সহজিয়া কড়চা-গামছা পেঁচানো দোররা ও হতভাগিনীদের নিয়তি by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দোররা একটি ফারসি শব্দ। দোররা একই সঙ্গে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ। অর্থাৎ এটি একটি বস্তুও। বস্তুর কোনো ধর্ম নেই, কিন্তু শব্দটির মধ্যে আছে ইসলামি আমেজ। কারণ, এটি মধ্যপ্রাচ্যের শব্দ। ইরানি ভাষার শব্দ হলেও বস্তুটির কোনো জাতীয়তা নেই। একসময় এটি পারস্যে ব্যবহূত হতো, আরব দেশে হতো, ইরাক, ইয়েমেন, মিসরেও হতো।
এখনো দুনিয়ার কোনো কোনো দেশে হয়, দেদার দোররা এস্তেমাল করা হয়, যেমন বাংলাদেশে।
দোররা বস্তুটি কী? এক মিটারের মতো লম্বা এই দ্রব্যটি বানানো হতো পাটের দড়ি শক্ত করে পাকিয়ে অথবা নারকেলের ছোবড়ার আঁশ পাকিয়ে। তাতে মোম ঘষে মজবুত করা হতো। এখন বাংলাদেশে অত ঝামেলায় যায় না কেউ, বাজারেও কিনতে পাওয়া যায় না, তাই ভেজা গামছা শক্ত করে পেঁচিয়ে দোররা বানানো হয়। যত বড় জঘন্য অপরাধীই হোক, পুরুষের পিঠের চেয়ে সামান্য অভিযোগে অভিযুক্ত নারীর পিঠ ও নিতম্বই দোররা প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত। সব নারীর জন্য অবশ্য দোররা প্রযোজ্য নয়, অসহায় দরিদ্র নারীর ওপরেই তা প্রয়োগ নিরাপদ।
অপরাধী ও পাপীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান বহু পুরোনো। শাস্তিও এক রকম নয়, বহু রকম। নানান দেশে নানান রকম। একেক কালে একেক রকম। প্রাচীন ভারতে অপরাধীকেই প্রমাণ করতে হতো, সে অপরাধী না নিরপরাধ। তার জন্য চার রকমের পরীক্ষা দিতে হতো তাকে। এক. অগ্নিপরীক্ষা। দগদগে জ্বলন্ত আগুন অথবা টকটকে লাল পোড়ানো লোহার ওপরে দাঁড়ালে যদি অভিযুক্তের পা না পুড়ত, তা হলে সে নিরপরাধ। (পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মানুষটি দাঁড়ালেও পুড়বে)। দুই. বিষ পরীক্ষা। অভিযুক্তকে ঢক্ঢক্ করে বিষ পান করতে দেওয়া হতো। যদি সে মারা না যেত, তা হলে নিরপরাধ। (বিষপানে নিষ্পাপও মারা যাবে)। তিন. ধান পরীক্ষা। ধান চিবিয়ে খেতে বলা হতো। যদি সে রক্তবমি না করত, তা হলে নির্দোষ। (দুনিয়ার যে কেউই রক্তবমি করবে) এবং চার. পানি পরীক্ষা। পানির মধ্যে নিয়ে অভিযুক্তকে চুবানো হতো। যদি সে পানির ওপরে ভেসে থাকত, তা হলে নির্দোষ। (তাজা মানুষ পানিতে ভাসে না)।
কাউকে শাস্তি দেওয়ার ভেতরে এক নির্মল আনন্দ ও সুখ আছে। যাকে ইংরেজিতে বলে স্যাডিস্টিক প্লেজার—মর্ষকামী সুখ। বিভিন্ন অপরাধের সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা রকম শাস্তির বিধান রয়েছে। বিষপানে মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড, ক্রুশ বিদ্ধ করে মারা, কারাগারে বন্দী করে রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি। এই উপমহাদেশেই একসময় বেশ কিছু বিচিত্র শাস্তি ছিল। পুরুষ অপরাধীকে উলঙ্গ করে তাকে দ্বিখণ্ডিত বা ফাটা বাঁশের মধ্যে এমনভাবে বসানো হতো যেন তার অণ্ডকোষ বাঁশের চিপার ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর শাস্তিদাতারা চাপ দিয়ে বিচি গালিয়ে দিত। লোকটি নপুংসক হয়ে যেত অথবা মারা যেত। এই শাস্তি-পদ্ধতিটি অনেক আগে উঠে গেছে। তবে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতন এত ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে যে শাস্তিটির পুনঃপ্রবর্তনের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। অপরাধী নারী হলে তাকে পুড়িয়ে মারা হতো। কিছুদিন আগেও ভারতের এক প্রত্যন্ত পল্লিতে এক ‘পাপিষ্ঠা’ নারীকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
আমাদের এই অঞ্চলেই শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হতো। প্রকাশ্য জনসমাবেশে অভিযুক্তকে লোহার সূক্ষ্ম শলাকার ওপরে বিবস্ত্র করে বসানো হতো। তারপর ধীরে ধীরে গুহ্যদ্বার দিয়ে ওই শলাকা বা শূলটি অপরাধীর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যেত। এসব শাস্তি দেখার মধ্যেও রয়েছে অপার আনন্দ।
মধ্যপ্রাচ্যে যা দোররা, প্রাচ্যে তা কশাঘাত বা বেত্রাঘাত। একই বস্তুর দেশ-কালভেদে ভিন্ন নাম। একই জিনিস, কোথাও নাম শরাব, কোথাও সুরা, কোথাও মদ। একইভাবে আরব-ইরান-তুরানে যা দোররা, হিন্দুস্তানে তা ফলা, বেত বা চাবুক। ফলা বা চাবুক ও দড়ি পাকিয়ে বানানো হয়, চামড়া দিয়েও বানানো যায়। তার একটা হাতল থাকে। চাবুক দিয়ে ঘোড়াকে পেটানো যায়, মানুষকেও পেটানো যায়।
চাবুক মারা বা বেত্রাঘাতের বিধান এখনো অনেক দেশে আছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে আছে। আমরা বলি, বেতিয়ে তার চামড়া তুলে নেব। ওটা কথার কথা। তবে সত্যি সত্যি যে বেত্রাঘাতে শরীরের চামড়া উঠে যায়, তা কয়েকজন ব্রিটিশ ও আমেরিকান জানেন। কয়েক মাস আগে বৈধ কাজগপত্র ছাড়া এক আমেরিকান সিঙ্গাপুরে বাস করছিলেন। অপরাধীকে জেলে ঢুকিয়ে জামাই আদরে ভাত খাওয়ানোর মানুষ সিঙ্গাপুরিরা নন। তার শাস্তি ১০ বেত্রাঘাত ও বহিষ্কার। তিন বেত মারার পরেই চামড়ার চাবুকের সঙ্গে বুশের দেশের লোকটির চামড়া উঠে আসে। অচেতন অবস্থায় তাকে অবশিষ্ট সাত বেত্রাঘাত করা হয়। ওই ধরনের চাবুকের বিধান কোনো দেশে অবশ্যই থাকা উচিত। বিশেষ করে নারী নির্যাতনকারী ও উত্ত্যক্তকারী এবং ফতোয়াবাজদের জন্য ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে আট রকম ‘ক্যাপিটাল ক্রাইমসে’র জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল। সেই আট রকম অপরাধের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি তো ছিলই, আর যেটি ছিল সেটি হলো স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্বামী যদি স্ত্রীকে হত্যা করে, সেটা ক্যাপিটাল ক্রাইম নয়। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওই আইন ও শাস্তির বিধান করেছিলেন পুরুষেরা, তাতে কোনো নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। যেমন—দোররা মারার বিধান প্রবর্তন করেন পুরুষেরা, কোনো নারী নন।
শরীয়তপুরের হেনা হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার জন্য কয়েকজন নিরপেক্ষ সাংবাদিকের ভূমিকাই প্রধান, কিন্তু একপর্যায়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট বিষয়টিকে গ্রহণ করায় এই বর্বর অপরাধের তদন্ত ও বিচার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
হেনা ধর্ষণ, ফতোয়া ও মৃত্যুটি শুধু দোররার ব্যাপার হিসেবে দেখলে ভুল হবে। সেভাবেই বিষয়টি দেখা হচ্ছে, কাগজে লেখা হচ্ছে, নারীনেত্রীরা লিখছেন, মানববন্ধন প্রভৃতি হয়েছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। বিষয়টি আরও বড়। আমাদের সেক্যুলারপন্থীরা শুধু ফতোয়াবাজদের বিচার হলেই সন্তুষ্ট। ইসলামপন্থীরা ফতোয়াবাজদের বাঁচাতে চাইবেন। এই দুইয়ের মাঝখানে যাঁরা, তাঁরা কিছুই চাইবেন না। ঘটনাটি ভুলে যাবেন। প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। হতভাগিনী হেনাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া ছাড়াও উচ্চ আদালতের আরও বহু কাজ আছে।
বিশ্ব মিডিয়ার উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে, এই মামলার এক নম্বর আসামি ধর্ম ও বাংলাদেশের মুসলমানেরা। হেনাকে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী দোররা মারা হলেও দোররা-পরবর্তী গোটা ব্যাপারটি ছিল সেক্যুলার—ধর্মনিরপেক্ষ—সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ, দেনদরবার, লেনদেন প্রভৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের এবং নারী-পুরুষ সব লিঙ্গের মানুষই যুক্ত ছিলেন। কি স্থানীয় সরকার সদস্য, কি চিকিৎসা কর্মকর্তা, গাইনি বিশেষজ্ঞ, থানার দারোগা, কি তদন্ত কর্মকর্তা—সবাই দায়ী। তাঁদের কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, কেউ সনাতন ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যখন কোনো জঘন্য অপকর্ম হয়, তখন তাতে ধর্মনিরপেক্ষভাবে সবার সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাংলার মাটিতে যখন কোনো কুকীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন। তখন সেখানে দলীয় পরিচয় বা অমুক নেতার সৈনিক—সেসব পরিচয় গৌণ হয়ে যায়।
চামটা গ্রামের ঘটনাটির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। সেসব পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের পর্যালোচনা করা ছাড়া শুধু ফতোয়া আর দোররা, মৃত্যু আর এজাহার, তদন্ত আর মামলা বিবেচনা করলে চলবে না। ক্ষতিগ্রস্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও দেখতে হবে, অর্থাৎ তাদের শ্রেণীচরিত্রও বিবেচনায় আনতে হবে। তাতে মার্ক্সবাদী হওয়ার ভয় নেই।
ব্যাপারটি যদি দরবেশ খাঁর মেয়ের জীবনে না ঘটে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের কোনো বড় দলের নেতার মেয়ের জীবনে ঘটত, তা হলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, গ্রাম্য বিচারক, মাদ্রাসার ফতোয়াবাজ, থানার দারোগা প্রভৃতির কী ভূমিকা হতো? তখন কি দুই ময়নাতদন্তের দুই রকম রিপোর্ট হতো? এ ঘটনাই যদি কোনো অমুসলমান পরিবারের মেয়ের জীবনে ঘটত, তা ঘটছেও, তখন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও তার ফতোয়া বোর্ডের সদস্য কারা হতেন? নাকি অমুসলমানদের সালিস ও শাস্তি দেওয়ার অধিকার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নেই। কয়েক মাস ধরে তো বাংলাদেশ শতভাগ সেক্যুলার!
গ্রাম্য সালিসি-ব্যবস্থা বঙ্গীয় সমাজে শত শত বছর ধরে রয়েছে। ছোটখাটো অপরাধ দমনে তা ভালো ভূমিকাই রেখেছে। ফতোয়াটা শুধু নারীঘটিত ব্যাপারে। দোররাটাও শুধু নারীঘটিত ব্যাপারেই, বিশেষভাবে নারীর জন্যই প্রযোজ্য, অন্য অপরাধীর জন্য নয়। ছাত্র ও যুব সংগঠনের ছেলেরা যখন মারামারি করে মাথা ফাটায়, টেন্ডার নিয়ে খুনখারাবি করে, তখন ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পাওয়া যায় না। দারোগা-পুলিশও থাকে নিরাপদ দূরত্বে। শুধু দরিদ্র নারীর বিচার করাতেই উৎসাহ আমাদের সমাজপতি ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের। অপরাধী যদি ক্ষমতাধর বা ক্ষমতাধরদের কেউ হয়, তাহলে তার ব্যাপারে তদন্ত ও বিচার করে কার বাবার সাধ্য। যেমন—ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের যে কিছুই হবে না, তা শুধু ডিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তাই ইঙ্গিত দেননি, এই কলামেও আমি লিখেছিলাম। নিহতের পরিবারের উচিত হবে বিচারের প্রত্যাশা না করে আরও তিনটি বছর ভুলে থাকা।
ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের মতো হেনা হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক নয়। এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার নিহতের দুই পরিবারই যে শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক, তা-ই নয়, সালিসকারী ও ফতোয়া প্রদানকারীরাও বিএনপির লোক নয় বলে জানা যায়। তা ছাড়া সরকারি ডাক্তার-কবিরাজ, দারোগা-পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট—সবাই দুই বছর ধরে আওয়ামী লীগের নিবেদিত সমর্থক না হয়েই পারেন না, ২০০১ থেকে ২০০৬ যতই হাওয়া ভবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখুন না কেন। হেনারা তাঁদের লোক নয় বলে প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের এ ঘটনা করুণার উদ্রেক করেনি। ঢাকায় বসে তাঁরা এখন কায়রোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
আগে হেনা হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের যে কথা বলেছি, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা দরকার। বিভিন্ন পর্যায়ের দৃশ্যপটের খলনায়ক ও তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে আলোচনা না করলে মূল ব্যাপারটির অর্ধেক অন্ধকারে থেকে যাবে।
দৃশ্যপট এক: লম্পট স্বভাবের চাচাতো ভাই শহর থেকে বাড়ি গেছে। ১৫ বছরের বোনটির শরীরের প্রতি তার লোভ। তাকে ফুসলিয়ে হোক বা জোর করে হোক, এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে তার শ্লীলতাহানি করে। মেয়েটির চিৎকারে ধর্ষকের বউ, মা প্রমুখ ছুটে যান অকুস্থলে। স্বামীকে অন্য মেয়ের সঙ্গে অবৈধ কাজ করতে দেখে ধর্ষকের স্ত্রীর ক্ষিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামীকে দু-চার ঘা না দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির ওপর। তার সঙ্গে যোগ দেয় ধর্ষকের পরিবারের অন্যরা। তাদের মধ্যে নারীই বেশি। নির্দয় মারধরে মেয়েটির রক্তক্ষরণ হয়। কাজটি করে নারীরাই।
দৃশ্যপট দুই: মেয়েটির বাবা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের কাছে বিচার দেন। বিচার বসে। যেহেতু ‘জেনা’র মামলা, তাই মাদ্রাসার ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। তাঁরা বলেন, মেয়েটির উপযুক্ত শাস্তি হলো তাকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে দণ্ড কমিয়ে শাস্তি দেন ১০০ দোররা। ওই বিচার-প্রক্রিয়া উপভোগ করেছেন গ্রামের আরও বহু লোক। তাঁরা কেউ প্রতিবাদ করেননি। প্রতিবাদ করার সাহস পাননি, এটা মিথ্যা কথা। ওই সালিসে ও দোররার সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরও আদালতে তলব করা উচিত।
দৃশ্যপট তিন: আগের দিনের পাশবিক মার ও দোররার পরে মেয়েটিকে মরণাপন্ন অবস্থায় তার বাবা উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। গরিব বাবার মেয়ে বলে সেখানে তাকে তেমন কোনো চিকিৎসাই দেওয়া হয়নি। আমি হেনার পরিবারে গিয়ে যা শুনেছি, তাতে তা-ই মনে হয়েছে। চিকিৎসকেরা মেয়েটিকে কী কী ওষুধ প্রয়োগ করেন, সে কাগজপত্র আদালতের পরীক্ষা করা উচিত। আসামির পরিবারের প্ররোচনায় চিকিৎসা ছাড়াই মেয়েটিকে বাড়ি নিয়ে আসা হয় এবং সে মারা যায়।
দৃশ্যপট চার: সঙ্গোপনে মেয়েটির লাশ দাফন করা হয়। তারপর মেয়ের বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে আপসে রাজি করানোর চেষ্টা হয়। এর মধ্যে কাগজে ঘটনা প্রকাশ পায়।
দৃশ্যপট পাঁচ: এই দৃশ্যের প্রধান কুশীলব সিভিল সার্জন। তিনি যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেন, তা এক উপন্যাস—বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর সহযোগী ছিলেন আরও তিনজন: আবাসিক চিকিৎসক (মেডিসিন) ও একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। উচ্চ আদালত সিভিল সার্জনকে ভালো কথা বলেছেন, ‘প্রতারণার চেষ্টা করলে আপনাকে জেলে পাঠানো হবে।’ এখন তাঁর বাঁচার একমাত্র পথ—প্রমাণ করা যে জোট সরকারের সময় তিনি বড়ই কষ্টে ছিলেন।
দৃশ্যপট ছয়: এটির মঞ্চ নড়িয়া থানা। কুশীলব পুলিশ কর্মকর্তারা। আসামিদের বাঁচানোর জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ। মোটামুটি সাফল্যের প্রান্তে পৌঁছানোর সময়ই সব নীলনকশা ভেস্তে যায় হাইকোর্টের নির্দেশে। টাকা-পয়সার লেনদেন কোনো কাজে এল না। আসামিদের বলা হলো, তোমরা কয়েক দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকো। হাইকোর্টের চাপে ধর্ষক ও সালিসকারীকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় পুলিশ।
এই বিশেষ মামলার জন্য আদালতের এই উদ্যোগকে আমরা অভিনন্দিত করি। কিন্তু হেনার ঘটনার পরবর্তী দুই সপ্তাহে দেশে আরও সাত-আটটি প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর কী হবে? সেখানেও সমাজ ও রাষ্ট্রের একই ভূমিকা। সমাজপতিরা প্রবলের পক্ষে, ফতোয়াবাজেরা নারীর বিরুদ্ধে, ধর্ষকের সহায়তায় থানা-পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র। ক্ষতিগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। দু-একটি ক্ষেত্রে কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান আইনি সহায়তা দেয়।
রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন থাকে না, তখনই সমাজে বেআইনি অনাচার বেড়ে যায়। ফতোয়াবাজি সেই বেআইনি কাজের একটি। অবৈধ যৌন সম্পর্ক মানুষের আদিম প্রবৃত্তির একটি। যারা নৈতিকতার ধার ধারে না, তারা ওই কাজে লিপ্ত হয়। যৌন অপরাধী যদি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে, তা হলে তাকে আইনের আওতায় আনাই সভ্য সমাজের রীতি। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো পাথর ছুড়ে মারার কথা শোনা যায়, দোররা মারার কথা, হিল্লা বিয়ে দেওয়া অথবা একঘরে করে মানসিক নির্যাতন করা। এসব করা হয় সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে, অন্য কাউকে নয়। প্রভাবশালী কারও ছেলেমেয়ে বিয়ের আগে বাবা-মা হলে তাদের বাচ্চাটিকে সালিসকারী ও ফতোয়াবাজেরাই গালে হাত দিয়ে আদর করেন।
গত ১০ বছরে ছয় শর মতো ফতোয়ার ঘটনার কথা জানা যায়। তার মধ্যে মাত্র একটি মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়টি কার্যকর হয়নি। আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ফতোয়াবাজেরা শক্তিশালী নয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে রয়েছেন থানার দারোগা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং একশ্রেণীর অসাধু সংবাদকর্মীও।
ছাতকছড়ার নূরজাহানের সময় থেকে হেনা পর্যন্ত গত ১৭ বছরে আমি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রায় ৪৫টি ঘটনা মনিটর করার চেষ্টা করেছি। কোনো অগ্রগতি দেখিনি। হেনা হত্যার যদি সুষ্ঠু বিচার হয়ও, তাতেই সমাজের কী লাভ? প্রতিদিনই এ-জাতীয় অপরাধের কথা পত্রিকায় আসছে।
আমরা একটি আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু সেই রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন না থাকে, প্রশাসন যদি দায়িত্ব পালন না করে, রাজনীতিকেরা যদি ধনী-নির্ধন সবার অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট না হন, তা হলে শুধু একটি মামলা নিষ্পত্তি করে চমক সৃষ্টি করা যাবে—সমাজ ও রাষ্ট্রের অসুস্থতা দূর করা যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
দোররা বস্তুটি কী? এক মিটারের মতো লম্বা এই দ্রব্যটি বানানো হতো পাটের দড়ি শক্ত করে পাকিয়ে অথবা নারকেলের ছোবড়ার আঁশ পাকিয়ে। তাতে মোম ঘষে মজবুত করা হতো। এখন বাংলাদেশে অত ঝামেলায় যায় না কেউ, বাজারেও কিনতে পাওয়া যায় না, তাই ভেজা গামছা শক্ত করে পেঁচিয়ে দোররা বানানো হয়। যত বড় জঘন্য অপরাধীই হোক, পুরুষের পিঠের চেয়ে সামান্য অভিযোগে অভিযুক্ত নারীর পিঠ ও নিতম্বই দোররা প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত। সব নারীর জন্য অবশ্য দোররা প্রযোজ্য নয়, অসহায় দরিদ্র নারীর ওপরেই তা প্রয়োগ নিরাপদ।
অপরাধী ও পাপীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান বহু পুরোনো। শাস্তিও এক রকম নয়, বহু রকম। নানান দেশে নানান রকম। একেক কালে একেক রকম। প্রাচীন ভারতে অপরাধীকেই প্রমাণ করতে হতো, সে অপরাধী না নিরপরাধ। তার জন্য চার রকমের পরীক্ষা দিতে হতো তাকে। এক. অগ্নিপরীক্ষা। দগদগে জ্বলন্ত আগুন অথবা টকটকে লাল পোড়ানো লোহার ওপরে দাঁড়ালে যদি অভিযুক্তের পা না পুড়ত, তা হলে সে নিরপরাধ। (পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মানুষটি দাঁড়ালেও পুড়বে)। দুই. বিষ পরীক্ষা। অভিযুক্তকে ঢক্ঢক্ করে বিষ পান করতে দেওয়া হতো। যদি সে মারা না যেত, তা হলে নিরপরাধ। (বিষপানে নিষ্পাপও মারা যাবে)। তিন. ধান পরীক্ষা। ধান চিবিয়ে খেতে বলা হতো। যদি সে রক্তবমি না করত, তা হলে নির্দোষ। (দুনিয়ার যে কেউই রক্তবমি করবে) এবং চার. পানি পরীক্ষা। পানির মধ্যে নিয়ে অভিযুক্তকে চুবানো হতো। যদি সে পানির ওপরে ভেসে থাকত, তা হলে নির্দোষ। (তাজা মানুষ পানিতে ভাসে না)।
কাউকে শাস্তি দেওয়ার ভেতরে এক নির্মল আনন্দ ও সুখ আছে। যাকে ইংরেজিতে বলে স্যাডিস্টিক প্লেজার—মর্ষকামী সুখ। বিভিন্ন অপরাধের সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা রকম শাস্তির বিধান রয়েছে। বিষপানে মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড, ক্রুশ বিদ্ধ করে মারা, কারাগারে বন্দী করে রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি। এই উপমহাদেশেই একসময় বেশ কিছু বিচিত্র শাস্তি ছিল। পুরুষ অপরাধীকে উলঙ্গ করে তাকে দ্বিখণ্ডিত বা ফাটা বাঁশের মধ্যে এমনভাবে বসানো হতো যেন তার অণ্ডকোষ বাঁশের চিপার ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর শাস্তিদাতারা চাপ দিয়ে বিচি গালিয়ে দিত। লোকটি নপুংসক হয়ে যেত অথবা মারা যেত। এই শাস্তি-পদ্ধতিটি অনেক আগে উঠে গেছে। তবে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতন এত ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে যে শাস্তিটির পুনঃপ্রবর্তনের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। অপরাধী নারী হলে তাকে পুড়িয়ে মারা হতো। কিছুদিন আগেও ভারতের এক প্রত্যন্ত পল্লিতে এক ‘পাপিষ্ঠা’ নারীকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
আমাদের এই অঞ্চলেই শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হতো। প্রকাশ্য জনসমাবেশে অভিযুক্তকে লোহার সূক্ষ্ম শলাকার ওপরে বিবস্ত্র করে বসানো হতো। তারপর ধীরে ধীরে গুহ্যদ্বার দিয়ে ওই শলাকা বা শূলটি অপরাধীর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যেত। এসব শাস্তি দেখার মধ্যেও রয়েছে অপার আনন্দ।
মধ্যপ্রাচ্যে যা দোররা, প্রাচ্যে তা কশাঘাত বা বেত্রাঘাত। একই বস্তুর দেশ-কালভেদে ভিন্ন নাম। একই জিনিস, কোথাও নাম শরাব, কোথাও সুরা, কোথাও মদ। একইভাবে আরব-ইরান-তুরানে যা দোররা, হিন্দুস্তানে তা ফলা, বেত বা চাবুক। ফলা বা চাবুক ও দড়ি পাকিয়ে বানানো হয়, চামড়া দিয়েও বানানো যায়। তার একটা হাতল থাকে। চাবুক দিয়ে ঘোড়াকে পেটানো যায়, মানুষকেও পেটানো যায়।
চাবুক মারা বা বেত্রাঘাতের বিধান এখনো অনেক দেশে আছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে আছে। আমরা বলি, বেতিয়ে তার চামড়া তুলে নেব। ওটা কথার কথা। তবে সত্যি সত্যি যে বেত্রাঘাতে শরীরের চামড়া উঠে যায়, তা কয়েকজন ব্রিটিশ ও আমেরিকান জানেন। কয়েক মাস আগে বৈধ কাজগপত্র ছাড়া এক আমেরিকান সিঙ্গাপুরে বাস করছিলেন। অপরাধীকে জেলে ঢুকিয়ে জামাই আদরে ভাত খাওয়ানোর মানুষ সিঙ্গাপুরিরা নন। তার শাস্তি ১০ বেত্রাঘাত ও বহিষ্কার। তিন বেত মারার পরেই চামড়ার চাবুকের সঙ্গে বুশের দেশের লোকটির চামড়া উঠে আসে। অচেতন অবস্থায় তাকে অবশিষ্ট সাত বেত্রাঘাত করা হয়। ওই ধরনের চাবুকের বিধান কোনো দেশে অবশ্যই থাকা উচিত। বিশেষ করে নারী নির্যাতনকারী ও উত্ত্যক্তকারী এবং ফতোয়াবাজদের জন্য ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে আট রকম ‘ক্যাপিটাল ক্রাইমসে’র জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল। সেই আট রকম অপরাধের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি তো ছিলই, আর যেটি ছিল সেটি হলো স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্বামী যদি স্ত্রীকে হত্যা করে, সেটা ক্যাপিটাল ক্রাইম নয়। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওই আইন ও শাস্তির বিধান করেছিলেন পুরুষেরা, তাতে কোনো নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। যেমন—দোররা মারার বিধান প্রবর্তন করেন পুরুষেরা, কোনো নারী নন।
শরীয়তপুরের হেনা হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার জন্য কয়েকজন নিরপেক্ষ সাংবাদিকের ভূমিকাই প্রধান, কিন্তু একপর্যায়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট বিষয়টিকে গ্রহণ করায় এই বর্বর অপরাধের তদন্ত ও বিচার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
হেনা ধর্ষণ, ফতোয়া ও মৃত্যুটি শুধু দোররার ব্যাপার হিসেবে দেখলে ভুল হবে। সেভাবেই বিষয়টি দেখা হচ্ছে, কাগজে লেখা হচ্ছে, নারীনেত্রীরা লিখছেন, মানববন্ধন প্রভৃতি হয়েছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। বিষয়টি আরও বড়। আমাদের সেক্যুলারপন্থীরা শুধু ফতোয়াবাজদের বিচার হলেই সন্তুষ্ট। ইসলামপন্থীরা ফতোয়াবাজদের বাঁচাতে চাইবেন। এই দুইয়ের মাঝখানে যাঁরা, তাঁরা কিছুই চাইবেন না। ঘটনাটি ভুলে যাবেন। প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। হতভাগিনী হেনাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া ছাড়াও উচ্চ আদালতের আরও বহু কাজ আছে।
বিশ্ব মিডিয়ার উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে, এই মামলার এক নম্বর আসামি ধর্ম ও বাংলাদেশের মুসলমানেরা। হেনাকে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী দোররা মারা হলেও দোররা-পরবর্তী গোটা ব্যাপারটি ছিল সেক্যুলার—ধর্মনিরপেক্ষ—সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ, দেনদরবার, লেনদেন প্রভৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের এবং নারী-পুরুষ সব লিঙ্গের মানুষই যুক্ত ছিলেন। কি স্থানীয় সরকার সদস্য, কি চিকিৎসা কর্মকর্তা, গাইনি বিশেষজ্ঞ, থানার দারোগা, কি তদন্ত কর্মকর্তা—সবাই দায়ী। তাঁদের কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, কেউ সনাতন ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যখন কোনো জঘন্য অপকর্ম হয়, তখন তাতে ধর্মনিরপেক্ষভাবে সবার সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাংলার মাটিতে যখন কোনো কুকীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন। তখন সেখানে দলীয় পরিচয় বা অমুক নেতার সৈনিক—সেসব পরিচয় গৌণ হয়ে যায়।
চামটা গ্রামের ঘটনাটির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। সেসব পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের পর্যালোচনা করা ছাড়া শুধু ফতোয়া আর দোররা, মৃত্যু আর এজাহার, তদন্ত আর মামলা বিবেচনা করলে চলবে না। ক্ষতিগ্রস্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও দেখতে হবে, অর্থাৎ তাদের শ্রেণীচরিত্রও বিবেচনায় আনতে হবে। তাতে মার্ক্সবাদী হওয়ার ভয় নেই।
ব্যাপারটি যদি দরবেশ খাঁর মেয়ের জীবনে না ঘটে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের কোনো বড় দলের নেতার মেয়ের জীবনে ঘটত, তা হলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, গ্রাম্য বিচারক, মাদ্রাসার ফতোয়াবাজ, থানার দারোগা প্রভৃতির কী ভূমিকা হতো? তখন কি দুই ময়নাতদন্তের দুই রকম রিপোর্ট হতো? এ ঘটনাই যদি কোনো অমুসলমান পরিবারের মেয়ের জীবনে ঘটত, তা ঘটছেও, তখন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও তার ফতোয়া বোর্ডের সদস্য কারা হতেন? নাকি অমুসলমানদের সালিস ও শাস্তি দেওয়ার অধিকার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নেই। কয়েক মাস ধরে তো বাংলাদেশ শতভাগ সেক্যুলার!
গ্রাম্য সালিসি-ব্যবস্থা বঙ্গীয় সমাজে শত শত বছর ধরে রয়েছে। ছোটখাটো অপরাধ দমনে তা ভালো ভূমিকাই রেখেছে। ফতোয়াটা শুধু নারীঘটিত ব্যাপারে। দোররাটাও শুধু নারীঘটিত ব্যাপারেই, বিশেষভাবে নারীর জন্যই প্রযোজ্য, অন্য অপরাধীর জন্য নয়। ছাত্র ও যুব সংগঠনের ছেলেরা যখন মারামারি করে মাথা ফাটায়, টেন্ডার নিয়ে খুনখারাবি করে, তখন ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পাওয়া যায় না। দারোগা-পুলিশও থাকে নিরাপদ দূরত্বে। শুধু দরিদ্র নারীর বিচার করাতেই উৎসাহ আমাদের সমাজপতি ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের। অপরাধী যদি ক্ষমতাধর বা ক্ষমতাধরদের কেউ হয়, তাহলে তার ব্যাপারে তদন্ত ও বিচার করে কার বাবার সাধ্য। যেমন—ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের যে কিছুই হবে না, তা শুধু ডিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তাই ইঙ্গিত দেননি, এই কলামেও আমি লিখেছিলাম। নিহতের পরিবারের উচিত হবে বিচারের প্রত্যাশা না করে আরও তিনটি বছর ভুলে থাকা।
ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের মতো হেনা হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক নয়। এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার নিহতের দুই পরিবারই যে শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক, তা-ই নয়, সালিসকারী ও ফতোয়া প্রদানকারীরাও বিএনপির লোক নয় বলে জানা যায়। তা ছাড়া সরকারি ডাক্তার-কবিরাজ, দারোগা-পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট—সবাই দুই বছর ধরে আওয়ামী লীগের নিবেদিত সমর্থক না হয়েই পারেন না, ২০০১ থেকে ২০০৬ যতই হাওয়া ভবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখুন না কেন। হেনারা তাঁদের লোক নয় বলে প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের এ ঘটনা করুণার উদ্রেক করেনি। ঢাকায় বসে তাঁরা এখন কায়রোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
আগে হেনা হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের যে কথা বলেছি, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা দরকার। বিভিন্ন পর্যায়ের দৃশ্যপটের খলনায়ক ও তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে আলোচনা না করলে মূল ব্যাপারটির অর্ধেক অন্ধকারে থেকে যাবে।
দৃশ্যপট এক: লম্পট স্বভাবের চাচাতো ভাই শহর থেকে বাড়ি গেছে। ১৫ বছরের বোনটির শরীরের প্রতি তার লোভ। তাকে ফুসলিয়ে হোক বা জোর করে হোক, এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে তার শ্লীলতাহানি করে। মেয়েটির চিৎকারে ধর্ষকের বউ, মা প্রমুখ ছুটে যান অকুস্থলে। স্বামীকে অন্য মেয়ের সঙ্গে অবৈধ কাজ করতে দেখে ধর্ষকের স্ত্রীর ক্ষিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামীকে দু-চার ঘা না দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির ওপর। তার সঙ্গে যোগ দেয় ধর্ষকের পরিবারের অন্যরা। তাদের মধ্যে নারীই বেশি। নির্দয় মারধরে মেয়েটির রক্তক্ষরণ হয়। কাজটি করে নারীরাই।
দৃশ্যপট দুই: মেয়েটির বাবা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের কাছে বিচার দেন। বিচার বসে। যেহেতু ‘জেনা’র মামলা, তাই মাদ্রাসার ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। তাঁরা বলেন, মেয়েটির উপযুক্ত শাস্তি হলো তাকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে দণ্ড কমিয়ে শাস্তি দেন ১০০ দোররা। ওই বিচার-প্রক্রিয়া উপভোগ করেছেন গ্রামের আরও বহু লোক। তাঁরা কেউ প্রতিবাদ করেননি। প্রতিবাদ করার সাহস পাননি, এটা মিথ্যা কথা। ওই সালিসে ও দোররার সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরও আদালতে তলব করা উচিত।
দৃশ্যপট তিন: আগের দিনের পাশবিক মার ও দোররার পরে মেয়েটিকে মরণাপন্ন অবস্থায় তার বাবা উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। গরিব বাবার মেয়ে বলে সেখানে তাকে তেমন কোনো চিকিৎসাই দেওয়া হয়নি। আমি হেনার পরিবারে গিয়ে যা শুনেছি, তাতে তা-ই মনে হয়েছে। চিকিৎসকেরা মেয়েটিকে কী কী ওষুধ প্রয়োগ করেন, সে কাগজপত্র আদালতের পরীক্ষা করা উচিত। আসামির পরিবারের প্ররোচনায় চিকিৎসা ছাড়াই মেয়েটিকে বাড়ি নিয়ে আসা হয় এবং সে মারা যায়।
