকে আশান্বিত করবে না, তেমনি উন্নয়নকাজ বন্ধ করে খাদ্য আমদানির ঘোষণা দেশকে এগিয়ে নেবে না।
আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দুই বছর আগে যাঁর দল বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে, জাতীয় সংসদের ৩৪৫ আসনের মধ্যে ২৩৮টিই যাঁর দলের করায়ত্তে, তাঁর কণ্ঠে এমন হতাশার সুর থাকবে। এর মাধ্যমে তিনি বিরোধী দলের হাতে আরেকটি ইস্যুই তুলে দিলেন না, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ব্যর্থতা এবং দুর্বলতাও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন বিরোধী দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘সবকিছুই যদি বিরোধী দল করে, তা হলে আপনারা ক্ষমতা ছেড়ে দিন, পদত্যাগ করুন।’ অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করলেও যে বিএনপি দেশ সুষ্ঠুভাবে চালাতে ও জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারবে, সেই ভরসা কম। তারাও ২০০১ সালে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে মাত্র তিন মাসের মাথায় সবকিছু লেজে-গোবরে করে ফেলেছিল।
এই মুহূর্তে জনগণ ভীষণ পেরেশানিতে আছে নিত্যপণ্যের দাম ও শেয়ারবাজার নিয়ে। তারা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে আশার বাণী শুনতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিরোধী দল দায়ী।’ বিরোধী দলের কারা দায়ী, সে কথা তিনি খোলাসা করে বলেননি। কিন্তু কারা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিএনপির ব্যবসায়ীরা চাল, তেল, ডালসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন, আবার তার প্রতিবাদে হরতালও ডাকছেন।’ বিএনপিই যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং শেয়ারবাজারে কারসাজি করে, তা হলে সরকার করছে কী? মন্ত্রীরা স্বপদে আছেন কেন?
রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে কিংবা জাতীয় সংসদে কোনো কথা বলেন, তা গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হবে। আমরা ধারণা করি, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। কারা কোথায় খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখছেন, কারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করছে, তাও নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তথা গোয়েন্দাদের অজানা নয়।
প্রশ্ন হলো, সেই বাজার সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার? বিএনপির নেতাদের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য থাকতে পারে, তাঁরা খাদ্যপণ্য গুদামজাত করে দামও বাড়াতে পারেন। কিন্তু পুলিশ, র্যাব তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কি বিএনপির কথায় চলে? যদি না চলে, তাহলে কেন অপরাধীদের চিহ্নিত করছে না? কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? যে র্যাব-পুলিশ মানুষকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুম করে দিতে পারে, ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী ব্যবসায়ীদের ধরতে পারছে না—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে যেসব খবর বের হয়েছে, তা আতঙ্কজনক। বুধবার ইত্তেফাক শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে ‘ফালু ও তাঁর আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী-বন্ধুসহ গোয়েন্দা নজরদারিতে কয়েকজন’ শিরোনামে। এতে বলা হয়, ‘কেলেঙ্কারির হোতাদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ফালু ছাড়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী লুত্ফর রহমান বাদলও রয়েছেন।...বাদল বর্তমান সরকারের সময়ে প্রভাবশালী এক নেতার হাত ধরে বনে যান দেশের অন্যতম ধনকুবের।...আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে কাছে পাওয়ার পর সব সময় ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে আছেন তিনি।’ (ইত্তেফাক, ৯ ফেব্রুয়ারি)
জনগণ জানতে চায়, আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতাটি কে?
গত দুই বছরে শেয়ারবাজার নিয়ে যেসব গুঞ্জন চলছিল, এখন দেখা যাচ্ছে, তার সবটাই সত্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি ভিন্ন হলেও, কর্মীরা রাস্তায় মারামারি করলেও দুই দলের রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ীদের মধ্যে দারুণ সখ্য। দিনের বেলায় তাঁদের মধ্যে রেষারেষি যতই থাক, রাতে একসঙ্গে খানাপিনা ঠিকই চলে। দুই দলের ব্যবসায়ীরা মিলে ব্যাংক করেন, কোম্পানি করেন, মিডিয়া করেন, সে খবরও প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কয়েক দিন আগে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। ‘সরকারি ও বিরোধী দলের ১৫ থেকে ১৬ জন ব্যবসায়ী শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এবং তাঁরা ইতিমধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন।’ তাঁর এই কথাকে সূত্র ধরেও সরকার শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের পাকড়াও করতে পারত। করেনি। সরকার এখন তাঁর নেতৃত্বেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, করলেও তাদের সুপারিশ কার্যকর হবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে খুদে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা যতটা বাহাসই করুন না কেন, জনগণের ভোগান্তি লাঘবের কোনো চেষ্টা দেখছি না। বিরোধী দলের ভূমিকা হলো প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার মতো। তারা চায় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হবে এবং সেই সুযোগে তারা আন্দোলন চাঙা করবে, হরতাল করবে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকারের মন্ত্রীরা বলে আসছেন, যেসব ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, তার বিষদাঁত ভেঙে দেবেন কি, সিন্ডিকেট আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার বাজার-সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করতে বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তিনি একবার বলেন ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়, টিসিবিকে সচল করার প্রয়োজন নেই। আবার বলেন টিসিবিকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি একবার ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে ধমক দেন, আরেকবার তাঁদের ঈমানের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেন। সবকিছু ব্যবসায়ীদের ঈমানের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনটা কী?
চালের দামের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কিন্তু মানুষ মোটামুটি মেনে নিয়েছিল, তাদের কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও। এখন সরকারকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, মানুষের আস্থা অর্জন। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও কর্মসংস্থান বাড়ানো। প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুত্-সংযোগ দেওয়া। উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপিও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে এরা অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ। ফলে তাদের প্রতি অনাস্থা জানাতেও সময় লাগেনি। এখন যদি জনগণ দেখতে পায়, আওয়ামী লীগ সরকারও সমানভাবে অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ; সে অবস্থায় সরকার শত চেষ্টা করেও জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারবে না, শেয়ারবাজারের ধসও ঠেকাতে পারবে না।
সরকারের অজানা থাকার কথা নয়, ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা এখনো সক্রিয় এবং সরকারের আশপাশেই আছেন। এসইসি যে ছয়টি ব্রোকার হাউসের লেনদেন স্থগিত রাখল, সেই সিদ্ধান্তটি আগে নিতে বাধা ছিল কোথায়? সন্দেহের তালিকায় কি আরও ব্রোকার হাউস নেই? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
সরকার ভালো কাজ করলে শত অপপ্রচার চালিয়েও কেউ সেটি খারাপ বানাতে পারে না। আবার খারাপ কাজ সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেও ভালো বানানো বা আড়াল করা যাবে না। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেছেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে চায়। কিন্তু বিরোধী দল তো সেই বিচার বানচাল করতে পারেনি। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ও কার্যকর করেছে। একইভাবে বিরোধী দল ও মহলবিশেষের বাধা সত্ত্বেও সরকার একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি করেছে। সরকার চেয়েছে বলেই কৃষকের হাতে সময়মতো সার ও বীজ পৌঁছে গিয়েছে, শহুরে ভদ্রলোকদের গাল খেয়েও কৃষকের চাষাবাদের সেচ নিশ্চিত করেছে।
সরকারের ৩৫-৩৬টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বড় জোর দু-তিনটি মন্ত্রণালয় সাফল্য দেখিয়েছে গত দুই বছরে। বাকি মন্ত্রণালয়গুলো কী করছে? সব ব্যাপারে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। অতীতে দেখা গেছে, সরকার বেকায়দায় পড়লেই বিরোধী দলের ও গণমাধ্যমের ওপর এক হাত নেয়। এই সরকারও নিচ্ছে। যোগাযোগ খাতে যে বেহাল অবস্থা, তা নিয়ে সংসদে কেউ কথা বললে, পত্রিকায় প্রতিবেদন হলে, সেটিকেও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে কিংবা আপন কৃতিত্ব ও মাহাত্ম্যে সদা বিভোর থাকলে দেশ ও জনগণের দুর্ভোগই বাড়বে। প্রতিদিন মতিঝিলে খুদে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের কান্না ও আহাজারি কি মন্ত্রীরা শুনতে পান না? তাঁরা কোনো দলের নন, নিজের শেষ সম্বল হারিয়ে আকাশবিদীর্ণ চিত্কার করছেন। কতটা অসহায় হলে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমাকে গুলি করেন।’
এই লাখ লাখ অসহায় মানুষের কান্নাকে শুধু বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না। আড়াল করা যাবে না ওএমএস এর লাইনে আসা মানুষের দীর্ঘশ্বাসও। শেয়ারবাজারে যারা ধস নামিয়েছে, যারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে, তারা পেশাদার অপরাধী, কেবল আত্মরক্ষার জন্য রাজনৈতিক লেবাস লাগায়—কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি। কিংবা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
এদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কী, সেটাই দেশবাসী জানতে চায়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments