শ্রদ্ধাঞ্জলি-চাচা কাহিনি by ইবনে মুস্তাফা
আমার ছোট চাচা অর্থাৎ প্রয়াত প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন, বর্তমানে করিমগঞ্জ ভারতের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর ডাকনাম ছিল সিতারা অর্থাৎ আকাশের তারা। সংক্ষেপে ডাকা হতো সিতু বলে। আমরা ছোটরা মানে ভাইপো-ভাগনেরা ডাকতাম ছোট চাচ্চু, ছোট মামু বলে।
১৯৪৯ সালে মাত্র কিছুদিনের জন্য বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন, তবে তাঁর প্রগতিশীল মনোভাবের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন এবং স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান। চাচি ও দুই ছেলে তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও চাচা আসতেন খুব কম। পরবর্তী সময় কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারি কিছুটা শিথিল হওয়ায় চাচার এ দেশে আগমনটা হতে থাকে ঘন ঘন।
১৯৬৮ সালে এক লম্বা সফরে এসে চাচা-চাচি তাঁর দুই ছেলে ফিরোজ, কবীর ও আরও অনেককে নিয়ে সোজা চলে আসেন আমাদের দেশের বাড়ি মৌলভীবাজারে। চাচা ঘুমাতেন খুব কম, ফলে এই সুযোগটা লুফে নিই আমরা। সারা দিন তো বটেই, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত—এমনকি কখনো কখনো শেষ রাত অবধি চলত আড্ডা। ছোট চাচার ভাষায় ফুর্তি-ফার্তির ফোয়ারা। ছোট চাচা যে শুধু লিখতেই জানতেন, তা নয়। গল্প শুরু, বলা ও শেষ করার আর্টটাও তিনি জানতেন পুরোদস্তুর। তাই যখন একটার পর একটা গল্প জুড়ে দিয়ে অবিরামভাবে বলে যেতেন, তখন আমরা বুঝতেই পারতাম না গল্পের শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায়। তার ওপর স্বাভাবিকভাবে যখন দ্বিপ্রাহরিক ভোজন বা বৈকালিক চা, নৈশভোজন অথবা নিদ্রাগমনের জন্য ইতি টানতে হতো, তখন সুন্দরভাবে শেষ করে দিতেন অর্ধেক বলা গল্পটা। তাঁর ভাষায়, এটা হচ্ছে লেখকের লেজকাটা হনুমানকে ডানাকাটা পরি বলে শ্রোতাদের কাছে চালিয়ে দেওয়া। মুজতবা আলী খেতেন খুব কম, কিন্তু ভালোবাসতেন তাঁর ভাষায় ‘তয় তজাম্মুল’ অর্থাৎ খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আয়েশ করে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন স্বাদের রকমারি খাবারের সোয়াদ নিতে। সেবারের আড্ডায়ই তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন আলু ভাজা, যা আজকালকার বাচ্চারা ফ্রেঞ্চফ্রাই বলে, তাই আমরা খেয়েছিলাম ৪০ বছর আগে ছোট চাচার কল্যাণে। শুধু খাওয়া নয়, চাচা নিজেও রেসিপি জানতেন হাজারো রান্নার।