দৃশ্যপট চার: সঙ্গোপনে মেয়েটির লাশ দাফন করা হয়। তারপর মেয়ের বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে আপসে রাজি করানোর চেষ্টা হয়। এর মধ্যে কাগজে ঘটনা প্রকাশ পায়।
দৃশ্যপট পাঁচ: এই দৃশ্যের প্রধান কুশীলব সিভিল সার্জন। তিনি যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেন, তা এক উপন্যাস—বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর সহযোগী ছিলেন আরও তিনজন: আবাসিক চিকিৎসক (মেডিসিন) ও একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। উচ্চ আদালত সিভিল সার্জনকে ভালো কথা বলেছেন, ‘প্রতারণার চেষ্টা করলে আপনাকে জেলে পাঠানো হবে।’ এখন তাঁর বাঁচার একমাত্র পথ—প্রমাণ করা যে জোট সরকারের সময় তিনি বড়ই কষ্টে ছিলেন।
দৃশ্যপট ছয়: এটির মঞ্চ নড়িয়া থানা। কুশীলব পুলিশ কর্মকর্তারা। আসামিদের বাঁচানোর জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ। মোটামুটি সাফল্যের প্রান্তে পৌঁছানোর সময়ই সব নীলনকশা ভেস্তে যায় হাইকোর্টের নির্দেশে। টাকা-পয়সার লেনদেন কোনো কাজে এল না। আসামিদের বলা হলো, তোমরা কয়েক দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকো। হাইকোর্টের চাপে ধর্ষক ও সালিসকারীকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় পুলিশ।
এই বিশেষ মামলার জন্য আদালতের এই উদ্যোগকে আমরা অভিনন্দিত করি। কিন্তু হেনার ঘটনার পরবর্তী দুই সপ্তাহে দেশে আরও সাত-আটটি প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর কী হবে? সেখানেও সমাজ ও রাষ্ট্রের একই ভূমিকা। সমাজপতিরা প্রবলের পক্ষে, ফতোয়াবাজেরা নারীর বিরুদ্ধে, ধর্ষকের সহায়তায় থানা-পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র। ক্ষতিগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। দু-একটি ক্ষেত্রে কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান আইনি সহায়তা দেয়।
রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন থাকে না, তখনই সমাজে বেআইনি অনাচার বেড়ে যায়। ফতোয়াবাজি সেই বেআইনি কাজের একটি। অবৈধ যৌন সম্পর্ক মানুষের আদিম প্রবৃত্তির একটি। যারা নৈতিকতার ধার ধারে না, তারা ওই কাজে লিপ্ত হয়। যৌন অপরাধী যদি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে, তা হলে তাকে আইনের আওতায় আনাই সভ্য সমাজের রীতি। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো পাথর ছুড়ে মারার কথা শোনা যায়, দোররা মারার কথা, হিল্লা বিয়ে দেওয়া অথবা একঘরে করে মানসিক নির্যাতন করা। এসব করা হয় সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে, অন্য কাউকে নয়। প্রভাবশালী কারও ছেলেমেয়ে বিয়ের আগে বাবা-মা হলে তাদের বাচ্চাটিকে সালিসকারী ও ফতোয়াবাজেরাই গালে হাত দিয়ে আদর করেন।
গত ১০ বছরে ছয় শর মতো ফতোয়ার ঘটনার কথা জানা যায়। তার মধ্যে মাত্র একটি মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়টি কার্যকর হয়নি। আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ফতোয়াবাজেরা শক্তিশালী নয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে রয়েছেন থানার দারোগা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং একশ্রেণীর অসাধু সংবাদকর্মীও।
ছাতকছড়ার নূরজাহানের সময় থেকে হেনা পর্যন্ত গত ১৭ বছরে আমি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রায় ৪৫টি ঘটনা মনিটর করার চেষ্টা করেছি। কোনো অগ্রগতি দেখিনি। হেনা হত্যার যদি সুষ্ঠু বিচার হয়ও, তাতেই সমাজের কী লাভ? প্রতিদিনই এ-জাতীয় অপরাধের কথা পত্রিকায় আসছে।
আমরা একটি আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু সেই রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন না থাকে, প্রশাসন যদি দায়িত্ব পালন না করে, রাজনীতিকেরা যদি ধনী-নির্ধন সবার অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট না হন, তা হলে শুধু একটি মামলা নিষ্পত্তি করে চমক সৃষ্টি করা যাবে—সমাজ ও রাষ্ট্রের অসুস্থতা দূর করা যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments