রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড-দেখতে দেখতে দুই মাস! by মাহফুজ মিশু

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মনে পড়ে; আপনিই বলেছিলেন, এই মামলাটি খোদ প্রধানমন্ত্রী তদারকি করছেন। কেন? আপনি কি এই মামলা তদারকি করতে পারছেন না? আর যদি প্রধানমন্ত্রীই তদারকি করেন, তাহলে এত দিনেও কেন কোনো কূল-কিনারা হলো না? তার মানে কি এই, খুনিরা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মধ্যে। এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই একদিন মিলবে।


হয়তো সেটি ৪৮ মাস কিংবা ৪৮ বছর পর দেখতে দেখতে দুই মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেল। কিছুই হলো না। হত্যাকারীরা ধরা পড়া তো দূরে থাক, মনে হচ্ছে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াই থমকে গেছে। আমরা যারা রুনি আর সাগরের সহকর্মী, তারাও ব্যস্ত নিজের কাজ নিয়ে। আর সাংবাদিক নেতাদের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর। মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচির আগের দিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর আগের কর্মসূচি স্থগিত করে সরকারকে আরও এক মাস সময় দিয়েছেন তারা। এর মধ্যেও অপরাধীরা গ্রেফতার না হলে কঠোর আন্দোলন করার কথা বলেছেন তারা। অবশ্য এসব সময় বাড়ানো নিয়ে চূড়ান্ত হতাশ নিহতদের পরিবার। সরকার তথা প্রশাসন, পুলিশ এবং অবশ্যই আমরা সাংবাদিকরা এই দুই মাসে সত্যিকার অর্থে কিছুই করতে পারলাম না। আমরা যা পেরেছি, তা লজ্জাজনক, ক্ষমার অযোগ্য। নিহত সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর সাগর সরোয়ারের মা, তাদের স্বজন আর সব হারানো মেঘ হয়তো কোনোদিনই আমাদের ক্ষমা করবে না। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী, পুলিশ, র‌্যাব_ সবাই কোনো রকম বাছ-বিচার না করে নিজের জন্য সুবিধাজনক মন্তব্য করেছি। এমনকি নির্মম এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ারও চেষ্টা করেছি। আমরা সাংবাদিকরা কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট না করতে পারলেও, নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। রুনি আর সাগরের চরিত্র হননের যে চেষ্টা হয়েছে, তাতে পুরো সাংবাদিক সমাজই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপারটা যেন এরকম, কারও কোনো সমস্যা থাকলে, তাকে মেরে ফেলা জায়েজ! কেউ একবারও ভাবিনি, রুনি আর সাগরের একমাত্র সন্তান মেঘের কথা। সে রোজ পত্রিকা পড়ে। এখন সব না বুঝলেও কয়েক দিন পর সে সবই বুঝতে পারবে। যখন সে জানবে, তার মা-বাবার সহকর্মীরা এ রকম, কিংবা নিজের মা-বাবাকে নিয়ে যদি কখনও প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সেই শিশুটির মানসিক অবস্থা কী হবে আর এর ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা একবারও ভাবিনি।
এর মধ্যে আবারও তদন্ত 'অনেক দূর এগিয়েছে' বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। বিশ্বাস করুন, আমরা অনেকেই এই মন্ত্রীর কথার অর্থ বুঝি না। কিংবা বোঝার সামর্থ্য নেই হয়তো। ফলে এই 'অনেক দূর' আসলে কত দূর_ কেউ তা জানে না। যেমন সাগর সরোয়ারের সব হারানো মা জানেন না, কত দিনে ৪৮ ঘণ্টা হয়? আমরা কোনোদিন ভুলব না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গত ১১ ফেব্রুয়ারি আপনিই বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। বিশ্বাস করেন, দেশের মানুষ আপনার সেই কথায় ভরসা পেয়েছিল; বিশ্বাস করেছিল। আমরা এখনও বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশ যে কোনো আসামিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধরতে সক্ষম। এ রকম বহু নজির আছে। মাননীয় মন্ত্রী, ৪৮ ঘণ্টা তো দূরে থাক, ৪৮ দিন পার হয়েছে। ঘণ্টা-দিনের হিসাব শেষে শুরু হয়েছে মাসের হিসাব। দুই মাস পার হয়ে গেল। এই অবস্থায় আপনি আর কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? কথায় আছে_ যার যায় সে-ই বোঝে। সন্তান হারানো দুই মায়ের কাছে প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা কতটা ভারী আর তা কীভাবে কাটছে_ তা কেবল তারাই জানেন। আপনি আপনার ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার ব্যাখ্যায় পরে বলেছিলেন, তদন্ত ত্বরান্বিত করতে এমনটা বলা হয়েছিল। তাই যদি হয়, তবে যে কাজ আপনি ৪৮ ঘণ্টায় করার তাগিদ দেন, দুই মাসেও তার কোনো অগ্রগতি হবে না কেন? মনে আছে, আপনার পুলিশপ্রধান কয়েক দিন পরই 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি'র কথা বলেছিলেন। কোথায় গেল সেই অগ্রগতি? হঠাৎ তা থমকে গেল কেন?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মনে পড়ে; আপনিই বলেছিলেন, এই মামলাটি খোদ প্রধানমন্ত্রী তদারকি করছেন। কেন? আপনি কি এই মামলা তদারকি করতে পারছেন না? আর যদি প্রধানমন্ত্রীই তদারকি করেন, তাহলে এত দিনেও কেন কোনো কূল-কিনারা হলো না? তার মানে কি এই, খুনিরা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মধ্যে। এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই একদিন মিলবে। হয়তো সেটি ৪৮ মাস কিংবা ৪৮ বছর পর!
কারণ আমরা বিশ্বাস করি, অপরাধী কখনোই পার পেতে পারে না। একদিন না একদিন তাকে ধরা পড়তেই হয়। ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে_ সত্য উদ্ঘাটিত হবেই। প্রিয় সহকর্মী মেহেরুন রুনি আর সাগর সরোয়ারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার সময়ই একদিন করবে। সেদিন সব রহস্যই উন্মোচিত হবে। শুধু প্রার্থনা, তাদের পরিবার বিশেষ করে একমাত্র শিশুসন্তান মেঘকে স্রষ্টা যেন ধৈর্য ধারণের শক্তি দেন।

মাহফুজ মিশু :সাংবাদিক
mahfuzmishu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.