এবার একটা পারিবারিক গল্প বলি, আমার ভাইপো নওশের তখন বছর তিনেকের। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি-ছোটাছুটি করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু সারাক্ষণ মুখে চুষনি। না ঘুমানো পর্যন্ত ওর মুখ থেকে চুষনি বের করা যেত না। উদ্বিগ্ন মাতা-পিতা এহেন মারাত্মক সমস্যার বিশদ বিবরণ দিয়ে সমাধান জানতে চাইলেন। চাচা খুব মন দিয়ে শোনার ভান করে আওড়াতে লাগলেন লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, জেনেভা, ভেনিস ইত্যাদির নাম। তারপর বললেন, ‘আমি এসব শহর ছাড়াও আরও বহু শহরে গিয়েছি, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও প্রাপ্তবয়স্ক কারও মুখে চুষনি দেখিনি। কাজেই তোমার ছেলে আরেকটু বড় হলে এমনিতেই চুষনি ছেড়ে দেবে। তখন তুমি হাজারো অনুরোধ করলেও সে মুখে চুষনি রাখতে রাজি হবে না, কাজেই চিন্তার কোনো কারণই নেই’ বলে ডান হাত তুলে অভয় দানের ভঙ্গি করলেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী অতিশয় সত্যবাদী ছিলেন। ধাপ্পাবাজির ধারও ধারতেন না তিনি অথচ দেশে বিদেশে বইয়ে গেয়েছেন নিজের সম্পর্কে উল্টো গীত। গৃহভৃত্য আবদুুর রহমান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘লোকটা আবার ধাপ্পা দিতে জানে না, আমার সঙ্গে এত দিন থেকেও কিন্তু তাতে আর আশ্চর্য হওয়ারই কী? বনমালীও গুরুদেবের সঙ্গে এত দিন বাস করে কবিতা লিখতে শেখেনি।’ নিজকে নিয়ে এমন রসিকতা কজন করতে পারে? চাচা যখন প্রথম সিলেট থেকে শান্তিনিকেতনে যান, তখন তাঁর উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব ছিল, এটা তিনি বলতেন, গুরুদেব বলেছেন আমার মুখে এখন কমলালেবুর গন্ধ রয়ে গেছে।
সব ব্যাপারে চাচা ছিলেন বৈচিত্র্যের অনুরাগী। তাই দেশে বিদেশে লেখার পর দেশে ও বিদেশে পিতৃদত্ত নামটাই সুলেখক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার পরও শুধু বৈচিত্র্যের কারণে সত্যপীর, টেকচাঁদ, রায়পিথৌরা ইত্যাদি ছদ্মনামে লিখতেন হরহামেশা।
এবার চাচার জবানিতেই চাচার আরেকটি কিসসা আপনাদের সামনে পেশ করি। এক বুড়া মিয়া সাহেব, যার বিবি সাহেবা ইন্তেকাল করেছেন বহুত আগে, ওনার বেটা-বেটিরাও বিয়ে-শাদি করে জিন্দেগি গুজরান করছে সুন্দরভাবে। তা তিনি হঠাৎ করে খায়েশ জাহির করলেন ওনার বেটির চাইতে কম বয়সী এক নওজওয়ান মেয়েকে শাদি করবেন বলে। মহল্লার সবাই তামাশার খোরাক পেয়ে বলতে লাগল, ‘চাচা, তোমার তো দাঁতে কোন তাকত নাই, শাদি করে ফায়দা কি?’ কেউ বা বলে, ‘মুরুব্বি, গোশত-রুটিও ঠিকমতো চিবাতে পার না বলে তিন ওয়াক্তই শুনি নরম খিচুড়ি গিলো। তা শাদির খোয়াব দেখ কী হিসেবে? আর কয়েক দিন পরেই তো বেহেশতে গিয়ে চাচিজানের সাথে মুলাকাত হবেই। চাই কি তোমার নেক কাজের জন্য ফাও হিসেবে কোনো খুবসুরত হুর-পরিও পেয়ে যেতে পারো। তা এই অবস্থায় দুনিয়ায় তোমার এই শাদির নিয়ত তো কেয়ামতের আলামত বলেই মালুম হচ্ছে।’
এই কিসিমের নানান বাতচিত শেষতক আর বরদাশত করতে না পেরে মিয়া সাহেব প্রবল গোস্সায় আওয়াজ তুলে বললেন, ‘খামোখা সবাই মিলে আমার দাঁতের পিছনে পড়লে কেন, হ্যাঁ? শাদির সাথে দাঁতের কী রিস্তা? নয়া বিবিকে আমি কি চিবিয়ে খাবো নাকি, হ্যাঁ?’
মৃত্যুও মুজতবা দেখেছেন ভিন্নভাবে। তাঁর ভ্রমণকাহিনি জলেডাঙ্গা বইয়ের ভূমিকায় পুত্রের উদ্দেশে নিজের মৃত্যু প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘যে দিন তুমি ভ্রমণ কাহিনি পড়তে শুরু করবে, সে দিন খুব সম্ভব আমি গ্রহ সূর্য তারায় তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে বড় মজার ভ্রমণ, তাতে টিকিট লাগে না, ভিসারও দরকার নেই। কিন্তু হায়! সেখান থেকে ভ্রমণ কাহিনি পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি। ফেরারও উপায় নেই, তাই এই বেলায়ও সেটা লিখে রাখছি।’
আজকের এই দিনে ১১ ফেব্রুয়ারিতে সেই সিতারা অর্থাৎ তারা চলে গিয়েছেন তারার জগতে, রাজার রাজার দেশে ১৯৭৪ সালে।
১৯৬৮ সালে এক লম্বা সফরে এসে চাচা-চাচি তাঁর দুই ছেলে ফিরোজ, কবীর ও আরও অনেককে নিয়ে সোজা চলে আসেন আমাদের দেশের বাড়ি মৌলভীবাজারে। চাচা ঘুমাতেন খুব কম, ফলে এই সুযোগটা লুফে নিই আমরা। সারা দিন তো বটেই, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত—এমনকি কখনো কখনো শেষ রাত অবধি চলত আড্ডা। ছোট চাচার ভাষায় ফুর্তি-ফার্তির ফোয়ারা। ছোট চাচা যে শুধু লিখতেই জানতেন, তা নয়। গল্প শুরু, বলা ও শেষ করার আর্টটাও তিনি জানতেন পুরোদস্তুর। তাই যখন একটার পর একটা গল্প জুড়ে দিয়ে অবিরামভাবে বলে যেতেন, তখন আমরা বুঝতেই পারতাম না গল্পের শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায়। তার ওপর স্বাভাবিকভাবে যখন দ্বিপ্রাহরিক ভোজন বা বৈকালিক চা, নৈশভোজন অথবা নিদ্রাগমনের জন্য ইতি টানতে হতো, তখন সুন্দরভাবে শেষ করে দিতেন অর্ধেক বলা গল্পটা। তাঁর ভাষায়, এটা হচ্ছে লেখকের লেজকাটা হনুমানকে ডানাকাটা পরি বলে শ্রোতাদের কাছে চালিয়ে দেওয়া। মুজতবা আলী খেতেন খুব কম, কিন্তু ভালোবাসতেন তাঁর ভাষায় ‘তয় তজাম্মুল’ অর্থাৎ খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আয়েশ করে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন স্বাদের রকমারি খাবারের সোয়াদ নিতে। সেবারের আড্ডায়ই তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন আলু ভাজা, যা আজকালকার বাচ্চারা ফ্রেঞ্চফ্রাই বলে, তাই আমরা খেয়েছিলাম ৪০ বছর আগে ছোট চাচার কল্যাণে। শুধু খাওয়া নয়, চাচা নিজেও রেসিপি জানতেন হাজারো রান্নার।
এবার একটা পারিবারিক গল্প বলি, আমার ভাইপো নওশের তখন বছর তিনেকের। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি-ছোটাছুটি করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু সারাক্ষণ মুখে চুষনি। না ঘুমানো পর্যন্ত ওর মুখ থেকে চুষনি বের করা যেত না। উদ্বিগ্ন মাতা-পিতা এহেন মারাত্মক সমস্যার বিশদ বিবরণ দিয়ে সমাধান জানতে চাইলেন। চাচা খুব মন দিয়ে শোনার ভান করে আওড়াতে লাগলেন লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, জেনেভা, ভেনিস ইত্যাদির নাম। তারপর বললেন, ‘আমি এসব শহর ছাড়াও আরও বহু শহরে গিয়েছি, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও প্রাপ্তবয়স্ক কারও মুখে চুষনি দেখিনি। কাজেই তোমার ছেলে আরেকটু বড় হলে এমনিতেই চুষনি ছেড়ে দেবে। তখন তুমি হাজারো অনুরোধ করলেও সে মুখে চুষনি রাখতে রাজি হবে না, কাজেই চিন্তার কোনো কারণই নেই’ বলে ডান হাত তুলে অভয় দানের ভঙ্গি করলেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী অতিশয় সত্যবাদী ছিলেন। ধাপ্পাবাজির ধারও ধারতেন না তিনি অথচ দেশে বিদেশে বইয়ে গেয়েছেন নিজের সম্পর্কে উল্টো গীত। গৃহভৃত্য আবদুুর রহমান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘লোকটা আবার ধাপ্পা দিতে জানে না, আমার সঙ্গে এত দিন থেকেও কিন্তু তাতে আর আশ্চর্য হওয়ারই কী? বনমালীও গুরুদেবের সঙ্গে এত দিন বাস করে কবিতা লিখতে শেখেনি।’ নিজকে নিয়ে এমন রসিকতা কজন করতে পারে? চাচা যখন প্রথম সিলেট থেকে শান্তিনিকেতনে যান, তখন তাঁর উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব ছিল, এটা তিনি বলতেন, গুরুদেব বলেছেন আমার মুখে এখন কমলালেবুর গন্ধ রয়ে গেছে।
সব ব্যাপারে চাচা ছিলেন বৈচিত্র্যের অনুরাগী। তাই দেশে বিদেশে লেখার পর দেশে ও বিদেশে পিতৃদত্ত নামটাই সুলেখক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার পরও শুধু বৈচিত্র্যের কারণে সত্যপীর, টেকচাঁদ, রায়পিথৌরা ইত্যাদি ছদ্মনামে লিখতেন হরহামেশা।
এবার চাচার জবানিতেই চাচার আরেকটি কিসসা আপনাদের সামনে পেশ করি। এক বুড়া মিয়া সাহেব, যার বিবি সাহেবা ইন্তেকাল করেছেন বহুত আগে, ওনার বেটা-বেটিরাও বিয়ে-শাদি করে জিন্দেগি গুজরান করছে সুন্দরভাবে। তা তিনি হঠাৎ করে খায়েশ জাহির করলেন ওনার বেটির চাইতে কম বয়সী এক নওজওয়ান মেয়েকে শাদি করবেন বলে। মহল্লার সবাই তামাশার খোরাক পেয়ে বলতে লাগল, ‘চাচা, তোমার তো দাঁতে কোন তাকত নাই, শাদি করে ফায়দা কি?’ কেউ বা বলে, ‘মুরুব্বি, গোশত-রুটিও ঠিকমতো চিবাতে পার না বলে তিন ওয়াক্তই শুনি নরম খিচুড়ি গিলো। তা শাদির খোয়াব দেখ কী হিসেবে? আর কয়েক দিন পরেই তো বেহেশতে গিয়ে চাচিজানের সাথে মুলাকাত হবেই। চাই কি তোমার নেক কাজের জন্য ফাও হিসেবে কোনো খুবসুরত হুর-পরিও পেয়ে যেতে পারো। তা এই অবস্থায় দুনিয়ায় তোমার এই শাদির নিয়ত তো কেয়ামতের আলামত বলেই মালুম হচ্ছে।’
এই কিসিমের নানান বাতচিত শেষতক আর বরদাশত করতে না পেরে মিয়া সাহেব প্রবল গোস্সায় আওয়াজ তুলে বললেন, ‘খামোখা সবাই মিলে আমার দাঁতের পিছনে পড়লে কেন, হ্যাঁ? শাদির সাথে দাঁতের কী রিস্তা? নয়া বিবিকে আমি কি চিবিয়ে খাবো নাকি, হ্যাঁ?’
মৃত্যুও মুজতবা দেখেছেন ভিন্নভাবে। তাঁর ভ্রমণকাহিনি জলেডাঙ্গা বইয়ের ভূমিকায় পুত্রের উদ্দেশে নিজের মৃত্যু প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘যে দিন তুমি ভ্রমণ কাহিনি পড়তে শুরু করবে, সে দিন খুব সম্ভব আমি গ্রহ সূর্য তারায় তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে বড় মজার ভ্রমণ, তাতে টিকিট লাগে না, ভিসারও দরকার নেই। কিন্তু হায়! সেখান থেকে ভ্রমণ কাহিনি পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি। ফেরারও উপায় নেই, তাই এই বেলায়ও সেটা লিখে রাখছি।’
আজকের এই দিনে ১১ ফেব্রুয়ারিতে সেই সিতারা অর্থাৎ তারা চলে গিয়েছেন তারার জগতে, রাজার রাজার দেশে ১৯৭৪ সালে।
No comments