সংস্কৃতির বিকাশ by মযহারুল ইসলাম বাবলা

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরই পুরোমাত্রায় আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা থামেনি, বরং এগিয়েছে। পাকিস্তানি শাসনামলজুড়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের সংস্কৃতি বিনাশের সক্রিয় চেষ্টা ছিল। সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হলেও কিছু ক্ষেত্রে সফল যে হয়নি,


তা বলা যাবে না। যেমন পহেলা বৈশাখ দেশব্যাপী এখন যেভাবে উদ্যাপিত হয়, সে আমলে তেমনটির সুযোগ ছিল না। আমাদের জাতিসত্তার এই দিনটিকে চাতুর্যের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার মোড়ক এঁটে দিয়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ দিনটির উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের মূলে প্রোথিত।
শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থ-বিত্তে সাবেক পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের চেয়ে হিন্দুরা ছিল অগ্রসর। পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিতজনরা পূর্ব বাংলায় থাকেনি। শিক্ষা গ্রহণ এবং জীবিকার প্রয়োজনে তাদের পশ্চিম বাংলায় প্রবাসী হতে হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনামলে কৃষিনির্ভর পল্লীসদৃশ পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বিকাশ তাই লক্ষণীয় নয়। যেটুকু ছিল তা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের হাত ধরেই বাঙালি সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক ধারা বিকাশ লাভ করেছিল। মুসলমানদের অংশগ্রহণ ক্ষীণ হওয়ার কারণেই বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি প্রচারণার সুযোগটি নিয়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র। পাকিস্তানিদের দমন-পীড়ন এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার-প্রচারণায় শেষ রক্ষা হয়নি। বিরুদ্ধস্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাঙালিরা তাদের সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা রক্ষা করেছিল। তাই আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে যায়নি। যুদ্ধ করে আমাদের জয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। সে বিবেচনায় বিশ্বে আমরা অহংকারী জাতি। যারা সশস্ত্র লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছে, তেমন জাতির সংখ্যা বিশ্বে খুব বেশি নয়।
পাকিস্তানি আমলে খুবই সংক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্নভাবে এ উৎসব পালিত হতো। এত আড়ম্বর ছিল না। তবে চেতনার স্থানটি ছিল যথেষ্ট দৃঢ়। প্রতি চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা বসত। লালবাগ শ্মশানঘাটের দক্ষিণের বিশাল জায়গাজুড়ে মেলা হতো। স্থানীয় ভাষায় 'চৈত পূজার মেলা' নামকরণ ছিল মেলার। আমরা প্রতিবার দল বেঁধে দিনমান মেলা উপভোগ করতাম। চৈত্রসংক্রান্তির পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টি ছিল অনিবার্য। মুষলধারে বৃষ্টি হতো। এখন সেই মেলাও নেই, বৃষ্টিও নেই। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি বদলে গেছে। প্রকৃতির প্রতি আমাদের নিষ্ঠুর আচরণের বদলা প্রকৃতিও নিচ্ছে নানাভাবে।
এ দিন সকালে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করত। এও সংস্কৃতিরই অঙ্গ। পুরনো হিসাবের খাতা পাল্টে নতুন খাতায় বেচা-বিক্রি লিপিবদ্ধ শুরু করত। মিষ্টি বিতরণসহ আগত সব ক্রেতাকে অধিক যত্নে আপ্যায়িত করা হতো। মিষ্টি খাওয়ার এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া না করে দল বেঁধে ক্রেতা সেজে মিষ্টি খেতাম। হিন্দু নারীরা স্নান শেষে নতুন শাড়ি ও গহনা গায়ে চড়িয়ে ছুটত মন্দিরে পূজা দিতে। বাড়িতে বাড়িতে উন্নত রান্নার আয়োজন করত। তুলনামূলকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাই দিনটিকে উৎসবের মতো পালন করত। পারিবারিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে উৎসবের জোয়ার বইতে দেখেছি। সে তুলনায় বাঙালি মুসলমানরা দিনটিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করত না।
স্বাধীনতার পর নববর্ষের দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দ ও উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। বিগত ১০-১৫ বছরে উৎসবের আধিক্য সীমাহীন বেড়েছে। এ দিনে এত আনুষ্ঠানিকতা অন্য কোনো জাতির ক্ষেত্রে দেখা যাবে না। বলা যায়, আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
দিনটির চেতনা-চরিত্র ধারণ ও লালনের ক্ষেত্রে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত ভোগ-বিলাসিতায় দিনটির মূল চেতনা হারিয়ে যেতে বসেছে। উৎসব-সংস্কৃতির ভোগ-বিলাসিতায় প্রশ্ন জাগে, যে দিনটিকে ঘিরে এত মাতামাতি, সেই বাংলা সনের তারিখ কতটুকু আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রয়োগ করে থাকি? রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ ব্যতীত কোন জাতীয় দিবস বাংলা সন-তারিখের ভিত্তিতে পালিত হয়? আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তিমূলে বাংলা সন-তারিখের ব্যাপক প্রভাব থাকলেও আজকের বাস্তবতায় বাংলা সনের ব্যবহার-প্রয়োগ কোনোটিই নেই। এমনকি বাংলা ভাষার শিক্ষাক্রম পর্যন্ত সংকুচিত হয়েছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা ছুটছে ইংরেজি মাধ্যমের বিদেশি শিক্ষাক্রমে। গরিব-প্রান্তিক শ্রেণীর জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি হয়েছে পশ্চাৎপদ শিক্ষা। একমাত্র নিম্ন মধ্যবিত্ত ও সাধারণের শিক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের বাংলা মাধ্যম।
এ দিনটি পালন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক বিতর্ক-বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, যা দিনটির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে খর্ব করেছে। সব সম্প্রদায়ের প্রাণের উৎসব নববর্ষ। অনভিপ্রেত এই বিতর্ক চলছে বিগত ১৯ বছর ধরে। এরশাদের শাসনামলে বাংলা মাসকে ৩০ ও ৩১ দিনে ভাগ করে খ্রিস্ট সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ নির্ধারণ করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে সব নির্বাচিত সরকারের শাসনমালেও বলবৎ আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, চাঁদের মাসের তারিখের পরিবর্তন যেমন অসম্ভব, তেমনি তিথি, ক্ষণ, লগ্নের পরিবর্তনও অসম্ভব। পূর্ণিমার তিথিতেই পূর্ণিমা অনিবার্য। যা দ্বিতীয়া বা তৃতীয়ায় সম্ভব নয়। নানা যুক্তি তাঁদের আছে। আর এ বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগী হয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের সংস্কৃতির বিকাশে অনেক অন্ধকার দূর করা সম্ভব হয়েছে, তাই এর আরো বিকাশ চাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.